সেইদিন ১৪ই ফেব্রুয়ারী ফাগুন রঙ্গিন প্রকৃতিতে ভালবাসা ফুলেল পসরা সাজিয়ে নেমে এসেছিল ধরায়। ভালোবাসায় ভালোবাসায় পুস্পিত স্বর্গ রচনা হয় এমন দিনে। গতবছর এমন দিনে ট্রেনিং সেন্টার এ এসে ভেবেছিলাম হয়তো আগামি এমন দিনে এই বন্দিশালায় থাকতে হবেনা। গতবছরের বসন্তের প্রথম দিন আর ভালোবাসা দিবস ছিল একেবারেই ভিন্নরকম যেখানে জীবন কোন রঙ খুঁজে পাচ্ছিলো না, অনেকটা ফিকে রসহীন। এখানে ক্যালেন্ডারের পাতাও মাঝে মাঝে উল্টো রথে চলে। আর তাই নির্ধারিত ৩৬৫ দিন শেষ হলেও বছর পূর্ণ হয়নি। তাই এই দীর্ঘ এক বছর যে জীবনকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম নিষ্ঠুর আর অদ্ভুত শৃঙ্খলার মারপ্যাঁচে, তাকে মাঝে মাঝে খুঁজে বেরাতাম একটু সুযোগ পেলেই। আর গত ১৪ই ফেব্রুয়ারী শুক্রবার পিএল নামক আরাধ্য বস্তুর দেখাও মিলে গেল। ভাগ্যক্রমে সেদিন ছিল ভালোবাসা দিবস আর তার আগেরদিন ছিল ১লা ফাল্গুন। যদিও দিনগুলো আমার জন্য তার নামের বিশেষত্ব সেভাবে বহন করেনা, তারপরও দিনগুলো একটু ভিন্নভাবে কাটানোর চেষ্টা করতাম। আর তাই সুযোগ পেয়েই বেরিয়ে পড়লাম আমরা একঝাঁক তরুণ সহকর্মী। মনে তাদের ক্ষণিক মুক্তির আনন্দ, পরনে তাদের নতুন নতুন রঙ্গিন পশাক, চোখে তাদের ফাগুনের রংমাখা ভালোবাসা। দিনটাকে আড্ডা, ঘোরাঘুরি, ফটোশেসন, কারো কারো ভালোবাসা আদান-প্রদান আর কারো জন্য নিত্য নতুন ভালোবাসা দেখার দিন।
গাড়ি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেইট এ আসলে আমরা কয়েকজন নেমে পরি অনেকটা উদ্দেশ্যহীন ভাবেই। বাস থেকে নামতেই দেখি এক সুদর্শন যুবক হাতে তার অনেকগুলো গোলাপ আর রজনীগন্ধার স্টিক। সাথে এক্তা ব্যাগে গিফট সদৃশ কিছু জিনিস। একটু অবাকই হলাম। ভাবলাম কোন বিক্রেতা নয়তো?! পাশ থেকে কেউ একজন বলতে শুনলাম- দেখো দেখো, ভণ্ড লোকটার কাণ্ড দেখ। কয়টা মেয়েকে যে প্রেম বিলাবে আজ! কথাটা শোনার পর আমারও কেন যেন মনে হয়েছিল তাই ই হবে। ধুম-ধারাক্কা স্টাইল ছিল তার বেশভূষায়। কিছুটা বখাটে টাইপের মনে হয়েছিল। ছেলেটা একটা অটোরিক্সা নিয়ে রাজশাহী শহরের দিকে যাচ্ছিল। আমরা ক্যাম্পাসে ঢুকলাম। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও আড্ডাটা খারাপ হয়নি। মায়ামাখা পথে হেঁটে হেঁটে একটা টি স্টল এ চা খেলাম সবাই মিলে। কয়েকজোড়া কপোত- কপোতীর রোমান্টিক দৃশ্যও ছিল চোখে পড়ার মত। আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পরে। আস্তে আস্তে দলটাও ছোট হতে থাকে। কিছুক্ষণ জম্পেশ আড্ডা আর ফটো সেশনের পর ক্যাম্পাস থেকে বের হলাম কয়েকজন। আমাদের পরের গন্তব্য ছিল রাজশাহী সিল্ক ইন্ডাষ্ট্রি ও সেগুলোর শো রুম। সেখানে যে যার যার মত কেনাকাটা করলাম হালকা-পাতলা। ওখানে ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ করেই দলছুট হয়ে গেলাম। এরপর আর কাউকে না খুঁজে ভাবলাম একটু পদ্মার পাড়ে যাই। একা একা নদীর পাড়ে খারাপ লাগবে না। ভাবলাম সেখানে হয়তো একটা রোমান্টিক পরিবেশও থাকবে। রিক্সা যোগে শহরের অলি-গলি আর তার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বালুরঘাট পৌঁছালাম। সেদিনের পদ্মার রুপ টাও যেন রোমান্টিকতায় ভরপুর ছিল। একা একা কিছুক্ষণ হাঁটলাম । পদ্মার এই পাড়টায় পর্যটন স্পট এর একটা আবহ ছিল । তাই এইদিনে ভালবাসা প্রকাশের আর প্রিয়ার হাত ধরে হাঁটার জন্য স্থানটা অসাধারণ ছিল। দেখা মিলল অনেক যুগলের। নিজের ভিতরে একটা একা ভাব থাকলেও তাকে কিছুটা উপভোগ করছিলাম। ওই দূরে চর দেখা যাচ্ছিল। কেউ কেউ বোট এ করে পদ্মায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বা পদ্মার মোহনীয় চরে ভালোবাসার পসরা সাজাচ্ছিল। সেইদিন দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে বসে পড়লাম আম গাছের নিচে একটা বেঞ্চিতে । উদাস হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলাম। ক্যামেরাটা বের করে পদ্মার বুকে ভাসমান নৌকাগুলোর দৃশ্য, চরের দৃশ্য... এসবের কয়েকটা স্ন্যাপ নিলাম। ঐ দূরে নীল আকাশ যেন নেমে আসতে চাইছে টলটলে নদীর বুকে, সুবিশাল চরে। আজ আকাশের ও যেন মনভাল নেই। নিজের একাকীত্ব কে ঘুচিয়ে একটু ভালোবাসার ছোঁয়া পেতে সেও যেন বার বার ভূতলের প্রকৃতিতে নেমে আসতে চাইছে। চরের উপরের দিকটায় শুভ্র-নীল এক অদ্ভুত মাখামাখি। কিছুক্ষণের জন্য নিজের অনুভূতিগুলো কখন যে মিলিয়ে গেল ওই আকাশ, নদীর চর আর নদীর জলে ভেসে বেড়ানো যুগলদের মাঝে। মন যেন আর নিজের মধ্য থেকে অন্যকোন খানে হারিয়ে গেল। পুরনো কোন স্মৃতির সাথে মেলানোর একটা চেষ্টা যেন।
হঠাৎ নিজের কল্পনায় যেন ছেদ পড়লো। পাশে একটা হইহাল্লা শব্দে চেতন ফিরে পেয়ে একটু বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে। দেখলাম ঘাটের ঐদিকটায় সেই বখাটে (সুদর্শন!!) ছেলেটা। হাতে তার সেই হরেক রকমের ফুল আর গিফটের প্যাকেট। তার সাথে আরেকটা ছেলে মনে হয় তাকে কোন কাজে হেল্প করছে। তাদের ঘিরে আছে কিছু অসহায়, সুবিধা বঞ্চিত লোকজন। ভাবলাম ওই ফালতুটা নিশ্চিত কোন ঝামেলা পাকিয়েছে। উঠে গিয়ে বুঝতে চাইলাম কি হচ্ছে। দেখলাম ওই ফুল আর গিফটগুলো ওই অসহায়, গরীব, বঞ্চিত, লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছে সে। সাথের ছেলেটা তাকে হেল্প করছে। একজন বৃদ্ধ ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আর হাতে পাওয়া গিফট (একটা নতুন জামা) ও ফুলের দিকে ভেজাচোখ, কিন্তু ঝলমলে হাসিমাখা মুখে বার বার তাকাচ্ছিল। একবার গিফটের দিকে, একবার ফুলের দিকে আর একবার ছেলেটার মুখের দিকে। সে দৃষ্টিতে আমি এক স্বর্গীয় ভালোবাসা দেখেছি, পরম মায়া আর আশীর্বাদ দেখেছি। এইরকম নিখাদ ভালোবাসা, পবিত্র ভালোবাসা সত্যি মেলা ভার। আমার চোখ যেন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল। দূরের শুভ্র-নীল এর পসরা, মোহনীয় পদ্মার চর, আর রঙের নৌকাগুলোও তাদের রঙ বদলে ফেলছে। চারপাশ যেন আঁধার হয়ে আসছিল। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। অবশেষে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নামলো। খেয়াল করলাম দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি আমার গাল বেয়ে পড়ছে আর সে বৃষ্টির উৎস আমার চোখজোড়া। অনেক বড় অপরাধবোধ কাজ করছিল আমার মধ্যে। একসাথে এতগুলো সুবিধা বঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো নিখাদ ভালবাসা, যেন ভালোবাসার মেলা বসেছে তাকে ঘিরে। ছোট ছোট শিশুগুলি মনের আনন্দে ভালোবাসার গান গেয়ে নাচছে। একজন বৃদ্ধা দুহাতে ছেলেটার দুগালে হাত দিয়ে দোয়া করে দিচ্ছিল, ঝলমলে হাসি ছিল বৃদ্ধার চোখেমুখে। আমি আপরাধীর মত স্থির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। আর মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম- আজকের এই ভালোবাসার দিনে আমি কয়জনের ভালোবাসা পেলাম আর কয়জনকেই ভালোবাসার সুবাসে মাতাতে পারলাম। অনেকটা স্বার্থপরের মত পাশে দাঁড়িয়ে স্বর্গীয় ভালোবাসার মোহনীয় সুবাস নিচ্ছিলাম।
একটু এগিয়ে গিয়ে তার সাথের ছেলেটাকে ইশারায় ডাকলাম। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, ছেলেটা তার বন্ধু। খুব কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সে আর বলল- আজ এইরকম রাজশাহী শহরের আরো কয়েকটা স্থানে তাদের এইরকম প্রোগ্রাম ছিল। সে বলে যেতে লাগলো- সে অনেক মেধাবী ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই একটা মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়। মন-প্রাণ উজার করে ভালোবাসতো মেয়েটাকে সে। সবকিছু ঠিকঠাকই এগিয়ে যাচ্ছিল। অনার্সের শেষে হঠাৎ একদিন এক প্রবাসী বড়লোক ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায় মেয়েটার। পরে বিদেশে পাড়ি জমায় সে। এ ব্যাপারে ছেলেটাকে সে কিছুই জানায়নি। কিছুটা ছলছল চোখে বলতে থাকে- তারপর থেকেই তার বন্ধু যেন কেমন হয়ে যায়। তার জীবনে ছন্দপতন হয়। পড়ালেখা থেকে দূরে সরে আসে ধীরে ধীর। নেশার পেয়ালাটাকে অতি আপন করে নেয় সে। ঐ অনার্সই পর্যন্ত তার পড়াশোনা। জীবন এখন তার কাছে একরকম অর্থহীন। বন্ধুদের সান্ত্বনায় আর সঙ্গ তাকে স্বাভাবিক জীবনে আসতে প্রেরণা যোগায়। কিন্তু আর সেভাবে ফেরা হয়না। দুই বছর আগে ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কের পর থেকে এখন টিউশনিই তার আয়ের মূল উৎস। তবে তাদের পারিবারিক অবস্থা ও ভালো। প্রতিবছর এইরকম বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এইভাবেই বেরিয়ে পরে সে। ফেরি করে ফেরে তার পবিত্র ভালোবাসাকে। এই অসহায় মানুষদের স্বর্গীয় হাসির মাঝেই খুঁজে ফেরে তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে, অন্তত এই বিশেষ মুহূর্তগুলোতে। সে বলেই যাচ্ছিল...।
হঠাৎ মোবাইলে কল আসে আমার। রিসিভ করতেই শুনলাম বন্ধুর জরুরি ডাক- এখনি নিউমার্কেট আসতে হবে। জরুরি কেনাকাটা আছে, এরপর লাঞ্চ আর ঠিক দুইটায় আমাদের গাড়ি। কথা বলতে বলতেই ঘড়ির দিকে তাকালাম। আর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট এর মত বাকি। আমি দ্রুত ফোনটা রেখে বাই বলে ছুটলাম। পর পর নির্ধারিত কাজগুলো সেরে ফিরে আসলাম আমার নিবাসে। সারাদিনের ব্যস্ততায় আর তেমন মনে আসেনি বিষয়টা। কারোসাথে আর শেয়ারও করা হয়নি সেভাবে। দিনের কাজগুলো সেরে রাতে যখন রুমে ফিরি- আবার মনে পড়তে লাগলো সেই ছেলেটার কথা, সেই দৃশ্যগুলো। পবিত্র এক ভালোবাসা দর্শন এর কথা। আর মনে মনে অপরাধবোধ- আমি তাকে খারাপ ভেবেছি। মার জন্য একটা সিল্কের শাড়ি কিনেছিলাম আমি। সেটা হাতে ছিল আমার, আমি আর কিই বা করলাম?! ওদের নামগুলো পর্যন্ত যেনে আসলাম না!! নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বার্থপর আর অপরাধী মনে হচ্ছিলো আমার। আর এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তির ও পথ খোঁজার চেষ্টায় আছি।