মিয়ানমার বর্তমানে একটি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনের অন্তত ৬০ শতাংশ এ এ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত নিরাপত্তা ও উপস্থিতি নিশ্চিত করছে এবং পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনসহ মিয়ানমারের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তাদের হামলার তীব্রতায় টিকতে না পেরে জান্তা সেনারা একাধিক স্থান থেকে পালিয়ে গেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এ রাজ্যের দখল নিতে সেখানে সংগঠিত হচ্ছে জান্তা বাহিনী।
আরাকান আর্মি (এ এ) অপারেশন ১০২৭ এর অংশ হিসেবে ১৩ নভেম্বর রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এ এ ২০২২ সালের নভেম্বরে জান্তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে রাখাইনে সেনাবাহিনীর উপর এই আক্রমণ চালায়। ১৬ নভেম্বর এ এ’র যোদ্ধারা রাখাইন রাজ্যের পাউকতাও শহরের পুলিশ স্টেশন দখল করে। ২১ নভেম্বর এ এ জান্তার অবস্থানে আক্রমণ চালায় ও পাউকতাও শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এ এ ৩ জানুয়ারী দক্ষিণ চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপের চিন লেট ওয়াতে এবং ৬ জানুয়ারী কিয়াউকতাউ টাউনশিপের বড় তাউং শায় তাউং ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় ও জান্তা ফাঁড়ি দখল করে।
ব্রাদারহুড এলায়েন্স ৭ জানুয়ারী রাখাইন রাজ্যের চকপিউ টাউনশিপের দানিয়াওয়াদ্দি নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়, ৮ জানুয়ারী চকপিউ টাউনশিপ সংলগ্ন রামরি শহরেও সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৪ জানুয়ারী এ এ চিন রাজ্যের পালেতোয়ার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং একাধিক সামরিক ফাঁড়ি দখল করে। ১৫ জানুয়ারী রাথেডাং টাউনশিপেও সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৬ জানুয়ারি জান্তা গানবোট থেকে বোমার আঘাতে মিনবিয়া টাউনশিপের একটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ১৪ জানুয়ারী এ এ মংডু শহরে একটি ঘাঁটি দখল করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করে। এ এ রাখাইন রাজ্যের চকপিউ সমুদ্রবন্দর প্রকল্প এলাকায় নভেম্বর থেকে জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এ এ প্রতিবেশী চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহর এবং উত্তর রাখাইন ও পালেতোয়া টাউনশিপের ১৬০টিরও বেশি সামরিক জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জানিয়েছে যে, রাখাইনের ছয়টি শহরের দখল নিয়ে জান্তা ও এ এ’র মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়েছে, এ এ দানবতীতে নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টারেও হামলা চালিয়েছে। নৌবাহিনীর স্থাপনায় হামলার পর একটি গানবোট আশপাশের অঞ্চলে নির্বিচারভাবে গোলাবর্ষণ করেছে। সিতওয়ের মিনবায়া এলাকার চারটি ঘাঁটিতে নতুন করে ৮০০ সেনা এসেছে। রাখাইনে জান্তাবাহিনীর কাছে সাগরপথে প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে। এতে বোঝা যায় জান্তা সহজে রাখাইন হাতছাড়া করার কোন ইচ্ছা নাই এবং সংঘর্ষ আরও দীর্ঘায়িত হবে।
এ এ কালাদান নদীর তীরে অবস্থিত বন্দরনগর পালেতোয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে যা মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শহর। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনের রামরি শহরে বোমারু বিমান দিয়ে এ এ’র ওপর হামলা চালায় রাখাইনের বুচিডং ও ফুমালিতে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের কারনে রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। সংঘর্ষ চলাকালীন অনেক সময় রোহিঙ্গাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। রাখাইনের চলমান সংঘর্ষে রোহিঙ্গাদের বসতিতে নিয়মিত অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে বলে জানা যায়। এ এ’র সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে এমন সন্দেহ থেকে হেলিকপ্টারে অনবরত গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রাখাইনে এ এ ও সেনাবাহিনীর সাথে চলমান যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে। ২৭ থেকে ৩০ জানুয়ারী পর্যন্ত মিয়ানমার দিক থেকে ফায়ার করা বেশ কিছু মর্টার শেল ও গুলি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে। এতে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছে।
২০২২ সালের অগাস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাদেশ সেসময় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর প্রতিবাদ, নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারনে বাংলাদেশে যেন এর প্রভাব না পড়ে সেজন্য আমাদের সীমান্ত রক্ষীদের প্রস্তুত থাকতে হবে এবং তারা প্রস্তুত রয়েছে।
২৬ জানুয়ারী এ এ রাখাইনের বন্দরনগরী পকতাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর ম্রাউক উ, মিনবিয়া, কিয়াকতো ও রাথিডং শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই শুরু করে। কিয়াকতো এলাকাটি সেনাবাহিনীর নবম কমান্ডের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ এ’র সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর লড়াইয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইনের কয়েক হাজার অধিবাসী রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে। ২৬ জানুয়ারী রাখাইনের বুচিডং ও ফুমালি এলাকায় এ এ ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয় ও সমগ্র রাখাইনে তা ছড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের মংডু ও বলিবাজার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অবস্থান করছে রোহিঙ্গারা। কিছু রোহিঙ্গা ডিঙি নৌকা করে নাফ নদীতে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ না করে, সে জন্য বাংলাদেশ সতর্ক ও প্রস্তুত রয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা পুরো সীমান্ত এলাকাজুড়ে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং বিজিবি যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত। অনেকের মতে, মিয়ানমারে ফেরা বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি রাখাইনকে দ্রুত রোহিঙ্গা শূন্য করতে রোহিঙ্গা বসতিতে হামলা চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে থাকা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) প্রায় সব কটি ক্যাম্প বিদ্রোহী গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে এবং বাকি কয়েকটি দখলের চেষ্টা চলছে। আরাকান আর্মি ২৮ জানুয়ারী রাখাইন রাজ্যের মিনবিয়া শহরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৩৮০ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর দখলে নিয়েছে। আরাকান আর্মির এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, জান্তার এ এ’র সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ্য নেই। তারা এখন আর্টিলারি ও মর্টার হামলার পাশাপাশি বিমান হামলা চালাচ্ছে। ২৭ জানুয়ারী মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্তে এসে পড়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে বিজিবি, বিজিপি’র কাছে লিখিত প্রতিবাদ লিপি পাঠায়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়, তারা ২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে সমাবেশ করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে প্রত্যাবাসন ইস্যুতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানায়। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে রোহিঙ্গারা একজোট হয়ে মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও এ এ’র মধ্যে সংঘাত বন্ধে অস্ত্রবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করছে চীন। অস্ত্রবিরতি হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবার আলোচনার পথ সুগম হবে বলে জানিয়েছেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। মিয়ানমারে জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী যারাই ক্ষমতায় থাকুক, বাংলাদেশের ফোকাস হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী, কারও পক্ষে বাংলাদেশ অবস্থান নেয়নি, এই ইসুতে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভূমিকায় আছে। এই নিরপেক্ষতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র জোরালো করার সম্ভাবনা তৈরি করতে সহায়ক হবে বলে অনেকে বিশ্লেষক মনে করে।
মিয়ানমার থেকে প্রানভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা গত প্রায় সাত বছর ধরে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে। দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদেরকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়েছে এবং তাদেরকে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে অবৈধভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তাদের মৌলিক চাহিদা, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাধীন ভাবে চলাফেরা, চাকুরী সব কিছু থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর মিয়ানমার জান্তা স্থানীয় রাখাইনদের সহযোগিতায় তাদেরকে অত্যাচার ও নৃশংসতার মাধ্যমে রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে।
রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পর রাখাইন রাজ্যে অল্প কিছু সময় শান্তি ছিল। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে রাখাইনের সশস্ত্র গুষ্টি আরাকান আর্মির (এ এ) তীব্র সংঘর্ষ চলতে থাকে। স্থানীয় রাখাইনরা আবার বাস্তুচ্যুত হয় এবং তাদের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকটের সময় রাখাইন বৌদ্ধসংঘগুলো এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল। চলমান পরিস্থিতিতে অনেক নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু মনে করে যে, মা বা থা ভিক্ষুরা উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ঘৃণা না ছড়িয়ে রাখাইনের উন্নয়নের জন্য সক্রিয় হলে জনগণের জীবনমানের উন্নতি হতো ও দেশে শান্তি বিরাজ করত। প্রত্যাবাসন কার্যকরী করতে রোহিঙ্গা ও রাখাইন জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা ও ব্যবধান কমাতে হবে। এই সংকট সমাধানে রাখাইন-রোহিঙ্গা সম্পর্ক উন্নয়ন ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এন ইউ জি রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোকে নাগরিকত্ব প্রদান ও তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছে । এন ইউ জি রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যা উৎসাহব্যঞ্জক। এ এ রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। এ এ’র নেতৃত্বও রোহিঙ্গাদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে এবং তারা রোহিঙ্গাদেরকে আরাকানের অধিবাসী মনে করে। আরাকানে মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং খ্রিষ্টানদের শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে থাকা সম্ভব বলে মনে করে এ এ আর্মি প্রধান থোয়ান ম্রা নাইং।
মিয়ানমার বর্তমানে একটি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনের অন্তত ৬০ শতাংশ এ এ’র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘর্ষের কারনে স্থানীয় বাসিন্দারা আতংকে রয়েছে। এর পাশাপাশি সেখানে খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাখাইনে জান্তার চলমান অবরোধের ফলে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের অধিকাংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকটে ভুগছে। রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহ দমনে জান্তা খাদ্য সরবরাহ বন্ধের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়শিবিরগুলো থেকে খাবারের সন্ধানে কেউ বাইরে গেলেও তাদের গ্রেফতার করছে। এ এ এবং রাখাইনের জনগণ জান্তার 'ফোর কাট স্ট্র্যাটেজি'র কারনে মানবিক সংকটে রয়েছে এবং ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান (ইউ এল এ) বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা চাইছে, এই সময় তাদের সহযোগিতা দরকার।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অনুকূল নয় এবং মর্যাদার সাথে নিরাপদে ফেরার মত পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। নিজ বসতভিটায় ফিরতে না পারার হতাশা ও ক্ষোভে রোহিঙ্গাদের অনেকে হিংস্র হয়ে উঠছে। এ অবস্থা দীর্ঘতর হলে তা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হতে পারে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণও কমানো হয়েছে। তিনি জানান যে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো খুবই জরুরি।
ভু-কৌশলগত কারনে রাখাইন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এ কারনে জান্তা বাহিনী এই রাজ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পুনরায় আক্রমণ শুরু করেছে এবং তা চালিয়ে যাবে। এ এও এই রাজ্যে সক্রিয় এবং সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ চলবেই। চলমান এই প্রেক্ষাপটে রাখাইনে স্থিতিশীলতা খুব সহসা আসার সম্ভাবনা কম। এখনে চীন, জাপান ও অন্যান্য বৈদেশিক বিনিয়োগে বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব সত্ত্বেও রাখাইন মিয়ানমারের একটা অনুন্নত রাজ্য। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন উভয়েরই মিয়ানমারে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। জাপান বে অফ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্টের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, জ্বালানি খাত এবং যোগাযোগ খাতে আর্থিক প্রতিশ্রুতি বাড়াচ্ছে। সেই সাথে মিয়ানমারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনর্বাসন প্রকল্পেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত সব পক্ষকে এ এ এবং জান্তা উভয়ের সাথেই যোগাযোগ রাখতে হবে। এই অঞ্চলে জাপান ও চীনের স্বার্থ রয়েছে এবং আশা করা যায় চীন এই রাজ্যের স্থিতিশীলতায় কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারবে। এর আগে জাপানের মধ্যস্থতায় বেশ কিছু সময় এখানে আপাতঃ শান্তি বিরাজ করছিল।
রাখাইন রাজ্যে চীনের গভীর সমুদ্র বন্দর, গ্যাস পাইপলাইন ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ কয়েক শ’কোটি ডলার প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। রাখাইনের চকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের তিনটি বৃহৎ প্রকল্পে চীনের স্বার্থ জড়িত। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হচ্ছে চকপিউ গভীর সমুদ্র বন্দর। চীনের সহযোগিতায় চকপিউতে ২৩০ কোটি ডলার ব্যয়ে ১০০ হেক্টর এলাকাজুড়ে শিল্পাঞ্চলে কৃষি, ইকোট্যুরিজম এবং শিল্প-কারখানা স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পগুলোতে রোহিঙ্গা ও রাখাইন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ কাজ করতে পারবে এবং রাখাইনের অবকাঠামোগত উন্নয়নে অবদান রাখবে। রাখাইন অঞ্চলে চীন তার স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইলে এ এ এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
কফি আনান কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন করে, যারা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি তাদের মিয়ানমারে অবস্থানের বিষয়টি হালনাগাদের মাধ্যমে সমাজের অংশ করে নিতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার অবাধ চলাচলের সুযোগ দিতে হবে। রাখাইনে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোও উপকৃত হতে পারে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আন্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি এবং সমাজের সব সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাখাইন প্রদেশে রাখাইনরাও মিয়ানমার সেনাবাহিনী দ্বারা নিগৃহীত এবং এখন পর্যন্ত তারা রাখাইনের উন্নয়নে তেমন কিছু করতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে তাদেরকে দক্ষ জনগুষ্টিতে রুপান্তর করা গেলে রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয় সম্প্রদায় মিলে একটা শক্তিশালী রাখাইন গঠনে ভুমিকা রাখতে পারবে। রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিক সুবিধা দিয়ে তাদেরকে মূল জনস্রোতের সাথে মিলে যেতে দিলে ও সেভাবে তাদেরকে প্রস্তুত করলে রোহিঙ্গারা রাখাইনের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। এক সময় রোহিঙ্গারা আরাকানে ব্যবসা, শিক্ষা, ও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। চাষাবাদ ও জীবিকার অন্যান্য পেশায়ও তারা অবদান রাখতে পারবে।
চীনের উদ্যোগে নেয়া পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নে মিয়ানমার সময় নিচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত তা সফলতার মুখ দেখেনি। যে গতিতে রোহিঙ্গাদেরকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তা বিবেচনা করলে বলা যায় যে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব আছে এবং রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমার জান্তার মনোভাব অপরিবর্তিত রয়েছে। রাখাইনে তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার ইচ্ছা থাকলে তাদের ছেড়ে আসা গ্রামগুলোকে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে চার পাঁচ ধাপে রোহিঙ্গাদেরকে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য রাখাইনে প্রস্তুতিমুলক কাজ চালিয়ে যেতে হবে। চীনের পাশাপাশি অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদেরকেও এই উদ্যোগে পাশে রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জড়িত সবাইকে জান্তা সরকারের পাশাপাশি এন ইউ জি এবং এ এ’সহ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথেও যোগাযোগ রাখা দরকার।
মিয়ানমার থেকে বাস্তচ্যুত হয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কারণে নানা ধরনের সমস্যার পাশাপাশি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও পরিবেশের উপর হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতি বছর ৩৫ হাজার করে নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করছে ও রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করার কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। সাড়ে বার লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে সক্ষম যুবকদেরকে তাদের দেশে ফিরে গিয়ে সেখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলে বাংলাদেশ মনে করে। উন্নত এবং শান্তিপূর্ণ রাখাইনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রোহিঙ্গাদেরকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা এখন থেকেই নিতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করা সকল পক্ষকে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই উদ্যোগ সফল করতে হবে। স্থিতিশীল ও উন্নত রাখাইনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রোহিঙ্গা ও রাখাইন জনগুষ্ঠির শান্তিপূর্ণ সহবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১২:২০