-লেখা নিয়ে আসছেন?
-জ্বি
-কই দেখি...
প্রত্যয় পাণ্ডুলিপিটা এগিয়ে দেয়। তার ছয় বছরে লেখা অসংখ্য কবিতার মধ্যে থেকে বেছে বেছে সেরা পঞ্চাশটা এনেছে ও। অনেক আশা, এবারের বইমেলায় ওর একটা বই বেরোবে।
-এইসব কি লিখসেন? পাণ্ডুলিপিটা একটু নেড়েচেড়ে বিরক্তভরে তাকায় প্রকাশক।
-কবিতা
-কবিতা? কতদিন ধরে লেখন?
-ছয় বছর।
-আগে কোথাও ছাপা হয়েছে?
-একটা পত্রিকায় কয়েকটা কবিতা ছাপা হয়েছে।
-পত্রিকায়! কোনও বই বের হয় নাই? প্রকাশকের বিরক্তি যেন আরেকটু বাড়ে।
-না। এবারই প্রথম ছাপানোর চেষ্টা করছি।
-হুম।হাজার ত্রিশেক টাকা হলে বই বের করা যাবে।
-টাকা? টাকা কেনো? প্রত্যয় আকাশ থেকে পড়ে।
-প্রথমবার বই বের করবেন। তাও আবার কবিতার বই। টাকা লাগবে না? আমরা কি নিজের টাকায় এই আজগুবি কবিতা ছাপাবো?
-আজগুবি না। একজন কবি কবিতাগুলোর প্রশংসা করেছে। কবিতাগুলোকে আজগুবি বলায় রেগে যায় ও।
-ওনাদের কথা ছাড়েন তো! লোকসান হলে তো তাদের হবেনা। এই বই ছাপতে হলে ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে। টাকা আনেন বই বেরোবে। না হলে নিজের রাস্তা দেখেন।
প্রত্যয় গম্ভীরমুখে বেরিয়ে আসে। আজ কয়েকমাস ধরে বিভিন্ন প্রকাশকের কাছে গিয়েছে ও। সবারই প্রায় এক কথা। এযুগে কবিতা কেও পড়ে না। উত্তেজক মাল-মশলা দেয়া উপন্যাস নিয়ে আসেন। নয়তো নিজের টাকায় বই প্রকাশ করেন।
কাজটা কি ঠিক হলো? প্রত্যয় ভাবে। বাবা তার এক বন্ধু সেলিম সাহেবের কাছে যেতে বলেছিলো, চাকরির জন্য। বাবা নাকি তাকে ফোন করে ওর কথা বলেছে। সেখানে যায়নি ও। চাকরি করাটা ওর হবে না। কারও হুকুম মেনে ও চলতে পারবেনা। ওর একমাত্র কাজ কবিতা কবিতা লেখা। একমাত্র স্বপ্ন নিজের কবিতার বই।
নিরাশ মুখে বাসায় ফেরে ও।
কি রে কিছু হলো? চাকরিটা হবে তো? দরজা খুলেই মা প্রশ্ন করে।
নির্বাক হয়ে মায়ের উৎকণ্ঠিত চোখজোড়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে প্রত্যয়।
-কি হলো, জবাব দিচ্ছিস না কেনো? আবার প্রশ্ন করে মা।
-হবে না। নিরাসক্তভাবে জবাব দেয় ও।
-কেনো? মায়ের কণ্ঠে হতাশা।
-ওনার কাছে যাইনি তাই হবে না। প্রত্যয় বিরক্ত হয়।
-যাসনি কেনো?
-আমাকে দিয়ে চাকরি হবেনা, মা।
-তাহলে কি হবে? রাগতস্বরে মা বলে।
-কিছুই হবেনা। বাবা ফেরেনি? জিজ্ঞেস করেই নিজের ঘরে চলে যায় ও।
-এখনো ফেরেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দেয় মা।
থমথমে মুখ নিয়ে ঘরে ফেরেন সিরাজ সাহেব।
তার মুখের অবস্থা দেখে মিনু কোনও কথা বলেননা। শুধু তোয়ালে লুঙ্গি এগিয়ে দেন। গোসল সেরে এসে বারান্দার ইজি চেয়ারে চুপচাপ বসেন তিনি। মিনু চা নিয়ে আসে।
-প্রত্যয় ফিরেছে? গম্ভীরমুখে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলেন সিরাজ সাহেব।
-ফিরেছে।
-ডাকো ওকে।
মিনু প্রত্যয়কে ডেকে নিয়ে আসে।
-আমাকে ডেকেছ, বাবা?
-সেলিমের কাছে যাওনি কেন? এমনিতে তুই করে বললেও রেগে গেলে ছেলেকে তুমি করে সম্বোধন করেন সিরাজ সাহেব।
-আরেকটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। মৃদুকন্ঠে জবাব দেয় প্রত্যয়।
-কোথায়?
-এক প্রকাশকের কাছে।
-চাকরির চেয়ে কবিতা বড় হলো? কাজ না করে কি কবিতা চিবিয়ে খাবে? রেগে ওঠেন সিরাজ সাহেব।
-বাবা, চাকরি করাটা আমাকে দিয়ে হবে না। কতবার বলবো! প্রত্যয়ও রেগে যায়।
-চাকরি হবেনা তো হবেটা কি? লেখাপড়া শেষ করা ছেলে চাকরি না করে কবিতা লিখবে! আমরা না থাকলে চলবে কি করে?
আর কোনও জবাব না দিয়ে প্রত্যয় চলে যায়।
প্রচন্ড রাগে সিরাজ সাহেব ছেলের পিঠের দিকে চেয়ে থাকেন।
পরদিন সকালে প্রত্যয় বাসা থেকে বের হলে ওর ঘরে ঢোকেন সিরাজ সাহেব। ছেলের ঘরে সাধারণত তার ঢোকা হয়না। চারদিক অগোছালো। এদিক সেদিক তাকিয়ে টেবিলের উপর একটা পাণ্ডুলিপি দেখতে পান তিনি।
পাণ্ডুলিপিটা তুলে নিয়ে দেখতে থাকেন। উপরে লেখা-
নীল খামে ভিরা কবিতা
ছেলে এতো ভালো লেখে? সিরাজ সাহেব অবাক হন। পড়তে পড়তে শেষ পাতায় চলে যান। সেখানে কয়েকটি লাইন লেখা-
আমার প্রথম কবিতার বই উৎসর্গ করলাম আমার বাবাকে, যাকে এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, যিনি এই পৃথিবীতে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। যদিও সামনাসামনি কখনোই প্রকাশ করেন না।
সিরাজ সাহেব অনেক কষ্টে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেন। পাণ্ডুলিপিটা তুলে নিয়ে তিনি বাইরে চলে যান। একটু পরে দুই কপি পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। আসলটা ছেলের ঘরে রেখে কপিটা নিয়ে যান।
কয়েকমাস পর। বইমেলা চলছে।
সিরাজ সাহেবের সাথে রিকশায় বইমেলায় যাচ্ছে প্রত্যয়। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে ওর। সেই ছোটবেলায় অনেকবার বাবার সাথে বইমেলায় গিয়েছে ও। তার কিছু স্মৃতি আজও জ্বলজ্বলে। বাবাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যেত ও। বাবা ধৈর্য ধরে হাসিমুখে জবাব দিতেন। তারপর মেলায় ঘুরে ঘুরে রঙীণ মলাটের প্রচুর ছড়া, কবিতা, আর গল্পের বই কিনে বাপ আর ছেলে ঘরে ফিরতো। এত বই দেখে মা ভীষণ রেগে যেতেন। কিন্তু তার রাগ অগ্রাহ্য করে বাপ-ছেলে নতুন বইগুলোর উপর হুমরী খেয়ে পড়তো।
বাবার দিকে আড়চোখে তাকায় প্রত্যয়। তাকে বেশ হাসিখুশি মনে হচ্ছে। বেশ উৎসাহের সাথে চারপাশে তাকাচ্ছেন।
-কি ব্যাপার কথা বলছিস না কেন? সিরাজ সাহেব ছেলেকে প্রশ্ন করেন।
-কি বলবো?
-ছোটবেলায় তো বইমেলায় যাওয়ার সময় কত কথা বলতি। এখন বলছিস না কেনো?
-কবিতার বই ছাপতে না পারায় এমনিতেই ওর মন ভালো নেই। তাই আর কথা বাড়ালো না।
সিরাজ সাহেব অবশ্য মিটিমিটি হেসেই চলেছেন।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে দুজনে নজরুল মঞ্চের কাছে এগিয়ে গেলো। সেখানে নতুন নতুন বইয়ের মোড়ক খোলা হচ্ছে। হঠাৎ বাবা প্রত্যয়ের হাত ধরে মঞ্চের দিকে হাটতে লাগলো।
-কোথায় যাচ্ছ, বাবা? প্রত্যয় একই সাথে রাগত ও বিস্মিত।
-আরে চলনা।
দুজনে মঞ্চে উঠে পড়ে। সেখানে একজন বিখ্যাত কবিও উপস্থিত। তিনি হাসিমুখে ওদের দিকে তাকান।
মঞ্চের টেবিলের উপর অনেক রঙীন কাগজে মোড়া বই। কবি মোড়ক খুলে বইটি তুলে ধরলেন।
সাথে সাথে ঘোষণা করা হলো-
নীল খামে ভরা কবিতা
প্রত্যয় আহমেদ
প্রত্যয় বিস্ময়ে বইটির দিকে একবার তারপর বাবার দিকে একবার তাকালো। তারপর উচ্ছ্বাসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ওকে জড়িয়ে ধরে সিরাজ সাহেবও কেঁদে ফেললেন।
তারপর দ্রুত চোখ মুছলেন।
আর যাই হোক, ছেলেকে নিজের অশ্রুভেজা চোখ দেখানো চলেনা।