somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এডভেঞ্চার পুবের পাহাড় বোর্ডিং পাড়ার পথে

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

থাইখং ঝিরি। থাইখং পাড়া। ছবিঃ শামসুল আলম ভাই।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়ার নাম তল্যাং ময়/ সাকা হাফং, মদক তোয়াং বা মদক মোয়াল
লম্বা সময়ের জন্যে অরণ্যবাস। সেভাবে প্রস্তুতী নেওয়া দরকার। কিন্তু রওনা হবার দিনে মার্কেটে যাবার মতো ফুরসত পেলাম। গাইড হিসাবে রুমা থেকে বিটি বম বা মুন বমের মতো পরিচিত দক্ষ লোককে যোগারের ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কাউকেই পেলাম না। ঠিক হলো ডিজিটাল দেশের ডিজিটাল গাইড হবে। আলম ভাই জিপিএসএ পছন্দ সই ট্রেকের সব ডিটেইলস ভরে নিলেন। স্টেডিয়াম মার্কেটে গিয়ে হেড ল্যাম্প আর কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতেই দিন কাবার। ৭দিন ক্যামেরা কিংবা জিপিএস চালানোর জন্যে এক্সট্রা একটা ১২ভোল্টের ভোটকা টাইপ ব্যাটারী আর ইনভার্টর কেনা হলো। আলম ভাই ইলেক্ট্রনিক্সকে হবি হিসাবে নিয়েছেন। উনি কি একটা সার্কিট ডিজাইন করেছেন যা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোতে পাওয়ার ব্যাক-আপ দেয়া যাবে। প্রয়োজন মতো শুকনোখাবার, ওষুধ-পত্র, সিগারেট, স্ন্যাক্স কেনা হলো।
১০ডিসেম্বর রাতের বাস। ভয়ঙ্কর কুয়াশা রাস্তায়। একদম সামনের সিটে বসে আমি আঁতকে উঠছি বার বার। কিচ্ছু দেখা যায় না সাদা সাদা। বছর খানেক আগে চোখে কাদা ঢুকে যাওয়ায় কর্ণীয়া তে কি যেন একটা সমস্যা হয়েছিল আমার। অন্ধের মতো কালো চশমা পড়তাম। কিচ্ছু দেখিনা। ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছিলাম সেবারে। আজকেও একই অনুভুতি। তবে বাসের ড্রাইভার খুবই দক্ষ লোক। প্রায় চোখ বুজে থেকেও সাঁই সাঁই করে বাস চালিয়ে সূর্য ওঠার ঢের আগে আমাদের নির্জন বান্দারবান বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল।

চিকন-কালা পাড়া। রেমাক্রি। মদক।
বান্দারবান থেকে থানছি যাবার বাস আছে। বিশেষ করে আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং অসম্ভব রোমাঞ্চকর পিক ৬৯, বাংলাদেশের হাইয়েস্ট হাইওয়ে (সবচেয়ে উচু রাস্তা) বানানো শেষ করার পর থানছিতে এখন ছোট ছোট কোস্টারও চলে। চিম্বুকের বুকে বাসটা ছাড়ে সকাল সাড়ে নয়টায়। আর ফার্স্ট ট্রিপ চান্দের গাড়ী সকাল সাড়ে আটটায়। আর আমাদের ঘড়িতে তখন মোটে ৬টা। কিছুক্ষন খামোখাই হাটা হাটি করলাম। ১০দিনের প্রিপারেশন নিয়ে তৈরি ব্যাগপ্যাক, পাথরের মতো ভারি লাগলো প্রথমে।
আগুন গরম পরোটা আর ডালভাজি, নাস্তার মেন্যু সাথে ধুমায়িত লাল চা। খেয়ে দেয়ে চাঙ্গা হয়ে ব্যাগ প্যাক আর অন্যজিনিস পত্র প্রথম চান্দের গাড়ীটার ছাঁদে তুলে দিলাম। বান্দারবানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট বগা-লেক কেওকারাডং। অর্থাৎ রুমার রাস্তা। রাস্তা তুলনামুলক ভাবে ভাঙ্গাচোড়া হলেও উচু নিচুর দিক দিয়ে থানছি রুমার চেয়ে অনেক বেশী। রোলার কোস্টারের মতো অনেকটা। রোলার কোস্টারে ভালো ভাবে বেধে ছেঁদে রাখা হয় গরুর মতো করে। কিন্তু চান্দের গাড়িতে তা নেই। নিজ দায়ীত্বে ছাদের চিপা চুপা অংশ শক্ত করে চেপে ধরতে হয়, নইলে উড়াল দিব আকাশে বলে সুপার ম্যান স্টাইলে শুন্যে উড়াল দিতে হবে।
প্রথম ব্রেক চিম্বুকের চুড়ায়। চিম্বুকের উচ্চতা নাকি প্রায় ২০০০ফুট। কিন্তু যেহেতু রাস্তাটাই অনেক উচুতে। ট্যুরিস্টরা গাড়ী থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে সামান্যই উঠে। এজন্যে ছোট্ট একটা পাহাড়ের মতো লাগে। কিন্তু ঘোর বর্ষাতে চিম্বুকে উঠলে দেখা যায় প্রকৃতির বন্য সৌন্দর্য। নিঃশ্বাসের সাথে নাক দিয়ে মেঘ ঢুকে যায়। কিন্তু যেহেতু বর্ষা ট্যুরিস্ট সীজন না। এই রুপটা বেশীর ভাগের কাছেই অচেনা।

চিম্বুক চুড়ায় যাত্রা বিরতী।
যাই হোক চিম্বুকে অল্প কিছুক্ষনের ব্রেক। বান্দারবান শহর থেকে থানছি অনেক দূর। সময় লাগে। এখানে লোকজন চা নাস্তা করে নেয়। ব্লাডারের চাপ কমিয়ে নেয়। আমরা গাছের গোড়ার বাধানো বেদীতে বসে নিচের সবুজ পাহাড়ে জড়া জড়ি করে থাকা মেঘের নদীর ছবি তুললাম।
এর পরে প্রতিটা স্টপে যাত্রী বদল হওয়া শুরু করলো। বাঙ্গালী যাত্রী কমে সেখানে পাহাড়ী যাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। বেশীর ভাগই মুরং। মুরং বা ম্রো ছেলেরা লম্বা চুল রাখে। সেটা ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবলারদের স্টাইলে মাথার উপরে খোপার মতো কেমন জানি একটা ভাজ করা। ম্রো ছেলেরা রুপ চর্চা করতে খুব পছন্দ করে। মাথার খোপায় চিরুনী, গালে রঙ (অথবা ফেস পাউডার), ঠোটে কিছু মাখে কি না জানি না, কিন্তু অনেকেরই ঠোট রুনা লায়লার “পান খাইয়া ঠোট লাল করিলাম বন্ধু আমার আইলো না....” টাইপের।
একটা স্টপেজে এরকম একজন ম্রো তরুন উঠলো। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তরুনী। লম্বা রেশমী চুল আর মেয়েলী চেহারা। চান্দের গাড়ীতে সাবধানতার জন্যে আমার হাতের কবজী চেপে ধরে বসে আছে। স্বভাবিক ভাবেই খুব অস্বস্তি লাগছিলো। সেই লোক দেখি যখনই চান্দের গাড়ী উচু থেকে সাঁ সাঁ করে ভরশুন্য অবস্থার মতো করে নামে আর আমি হাত পা শক্ত করে ফেলি, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বিরক্তিতে চেপে রাখা কঠিন।
একটা পানের বস্তার উপরে বসে ছিলাম। নড়া চড়ার উপায় নেই। চারিদিকে অসংখ্যা নারী-পুরুষ। পানের মালিক একটু পর পর রাগত স্বরে খাস চাটগাঁইয়া উচ্চারনে আমাকে কি জানি বলে, আমি ভাব ধরলাম কিচ্ছু বুঝতেছি না। নড়া চড়া করি আর ছিটকে পড়ি গাড়ী থেকে।
বলি-পাড়ায় ২য় বিরতী। বলিপাড়া থেকে কেওকারাডং যাবার একটা অপ্রচলিত পথ আছে । চ্যামা খাল ট্রেইল। ট্রেইলটা একটু কঠিন কিন্তু ভয়ঙ্কর সুন্দর। ফেব্রুয়ারীতে আমরা চ্যামা খাল ট্রেইলে অনেক দুর্দান্ত মজা করছি।
বলিপাড়া বাজারে মালপত্র নামলো, নতুন মালপত্র উঠবে থানছি বাজারের জন্যে। আমরা সেই অবসরে বাজারে একটা চক্কর লাগালাম। খুব বেশী একটা পরিবর্তন দেখলাম না। এক হতচকিত বাবাকে দেখলাম গামছায় জড়িয়ে একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে শশব্যাস্ত হয়ে থানছিতে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার ম্যালেরিয়া। এদিকে পাহাড় এবং জঙ্গল অনেক ঘন। ম্যালেরিয়াও খুব বেশী। আর চিকিতসা সুবিধা অপ্রতুল না বলে শুন্য বলাই ভালো। একেকটা গ্রাম থেকে কাছের ক্লিনিক কয়েকদিনের রাস্তা। অগুনিত উচু উচু পর্বত ডিঙ্গিয়ে আসতে হয়। গহীনের এই শিশুগুলো বাঁচলো কি মরলো কারো মাথা ব্যাথা নেই।

পাহাড়ে এখন ম্যালেরিয়ার সময়। একদম গহীনের গ্রাম গুলোতে প্যারাসিটামল কিনতেও দু-দিনের রাস্তা পার হতে হয়। অসহায় এক বাবা তার বাচ্চাকে নিয়ে বান্দারবান শহরের দিকে দৌড়াচ্ছে। বলিপাড়া। থানছি।

বলিপাড়ায় একজন ত্রিপুরা মহিলা। মহিলার ইয়ারিংটা দর্শনীয়।

থানছিতে নেমে সব জিনিসপত্র নতুন করে বাধা ছাদা করে নিলাম। সাঙ্গু পার হতে খেয়া নৌকা লাগে। নৌকা জ্যাম লাগায় কিছুক্ষন ফটোসেশন করে থানছি বাজারে নামলাম। আসার আগে পরিচিত কয়েকজন এক বম ব্যাবসায়ীর ঠিকানা দিয়েছিল। থানছিতে শহরে বম-দের সংখ্যা কম। ম্রো-রাই বেশী। আর আছে মং-রা (মারমা)। ভদ্রলোককে খুজে পেতে সময় লাগলো না বেশী। থানছি আর্মি ক্যাম্প বলতে আর্মি ইঞ্জিনিয়ার্সদের ক্যাম্প। সব নিয়ন্ত্রনে আছে বিডিআর। সবসময় শুনে আসছি ওরা ট্রেকারদের নানা ভাবে নিরস্ত করে। প্রথম তল্যাং ময় অভিযান নিয়ে মাউন্টেনিয়ার সজল খালেদ বিডি নিউজে যেই লেখাটা লিখেছিলেন তাতেও একই কথা। অথচ আমরা কোন সমস্যাতেই পড়লাম না। ইয়াংরাই (তিন্দু পেরিয়ে আরো গভীরে) ক্যাম্পের একজন সুবেদার ভদ্রলোকের সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন ট্যুরিস্ট মৌসুমে তারা অনেক উদার এবছর। তিন্দু কিংবা তাজিনডং যেতে কাউকে কোন বাধা নিষেধ করছে না। চাইলে ইয়াংরাই কিংবা বড়-মদক পর্যন্তও হয়তো যাওয়া যাবে। তবে তাতে সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলা লাগবে।
আমরা বান্দারবান থেকে রওনা হয়েছি সাড়ে আটটায়। থানছি পৌছাতে বেশ সময় লাগলো, তিনটার মতো। হালকা খাওয়া দাওয়া শেষে বম সেই ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম সাড়ে চারটার পরে। শুরু হলো ট্রেকিং।

থানছি। ঝুলন্ত ব্রীজ। এখান থেকেই দির্ঘ হাঁটা শুরু।
থানছি ব্রীজ থেকে নেমে বাম দিকের ঢাল বেয়ে উঠা শুরু হলো। রাস্তাটা এমন কিছু কঠিন না। কিন্তু পিঠে আগামী ১০দিনের রসদ ভরা ভোম্বা সাইজের ব্যাগ প্যাক। স্লিপিং ব্যগ, গরম কাপড় আর দুনিয়ার জিনিস। খুব দ্রুতই ক্লান্ত হয়ে গেলাম ২জনে। ভরসার ব্যাপার যতোই দিন যাবে জিনিসপত্র ততোই কম হবে।
প্রায় একঘন্টা পাহাড়ী রাস্তায় হাটার পরে কয়েকজন পাহাড়ীর সাথে দেখা। বাড়ী তৈরির জন্যে টিন নিয়ে যাচ্ছে। তারা সবাই টুতং পাড়ার। আলম ভাই বেশ পিছে পড়েছিলেন আর থানছি থেকে তেমন পানি ভরে নেয়া হয়নি। সামনে অনেকটা পথ। ওদের সাথে টুতং পাড়ায় ঢুকলাম পানি নিতে।
টুতং পাড়া ম্রো-দের (মুরং) গ্রাম। ঝকঝকে তকতকে চমতকার একটা ছবির মতো গ্রাম। ঢোকার মুখেই ঢালের গায়ে একটা গীর্জা। এর পরে নামতে হয়। প্রথমে বাচ্চাদের একটা স্কুল। স্কুলের বাচ্চারা লেফট-রাইট করছে শেষ বিকালে। সামনে ১৬ই ডিসেম্বর। বিজয় দিবস পালন হবে স্কুলে। স্কুলের দুজন শিক্ষক। একজন জাতীতে চাক (চাকমা নয়, চাক আরেকটা আদিবাসী)। দেখলাম ওরা ড্রিলে অদ্ভুত ভাবে সুর করে করে কমান্ড দেয়। দল সামনে চলবে, চলরে চলরে চলরে চঅঅঅঅল। আমাদের দেখে ভদ্রলোক এক বয়স্ক ছাত্রের হাতে দায়িত্ব সপে দিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। উনার নাম সাংরাই চাক। পাহাড়ী এই স্কুল গুলোর কাজ কর্ম খুব সোজা। ক্লাস ৫ পর্যন্ত পড়ানো হয়। ছোট ক্লাসে নিজেদের ভাষায় মোটামুটি, কিন্তু বাকীদের বাংলা শিখতে লাগে। এর পরে পড়তে চাইলে থানছি যেতে হয়। আর এসএসসি বা এইচএসসি করতে চাইলে যেতে হয় রুমা অথবা বান্দারবান শহরে। গাড়িতে গেলেও সারাদিন লেগে যায়।
শিক্ষকরা অনেকেই অন্যগ্রাম থেকে আসে। তাদের জন্যে গ্রামবাসীদের ঘর বানিয়ে দেয়া লাগে। শিক্ষকরা স্কুল টাইমের পরে সবার মতো জুম করেন। থানা শিক্ষা অফিস থেকে কেউ কেউ মাসিক ভাতা পান।
সাংরাই চাক দাদার সাথে গল্প গুজব করে পানি টানি ভরে আগের ট্রেইলে ফিরে দেখি আলম ভাই বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছেন।



টুতং পাড়ার বাচ্চারা বিজয় দিবস কুচকাওয়াজের প্রস্তুতী নিচ্ছে।


টুতং পাড়া।

পাহাড়ে সূর্য ডুবে খুব দ্রুত। ধুপ করেই চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। যতোই আগাচ্ছি রাস্তা ততোই খারাপ। বোর্ডিং পাড়া পর্যন্ত ডাব্লুএফপি এর খাবার যায়। তাই রাস্তার যত্ন নেয়া হয়। কিন্তু ভয়ঙ্কর উঠা নামা। এর চেয়ে রুমা, নাইক্ষং ছড়ি, লামা বান্দারবানের বাকী উপজেলার রাস্তা খারাপ হলেও উঠা নামা এত না। কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্লান্তিতে আমরা নুয়ে যাচ্ছিলাম। আলম ভাইএর জিপিএস দেখে দেখে চলছি। কৃষ্ণপক্ষের রাত। চাঁদ-মামার দেখা পাওয়া যাবেনা।
পথে লম্বা চুলের কয়েকজন মুরং লোককে দেখলাম একই পথে। বেচারারা “বাংলি” জানেনা। তাই কথা বলে সুবিধা হলো না। ভাঙ্গা বাংলায় জানলাম তারাও নাকি বোর্ডিং পাড়াতেই যাচ্ছেন। কিন্তু একটু পড়েই তাদের হাটার সাথে তাল মিলাতে না পেরে আমরা পিছিয়ে পড়লাম। এক জায়গায় পথ দু-ভাগ। আমরা শর্টকাট মনে করে ভুল পথে ঢুকে গেলাম।
চারিদিকে সূচীভেদ্য গাড় অন্ধকার। জঙ্গল এদিকে ভয়ঙ্কর ঘন। মুলত শিকারীদের রাস্তা এটা। এই সীজনে হরীন প্রচুর। চারিদিকে প্রচুর হরীনের ডাক আসছিলো। ক্লান্ত হয়ে আমরা একটা বিশাল গাছের তলায় রেস্ট নিতে বসলাম। সাথে বিস্কুটের প্যাকেটটা খোলার তোরজোর।

পিঠে হ্যাভার-স্যাক, বুকে স্মল ব্যাগ। নিচে ট্রাইপড আর উপরে স্লিপিং ব্যাগ। ১০দিনের ট্র্যাক মানেই অনেক ওজন আর সেই সঙ্গে রাস্তার দশা এই রকম।--ছবি আলম ভাই
এই সময় খুব কাছেই একটা গর্জন শোনা গেল। রাতের বেলা স্বাভাবিক ভাবেই আমি ঘাবরে গেলাম। আলম ভাই আর আমি দুজনেই এই আওয়াজটার সাথে পূর্বপরিচিত। এটা ভাল্লুকের ডাক। থানছি বাজারে একবার ভাল্লুকের চামড়া দেখেছিলাম। এদিকে ভাল্লুক আছে জানতাম। রোয়াংছড়ি উপজেলার রণীং পাড়ায় এই ডাক চিনিয়ে দিয়েছিল লালতুয়ার ছেং নামের একজন বম শিক্ষক। বান্দারবানের মেঘলা চিড়িয়াখানার দৈত্যাকার ভাল্লুকটাকে ধরা হয়েছিল রণীং পাড়ার জঙ্গল থেকে। সিপ্পি আরসুয়াং উঠার সময় জুম ক্ষেতে ভাল্লুকের তাজা বাথরুম দেখেছিলাম। তার কয়েকদিন আগে জুমে কাজ করতে গিয়েছিল তঞ্চংগ্যা মেয়েরা। সিপ্পির বাঁশের জঙ্গল ভেঙ্গে দৈত্যাকার এক ভাল্লুক বেড়িয়ে মেয়েদের ধাওয়া দিয়েছিল শুনেছিলাম। আলম ভাই রাত নামলে চাঙ্গা হয়ে উঠেন। আমার উলটো। আমি এই জায়গায় একমুহুর্ত থাকতে রাজী নাই। তাকে ঠেলা দিয়ে উঠিয়ে জোড় কদমে চলা শুরু করলাম।
রাত আটটার দিকে এক পাহাড়ের উচু থেকে দূরে টিমটিমে হ্যারিকেনের আলো চোখে পড়লো বিন্দুর মতো। বোর্ডিং পাড়ার আলো। বুকে হাতির বল আসলো। একটু আগাতেই হৈ হল্লার আওয়াজ। ভাবলাম গ্রামে বোধহয় কোন উতসব হচ্ছে। আমাদের টর্চলাইট আর হেডল্যাম্পের আলো দেখে ওরাও ঝিরি পেড়িয়ে এগিয়ে এল আমাদের স্বাগত জানাতে। এদের মাঝে একজন ভিডিপির সদস্য। উনি বাদে বাকী সবাই বদ্ধ মাতাল। জুমের সময় শেষ। সবার ঘরে ঘরে নতুন ফসল। কাজ কর্ম নেই। তাই সবাই বের হয় হাতে বানানো গাদা বন্দুক নিয়ে শিকার করতে (আর্মি ক্যাম্পের পারমিট নিতে আগ্নেয়াস্ত্রের জন্যে) নইলে ঘরে বানানো দো-চোয়ানীতে বুঁদ হয়ে থাকে।
এটাও মুরং দের গ্রাম। অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠির তুলনায় পরিচ্ছন্নতা একটু কম। কিন্তু গ্রামটা অনেক বড়। অনেক গুলো পরিবার। আর বেশ অবস্থাপন্ন। অনেক বাড়ীতেই গয়াল বাধা দেখলাম। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে কোনরকমে একটা বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। ঘরে ঢুকে দেখি সোলারে ডিভিডি চলছে। সবাই আয়োজন করে বাংলা সিনেমা দেখতেছে। ধুন্ধুমার মারা মারি। নায়ক চিল্লানী দেয় আর তার প্রতিটা কথাই প্রতিফলিত হয়। গ্রামের লোকেরা বাংলা বেশ কম বুঝে। বাংলি (মোটামুটি সবাই বাঙ্গালী না বলে বাংলি বলে)। কথা অনুবাদকের কাজে সাহায্য করতে আসলো ফিলিপ নামের এক পিচ্চি। সে থানছিতে ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওরা কয়েকবার দো-চোয়ানী খাবার জন্যে সাধা সাধি করলো। আমি এমন ভাব ধরলাম ওদের ভাষা বুঝি না। ঝটপট স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢুকে জিপার টেনে দিলাম।
রাতে ছাড়া ছাড়া ঘুম হলো। লম্বা ট্রেকের প্রথম রাতটা আশে পাশে কয়েকজনের নেশার ঘোড়ে চিতকারের মাঝেই মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়লাম, অনেক বর্ধিষ্ণু এবং অর্থনৈতিক ভাবে বেশ স্বচ্ছল গ্রাম বোর্ডিং হেডম্যান পাড়ায়।


আমি নিশি শেষে শীত কুয়াশার জড়িয়ে চাদর তাহারে, খুঁজবো সবুজ বন ফুলে খুঁজে না পাই যাহারে...কবে যাব পাহাড়ে আহারে আহারে ... শীতের চাদরে বোর্ডিং পাড়া।



জুম শেষ। কাজে অখন্ড অবসর। তাই হয় চলো শিকারে নইলে ঘরে ঘরে দো-চোয়ানির আড্ডা।


ম্রো-পুরুষেরা বাহারী চুল রাখতে পছন্দ করে। যথেষ্ঠ রুপ-সচেতন।


সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৯:২০
১৭টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×