somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

" রুপালী রংয়ের অনূভুতি "

০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভিনদেশে বসবাস করার সবচেয়ে বড় আচানক ব্যাপার হচ্ছে, বাজার-ঘাটের সমস্যা!!! ইচ্ছে করলেই বাজারে গিয়ে গলা উঁচু করে দরদাম করে বাজার সদাই করা যায় না।বাজার-ঘাটে নিজের পছন্দ বলতে এখানে কিছুই নেই,যা আছে তা শতভাগ কৃত্রিম।শাক-সবজির গায়ে কোন গন্ধ নেই,নেই মাছের বাজারের গন্ধও!! বাজার করতে যেতে হয় ছাদ ঘেরা কাঁচের ঘড় নামক "ফুড সিটি'তে"।সেই ঘড়ে লোকজন বাজার করে চলেছে চাকা লাগানো ট্রলি ঠেলে নিয়ে,যা যা চোখে পরছে হাত দিয়ে পুরে নিচ্ছে ট্রলিতে। হাতে বাজার এর ব্যাগ নামক বস্তুর কোন নাম গন্ধই নেই।রোবটের মত লোকজন চলাফেরা করছে ট্রলি হাতে নিয়ে, যাদের পছন্দের কোন বালাই নেই,নেই কোন দামদরের ব্যাপার স্যাপার ও।এ কেমন বাজার বাপু!! হাতে বড় একটা চটের ব্যাগ না থাকলে কি বাজার করার জোশ আসে নাকি ???

শাক-সবজি গুলি এত এত বার করে ধুয়ে মুছে সাজিয়ে রাখার কি দরকার!!! একেবারে নাকের ডগায় লাগিয়ে ও কোন গন্ধ পাওয়া যায় না।সবজির গায়ে যে একটা কাঁচা গন্ধ থাকে,তা একে বারেই নেই, মলিন।এর চাইতে আমার দেশের কাঁচা-বাজার'ই ভালো,বাজার করতে গেলে কত রকমের গন্ধ'ই না ভেসে আসে।ছোট ছোট ডালা আর বস্তার উপর ঢিবি করে রাখা সব শাক-সবজি। বাজারে ঢুকলেই পিয়াজ,রসুন আর কাঁচা মরিচের একটা চির চেনা ঝাঁঝ নাকের দরজায় এসে টোকা দেয়।আর মাছের বাজারে গেলেই তো মন শান্তি,আহা কত রকমের ছোট মাছ,খঁলশে মাছ,চাঁদা মাছ, চিংড়িমাছ, পুঁটিমাছ, মলা-ঢেলা মাছ। ছোট ছোট ভাগ করে বসে থাকে জেলেরা।আর রুই,কাতলের কথা নাই বা বললাম।কাঁচা মাছের তীব্র নেশাতুর একটা গন্ধ সবখানে'ই ছরিয়ে থাকে। জেলেদের সাথে দেনদরবারের গুন গুন আওয়াজ তো আছেই আর সাথে জগতের সমস্ত মাছির আড্ডা জমে যায় মাছের রুপ দর্শনে।ওরা ঘুড়ে ফিরে বেড়ায় আপন মনে, কখনো এই জেলের টুকরি তো কখনো ওই জেলের টুকরি। কেউ ওদের বাধা দেবার নেই,ওরা উন্মুক্ত, ওরা স্বাধীন! আর এইসব ভিনদেশের বাজারে মাছিরা তো নেই সাথে মাছের গন্ধ ও নেই।আমার কাছে এই ব্যাপারটা বরই অদ্ভুত লাগে,মাছের বাজারে মাছ আছে কিন্তু, মাছের কাঁচা গন্ধ নেই। ওইসব বিদেশী গন্ধবিহীন মাছে আমার মন টানে না, বিদঘুটে দেখতে সব,একবার দেখলেই আর একবার দেখতে ইচ্ছে জাগে না।

যতদুর মনে পরে সেই ছোটবেলা থেকেই আব্বার সাথে হাট করতে যেতাম হ্যান্ডেল ওয়ালা চটের ব্যাগ হাতে নিয়ে।যাওয়ার সময় আম্মায় কইয়া দিত কি কি আনতে হবে? আমি খুব মনযোগ দিয়া শুনতাম আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে,আর বাড়ির গার্ডিয়ান এর মত হু,হু, শব্দ করতাম যেন কোন কিছুই মিস না হয়ে যায়।আম্মাও খুব সুন্দর করে বলে যেতেন,বাজান বেশি কইরা শাক-সবজি আনবা,লাল শাক নিবা,লম্বা লম্বা বেগুন নিবা,ছিম নিবা, ফুলকপি নিবা,আম্মা আসলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলতেন যেন আব্বার কানে যায়,আব্বাও না শুনার ভান করে অন্যদিকে চেয়ে থাকতেন।কিন্তু যেই না আম্মা আমারে কইছে যে,বাজান পিয়াজ,রসুন নিবা,আর আব্বায় যেন হুশ ফিরে পেতেন !! চিল্লান দিয়া কইত,তোমারে না সেইদিন'ই দুই কেজি পিয়াজ আইনা দিলাম,এই কয় দিনই শেষ কইরা ফেলাইলা,খালি কি পিয়াজ খাও নাকি????

আম্মা আমার মুখের দিকে তাকাইয়া নিচু গলায় আব্বার কথার উওর দিতঃ পিয়াজ না আইনা দিছিলা সেই গতমাসে,এক কেজি পিয়াজ দিয়ে আর কয়দিন চালানো যায়।আব্বা তখন একটু নরম হইয়া আমারে কইত চল, বাজারে যাই,পিয়াজ আনন লাগবেনা ??? নইলেতো আর পরের বেলা ভাত জুটবে না,চল আইজ বাজারের সব পিয়াজ কিনে আনবো। আমি খালি মুচকি দিয়া হাসতাম,আমি জানি যত কিছুই হোক না কেন,আব্বা হাফ কেজি থেকে এক কেজির বেশি পিয়াজ কিনবে না।

অল্প আয়ের সংসারে এমন টানাপোড়ন লেগেই থাকে,আমি সব বুঝতাম কিন্তু মাছের বাজারে গিয়েই সব ভুলে যেতাম,ইলিশ মাছ দেখলেই আমার চোখ চকচক করত,চোখে রুপালী এসে ভর করতো।আর আমার পা আটকিয়ে আসতো ইলিশ মাছের জেলেদের সামনে গেলেই,কেমন যেন একটা কাঁচা ইলিশের গন্ধ আমার শরীরে ছরিয়ে যেত,মস্তিষ্কের কোনায় কোনায় পৌছে যেত,কিন্তু আমি আব্বাকে কখনই কিছু বলতাম না।তবে আব্বা আমার চোখজোড়া দেখেই হয়তোবা বুঝে যেত আমার ইচ্ছের কথা,আমারে জিজ্ঞাস করতেনঃ বাবা,ইলিশ মাছ নিবা ??
আমি প্রথম বার কিছুই বলতাম না, আমার চোখ তখন ইলিশের চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে,আমার মনে হইতো ইলিশ মাছগুলিই মনে হয় আমার দিকেই চেয়ে আছে।আব্বা যখন আবার জিগাইতেন তখন আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতাম,আর খুঁজতে থাকতাম কোন ইলিশের পেট মোটা, আমার ধারনা ছিল পেট মোটা ইলিশে বড় বড় ডিম থাকে, ইলিশ মাছের চেয়ে ইলিশের ডিমেই আকর্ষণ টা বেশি থাকত। আমি তখন ভুলে যেতাম সংসারের টানাপোড়নের কথা,আমি ভুলে যেতাম, যে আব্বা হাফ কেজির যায়গায় এক কেজি পিয়াজ কিনতে দুইবার হিসেব করে, সেই আব্বা শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়েই হয়তোবা ইলিশের দাম মিটিয়েছে পকেটের টানা টানি অবস্থা শর্তে ও।আমার মাথায় তখন শুধুই ইলিশেরা ঘুরে বেড়াইত। পরে ইলিশ কিনে বাসায় ফেরার পথে আব্বার হাতে বাজারের ব্যাগ আর আমার হাতে ইলিশ।নাকে দড়ি লাগানো ইলিশ ঝুলছে আমার হাতে,খুশি খুশি চেহারায় বাড়ি ফিরতাম যেন রাজ্য জয় করে ফিরেছি।

বাড়ি ফেরার পর জগতের সমস্ত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম ইলিশের দিকে।আম্মা পিড়ি'তে বসে,চুলা থেকে এক ডিব্বা ছাই হাতে নিয়ে, বটি'তে ইলিশ মাছের আঁইশ ছারাইতেন আর আমি অন্য আর একটা পিড়ি নিয়ে সামনে বসে থাকতাম এক দৃষ্টিতে বিড়ালের মতন। লক্ষ শুধু ইলিশের পেটের দিকে,কখন আম্মা পেটটা কাটবে আর বেরিয়ে আসবে ডিম,কতবড় হবে ডিম টা,মনে নানা প্রশ্ন খেলা করত, আমার আর ধৈর্য সইত না। কিছুক্ষনের মধ্যেই অবশেষে ডিম বেরিয়ে আসত আর আমি আগ্রহ ভরে শুধুই দেখতাম। বেলা-শেষে মায়ের রান্না হইলে এক পিস ইলিশের টুকরো আর এক পিস ইলিশের ডিম দিয়ে ভাত খেতে বসতাম।আহা!!! কি যে স্বাদ,আম্মা আমার পাসে বসে ইলিশের কাঁটা বেছে দিতেন আর আমি ছোট্ট ছোট্ট করে ডিম ভেংগে নিয়ে মুখে পুরে দিতাম,অমৃত স্বাদ !!!! এই স্বাদ পৃথিবীর কোথাও পাওয়া সম্ভব না,এই স্বাদে আমার মায়ের হাতের ছোঁয়া মাখানো ,মায়ের হাতের গন্ধ মাখানো। আমার "মা" ছারা আর কেউ আমার মনের মত করে সরিষা-ইলিশ রান্না করতে পারে না।আমার চোখে, আমার মা সবসময়'ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি,সর্বশ্রেষ্ঠ।

গতকাল এই ভিনদেশী বাজারে হঠাৎ করেই একজোড়া মাছের উপর চোখ আটকিয়ে গেল,দেখতে ইলিশের মতই। দেখি ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে চেয়ে আছে।নিজেকে আর সামলাইতে পারলাম না,জানতাম এখানে আমার "মা" নেই কিংবা আমার নিজের ও ইলিশ রান্নার হাতেখড়ি নেই, তারপরেও নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে না পেরে বাড়িতে নিয়ে এলাম ইলিশ জোড়া। অনেক আগ্রহ ভরে মাছের আঁইশ তুলে চোখ বড় বড় করে ইলিশের পেট কাটলাম,কিন্তু না,এই ইলিশের পেটে ডিম নেই।খানিকটা উৎসাহ কমে গেল, তারপরে ইলিশ ভাজি করলাম,তেমন কোন গন্ধই আমাকে আর জাগিয়ে তুলতে পারলো না।রান্না করে একা একা খেতেও বসলাম, কিন্তু আমার মায়ের হাতের সেই ইলিশ রান্নার যে গন্ধ,যে স্বাদ মুখে লেগে আছে সেই স্বাদকে মুছে ফেলে এই ইলিশ রোপণ করে দিল অজানা তেঁতো স্বাদ।যে স্বাদে ইলিশের গন্ধ নেই,নেই মায়ের ছোঁয়া ,তারপরেও আমি আগ্রহ ভরে খেতে থাকলাম কল্পনায় আম্মার হাতের সেই ইলিশের স্বাদ মুখে নিয়ে।কল্পনায় ভাসতে থাকলো আম্মার হাতের সরিষা-ইলিশ, একটু একটু করে ভাত মুখে পুরে দিচ্ছি আর সাথে ইলিশ। মনে হচ্ছিল আম্মা পাসে বসেই কাঁটা বেছে দিচ্ছেন,আর আমি বিমুগ্ধ নয়নে ইলিশ মুখে পুরে স্বাদ নিচ্ছি,মায়ের হাতের সরিষা-ইলিশের স্বাদ !!!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:৪০
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×