তিতলির বারান্দার কোণায় অযত্নে ফেলে রাখা একটা বাক্সের ভেতর একজোড়া চড়ুঁই নতুন সংসার পেতেছে। তিতলিদের ছোট্ট দুই কামরার বাসায় কোন স্টোর রুম নেই। বারান্দার এক কোনায় তাই সে সংসারের অব্যবহৃত জিনিস-পত্র রেখে দিয়েছে। বৃষ্টির ছাট যেনো জিনিস-পত্রের গায়ে না লাগে, এজন্য একপাশের গ্রিল পলিথিন দিয়ে আটকে দিয়েছে। সুন্দর গোছানো যায়গা পেয়ে চড়ুঁই দু’টো বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের বাসা বানানোর উপকরণ এনে ছোট্ট একটা বাসা বানিয়ে ফেলেছে। প্রথমদিকে তিতলি বুঝতে পারেনি। বেশ কিছুদিন ধরে বারান্দা ও বারান্দা সংলগ্ন তার শোবার ঘরের জানালায় চড়ুঁই পাখির ওড়াউড়ি দেখেছে। তিতলিকে দেখলেই তারা ফুড়ুৎ করে পালিয়ে যেতো। গত দু’দিন আগে ঘর ঝাট দেবার সময়, বারান্দার কোণা থেকে কিচির-মিচির শব্দ শুনে বাক্সগুলোর দিকে তাকাতেই, একটার মধ্যে থেকে একটা চড়ুঁই ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যায়। তখন তিতলি বাসাটার সন্ধান পায়। নানান প্রকার খড়-কুটো, মরা ঘাস, গাছের শুকনো বাকলের অংশ বিশেষ, আরও কত কি যোগাড় করে ছোট্ট বাটি আকৃতির একটি বাসা তৈরি করেছে তারা। দেখতে খুবই সুন্দর, একরাশ ভলোবাসা ও পরিশ্রম দিয়ে তৈরি। বাসাটি আবিস্কার করে তিতলি খনিকক্ষণ ঠায় হয়ে দাড়িয়ে ছিলো; কি করবে তা সে বুঝে উঠতে পারছিলো না। একটুপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তার মনটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। তিতলির শরীরের যে অবস্থা তাতে তার মন খুশি থাকা অত্যন্ত জরুরী। তার সারাদিনের একাকিত্ব দুর করতে এরা তার নতুন সঙ্গী হতে পারে।
তিতলির পরিচয়টা একটু দেওয়া দরকার। তিতলি খুবই সাধারন মেয়ে, আর পাঁচজনের মতো একজনের স্ত্রী। পতিব্রতা স্ত্রী কিনা বলা যাচ্ছে না, তবে ভালোবাসার বাঁধনে যেসব নারীরা পুরুষকে বেধে রাখতে পারে, তিতলি তাদেরই একজন। প্রায় তিন বছর হলো, গৌরিপুর রেল স্টেশন রোডের একটা তিন তলা ভাড়া বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তিতলি ও ফয়সাল তাদের ছোট্ট সংসার পেতেছে। দুই রুমের এই ফ্ল্যাট বাড়িতে যখন তারা নতুন জীবন শুরু করে তখন একটা চৌকি, রান্না ঘরের চুলা ও কিছু বাসন-কোসন ছাড়া আর তেমন কিছুই ছিলো না। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে এই বাড়িতেই প্রথম সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া তাদের। ফয়সালের কর্মস্থল গৌরিপুর রেল স্টেশনের পাশে হওয়ায় তিন বছর আগে ভাড়া করা এ ছোট্ট ঘরটা আর বদল করা হয়নি। এ তিন বছরের চেস্টায় ফয়সাল নতুন চাকরী পাবার পর একটু একটু করে তিতলি তাদের সংসারটা সাজিয়েছে। এই দীর্ঘ তিন বছরে অর্থের অভাব তাদের সংসারে প্রভাব ফেলতে পারেনি বটে, তবে ভালোবাসার টানে দু’জন একে-অন্যের হাত ধরে বেরিয়ে আসার ফলে আত্মীয় পরিজনের সাথে ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি। তাই ফয়সাল কাজে বেরুলে এই উচ্ছল মেয়েটাকে সঙ্গ দেবার মতো কেউ থাকেনা। ফয়সাল কাজে বেরিয়ে গেলে তিতলির ভারী একা লাগে। সেই একাকিত্ব ঘোচাতেই ঘর সাজানোর কাজে তিতলির ব্যস্ত থাকা। এখন তিতলি অসুস্থ। তাদের সংসারে নতুন একজন আসতে চলেছে। এখন তাদের দুজনের সাথে যুক্ত হবে নতুন একটা প্রাণ। এ’সময়ে ভারি কাজ করা মানা থাকলেও তিতলি প্রায়শঃই ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে।তাদের কাজের লোক একজন আছে বটে, কিন্তু কাজের লোকের কাজ তার পছন্দ হয় না। তাইতো ঘর ঝাট দিতে গিয়ে তার সাথে এই চড়ুঁই পখিদের দেখা।
বিকালে ফয়সাল ফেরার সাথে সাথেই তার হাত ধরে পাখির বাসা দেখাতে নিয়ে গেলো তিতলি। তিতলির উত্তেজনা ও আনন্দ দেখে ফয়সালও খুশি হয়। ছোট্ট গোল বাসাটিতে তিতলি ও ফয়সালের মতো দু’টি পাখি একে অন্যের দিকে মুখোমুখি বসে আছে। সান্ধ্যকালীন চা নিয়ে দু’জনে বারান্দায় বসে যেমনটি গল্প করে, এরাও তেমন বসে কিচির মিচির করে দু’জনে গল্প করছিলো। তিতলি ও ফয়সালের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা চুপ হয়ে যায়। নতুন প্রতিবেশিদের দায়িত্ব তিতলির হাতে দিয়ে আনন্দিত মনে বারান্দা থেকে ঘরে চলে আসে ফয়সাল। আগে রাতের বেলায় দু’জনে শুয়ে তাদের আগত সন্তান নিয়ে গল্প করতো, কিন্তু এখন তার সাথে চড়ুঁই পাখির সারা দিনের কর্মকান্ড ও তাদের দেখভালের গল্পও যুক্ত হয় দু’জনার গল্পের আসরে।
পাখি দু’টোর যত্ন-আত্তির কথা ভেবে, একদিন সকাল বেলায় তিতলি দুটি প্লাস্টিকের বোতল কেটে গ্রীলের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। তাদের খাবারের কথা চিন্তা করে একটাতে কিছু ভাত, আর অন্যটাতে কিছু পানি দিয়ে রাখে। একটু পর পর তিতলির কৌতুহলি চোখ প্লাস্টিকের বাটির খাবার কমেছে কি-না সেই খোঁজ রাখে সারাদিন। কিন্তু খাবার কমে না। চড়ুঁই-রা কি খায় কে জানে! পরদিন ভাত বদলে কিছু চাল দিয়ে রাখে, তাতেও খুব একটা আগ্রহ নেই পাখি দু’টোর। একবার অবশ্য বারান্দার জানালা দিয়ে লুকিয়ে একটাকে পানি খেতে দেখেছে। উফ! কি আনন্দ লাগে তার। কাজের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই বারান্দায় এসে পাখি দু’টোকে একপলক দেখে যায়। মাঝে মধ্যে বাসাটা ফাঁকা দেখলে বারান্দা দিয়ে খোলা আকাশে তাদের খোঁজা-খুঁজি করে তিতলি। খালি বাসা দেখলে খুব মন খারাপ হয়। বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে, পেটের আগত সন্তানের সাথে সে অবসরে গল্প করে,“ জানিস, আমাদের বাসায় না এক জোড়া চড়ুঁই পাখি বাসা বেঁধেছে। সারাদিন দুইজন কিচির মিচির করে, হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যেনো উড়ে যায়। দুটোই খুব দুস্টু। তুই যখন আমার কোলে আসবি, তখন তোকেও দেখাবো। আচ্ছা তুইও কি ওদের মতো দুস্টু হবি?”
রুটিন চেকআপ শেষ করে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাসায় ফেরার সময়, এক বিকালে ফয়সালের কাছে পাখির খাবার কিনে দেবার বায়না করে তিতলি। মফস্বলে পশু-পাখির দোকান খুঁজে না পেলেও, একটি অ্যাগ্রো-ফার্মের দোকানে পাখির খাবার পাওয়া গেলো। খাবার কিনে এনে গ্রীলে ঝোলানো বাটিতে খাবার দেয় তিতলি। পাখি দুটো এখন আগের থেকে অনেক পোষ মেনে গেছে। তিতলিকে এখন তারা ভয় পায়না, বরং তারাও তাদের বাসা থেকে গলা বাড়িয়ে তিতলিকে দেখে। ইদানিং তিতলি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে বেশ জোরে জোরে গল্প করে। তিতলির ধারণা, পাখি দুটো তার কথা বুঝতে পারে। মাঝে-মধ্যে কিচির-মিচির করে তারা যেনো তিতলির গল্পে সায় দেয়। শহরের মানুষের জীবনযাত্রার সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে বলেই হয়তো এদের শহুরে পাখি বলে।
সপ্তাহখানেক পরে, এক সকালে তিতলি খাবার দিতে গিয়ে তাদের বাসায় একটা ডিম আবিস্কার করে। মুহুর্তে তার সমস্ত শরীরে এক আনন্দের শিহরণ বয়ে যায়। আরও একটি নতুন প্রাণের আহ্বান। চিৎকার করে ফয়সালকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ডিমটা দেখায় সে। ফয়সালের মধ্যেও একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। হাসিমুখে সে বলে,“ দ্যাখো আরও ডিম হবে।” “একসাথে এত বাচ্চা-কাচ্চা আমি সামলাতে পারবো না”- বলে তিতলিকে লজ্জা দেয় সে। পরদিন আরও একটি ডিম; এবং এভাবে একে একে চারটি ডিম পাড়ে চড়ুঁইটি। আবু ইসহাকের ‘মহাপতঙ্গ’ গল্পের মতো যদি এরা কথা বলতে পারতো তবে তিলতি তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিতে পারতো। অনেক কস্ট করে ফয়সাল আর তিতলি পুরুষ আর স্ত্রী চড়ুঁই দুটিকে পৃথকভাবে সনাক্ত করতে পেরেছে। স্ত্রী চড়ুঁইটার দেহতল ও উপরিভাগ মেটেরঙা আর পুরুষ পাখিটার ঠোঁটের গোড়া থেকে শুরু করে মাথার চাঁদি পর্যন্ত ধূসর, পিঠের ওপরটা অপেক্ষাকৃত উজ্জ¦ল লালচে-কালো ধুসর। স্ত্রী চড়ুঁইটা এখন রুটিন করে ডিমে তা দেয়। তিতলিরও আর বেশিদিন বাকি নেই। একসাথে বাচ্চা-কাচ্চায় ভরে উঠবে বাড়িটি, ভেবে তিতলি খানিকটা লজ্জা পায়। ডিমে তা দেবার সময় তিতলি বাসার অনেক কাছে গেলেও স্ত্রী চড়ুঁইটা ডিম ছেড়ে পালায় না। ডিম হবার পর থেকে পুরুষটাই বেশি বাইরে ঘোরাঘুরি করে। তিতলির ভারি অভিমান হয়। আচ্ছা পুরুষ জাতটাই কি এমন!
দিন-দশেক পর এক সকালে হঠাৎ তিতলির ব্যথা উঠলে ডাক্তারের পরামর্শে তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। তিতলি এমনিতেই অনেক রোগা-শোকা। বাচ্চা পেটে আসার পরথেকেই এটা ওটা ঝামেলা লেগেই আছে। হাতে আরও কয়েকটি দিন সময় ছিলো, কিন্তু হঠাৎ করেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফয়সালের ইচ্ছা ছিলো ময়মনসিংহ নিয়ে যাবে, কিন্তু স্থানীয় ডাক্তার তাকে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে তিতলিকে ভর্তি করতে বললেন। বিকালের দিকে ময়মনসিংহ থেকে একজন বড় গাইনিকোলজিস্ট আসবেন, তিনি প্রসেস করবেন। তার আগে তিনি ক্লিনিকের ডাক্তারকে রুটিন টেস্টগুলো করে রাখতে বলেছেন। ইতিমধ্যে সেগুলো করা হয়েছে। রিপোর্টগুলো এখনও আসেনি। ফয়সাল তিতলির হাত ধরে বসে রয়েছে। তিতলির প্রসব বেদনা ক্রমশঃ বাড়ছে। এই সমস্ত দুনিয়ায় তারা দু’টি মাত্র প্রাণী। এ’সময় মুরুব্বীগোছের কেউ পাশে থাকলে ভালো হয়। কিন্তু যারা এই তিন বছরে একটি বারের জন্যও খোঁজ নেয়নি তাদের এ দুঃসময়ে খবর দিতে তিতলি বা ফয়সাল কারও মন সায় দেয়না। হঠাৎ তিতলি ফয়সালকে অবাক করে দিয়ে বলে, “প্রায় বারো তেরো দিন হয়ে গেলো চড়ুঁই দুটো ডিম পেড়েছে। ওদেরও বাচ্চা হবে।” এই তীব্র প্রশব বেদনার মাঝেও সে চড়ুঁই পাখিদের কথা ভোলেনি। সময় যাবার সাথে সাথে তিতলি ক্রমশঃ দূর্বল হয়ে পড়ে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে, ঠোঁট কামড়ে, চোখ বন্ধ করে সে সময় পার করতে থাকে। সন্ধ্যার পর ডাক্তার এলে তিতলিকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়।
যখন তিতলিকে কেবিন থেকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ফয়সাল খুব ঘাবড়ে গেছিলো। প্রসব বেদনায় তিতলির মুখ প্রায় নীল হয়ে গেছিলো, কিন্তু কিছুতেই ফয়সালের হাত ছাড়তে চাইছিলো না। বিদেশে বাচ্চা প্রসবের সময় স্বামীকে সাথে থাকার অনুমতি দেয়, কিন্তু বাংলাদেশে এসবের কোন বালাই নেই। অপারেশন থিয়েটারের দরজা বন্ধ। সময় যেতে থাকে, কিন্তু ফয়সালের কাছে এই প্রতীক্ষার প্রহর ফুরায় না। ছোট ছোট অনেক স্মৃতি তার মনে ভেসে উঠতে থাকে। বেশিরভাগই এলোমেলো স্মৃতি। সেই যে, লেকের পাড় দিয়ে তিতলি ধীর পায়ে হেটে আসতো, আর সে প্রতীক্ষা করতো কখন তাকে দেখতে পাবে। বুকের ওপর শক্ত করে বই-খাতাগুলো ধরে গুটি গুটি পায়ে তার বান্ধবীদের সাথে কোচিং ক্লাসে যেতো। মাথাটা নীচু করে আড়ঁচোখে চুরি করে ছেলেদের দলটার মধ্যে শুধু ফয়সালকেই খুঁজতো সে। তখন তার নাকের নীচে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম শিশিরের মতো ফুটে উঠতো। পরে অবশ্য একদিন তিতলি বলেছে, যে ঐ সময় ফয়সালকে দেখতে পেলেই তার বুক ধরফর করতো আর কপালে প্রচন্ড ঘাম হতো। ওই রাস্তাতেইতো, একদিন মেয়েদের দলটাকে আটকে সবার সামনে তিতলিকে একটা চকলেট বক্স আর দোলনচাঁপার একটা বড় তোড়া দিয়েছিলো ফয়সাল। এক সলজ্জ হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে নেবার মাধ্যমেই শুরু হয় দু’জনের পথচলা। তারপর কেটে গেলো কত বছর। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে, নতুন সংসার আর এখন নতুন অতিথির প্রত্যাশা; সত্যিই অনেকটা সময় চলে গিয়েছে। সময়ের কথা মনে পড়তেই হাতের ঘড়িটার দিকে তাকায় ফয়সাল। প্রায় চার ঘন্টা সময় পেরিয়ে গেছে। এতটা সময়তো লাগার কথা নয়। একটা চিন্তার বলিরেখা স্পস্ট হয় তার কপালে। আনমনে পায়চারি করতে থাকে ক্লিনিকের করিডোর দিয়ে। এখন প্রায় মধ্যরাত। হঠাৎ অপারেশন থিয়েটার খুলে যায়। মহিলা ডাক্তারটা বেরিয়ে আসে, ফয়সালের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটা নাড়িয়ে তার চেম্বারের দিকে চলে যায়। ঠায় হয়ে দাড়িয়ে থাকে ফয়সাল, যেনো কি ঘটছে তার কিছুই সে বুঝতে পারছে না। অচেতন তিতলিকে কেবিনে আনা হয়েছে, কিন্তু তার সাথে কেউ নেই। কিন্তু ক্যানো নেই?
পরদিন খুব সকালে তিতলিদের বাসার সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স থামে। ফয়সালের সহকর্মীরা ও বাড়ির অন্যান্য প্রতিবেশিরা ততক্ষণে বাড়ির গেটের কাছে জড়ো হয়েছে। তিতলির মেয়েকে একটা ধবধবে সাদা কাপড় মুড়িয়ে বুকের কাছে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামে ফয়সাল। তিতলিকে স্ট্রেচারে করে তিনতলায় ওঠানো হয়। সিজারের পেশেন্ট, ডাক্তার কিছুতেই ছাড়তে চায়নি। তিতলির মেয়েটা মাত্র একটিবারের জন্য তার বাসায় যাবে আর তিতলি থাকবে না, তাই কি হয়! ডাক্তার-নার্সদের সাথে একপ্রকার ঝগড়া করেই সে চলে এসেছে। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে একটা একটা করে সিড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে ফয়সাল। তাদের দু’জনের নির্লিপ্ততা প্রতিবেশিদের হতবিহ্বল করে তোলে। ফয়সালের কলিগ, বাসার মালিক ও প্রতিবেশিরা মিলে সব জোগারযন্ত করে রেখেছে। শোকার্ত পরিবেশ, কিন্তু ভয়াবহ রকমের শান্ত। কোন উচ্চস্বরে কান্না বা বিলাপের কোন শব্দ নেই, নেই কোন ফিসফিসানি কথার শব্দ; রয়েছে এতগুলো মানুষের সিড়ি ভাঙার সময়ে চটি ঘসার খসখসানির শব্দ, আর কিছু দীর্ঘশ্বাস। তিতলিকে স্ট্রেচার থেকে খাটে নামানো হয়। গুটি কতক লোক আর কিছু মাঝ বয়সী মহিলা রুমে প্রবেশ করে। ফয়সালকে ঘরে ঢুকতে দেখে তার এক কলিগ এক মহিলার দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,“ খালা, গোছলের গরম পানি আর যা লাগে একটু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেন। পাশের ঘরে সব রাখা আছে।” কথা শুনে মহিলাটিও ব্যতিব্যস্ত হয়ে আরও দু’তিন জন মহিলাকে চোখের ইশারায় ডেকে নেয়। তিতলির মুখের দিকে তাকিয়ে ফয়সাল সবাইকে পাশের কামরায় বসতে অনুরোধ করে। তিতলি ও ফয়সাল মুখোমুখি বসে আছে। ফয়সালের কোলে তাদের প্রথম সন্তান; মৃত সন্তান। ফয়সালের দুর্দিনে, সংসার শুরুর প্রথমদিকে, সেই প্রচন্ড অভাবের মুহুর্তে ফয়সালের চোখের দিকে তাকিয়ে তিতলি যেভাবে ফয়সালকে সাহস দিতো; আজও একইভাবে দু’জন চোখাচোখি হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তিতলির ঠোঁট দু’টো মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। এতদিন তিতলি, ফয়সালকে সাহস জুগিয়েছে। তিতলি ভেঙে পড়লে ফয়সাল তাকে কিভাবে সাহস যোগাবে? হঠাৎ, তাদের নিস্তব্ধতা ভাঙায় বারান্দা থেকে ভেসে আসা চি-চি শব্দ। চোখের কোণায় জমে থাকা অশ্রুফোটাটা মুছে তিতলি বলে, “চড়ুঁই দু’টোর মনে হয় বাচ্চা হয়েছে। আমাকে একটু বারান্দায় নিয়ে যাবে?” বারান্দায় ফয়সালের কাঁধে ভর দিয়ে দাড়ায় তিতলি। চড়ুঁই দু’টোর দু’টি ছোট্ট ছানা হয়েছে। এখনও চোখ ফোটেনি; তারপরও প্রাণপনে চিৎকার করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এতটুকু বাসায় তাদের চারজনের মিস্টি মধুর সংসার। বড় চড়ুঁই দুটো গলা বাড়িয়ে তিতলি ও ফয়সালকে দেখে, কিচির-মিচির করে তাদের উদ্দেশ্যে কি যেনো বলে; যেনো তাদের বাচ্চা হবার সু-সংবাদ দেয়। তিতলি ও ফয়সালের অশ্রু নীরবে কপোল গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে।
যোহরের নামাজের পর লাশ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। পুতুলকে বাসা থেকে বের করে পাড়ার মসজিদের সামনে একট গাছের ছায়ায় রাখা হয়েছে। ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময় বাচ্চার নাম পুতুল দিয়ে সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। সারাক্ষণ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলেও, বাচ্চাকে বাসা থেকে বের করে আনার সময় তিতলিকে বেধে রাখা যায়নি, হাউ মাউ করে কেঁদেছে; হয়তো এখনও কাঁদছে। অপারেশন থিয়েটারে জন্ম নেবার সময় মৃত শিশুর জানাজা হয়না। নামাজ শেষ করে ফয়সাল তাই চুপ-চাপ পুতুলের পাশে দাড়িয়ে আছে। স্থানীয় কবর খানায় তার জন্য কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এখন পুতুলের লাশ নিয়ে যেতে হবে। এতবড় খাটিয়ার এক কোণে ছোট্ট কাফন জড়িয়ে পুতুলকে রাখা হয়েছে, তবুও এ খাটিয়ার ওজন ফয়সালের কাছে যে কতটা ভারী, তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে খাটিয়া কাঁধে নিলো ফয়সাল। কবরের সহযাত্রীরা পেছন পেছন হেঁটে আসছে। তাদের মুখে অনুচ্চ স্বরে উচ্চারিত হচ্ছে,“আশ্হাদু আল-লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু-লা-শারীকালাহু ওয়া আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদান আ'বদুহু ওয়া রাসূলুহু।” প্রচন্ড রোদ আকাশে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, যেনো পুতুলের কাফন পরানো লাশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আকাশপানে তাকিয়ে হাটঁতে হাঁটতে বিমর্ষ ফয়সাল খেয়াল করে, একটা পাখি তাদের অন্তিম যাত্রার সঙ্গী হয়েছে। একটু ভালো করে তাকানোর পর সে পাখিটাকে চিনতে পারে। এতো তাদের বাসার পুরুষ চড়ুঁই পাখিটা। ফয়সালদের সামনে সে উড়ে উড়ে যাচ্ছে, যেনো পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিচির-মিচির করে যেনো বলছে, আমরাও আছি, তোমাদের সাথেই আছি।