পর্ব-১
২৫ শে মার্চের নারকীয় হত্যাকান্ডের পর হানাদার বাহিনীরা ভেবেছিল বাঙালীদের নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে, আর কখনও তারা মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবেনা । সেই হানাদার বাহিনীরা সম্ভবত ভুলে গিয়েছিল বাঙালী জাতির অতীত ইতিহাস ,সম্ভবত ভুলে গিয়েছিল ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ,৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের ইতিহাস ,৬৯ এর গণ অভ্যুথ্যানের ইতিহাস,যে অভ্যুথ্যানে তাদের গুরু আইউব খানের মত শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ও ক্ষমতা থেকে বিতারিত হতে হয়েছে । ২৫ শে মার্চের সেই কালরাতের হত্যাকান্ডের পর বাঙালী জাতি ঠিক ই ঘূরে দাড়িয়েছিল ।আর এই ঘূরে দাড়ানোর নেপথ্যে অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে একটি সরকার ,যার নাম মুজিব নগর সরকার ।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ব্যপারে যাবতীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন ।সেই সময় বঙ্গবন্ধু কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ২৫ শে মার্চের সেই কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় ।এর আগে সে রাতে আনুমানিক ১১টায়, তাজউদ্দিন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম প্রমুখ বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ গ্রহণ করে ৩২ নম্বর থেকে বিদায় নেন। পরে ড. কামাল হোসেন নিজ বাসভবনে গ্রেফতার হন।।সেই সময় থেকে বাঙালী জাতি মূলত নেতৃত্ব শুন্য হয়ে পড়ে।জাতির এই ক্রান্তি কালে সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য একটি সরকার গঠন করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছিল। যার ফলে গঠিত হয় মুজিব নগর সরকার এবং এই সরকার গঠনের পরিকল্পনা যিনি প্রথম করেছিলেন তিনি হচ্ছেন তাজউদ্দিন আহমেদ ।
২৫শে মার্চএর রাত থেকে ঢাকা শহরে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারফিউ জারী করা হয়।২৭শে মার্চ সকালে ৫-৬ ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। সেই সময় জীবনের ঝুকি নিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ চুয়াডাংগা জেলার জীবন নগরে চলে যান । সঙ্গে ছিলেন ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম।
দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় -১৬ ই ডিসেম্বের ১৯৭২ দেয়া সাক্ষাৎকারে সেই দিনের সৃতিচারণ করে তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন
“সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনায় যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা বাংলাদেশ ও এদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের স্বার্থেই নিয়েছিলাম ।বাঙালীর আশা আকাঙ্ক্ষা আর বাঁচামরার প্রশ্নকে সেদিন সবচেয়ে উচুতে স্থান দিয়েই আমি কাজ করে গিয়েছি আওয়ামীলীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এবং খাটি বাঙালী হিসেবে আমার দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করতে পারায় আমি খুশি। তবে সামগ্রিক সাফল্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের।--- বাংলাদেশের এই বিপ্লব কোনও একদিনের ঘটনা নয়। এর জন্য আওয়ামীলীগ বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বাঙালী জাতিকে ধীরে ধীরে বিপ্লবের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে এবং এভাবেই তাদের মানসিক প্রস্তুতি ঘটিয়েছে ।
এরপর ২৫শে মার্চ রাতে জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙ্গালীর উপর ঝাপিয়ে পরলে সমগ্র বাঙালী জাতি তার প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ শপথ নিয়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে । হামলা শুরু হওয়ার পর ঢাকা থেকে পালিয়ে আমি জীবন নগরে পোছাই ।সঙ্গে ছিলেন ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম । পালিয়ে যাওয়ার পথে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা লাভের যে চেতনার উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অনিবায র্সুযোগ দিয়েছিল। জীবন নগরের কাছে সীমান্তবর্তী টংগী নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হল একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা ।
সেদিন ঐ সীমান্তেই মেজর উসমানের সাথে আমার দেখা । তার কমান্ডে একটি ব্যাটালিয়ন তখন,কিন্তু হাতে সেকেলে রাইফেল। এর বিপরীতে পাকিস্তানী খান সেনাদের হাতে আধুনিক সয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিপুল সম্ভার । যাহোক ১ এপ্রিলের মধ্যেই আমি কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংগ্রহ করি এবং সেগুলো মেজর উসমানের হাতে দিয়ে দিই যা দিয়ে তিনি ঐ সীমান্তে পাক বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করেন ।”
সাক্ষাৎকারটির উৎসঃ ইতিহাসের উজ্বল একটি দিন ১৭ ই এপ্রিল –সিমিন হোসেন রিমি http://www.genocidebangladesh.org
শুভ,সিলেট