চিম্বুকের চুড়ায় রেস্টুরেন্ট থেকে। সকাল ১১টাতেও প্রচুর মেঘ...
পূর্ব কথনঃ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া কোনটি তা নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের। কেওকারা-ডং এর চুড়ায় সেনাবাহিনীর লাগানো পাথরের ফলকে উচ্চতা লেখা আছে ৩১৭৬ফুট। এখন জিপিএস রিডিং অনুযায়ী সবাই ৩১৯৬ফুটকে সঠিক বলে ধরে নেয়। সবচেয়ে বিতর্কিত চুড়া মনে হয় তাজিনডং। থানছির ভৌগলিক প্রকৃতি অনেক বেশী উচু নিচু আর দুর্গম; রুমার তুলনায়। তাই কেওকারাডং এ ওঠার চেয়ে তাজিংডং উঠা সবসময় একটু বেশী কষ্টের। অনেকেই কোন ধরনের পরিমাপ ছাড়াই এটাকে শীর্ষ চুড়া বলা শুরু করে দেয়। কেওকারাডং এর সাথে পরিচয়ের অনেক পরে তাজিনডং এর নাম বই পত্রে আসতে থাকে। নতুন চুড়াটাকেই বই পত্রে শীর্ষচুড়া লিখে ফেলতে থাকে লোকজন। আসল ভেজাল লাগলো ৯৭ সালে শান্তিচুক্তির সময়। সরকারী ভাবে চুড়াটার নাম পরিবর্তন করে “বিজয় পর্বত” রেখে পাঠ্য বইতে জোর করে বাংলাদেশের উচ্চতম চুড়া বলে চালিয়ে দেয়া হয়। অথচ কেওকারাডং এর প্রায় ৩২০০ ফুটের সামনে তাজিনডং এর ২৭০০ ফুটের একটু বেশী উচ্চতা বেশ হাস্যকর। তাজিনডং এর ৩টি চুড়া। তাজিনডং (সবচেয়ে উচুটা), লং-ফে ডং এবং চিনচিরময় কোনটাই ২৮০০ফুট নয়।
তাজিনডং... শেরকর পাড়ার দিক হতে। আরো দুটো রাউন্ড দিয়ে উঠতে হবে...
তাজিনডং এর চুড়ায় জিপিএস রিডিং ২৭১০ফুট। ১৫ফুট +/-
বাংলাদেশ আর্মির কাছে ডিটেইলস ম্যাপ আছে, কিন্তু সামরিক খাতিরে সেটা সর্বসাধারনের ধরা ছোঁবার বাইরে। অথচ গুগল আর্থের কল্যানে আমরা ঘরে বসেই দুর্গম সব জায়গা গুলো চষে বেড়াতে পারি। প্রসঙ্গক্রমে বলি। ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ আর্মিরা বান্দারবানের উচু পিক গুলোর একটা সামরিক ম্যাপ বানায়। সিআইএ তাদের সংগ্রহে ম্যাপটা পরে উন্মুক্ত করে দেয়। ব্লগার রাব্বি ভাইএর কল্যানে ম্যাপটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ১৯৩৫সালের ম্যাপটার অনেক মজার বিষয় আছে। ২০০৮ সালে আমরা সিপ্পি পর্বত চুড়ায় ট্রেক করি। সিপ্পির ৩টা পিকের মাঝে সর্বোচ্চ আরসুয়াং এর উচ্চতা (সম্ভবত বাংলাদেশের ৪র্থ শীর্ষ চুড়া) আমরা পাই ৩০২০ফুট। ব্রিটিশদের ম্যাপে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ মিলিয়ে একই স্থানে যেই চুড়োটা আছে তার নাম দেয়া “রাইমু তল্যাং” (বম ভাষায় তল্যাং মানে চুড়া), যেই যুগে জিপিএস ছিলনা। রাইমু-তল্যাং এর উচ্চতা লিখা ৩০২২ফুট। আশ্চর্য রকম ভাবে মিলে যায়।
মেঘে ঢাকা সিপ্পি আরসুয়াং। ৩০২০ফুট। রনীং পাড়া থেকে।
থানছির দক্ষিন-পুবে মদক মোয়াল। অনেক বই পত্রে শীর্ষ চুড়া হিসাবে মদক মোয়াল লেখা থাকে। মজার ব্যাপার মোয়াল মানে পাহাড়ের সারি বা রেঞ্জ। যেমন চিম্বুক রেঞ্জ, কেওকারাডং রেঞ্জ তেমনি মদক রেঞ্জ। ছোট মদক থেকে বেশ কিছুটা দূরে আরেকটা বিশাল চুড়া আছে। যেটা কিনা একদম মায়ানমার বর্ডার ঘেষে। বাংলাদেশের সর্বশেষ পার্বত্য চুড়া। কোন দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা ঠিক করে কোন প্রমিনেন্ট নদী বা পাহাড়ের রিজ ধরে। ঐ পাহাড়টা বরাবর বাংলাদেশ আর মায়ানমারের বর্ডার। যদিও গুগল আর্থে মুল চুড়াটাকে মায়ানমারের ভিতরে দেখায়। কিন্তু বাস্তবে গেলে দেখা যায় রিজের নিচ দিয়ে সীমান্ত পিলার গুলো। নিশ্চিত ভাবে চুড়াটা বাংলাদেশের। ১৯৩৫ সালের ম্যাপে চুড়াটার নাম দেয়া মদক-তোয়াং। উচ্চতা লেখা ৩৪৬৫ফুট, কেওকারাডং এর চেয়ে প্রায় ৩০০ ফুট বেশী। মদক রেঞ্জের (মোয়াল) এক্সটেন্ডেড পার্ট মনে হলেও মদক তোয়াং সম্পুর্ন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পিক। সিআইএর ম্যাপের মদক তোয়াং এর যেই অবস্থানে বাস্তবে ওখানকার লোকেরা পাহাড়টাকে মদক তোয়াং বলে চেনেনা। থানছির গভিরে প্রায় সব কটা উচু চুড়া থেকে ঐ চুড়াটাকে পরিষ্কার দেখা যায়। বমরা বলে তল্যাং ময়। তল্যাং মানে চুড়া আর ময় মানে সুন্দর। অর্থাৎ সুন্দর চুড়া। পাহাড়ের খুব কাছের গ্রাম শালুকিয়া পাড়া। গ্রামবাসীরা ত্রিপুরা আদিবাসী। ওরা ডাকে “সাকা হাফং” বলে। যার অর্থ “পুবের পাহাড়”।
চূড়ার কনক্রিটের ছাউনিটাই কেওকারাডং। গাড়ির রাস্তা থেকে। এই রাস্তাটা এ বছরে নষ্ট হইছে। ট্রেকিং ছাড়া গতী নাই।
পুবের পাহাড়ে প্রথম অভিযাত্রি ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ এক্সপ্লোরার জীন ফুলেন। জীন ফুলেন প্রথম ব্যাক্তি হিসাবে ইউরোপের সবগুলো পর্বত চুড়ায় আরোহন করে গীনেজ রেকর্ড গড়েন। এর পরে বের হন আরো বেশী কিছু করতে। ১৯৪টা স্বাধীন রাষ্ট্রের মাঝে ১৪৯টায় গিয়ে সবচেয়ে উচু চুড়ায় উঠে নতুন গিনেজ রেকর্ড গড়েন। জীন ফুলেন এই রেকর্ড গড়তে ২০০৬সালে থানছি আসেন। বাকলাই পাড়ার স্কুল শিক্ষক লাল-ময় বম কে নিয়ে উনি তল্যাং ময় উঠেন। উনি চুড়ায় নিয়ম অনুযায়ী চিঠি লিখে আসেন পরবর্তি অভিযাত্রীদের জন্যে। তাতে উচ্চতা লিখা ছিল ৩৪৯১ফুট। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যম মোটেও পাত্তা দেয়নি ব্যাপারটাকে। পড়ের বছর ২০০৭ এর ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো বাংগালী ট্রেকারেরা পাহাড়টা জয় করে। বিএমটিসি (বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং এন্ড ট্রেকিং ক্লাব) এবং নেচার এডভেঞ্চার ক্লাব দু-দলই প্রথম পা রাখা দল হিসাবে দাবী করে। বিএমটিসি পাহাড়টির নাম রাখে তল্যাং ময় (বম) আর নেচার এডভেঞ্চার রাখে সাকা হাফং (ত্রিপুরা)। বাংলাদেশের প্রেসে উচ্চতা হিসাবে নেচার ক্লাবের হয়ে আলম ভাইএর জিপিএস রিডিং ৩৪৮৮ফুটকে গ্রহন করে নেয়।
তল্যাং ময় (বম) বা সাকা হাফং (ত্রিপুরা)। অথবা ব্রিটিশ আর্মির ম্যাপের মদক-তোয়াং। দোনারাং পাড়া, রেমাক্রি থেকে।
সাকা হাফং বা তল্যাং ময়ের জিপিএস এলিভেশান। ডেভিয়েশান ১৩ফুট। আমরা সর্বোচ্চ ৩৪৯০ পাইছি, সর্বনিম্ন ৩৪৬০ফুট। এভারেজে ৩৪৭৫এর আশে পাশে ছিল বেশীরভাগ সময়।
২০০৮সালে সাকা হাফং বা তল্যাং ময় এর নাম শুনি নেচার ক্লাব আর বিএমটিসির কাছে। কিন্তু যাবার সুযোগ বা সামর্থ কিছুই হয়ে উঠেনি। ২০০৮ এবং এবং এ বছর আরো ২টি দল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়ায় পা রাখে। পরের দল তৈরির আপ্রান চেষ্টা করেও সফল হই নি। শেষে প্রথম দলের সদস্য আলম ভাই রাজী হলেন। আমি আর আলম ভাই রওনা হলাম ১০ডিসেম্বর রাতের বাসে। মায়ানমার সীমান্তের একদম গা ঘেষে থাকা রহস্যময় জঙ্গল আর অদ্ভুত সুন্দরী রেমাক্রির কোলে দাঁড়ানো চুড়ার দিকে। ওখানে দিনের বেলাতেও হরীণের পাল ঘুড়ে বেড়ায়। বন্য ময়ুর-বন মোরগের পাশা পাশি, ভাল্লুক, মেছো বাঘ আর দাঁতালো বন্য শুকর। আর আছে কালাবাহিনী (আরাকান লিবারেশন আর্মি) আর অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠনের নাম। আমাদের দলে সদস্য মাত্র দুজন। দুটো জিপিএস আর বিশাল সাইজের দুই ব্যাগ প্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম সাকা হাফং এর দিকে। প্রথমে তাজিনডং এর পরে সাকা হাফং (তল্যাং ময়) সবশেষে কেওকারাডং মেপে দেখবো।
(চলবে)...................................................................
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৯:২০