বৈশাখ মাসের গুমোট বিকেল বেলা, কোথাও কোন বাতাস না থাকায় গরমে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠগত। অনেকেই এ সময়টাকে নিন্মচাপের পূর্বাভাস বলেন। আগেকার দিনে বৈশাখ মাস এলেই, তপ্ত দুপুরের পর আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করে সন্ধ্যায় উথাল-পাথাল ঝড় উঠতো। কাল-নাগিনী যেমন ফণা তুলে ছোবল মারে, এ ঝড়ও হু-হু করে ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। লোকে তাই এর নাম দিয়েছে কাল-বৈশাখীর ঝড়। এখনকার দিনে কাল-বৈশাখী কালে-ভদ্রে আসে। গেলো বছরতো, বৈশাখ পেরিয়ে জৈষ্ঠ্য মাসে গিয়ে একটা দমকা ঝড় উঠলো। বিজ্ঞানীদের মতে, এটা নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে প্রাণীকুল আজ অতিষ্ট। আগের ছয় ঋতু এখন আর নেই। ছয় ঋতুর বদলে এখন আছে অতি-গরমকাল, বর্ষাকাল, হালকা গরমকাল তারপর আবার সেই অতি-গরমকাল। গ্রামে দিন কয়েকের জন্য শীত পড়ে বটে, তবে শহরাঞ্চলে শীতকাল কি জিনিস তা শুক্র-টু-শুক্র সাত দিনও ঠিকমতো বোঝা যায় না। ছোটবেলায় ফাইনাল পরীক্ষা শেষে শীতকালে নানী-দাদী বাড়ী গেলে খেজুরের রস খাওয়া যেতো। এখন খেজুরের রস আছে কিনা কে জানে! আছে হয়তো; নইলে বাজারে খেজুরের গুড় আসে কোথা থেকে? আসলে প্রচন্ড গরমের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ থাকলে অবচেতন মন শীতলতা খুঁজতে থাকে। তাই এই গুমোট বিকেলে মনটা একটু ঠান্ডা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বৈশাখের এই গরমের একটা জুৎসই নাম দেওয়া দরকার। ভাদ্রমাসে তাল পাঁকে, আর জৈষ্ঠ্যে পাঁকে কাঁঠাল। গ্রামের মানুষ তাই এই ভাদ্র মাসের গরমের নাম দিয়েছে তাল পাঁকা গরম, আর জৈষ্ঠ্য মাসের গরমের নাম দিয়েছে কাঁঠাল পাকা গরম। আচ্ছা বৈশাখ মাসে কি পাকে? আম!
বৈশাখের এমন একটা পড়ন্ত বিকেলে অবন্তী ছাদে উঠেছে একটু ঠান্ডা বাতাসের আশায়। খোলা চুলে, বাসায় পরা একটা পরুন সুতির রংচটা ত্রি-পিচ গায়ে দিয়ে ছাদে চলে এসেছে সে। মফস্বলের পাঁচতলা একটা বাড়িতে অবন্তীরা ভাড়া থাকে। ভাড়া বাড়ী হলেও ছাদটা থাকে সারাক্ষণ খোলা, আর তেমন একটা কেউ ওঠে না। এমনকি কাপড় নাড়তেও না। মফস্বল শহরে বহুতল বাড়ীর ঘনত্ব কম থাকায় উঁচু বাড়ির ছাদে উঠলে শহরের অনেকটা দেখা যায়। অবন্তীদের বাড়ীর অবস্থানগত আরও একটা বিশেষত্ব হলো, ওদের বাসার পেছনদিকে তিনটা একতলা বাড়ী, তারপর বিশাল একটা পুকুর। আর সামনের বড় রাস্তাটা পেরিয়েই বিশাল একটা সবুজ মাঠ। তাই ছাদে উঠলে দুরের দিগন্তেও চোখ চলে যায়। মাঝেমধ্যে আকাশ পরিস্কার থাকলে ওই দুরের বাড়িঘর গুলোকে সবুজের বুকে ফেলে রাখা জঞ্জাল মনে হয়। পুকুরের পাড় ঘেসে আসা সরু সি-সি রাস্তাটা অবন্তীদের বাড়ির ডানপাশে একটা বাড়ি পর, বড় রোডের সাথে মিশেছে। রাস্তাটা সোজা নয়, বরং সর্পিলাকার। সরু গলি রাস্তাটায় যানবাহন খুব একটা চলাচল করে না। অবন্তীদের বাড়ির সামনের বড় রাস্তায়ও রিক্সা-ভ্যান ছাড়া তেমন কিছু একটা সচরাচর দেখা যায়না। আসলে মফস্বল শহর বলেই হয়তো গাড়ীর সংখ্যা অনেক কম। ইদানিং অবশ্য ব্যাটারী চালিত অটো-রিক্সা বের হয়েছে। সারাদিন এগুলো প্যাঁ-পুঁ করে চলে এবং যেকোন সময়ে, যেকোন গলিতে ঢুকে এরা জ্যাম বাধিয়ে দিতে পারে। দেখতে কিছুটা আগেকার দিনের মিশুকের মতো হলেও কোন আঙ্গিকে রিক্সার মতো নয়। তবুও এর নাম অটো-রিক্সা হলো কেন কে জানে? গরম বেশি বলে হয়তো যানবহনের পাশাপাশি মানুষও ঘর থেকে বের হয় কম। তাই পাড়ার আড্ডাবাজিতেও আজ-কাল লোক কম হয়। অবন্তীর অবশ্য যাবার কোন যায়গা নেই। মেয়েমানুষেরা পাড়ার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়না। ভার্সিটি চত্তরে চা-য়ের দোকানের আড্ডা অবশ্য ভিন্ন কথা। অবন্তীর লেখাপড়া বলতে গেলে একরকম শেষ। অনার্স ফাইনাল দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে চলে এসেছ। রেজাল্ট এখনও হয়নি, আর তাড়াতাড়ি হবে বলেও মনে হয় না। বাসায় আসার পর একদিন শোনা গেলো, ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনৈতিক দু’দলের মধ্যে গ্যানজাম লেগেছে। ক্যাম্পাস বন্ধ করে সবাইকে হল ছাড়তে বলা হয়েছে; কিন্তু দল করে এমন অনেকেই হল ছাড়ছেনা। তবে সাধারণরা যে যার বাড়ি চলে গেছে। তাই কখন রেজাল্ট দিবে কে জানে! ভার্সিটিতে ঢোকার পর অনেক নতুন নতুন বন্ধু বান্ধব তৈরি হয় একথা যেমন ঠিক, তেমনি মফস্বলে ইতিপূর্বে তৈরি হওয়া বন্ধুর সংখ্যাও দ্রুত কমে যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা আরও দ্রুততার সাথে ঘটে। এলাকায় অবন্তীর তাই তেমন কোন বন্ধু-বান্ধব নেই, আড্ডাবাজিও নেই। দিনের বেলায় মায়ের কাজে সাহায্য করা, ঘরের খুঁটিনাঁটি কাজ সেরে বিকেলে ছাদে এসে নিঃসঙ্গ সময় কাটানো, তাই তার একটা রুটিন হয়ে দাড়িয়েছে। সেই রুটিন মাফিক আজ অবন্তী ছাদে এলেও আজ তার জীবনের একটা বিশেষ দিন। আজ অবন্তীর বিয়ে।
অবন্তী সম্বন্ধে একটা ছোট্ট বর্ণনা দেওয়া যাক। এমন কোনো বিশেষ গুণ নেই, যা দিয়ে তাকে বিশেষায়িত করা যায়। অবন্তী কালো। শ্যামলা নয়, কালো। ছোট বেলায় অনেকেই তাকে শ্যামা নামে ডাকতো। এই নামটা কিভাবে পরিবর্তিত হয়ে অবন্তী হয়েছে, তা তার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, ছোটবেলায় মা আর মামার সামনে কেউ তাকে শ্যামা নামে ডাকলে তারা ভীষন গালমন্দ করতেন। অবন্তী নামটা হয়তো তার মামারই দেওয়া। কালো মানুষের মুখের গড়ন অনেক সময় সুন্দর হয়। কিছু মানুষের চোখ হয় অনেক সুন্দর, মায়াময়। অবন্তীর চেহারায় এর কোনটাই তেমনকরে ফুটে ওঠে না। প্রথম দর্শনে আকৃষ্ট করার মতো কিছুই তার মাঝে নেই। অবন্তী লেখাপড়ায় মোটামুটি। কোনদিন আহামরি রেজাল্ট করেনি; তাই বলে কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় শেণিও সে পায়নি। গান-বাজনা, নাচ, কবিতা আবৃত্তি কোন কিছুই সে পারেনা। তবে গুনগুন করতে ভালোবাসে। গুনগুন করলেই সবাই শিল্পী হয়না।
অবন্তীদের নিন্ম-বিত্তের সংসার বলা যায়। সরাসরি গরীব বলতে যা বোঝায়, সংসারটা এখনও সে পর্যায়ে যায়নি। অবন্তীর বাবা টেলিফোন অফিসের একজন তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারি ছিলেন। সম্প্রতি রিটার্য়াড করেছেন। ছোট একটা ভাই আছে তার। এবার এইচ.এস.সি পাশ করে বিভিন্ন ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন দিয়ে বেড়াচ্ছে। এখনও কোথাও চান্স হয়নি। অবন্তীর মতো সেও মধ্যম মার্কা ছাত্র। তাদের সংসারে মা ছাড়া আরও একজন আছে। সেটা হলো অবন্তীর মামা। ছোট বেলা থেকেই মামাকে সে তাদের সাথেই দেখে আসছে। তিনি বেকার, কিছুই করেন না। বিয়ে-সাদি কিছুই করেননি, আর করে সংসারী হবেন বলেও মনে হয় না। এ পরিবারের গলগ্রহ হয়ে সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতেই তিনি বেশী পছন্দ করেন। দুলাভাইয়ের নিত্য বকাঝকা তিনি বিশেষ গায়ে মাখেন না। পাঁচ সদস্যের সংসারে তৃতীয় শ্রেনীর একজন কর্মচারির রিটার্য়াডের টাকা একমাত্র চলার অবলম্বন হলে সে সংসারকে নিন্মবিত্ত ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। তিন বেলা ডাল-ভাত যোগানোই যেখানে কস্টকর, আয়োজন করে বিয়েতো সেখানে বিলাসিতা।
অবন্তীর বিয়ের প্রসঙ্গে একটু আসা যাক। নিন্ম আয়ের পরিবারে মেয়ে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে- মানেই বিবাহ উপযুক্ত। সে সময় থেকেই চলে উপযুক্ত পাত্রের খোঁজ। অবন্তীও তার ব্যতিক্রম নয়। ভার্সিটি ছুটি হলে যখনই সে বাড়ি এসেছে, তখনই তাকে অনেকে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে পরিবারিকভাবে দেখতে এসেছে। তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন, নানা জায়গা হতে এসব বিয়ের প্রস্তাব আনতো। মা আগ্রহভরে এই দেখাদেখির বিষয়টা সারতে চাইলেও প্রথম দিকে বাবার খুব একটা সায় থাকতো না। অবন্তী যখন ফাইনাল ইয়ারে উঠলো, আর তার বাবা রিটার্য়াড করলো; তারপর থেকে বাবাও পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে বেশ আগ্রহী থাকতেন। চাকুরী শেষ, এখনও মেয়ের বিয়ে দিতে পারেননি, আশেপাশে পরিচিত সব আত্মীয়-স্বজন, কলিগদের মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়টা তাকে ভাবাতো। প্রথম দিকে এই দেখা-দেখি বিষয়টাতে অবন্তী মোটেই রাজী ছিলো না। একটা নিন্মবিত্ত পরিবারের উঠতি মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর লেখাপড়া শেষ করে উপার্জনক্ষম হয়ে সংসারের হাল ধরবে, এমন চিন্তা প্রগাঢ়ভাবে তার মধ্যে কোনদিন কাজ করেনি ঠিকই; তবে লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে হবে, এটা সে চেয়েছিলো। তাইতো প্রথম দেখাদেখির বিষয়টা তার মনে একটা ভীতি সঞ্চার করে। একটা মেয়ের জন্য বিয়ের উদ্দেশ্যে অপরিচিত ব্যক্তিদের সামনে পাত্রী সেজে বসা এবং তাদের বিচিত্র প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যে কতটা অপমানজনক, তা একটা সমন্ত মেয়েই শুধু বোঝে। এ প্রস্তাব আসা এবং পরে কোন কারন না জানিয়ে প্রস্তাব ভেঙ্গে যাওয়া দেখতে দেখতে তার কতকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তার নিজস্ব কোন পছন্দ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক-কে দেখে হয়তো ক্ষণিক ভালো লেগেছে, তবে মনে ধরার মতো কারও সাথে তার সাক্ষাত হয়নি। এমনকি কেউ তার কাছে এসে ভালোবাসার কথাও বলেনি। এ বিষয়টা নিয়ে তার অনেক দুঃখ জমা থাকলেও তার করার কিছু নেই। দেখতে অসুন্দর মেয়েদের কপালে প্রেমিকের ভালোবাসা প্রাপ্তি লেখা থাকেনা।
আজ অবন্তীর বিয়ে হলেও বাড়ী কোন আয়োজন নেই। আসলে আজ বিয়ে হবে কিনা তাও ঠিক করে সে জানেনা। কিছুদিন আগে তাদের এক প্রতিবেশী, মাজেদা খালা, অবন্তীর মা’কে এসে জানায়, তার দূসর্ম্পকের এক আত্মিয়া মাজেদা খালার বাসায় বেড়াতে এসে, ছাদে অবন্তীকে দেখে পছন্দ করেছে। এখন তিনি তাকে তার পুত্রবধু বানাতে চান। ছেলে একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে বিবিএ কমপ্লিট করে একটা ফার্মে জব করছে। ইনকাম মোটামুটি। ছেলে দীর্ঘদিন মাকে বিয়ে করবে না বলে ঘুরিয়েছে। শেষমেষ কিছুদিন আগে তার মা অসুস্থ্য হয়ে পড়লে ছেলে রাজী হয়। ছেলের নিজস্ব কোন পছন্দ নেই বিধায় জোর কদমে চলছিলো মেয়ে দেখা। অবন্তীকে ছাদে প্রথম দেখার পর, মাজেদা খালার সাথে সেই মহিলা একদিন এসেছিলো, অবন্তীর মায়ের সাথে গল্প করতে। অবন্তী তখনও উপস্থিত ছিলো। সেদিন অবশ্যি তিনি এ প্রসঙ্গে কিছু বলেননি। পরে মাজেদা খালা এসে বিষয়টা জানান। অবন্তীর মা-বাবা কেউ ছেলেকে দেখেনি। ঠিক দেখেননি বললে কিছুটা ভূল হবে। মাজেদা খালা ছেলের বায়োডাটা আর থ্রি-আর সাইজের একটা ফটো এনেছিলেন, অবন্তীর মা’কে দেখাতে। ছেলের ভার্সিটির কনভোকেশনের ছবি। ছবিটাও প্রায় আট বছর পুরানো হবে। ছেলের নাম মোঃ কামরুল ইসলাম। বয়স বত্রিশ। মা বলছিলেন, বয়সটা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে না! কিন্তু বাবা আর মাজেদা খালা এ কথায় ভেটো দিলেন। ইদানিং সব পাত্রকেই কেনো জানি অবন্তীর বাবার পছন্দ হচ্ছে। কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা কন্যা সম্প্রদানেই যেনো তৃপ্ত হয়। বাবা মায়ের সাথে কথা বলে খালা আজকের দিনটা ঠিক করেছেন। আজ ছেলে আসবে অবন্তীদের বাসায়। ছেলে, মেয়ে পছন্দ করলে কাজি ডেকে আজই কলমা পড়িয়ে দেওয়া হবে। দেনমোহর, দেনা-পাওনা এসব কোন বিষয়েই দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়নি। মাজেদা খালা জানিয়েছেন, এগুলোতে কোন সমস্যা হবে না। অবন্তীর মা, ছেলের পুরানো ছবিটা অবন্তীকে দেখতে দিয়েছিলো। অবন্তী দেখেনি, দেখে কি লাভ! পছন্দ অপছন্দতো পাত্রের হাতে। প্রথমদিকে পাত্র বা তার ছবি লুকিয়ে এক নজর দেখলেও এখন আর তা দেখতে ইচ্ছা করে না। যার রূপ নেই তার পছন্দ করার অধিকারও থাকেনা।
বিয়ে বাড়ি সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক। অবন্তীর মা ধরেই নিয়েছেন, আজ বিয়েটা হচ্ছে। অন্তত মাজেদা খালার কথায় তিনি সেই ভরসা পেয়েছেন। তাকে অনেকটা খুশি খুশি দেখাচ্ছে। অবন্তীর একটা সুন্দর শাড়ী পরা ছবি, অ্যালবাম থেকে সরিয়ে মাজেদা খালাকে লুকিয়ে মা দিয়েছিলো। সেটা নাকি ছেলে দেখেছে, তারপর দেখতে আসছে। তাছাড়া মা’র হবু বেয়াইনও এর মধ্যে দু’দিন ফোন করে সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেছেন। মাজেদা অবন্তীর হবু শ্বশুরবাড়ী সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছে, তাতে মোটামুটি একটা মধ্যবিত্ত ভদ্র পরিবারই মনে হয়। মাজেদা খালা জানিয়েছেন, ছেলের বাড়ি ওরা ছয় থেকে আট জন আসবে। মাজেদা খালা কাজিকে বলে রেখেছেন, কল দিলে তিনিও হাজির হবেন। যেহেতু বিয়ে শতভাগ চুড়ান্ত না, তাই অবন্তীর মা, অবন্তীর বাবাকে কাউকে দাওয়াত করতে দেননি। বিয়ে হলে পরে সুবিধামতো সময়ে অনুষ্ঠান করা যাবে। তাছাড়া হুট করে সিদ্ধান্ত হওয়ায় টাকা-পয়সাও তেমন যোগড় করা হয়নি। অবন্তীর বাবা আর মামা দু’জনে সকালে চার-পাঁচ ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করে এনেছেন। তারা বিশাল চিন্তিত। বাজার থেকে ঠিক করে সব আনা হয়েছে কিনা, বা কোনটা বাদ পড়লো কিনা, সেটা লিস্ট ধরে দুইজনে মিলিয়ে দেখছেন। অতিথি আপ্যায়ন ও বিয়ে কিভাবে ও কখন হবে তা নিয়ে দুজনে বসে বিস্তর পরিকল্পনা করছেন। অবন্তীর ভাই নির্বিকার। সে তার আসন্ন ভর্তি পরীক্ষা সামলাতে এক ঘরে দরজা লাগিয়ে পড়ছে, যেনো এরকমটা সে দেখে অভস্ত্য। অবন্তীর মা, পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীকে ডেকে এনেছেন, একটু সাহায্য করতে। তাকে বলেছেন অবন্তীকে দেখতে আসছে। বিয়ে হবে, এটা বলেননি। বিয়ের কথা বলতে গেলে বাড়ীর প্রতিটা পরিবারকে বলতে হবে। শেষে, কোন অঘটন ঘটলে ভিষণ লজ্জার ব্যাপার হবে। সকাল থেকেই তার মায়ের একটুও বিশ্রামের ফুসরত নেই। অবন্তী রান্নার কাজে সাহায্য করতে গেছিলো, কিন্তু তার মা তাকে আজ কাজ করতে বারণ করেছেন। ইতিপূর্বে, এ ঘটনা তার সাথে ঘটেনি। ঘরটা তাই একটু গোছ-গাছ করে সে ছাদে চলে এসেছে। একান্তে নিজেকে সময় দেওয়ার জন্য এ ছাদটা হলো তার সর্বত্তম যায়গা। আজ বৈশাখের এই দিনে এত বেশি গরম পড়েছে যে, মনটা বিয়ে বাদ দিয়ে শীতলতা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ছাদে প্রশান্তি খোঁজা অবন্তীর মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো। ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছে, বিয়ে মানে কতটা ধুম-ধামের ব্যাপার। আর তার বেলায়? বিয়ের দিন এতটুকু মেহেন্দি বা এক বাটি হলুদও জুটলো না। এমন শুধুমাত্র কলমার বিয়ে সে ইতিপূর্বে কয়েকটা অ্যাটেন্ডও করেছে। তার বান্ধবী, সুমির এই রকম বিয়েতে কম করে হলেও ত্রিশজন হাজির ছিলো। আর সে কোন বান্ধবীকেও বিয়ের কথাটা বলতে পারছে না। কোন উৎসব নেই, কোন আয়োজন নেই। তার বুক ফেঁটে কান্না আসছে। বিয়ের সময় পরিবার থেকে চলে যেতে হবে বলে মেয়েদের কান্না আসে; আর তার কান্না পাচ্ছে এমন করে বিয়ে হচ্ছে বলে। সে তো কোন অন্যায় করেনি, তবে কেনো এমন আয়োজন! খুবই খারাপ লাগছে তার। নিজেকে খুব নিঃস্বঙ্গ লাগছে। প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কোনদিন সে খুব একটা ভাবেনি এটা ঠিক; তবে তার মনের গহীনে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন আঁকা ছিলো। স্বপ্নটা সে বহুবার দেখেছে। এতবার দেখেছে যে, মাঝে মাঝে তার কাছে ব্যাপারটা একদিন সত্যিই ঘটবে বলে মনে হয়। কোন এক পড়ন্ত বিকেলে, একটা সুন্দর ছেলে লাল টি-শার্ট পরে, একটা গোলাপ মুখে আটকে নিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে আসবে। তার সামনে জোরে ব্রেক করে সাইকেল থেকে নামবে। মুখে আটকে নিয়ে আসা গোলাপটি হাতে নিয়ে তার সামনে হাটু গেড়ে বলবে,‘তুমি যদি রূপা হও, তবে আমি লাল শার্ট বাদ দিয়ে সারা-জীবন হলুদ পাঞ্জাবী পরতে রাজি আছি।’ অবন্তী একটু অবাক হবে, তারপর লজ্জা মেশানো শাসনের স্বরে বলবে,‘হিমু রুপাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, তাই হিমু হলে গোলাপ নেওয়া যাবে না।’ খুবই হাস্যকর একটি স্বপ্ন। প্রথমদিন এ স্বপ্নটা দেখে মনে মনে খুব হেসেছিলো। পরে বেশকয়েকবার ঘুরেফিরে স্বপ্নটা তার মনে ভাসতে থাকে। মনেহয় একদিন স্বপ্নটা সত্যি হলেও হতে পারে। এই স্বপ্নটা সে অনেকদিন ধরে দেখে এসেছে। স্বপ্নটা বোধহয় শুধু স্বপ্নই রয়ে গেলো।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। এই সময়টার একটা সুন্দর নাম আছে, গোধূলী লগ্ন। অবন্তীর হাতে আর বেশী সময় নেই। তার একাকী জীবনের পরিসমাপ্তি হতে চলেছে আজ। আকাশে লাল আভা দেখা দিয়েছে। দুরের দৃশ্যগুলো একটু একটু করে আধারে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। হঠাৎ একটি কাকতালীয় ব্যাপার ঘটলো তার সাথে। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাদের বাড়ীর ডান পাশের সর্পিলাকার গলিটার শেষ মাথায় পুকুর পাড়ে কৃষ্ণচুঁড়া গাছের নিচ দিয়ে একটা লাল শার্ট পরা ছেলে সাইকেল চালিয়ে বড় রাস্তার দিকে আসছে। এই কি তার স্বপ্নের ছেলেটি! আধার ঘনিয়ে আসছে ক্রমশঃ, তাই তার ঠোঁটে লাল গোলাপ আটকানো আছে কিনা তা দেখা যাচ্ছে না। ছাদে ডানদিকের রেলিংটা ধরে বেশ খানিকটা ঝুঁকে দেখার চেস্টা করছে সে। তার হাত কাপছে। একটা অজানা ভয় শিহরণ জাগাচ্ছে তার মনে। ছেলেটি কি তার জন্যই আসছে? সে কি দৌড়ে গিয়ে নিচে নেমে যাবে! তার স্বপ্ন কি আজ সত্যিই তার কাছে ধরা দেবে? হঠাৎ পরিচিত গলার ডাক শুনে সে সম্বিৎ ফিরে পেলো। অবন্তীর মা তাকে ডাকছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। পাখীরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে। তাকেও ফিরতে হবে, যেতে হবে বাস্তবিক সংসারে। শুরু হবে তার নতুন অধ্যায়। পশ্চিম আকাশে ডুবে যাওয়া সূর্যটার সাথে তার বহুবার দেখা স্বপ্নটাও আজ হারিয়ে গেলো।