আমাদের লিচুকে নিয়ে বলতে গেলে আস্ত একটা মহাভারত হয়ে যাবে। যেমন, এই লিচুর নাম। যার ভাল নাম অমিতাভ রায়, তার ডাকনাম কী করে লিচু হয়? কোনও হিসেব মেলে না। ওদের বাড়ি কেন, আমাদের গোটা পাড়ায় লিচুগাছ নেই। আম, জাম, কাঁঠাল, সবেদা, জামরুল, নানারকম কলা, পেয়ারা, সবই আছে, কেবল লিচুগাছটাই নেই! কিন্তু আমাদের লিচু আছে। অল্পবয়স থেকে আমাদের যে দল, তার সর্দার ওই ব্যাটাই। সে যে কত সুন্দর! কী মজার! কী দস্যু! এই এলাকায় তার জবাব নেই। মাঝে-মাঝে মনে হয়, ও-ই আমাদের ইন্দ্রনাথ। আর বাকি ক’জন আমরা সকলে শ্রীকান্ত। লিচু অসম্ভবকে সম্ভব করে, আমরা সভয়ে-সগর্বে তাকিয়ে থাকি!
এখনই একটা কথা মনে পড়ে গেল। কেসটা নাম নিয়েই। তখন আমরা এইটে পড়ি। ভোরবেলা হানা দিলাম পাশের পাড়ায়। নন্দীদের উঠোন জুড়ে মস্ত লিচুগাছ। ভোর মানে, ভোর হতে তখনও একটু বাকি। অন্ধকারের শরীরে চাপা হাসির মতো আলো দেখা দিচ্ছে। খুব রহস্য-রহস্য লাগে তখন। যাই হোক, গাছে উঠেছে লিচু আর সোনা। থোকা-থোকা লিচু ছিঁড়ে তারা নীচে ফেলছে, আমরা বাকিরা লুফে নিচ্ছি। চারদিকে খেয়াল রাখছি। একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে। শেষরাতের এইসব চুরিচামারির দিনগুলো মনে পড়লেই টগবগ করে ওঠে সারা শরীর। এখন আমরা কলেজে উঠেছি। বাঁদরামির চরিত্র পালটেছে। মেয়েরা চারপাশ দিয়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে যাযাবর মনের এক-একটা অংশ। তবু বলব, সেদিনের ওইসব আনন্দের তুলনা নেই।
যে কথা হচ্ছিল, আমরা নীচে পাহারা দিচ্ছি, আর লোভনীয় লালচে লিচুফল কুড়োচ্ছি, হঠাত্ চেঁচামেচি করে বাড়ির লোকজন বেরিয়ে এল। মুহূর্তে গা-ঢাকা দিলাম আমরা। নন্দীদের বাড়ির পিছনদিকে খড়ের মাঠ। আমাদের এখানে প্রত্যেক পাড়ার ধার ঘেঁষেই লম্বা খড়ের মাঠ, ফসলের মাঠ। ছোট্ট একটা নদীও আছে কাছেই। নানা পাড়ার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে ছোট্ট নদীটা কিছুটা দূরে বড় নদীর সঙ্গে গিয়ে মিশেছে।
খড়ের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েছি আমরা। সোনাকে দেখলাম গাছ থেকে এক লাফ দিয়ে নেমে চোখের পলকে ওপাশে মিলিয়ে গেল। বাকি থাকল দুষ্টুশিরোমণি আমাদের সর্দার। ও কি আগেই কেটে পড়েছে? আমাদের চোখে পড়েনি তো! তা হলে সে নামতে বা পালাতে এত দেরি করছে কেন?
প্রতাপ কানের কাছে ফিসফিস করল, “কী রে! কী বুঝছিস?”
সর্দারকে আমার বিরাট বিশ্বাস। সে যে ইন্দ্রনাথ। সেবারই আমাদের এইট-এর বাংলা বইতে ইন্দ্রনাথের মাছ চুরির গল্পটা পড়েছিলাম। তারপর অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে বুঝেছিলাম, আমাদের দলে ইন্দ্রনাথ কে।
প্রতাপকে বললাম, “চুপচাপ থাক। যতদূর মনে হচ্ছে, একটা কাণ্ড হবে।”
তখন অন্ধকার আরও একটু কেটেছে। লালচে হালকা আলো এসে পৌঁছেছে পৃথিবীতে। চোখে পড়ল নন্দীবুড়ো হাতে একটা লাঠি নিয়ে চিত্কার করছে লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে।
বুক ছ্যাঁত্ করে উঠল। তবে তো মরেছি! সর্দার এখনও গাছে? প্রথম কথা, সর্দার ধরা পড়লে দলের ইজ্জত থাকবে না। দ্বিতীয় কথা, সে ধরা পড়লে পুরো দলটার কথাই বুঝে যাবে সকলে। অল্পবয়সে বড়রা বকা-টকা দিয়ে ছেড়ে দিত। এখন বড় হয়ে গিয়েছি। বাড়িতে হুলস্থুল কাণ্ড হবে। অতএব, সর্দারকে উদ্ধার করতেই হবে। আমি বললাম প্রতাপকে। প্রতাপ অন্যদের। আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকলাম সকলে। আচমকা হানা দিয়ে ছিনিয়ে নিতে হবে আমাদের সর্দার।
মাথার উপর কয়েকটা পাখি কিচিরমিচির করে উড়ে গেল। আমরা সাবধানে এগোচ্ছি। বেশ একটা বিপ্লবী-বিপ্লবী ভাব। উঁচু-নিচু পার হয়ে অবশেষে নন্দীদের জিয়লগাছের বেড়ার পাশে। সামনে ওদের গোয়ালঘর। ওইটুকুই আমাদের আড়াল। তবে নন্দীবুড়োর ছেলেরা হাজির হলে আমাদের লড়াই অত সহজ হবে না।
বেশিদূর দুঃশ্চিন্তা করার আগেই ঘটনাটা ঘটল। আশ্চর্য ঘটনা। খেলার গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরা আমাদের অধিনায়ক অমিতাভ রায় রিল্যাক্সড ভঙ্গিতে গাছ থেকে নেমে নন্দীবুড়োর মুখোমুখি। পালানোর কোনও লক্ষণই নেই! ও দৌড়লে ওর সঙ্গে বুড়োমানুষ পারবে? উলটে আত্মসমর্পণ করছে আমাদের ইন্দ্রনাথ! কান খাড়া করলাম। শুনতে পেলাম সর্দার বলছে, “গুড মর্নিং। আপনার হাতে লাঠি কেন? গাছের বাদুড় তাড়াবেন? বাদুড় আমি তাড়িয়ে দিয়ে এসেছি, জ্যাঠামশাই।”
লাঠি উঁচিয়ে সর্দারের হাত চেপে ধরল নন্দীবুড়ো। অবশিষ্ট দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “বাদুড় ধরতে যাব কেন হতভাগা? বাঁদর ধরব। আস্ত চোর কোথাকার!”
সর্দার বলল, “কে চোর?”
নন্দীবুড়ো আবার মারার ভঙ্গি করে বলল, “তুই ছাড়া আবার কে? হাতেনাতে ধরেছি। সুবল-হারান বের হোক, দ্যাখ তোর কী করে! এই সুবল…”
আমরা একটু থতমত খেয়ে গিয়েছি তখন। সকলে চোখাচোখি করছি। আক্রমণ করে সর্দারকে উদ্ধারের এটাই যথার্থ সময় কি না, বুঝতে পারছি না। তার মধ্যে সর্দারের প্রতিবাদী গলা কানে এল, “কে চোর? জ্যাঠামশাই? আপনার কি মাথাখারাপ?”
নন্দীবুড়ো চেঁচাল, “বুঝতে পারছিস না কে চোর? সুবল আসুক, ন্যাকামি ঘোচাবে।”
আর ঝুঁকি না নিয়ে এবার আমরা তৈরি হলাম। সুবল-টুবল এলে বিপদ। অন্ধকার অদৃশ্য হচ্ছে। এবারই ছিনিয়ে নিতে হবে আমাদের ইন্দ্রনাথকে। সর্দারকে অভয় দেওয়ার জন্য একটা শিস দিলাম। ভয় নেই আমরা আছি। সর্দারও উলটে শিস দিল। খুশির শিস। যেন বলছে, নো প্রবলেম।
দেখলাম, বাঁ হাতে একগুচ্ছ ফল তুলে ধরে সর্দার বলছে, “এটা কোন গাছের ফল?”
নন্দীবুড়ো চেঁচাল, “এই তো… এই গাছের।”
সর্দার বলল, “এই ফলের নাম কী জ্যাঠামশাই?”
নন্দীবুড়ো ভেংচি কেটে বলল, “জানিস না? এর নাম লিচু। লিচু চুরি করতে এসে ধরা পড়েছিস, দামড়া কোথাকার!”
সর্দারের কাছ থেকে ফলের গোছা কেড়ে নিল নন্দীবুড়ো।
সর্দার বলল, “আর আমার নাম কী জ্যাঠামশাই?”
গোয়ালঘরের পিছন থেকে আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, “লি…চু…”
নন্দীবুড়ো হাঁ। সর্দার ওর হাত থেকে ফের ফলের গোছা কেড়ে নিয়ে বলল, “লিচু যদি ক’টা লিচু নেয়, তাকে কি চুরি বলে? আমি যদি পেয়ারা নিতাম তা হলে, চোর বলতে পারতেন। চোর ধরবেন? ওই দেখুন, গোয়ালঘরের পিছনে লুকিয়ে আমায় আওয়াজ দিচ্ছে। ওদের নাম রাম-শ্যাম-অমল-বিমল…”
কী বুঝে নন্দীবুড়ো সেদিন সত্যিই আমাদের তাড়া করেছিল। হাসি থামাব? না দৌড়ব? আমরা খড়ের মাঠ, নদী পেরিয়ে কোনওরকমে বাঁচি। আর উনি? ধীরে-সুস্থে আরও ক’টা লিচু খেয়ে, ক’টা লিচু পেড়ে তবে রওনা।
এই হচ্ছে আমাদের অমিতাভ রায় ওরফে লিচ। আমি একটু লিখি, মানে সবে মকশো করছি। শরত্চন্দ্রর সঙ্গে আমার কোনও তুলনাই হয় না। কিন্তু ‘ইন্দ্রনাথ’ পাওয়ার সৌভাগ্যে যেন আমি ওঁর পাশে একটা ছোট জায়গা পেয়ে গিয়েছি। এতেই আমার আনন্দ।
|| ২ ||
আমাদের কলেজটা বড় টাউনে। পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। রাস্তাটা একটু জটিল। প্রথমে সাইকেলে মিনিট কুড়ি লাগে বাজার পৌঁছতে। বাজার থেকে আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট। রোজ কলেজ যাওয়ার পথে বদলে যায় পৃথিবী। সবুজ, খোলামেলা, ধীরগতির জীবন থেকে টপ করে পৌঁছে যাই নতুন অট্টালিকায় ভরা জগতে। পাকা রাস্তা, ঝলমলে গাড়ি, অসংখ্য মানুষজন। বায়না করে আমরাও সবাই এক-একটা মোবাইল ফোনের মালিক। আমাদের সবুজ গ্রামের দিকে একটা কালো রাস্তা এগোচ্ছে। শহর ছড়িয়ে পড়ছে আমাদেরও ডালপালায়।
সত্যি বলতে, কলেজে পড়া নিয়ে আমার আগে ভারী একটা উত্তেজনা ছিল। কলেজে ভর্তি হয়েছি। বড় হয়ে গেলাম। ওজন বেড়ে গেল। কিন্তু কলেজে পা রেখেই আমি-লিচু-প্রতাপ-কমল-বিশ্ব হঠাত্ যেন বোম্কে গেলাম। হাতের মুঠোয় বন্দি একটা জগত্ ছিল আমাদের। ছোট, মজাদার, দাপুটে। কিন্তু এখানে যেন কেউ আমাদের গুরুত্ব বোঝে না, শক্তি বোঝে না। কিছুতেই থই পাচ্ছি না। ক্যান্টিনে গেলেই টাউনের ছেলেরা বিস্ময়ের গলায় বলে, “কী রে! তোরা এখানে! তোরা কি চা খাস?”
আর টাউনের মেয়েরা বাঁকা চোখে এমন করে আমাদের দ্যাখে যেন, আমাদের পায়ে কাদা লেগে আছে, যেন আমরা উলটো জামা পরেছি! সর্বত্র চাপা ব্যঙ্গ আর অপমান আমাদের ঘিরে ফেলেছে।
কয়েকমাস পরে লিচু বলল, “হুম… এবার একটা কিছু করা দরকার।”
পাড়ার কালভার্টে বসে আছি রাতে। সামনে দিঘি। জলে ঝিলমিল জোছনা। কবিত্বে ভরে যাচ্ছে আমার মন। এই সুন্দর প্রকৃতির সন্তান আমরা। লিচু কনুইয়ের খোঁচা মেরে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কী মনে হচ্ছে তোর? তুই তো লেখাপড়ায় ভাল… কিছু টিপ্স দে।”
মুগ্ধ মনে, শিল্পীসুলভ ঘোরে ভেসে যেতে-যেতে যেন আমি দৈববাণীর মতো বলে উঠলাম, “ওই স্বপ্নের মতো চাঁদ আমরা ছুঁয়ে ফেলব একদিন…” বলেই সতর্ক হয়ে গিয়েছি। সবাই নিশ্চয়ই খুব হাসবে। লিখি বলে আমি খুব সেনসিটিভ, একটু উপহাসও আমার সয় না, মরমে মরে থাকি সবসময়।
না, অন্যদিনের মতো হল না। সিরিয়াস গলায় লিচু বলল, “ঠিক, চাঁদ আমরা ধরবই। চাঁদ ছুঁতে না পারলে আমার নাম লিচুই নয়। আমার নাম হবে আম।”
প্রতাপ ফোড়ন কাটল, “বস, নাম তো অমিতাভ থেকে আম হওয়াই উচিত ছিল।”
লিচু ধমক দিল, “শাট আপ। ওসব ছাড়। অনেক কাজ এখন। আমরা আমাদের নদীতে এক ডুবে মাটি ছেড়ে মুঠোয় চিংড়ি তুলেছি কতবার। সেই দম এবার দেখাতে হবে। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে সবকিছু।”
বিশ্ব ‘ধুস’ বলে সিগারেট ধরাল। চাঁদের আলোয় ধোঁয়া মিশল। একটা রাতচরা পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল কোথায়। সবাই চুপ করে যাওয়ায় রাত নিঝুম হল আরও। আমি অনুভব করলাম শত-শত লেখা মিশে আছে চারপাশে। মনটা আবেগে হুহু করে উঠল। কী হবে আগামী জীবনে? আমরা বন্ধুরা কি একসঙ্গে থাকব অনেকদিন পরের এরকমই কোনও জোছনারাতে? নাকি জীবন আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আলাদা-আলাদা দ্বীপে? কিংবা সবগুলো লেখা লিখে ফেলার মতো একটা জীবন পাব আমি? আমার নিরন্তর ভাবনার মধ্যে দিয়ে কোথাও একটা কষ্ট ঘনিয়ে উঠছিল নিশ্চিত। তখনই সব ঘোর ভেঙে দিয়ে লিচুর উল্লসিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “ইউরেকা!”
কালভার্টে বসে ছিলাম আমরা। লিচু সেখান থেকে নেমে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াল।
“ক্যান্টিনে রোজ আওয়াজ মারে, ছেলেটার নাম রিপন না?”
প্রতাপ বলল, “হ্যাঁ। খুব মাতব্বর। ইউনিয়নের পান্ডা তপেশদা’র খুব ক্লোজ়। ও ব্যাটা পার্টি করে না। পার্টি ফান্ডে চাঁদা দেয় ভাল। বাবার বড় বিজ়নেস। তপেশদারা তাই ওকে খাতির করে। এক নম্বরের মিতুল-নৃত্যম!”
লিচু তেড়ে গেল, “তোর তো ইতিহাস, সংস্কৃত আওড়াচ্ছিস কেন?”
“কোথায় সংস্কৃত? কলেজের মিতুলকে চিনতে পারছিস না?”
আমি টুক করে ঢুকে গেলাম ওদের কথার ভিতরে। মিতুলের সঙ্গে কোনওদিন দেখা হয়নি। সে ইংরেজির। তার উপর সুন্দরী। কলেজভর্তি ভক্ত তার। বাংলা নিয়ে পড়ি, আমাকে কি আর সে কৃপা করবে? তবু যখন ঝড় বয়ে যায়, তখন সবার গায়েই ঝাপটা লাগে। আমার গায়েও লেগেছে। সেই দুর্বলতা থেকেই আমি বললাম, “মিতুল কি নাচে নাকি? গান গায় শুনেছি।”
প্রতাপ বলল, “নাচে না, নাচায়। সবাই ওর জন্য আকুল হয়ে থাকে। ছটফট করে। ওই নাচটার নামই মিতুল-নৃত্যম।”
কমল হাসতে-হাসতে বলল, “প্রতাপটা খুব কথা শিখেছে তো!”
লিচু অন্যরকম গলায় বলল, “শোন, রাত বাড়ছে। তাড়াতাড়ি কথাটা শোন। মিতুল আর রিপনের ব্যাপারটা জানি। রিপন কয়েকবার বাইকে চড়িয়েছে মিতুলকে। তার বেশি কিছু নয়। রিপনকে আঘাত করে কলেজে আমরা প্রথম জয়পতাকা ওড়াব। আমরা কি কম নাকি? কলেজ টিমে গোলে খেলব আমি। এই জেলায় আর কেউ আছে নাকি আমার জায়গায়?”
ঘটনাটা সত্যি। সাব জুনিয়র লেভেলে লিচু জেলা দলে নিয়মিত খেলেছে। এখন স্থানীয় লিগে বড় ক্লাবের গোলকিপার। কলেজ টিমে ও হেসেখেলে চান্স পাবে। লিচু পরের কথায় এল, “শ্যামল কবি-সাহিত্যিক। প্রতাপ, কমল ভাল স্টুডেন্ট। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের বিশ্ব আছে। রিপননিধন যজ্ঞে বিশ্ব আমাদের প্রথম বাজি।”
বিশ্ব চুপচাপ থাকে বেশি। এতক্ষণ পর ওর নাম উঠতে কথা বলল। জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার, হঠাত্ আমি কেন? আমি তো কবি নই, খেলোয়াড় নই, ভাল স্টুডেন্টও না।”
লিচু সুর করে বলল, “তুই আমাদের রোমিও। ছ’ ফুট হাইট, গালে হালকা দাড়ি। মায়া-মায়া চোখ। গলার স্বর ভারী। সবচেয়ে বড় কথা, তোর বাবার বড় ব্যবসা। এবার তোর কাজ মিতুলকে কবজা করা।”
বিশ্ব প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “মানে? এসব আমার দ্বারা হবে না।”
লিচু ধমক দিল, “চুপ কর। এটা দলের সিদ্ধান্ত। কী বন্ধুগণ?”
মজার খোঁজে আমরাও সমস্বরে বললাম, “কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।”
বিশ্ব কোনও কথা না বলে একলাফে কালভার্ট থেকে নেমে পালিয়ে গেল মুহূর্তে। একগাল হেসে লিচু বলল, “চিন্তা করিস না। ও তো মডেল মাত্র। ওকে নিজে থেকে কিছু করতে হবে না। খেলব তো আমি। তুই কী বলিস শ্যামল? মিতুল মেয়েটাকে ওই উচ্চিংড়েটার সঙ্গে মানায়? আমাদের বিশ্বজিত্ কত বেশি সুন্দর।”
বুকের ভিতর কেউ যেন কেঁদে উঠল। কিন্তু ‘কমিটির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত’ মেনে নিয়ে আমি কষ্টটাকে গিলে ফেললাম। বাড়ি ফিরে সেই রাতেই লিখলাম কয়েকটা প্রেমের কবিতা। আমার হাতে তো এর বেশি কিছু নেই!
|| ৩ ||
বিশ্ব সেই যে পালিয়ে গেল, আর কোনও খোঁজ নেই। কলেজেও যায় না। আমাদের আড্ডাতেও আসে না। বাড়িতে গিয়েও দেখা মিলছে না। আমার মনে হয়, সে আড়াল থেকে আমাদের দেখেই ফুটে যায়। যাই হোক, ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে, লিচু সর্দারের প্ল্যান-এ সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সর্দারকে খুব চিন্তামগ্ন লাগে। আমারও আর সহ্য হয় না, রোজ কলেজ শেষে রিপনের বাইকে মিতুলের হুশ করে বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু যাবতীয় হীনম্মন্যতা লুকিয়ে, কেয়ারলেস বিউটি হয়ে থাকাটাই একজন লেখককে মানায়। আমি সেই ধর্ম পালন করে যাই।
দু’ একদিন পর কলেজে ঢুকেই লিচু বলল, “তুই একটা ফালতু। এই মোবাইলের যুগে মিতুলের নাম্বারটা জোগাড় করতে পারলি না?”
হতভম্ব আমি বললাম, “আমাকে তো তুই বলিসনি কিছু। আমি তো কোনও দায়িত্ব পাইনি!”
লিচু আমার পিঠে হাত রেখে বলল, “বিশ্বটাকে দিয়ে হবে না। প্রতাপ আর কমল হচ্ছে চাপা প্রতিভা। সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না। কিন্তু তুই হচ্ছিস কবি, উঠতি সাহিত্যিক। তোর গুণের কদর না করে কেউ পারে? তোকে দিয়েই হবে।”
মনের ভিতর হঠাত্ যেন প্রলয় এল আমার। মিতুলের জন্য আমি নির্বাচিত, ভাবতেই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। কিন্তু মনের ভাব চেপে আমি বললাম, “আমি ওই মেয়েটাকে তেমন পছন্দ করি না। কেমন যেন লোকদেখানো ভাব সবসময়। এরকম মেয়েরা অগভীর হয়। তবু তুই যখন বলছিস। অপমানের উত্তর তো দিতে হবে আমাদের। কী করতে হবে আমাকে?”
লিচু বলল, “চল, মিতুলের সঙ্গে এখনই কথা বলি। আর দেরি নয়।”
আর্তনাদের মতো হয়ে হঠাত্ আমার গলাটা, “কী বলবি ওকে?”
লিচু উদাস গলায় বলল, “সেটা কী আর জানি! আলাপ তো হবে। কান টানলে মাথা আসবে। মনে রাখবি, বিদেশের মাটিতে ওপেনার প্রথম বলেই আউট। এবার আমাদের জুটি। ধৈর্য ধরে লম্বা ইনিংস খেলতে হবে।”
লিচু আমাকে বলল বটে ও কথা। কিন্তু মিতুলের মুখোমুখি সে তার স্বাভাবিক ঝোড়ো খেলাটাই খেলল।
ক্লাস থেকে মিতুল বেরতেই লিচু এগিয়ে গিয়ে বলল, “হাই মিতুল!”
আমাদের একপলক দেখে মিতুল সত্যিকারের একটা ছোট্ট হাই তুলল, মুখে কিছু বলল না। লিচুর তাতে কী এসে যায়! বলল, “আমি অমিতাভ। আমাদের সাব-ডিভিশন ফুটবল টিমে এবার গোলকিপার কাম ক্যাপ্টেন। এই দ্যাখো,” বলে চারপাতার লোকাল কাগজ ‘পল্লিবার্তা’ বের করে মিতুলকে দেখাল খবরটা।
ভুরু উপরে তুলে মিতুল বলল, “কনগ্র্যাট্স।’’
লিচুকে ঠেকায় কে? আরও খুশির গলায় সে বলল, “আর এ হচ্ছে শ্যামল। কবি-সাহিত্যিক হিসেবে নাম করছে। কী রে, কলেজ ম্যাগাজ়িনে লিখবি তো? নাকি শুধু কলকাতার বড় কাগজেই লেখা দিবি?”
আমি লজ্জায়, সঙ্কোচে নার্ভের চাপে দিশেহারা! কোনওক্রমে ‘চুপ’ আর ‘ধুস’ মিলিয়ে মিশিয়ে ‘ধুপ্স’ বলে বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মিতুল সপ্রশংস দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কবিতা আমি পড়ি না, ও ছাই বুঝিও না। কিন্তু একজন অনারেব্ল পোয়েট আমার সামনে দাঁড়িয়ে… জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না।”
লিচু ফট করে বলে বসল, “শ্যামল তোমাকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছে। খুব ভালবাসে তোমাকে।”
মিতুল চোখ বড়-বড় করে বলল, “তাই, দাঁড়াও তোমাদের নামটা লিখে নিই,” বলে ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করল।
লিচু বলল, “নাম লিখবে কেন?”
মিতুল মিষ্টি হেসে বলল, “রোজই পাঁচ-দশজন প্রেমিকের সঙ্গে আলাপ হয় তো, নাম মনে থাকে না। লিখে রাখি। প্রেমের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে রিপনকে দিই, রিপন ব্যবস্থা করে দেয়।”
স্তম্ভিত হয়ে যাই মিতুলের মিষ্টি-মিষ্টি বিষাক্ত কথায়! পালাবার পথ পাই না। দেখি, লিচুরও মুখ থেকে গদগদ ভাব উধাও। বাউন্সারকে হুক করে গ্যালারিতে পাঠাল সে নিমেষে। ঝড়ের বেগে সে বলে গেল, “এই মিতুল, তুই নিজেকে কী ভাবিস রে? সাজানো-গোছানো একটা পুতুল কোথাকার! তোর রিপনকে বলে দিস, পারলে যেন কিছু করে। ফাঁকা কলসি বাজে বেশি। এই নে, প্রথম আলাপ হল বলে একটা উপহার এনেছি,” বলে লিচু কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে কাগজের ঠোঙা বের করল। ঠোঙার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনল একটা কী! তারপর সেটা মিতুলের পায়ের কাছে ছেড়ে দিতেই হুলস্থুল কাণ্ড। নির্বিষ একটা হেলেসাপ এঁকেবেঁকে তার খেল দেখাচ্ছে। সুন্দরী মিতুল ভয়ে চিত্কার করে লাফাচ্ছে। লিচু আমার হাত ধরে টানল। দু’জনে মুহূর্তে উধাও। লিচু মিচকে হাসি হেসে বলল, “মিতুল যে নাচটা এখন নাচছে, তার নাম হেলে-নৃত্যম!”
|| ৪ ||
কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার বাসে উঠিনি। লিচু আমাদের নিয়ে এল অদূরে পৌরসভার বাহারি পার্কে। ফুলবাগান, দোলনা, সব এই গনগনে দুপুরে নীরব, থমথম হয়ে আছে। মাঝে একটা পুকুর। জলের পাশে গিয়ে বসতেই একটু আগের ঘটনাটার মজা সরিয়ে বাস্তবটা এসে মনে কড়া নাড়ল।
কলেজে নিশ্চয়ই একটা ঝামেলা হচ্ছে। এরপর কলেজ আসব কী করে? লিচু সর্দার কী বলে? তাকিয়ে দেখি, সে নির্বিকার মুখে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত।
একটু পরে প্রতাপ আর কমল ছুটে এল। উত্তেজিত গলায় প্রতাপ বলছে, “কী করেছিস তুই? সারা কলেজে ঢিঢি পড়ে গিয়েছে!”
লিচু প্রসন্নমুখে বলল, “কী বলছে সকলে?”
প্রতাপ বলল, “বলছে, অমিতাভ বলে একটা ছেলে মিতুলের গায়ে সাপ ছেড়ে দিয়েছে।’’
খুব একচোট হেসে নিয়ে লিচু সিরিয়াস গলায় বলল, “যাক, কলেজে এসে অন্তত ‘অমিতাভ’ নামটা প্রতিষ্ঠা পেল! সাবধান, কেউ যেন ‘লিচু’ নামটা ফাঁস করিস না।”
কমল জিজ্ঞেস করল, “তোরা এখানে বসে আছিস কেন?”
লিচু বলল, “রিপনের জন্য অপেক্ষা করছি। এত কাণ্ড তো রিপনের জন্যই করা। এসএমএস করে দিয়েছি ওকে যে, আমরা এখানে আছি।”
ভয় পেলাম। এবার তো মারামারি হবেই। লিচু সর্দার মনে হচ্ছে, এই কলেজ-কাণ্ডে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সবচেয়ে ক্ষতি হল আমার মিতুলকে নিয়ে ভাবনায়। আর কি ওর মুখ ভাবলে প্রেমের কবিতা আসবে?
ঘটনাটা ঘটতে বেশি সময় নিল না। রিপন আর বিধ্বস্ত মিতুল এল একটা বাইকে। আর একটা বাইকে আরও দু’জন। বাইক থেকে নেমে ওরা আমাদের ঘিরে ধরল। হিংস্র মুখ নিয়ে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থাকল মিতুল।
রিপন খুব র্যালা নিয়ে লিচুর জামার কলার ধরে তুলল। গর্জন করে বলল, “ক্ষমা চা মিতুলের কাছে। যা, ওর পা ধর।”
আমার মাথায় কী যেন হয়ে গেল। ইন্দ্রনাথের হেনস্থা আমি মেনে নিতে পারি না। ঝাঁপিয়ে পড়লাম রিপনের উপর, “ছাড়, জামা ছাড় আগে।”
মুহূর্তে ওরা তিনজন লিচুকে ছেড়ে আমাকে ধরল। ধুমধাম মারল ক’টা। গড়িয়ে পড়লাম মাটিতে। মিতুলের অনেকটা কাছেই। অপমানবোধে চট করে উঠে দাঁড়ালাম। উঠতে যেটুকু সময়। তার মধ্যেই কুরুক্ষেত্র বেঁধে গিয়েছে। প্রতাপ আর কমল সব ব্যাপারেই চাপা প্রতিভা। অন্য দু’টোকে ওরাই দেখে নিল। আস্ফালন করতে-করতে তারা বাইকে করে পালাল। যেন আরও দলবল ডেকে আনবে।
সবিস্ময়ে এবার দেখলাম, আমি আর মিতুল, মার খাওয়া কবি আর কবিতা-মরীচিকা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে দুই পক্ষের দুই বীর, লিচু আর রিপন।
রিপন বলল, “তুই কার সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছিস, জানিস না!”
লিচু হেসে বলল, “তুই যার সঙ্গে লড়তে চাইছিস, তার নাম দেবীপুর, আমাদের গ্রাম…”
আমি চিত্কার করলাম, “ফাইট লিচু!”
ওরা দু’জনে একে অপরের চোখে চোখ রেখে ঘুরছিল। আমার চিত্কার শুনে সব ভুলে লিচু আমার দিকে তেড়ে এল, “এই শালা! তোদের বললাম না ডাকনামটা চাউর করবি না, গাধা কোথাকার!”
‘সরি’ বলার আগেই, রিপন পিছন থেকে ছুটে এসে পা তুলল লিচুর দিকে। লিচু বিদ্যুত্বেগে ঘুরে ধরে ফেলল ওর পা। একটু মুচড়েও দিল। রিপনের অসহায় অবস্থা দেখে আর্তনাদ করে উঠল মিতুল, “ওকে ছেড়ে দাও… ছেড়ে দাও…”
লিচু বলল, ‘‘আমার কোচ বলেন, গোলকিপারের দরকার প্রচণ্ড অনুমান ক্ষমতা আর পজ়িশন জ্ঞান, বুঝলি রে টাউনের পো? যা… চলে যা,” বলে ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল পুকুরের জলে। আশ্চর্য ব্যাপার, ওই ছোট্ট পুকুর পার হওয়া দূরের কথা, রিপন ডুবছে, ভেসে উঠছে… ওর মুখটা অসহায় লাগছে কেমন!
মিতুল চিত্কার করে ওদিকে ছুটে গেল। আমিও গেলাম। লিচু আমাকে বলল, “খবর নিয়েছিলাম, ব্যাটা সাঁতার জানে না। দেবীপুরের সঙ্গে লড়বি, সাঁতারই জানিস না! ওকে জলে চুবানি খাওয়াতেই তো এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছি।”
মিতুল পা দাপাচ্ছে আর বলছে, “প্লিজ় অমিতাভ…”
অপূর্ব এক জয়ের হাসি মুখে ফুটিয়ে লিচু ঝাঁপ দিল জলে, চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল রিপনকে ডাঙায়। কয়েক মিনিটের ব্যাপার। তাতেই রিপন কাত!
প্রতাপ আর কমল যখন রিপনের পেটে জল গিয়েছে কি না চেক করছে, লিচু তখন মিতুলকে এসে বলছে, “ছিঃ! সাঁতারই জানে না। তোমার ডায়েরিটা আমাকে দাও এবার। রিপনকে দিয়ে কিস্সু হবে না।”
একটু পরে রিপন উঠে ম্লানমুখে চলে গেল বাইকে একাই। প্রতাপ একটা রিকশা ডেকে দিল মিতুলকে। আড়চোখে একবার দেখলাম, ওর মুখে কান্না থমকে আছে। আর হিংস্রতা নেই। মনে মনে ভাবলাম, কান্নাই যেন থাকে তোমার মধ্যে মিতুল। তা হলে তোমাকে নিয়ে লেখা অতগুলো কবিতা আমাকে আর ছিঁড়ে ফেলতে হবে না।
|| ৫ ||
মাঝে-মাঝে আমি ভাবতাম, লিচু সর্দারের কাণ্ডটায় কি একটু নিষ্ঠুরতা থাকল? আমাদের জীবনের গল্পে ওটা কি একটা কালো দাগ? সৌজন্যমূলক হাসি বিনিময় হত আমাদের সঙ্গে মিতুল-রিপনের। ওরা দু’জন অবশ্য আর বাইকে ভটভটিয়ে বেরিয়ে যেত না। কেমন আলাদা-আলাদা লাগত। এরকমই তো আমরাও চেয়েছিলাম। কিন্তু সব কিছু ঘটে যাওয়ার পরও মনটা খচখচ করত আমার। নিজেদের হীনম্মন্যতা কাটাতে আমরা কি অযথা আক্রমণ করেছিলাম ওদের?
সব খচখচানি মিটে গেল একদিন। বছরখানেক পরে জেলা প্রতিযোগিতায় আমাদের কলেজ ফাইনালে। এই প্রথমবার। গোলে আমাদের লিচু। গোটা টুর্নামেন্টে সে ভাল খেলেছে। যাই হোক, ফাইনালে নির্ধারিত সময়ে ফলাফল দাঁড়াল ১-১। মিতুল পা দাপাচ্ছে আর বলছে, “প্লিজ় অমিতাভ…” তখন কোনও পাগলাটে ব্যাপার নেই। দু’ দলের গোলরক্ষকই প্রথম তিনটে গোল খেল। পরের কিকটা বারে মারল আমাদের কলেজের ভোলা। সবাই দাঁতে ঠোঁট কামড়ে অপেক্ষা করছি। শান্ত ভঙ্গিতে লিচু গিয়ে দাঁড়াল আর শরীরটাকে ডানদিকে ছুড়ে আটকে দিল কোণ ঘেঁষা নিচু একটা শট। কলেজের হয়ে পঞ্চম কিক নিল ভোলা। গো-ও-ও-ও-ল! এবার লিচুর পালা। আমরা ওকে দেখে হাত নাড়লাম। কোনওদিকে তাকাচ্ছে না। নির্বিকার মুখে জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। চিত্কার করলাম, “জয় দেবীপুর!” বিপক্ষের খেলোয়াড় ছুটে এসে পা রাখল বলে। এবার বাঁদিকে পাখির মতো উড়ে গেল লিচুর শরীর। উঁচু শট এক ঘুসি মেরে বারের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিল।
পাগলের মতো নাচছি আমরা। সকলে ছুটে যাচ্ছে লিচুর দিকে। জয়ের আনন্দ একেই বলে। সাবাস লিচু!
এর পরের দৃশ্য লিখতে কলম ভেঙে যাচ্ছে। তবু সত্যের সাধক একজন লেখক হিসেবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য! লিচুর দিকে ছুটে যাচ্ছে যে আত্মহারা দর্শক, তাদের সকলের আগে মিতুল। মরালীর মতো পা ফেলে সে দৌড়চ্ছে, ওড়না উড়ে গেল শূন্যে… জড়িয়ে ধরল সে ধুলোবালি মাখা আমাদের লিচুকে!
অনেক দর্শকের পিছনে আমিও তখন ছুটছি। আমি, প্রতাপ, কমল… ওই তো রিপনও… একজন বন্ধু জিতলে তো সব বন্ধুই জিতে যায়। কতবার জীবনে আমরা একা হেরে যাই। সকলেই হেরেছে। কিন্তু জিতে যাওয়া বন্ধুকে জড়িয়ে ধরার জন্য দৌড়তে পারলে সেরে যায় সব ক্ষত। আর কোনও কষ্ট হয় না। একসঙ্গে আমাদের কী সুন্দর দেখতে, মিতুল!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৩