somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আটটা চল্লিশ

২৪ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি ইন্দিরা। আমি দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায়। এক জনের জন্য অপেক্ষা করছি। সে দেরি করছে। সেই ফাঁকে আপনাকে একটা গল্প বলব। আমার নিজের গল্প। গল্প শোনার পর আপনি অবাক হবেন। তবে গল্পটা বলার আগে একটা অনুরোধ আছে। দয়া করে গল্পটা বিশ্বাস করবেন না। কারণ, গল্পটা আমিও বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া গল্পে একটা বিচ্ছিরি জটিলতা আছে।
আমার বয়েস পঁচিশ বছর তিন মাস। ঠিক এক বছর দু’মাস আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার বিয়ে করার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। তার দুটো কারণ। একটা কারণ গোপন, আর একটা কারণ সবাইকে বলা যায়। আমি আপনাকে দুটো কারণই বলব। গল্প বলতে বসে কিছু লুকনো ঠিক নয়। প্রথমে যে কারণটা সবাইকে বলা যায় সেটাই বলি। আমাকে দেখতে ভাল নয়। ‘খারাপ’ বললে কেমন যেন লাগে, তাই বলব ‘অতি সাধারণ’। যা যা থাকলে একটা মেয়েকে মোটামুটি সুশ্রী বলা যায়, তার কোনওটাই আমার নেই। আমার গায়ের রং ময়লা। চোখ ছোট ছোট, নাকও থেবড়া। এই চেহারা আমি আমার মায়ের থেকে পেয়েছি। হেরিডিটরি অ্যাচিভমেন্ট। আমার হাসিতেও সমস্যা। হাসি এমন একটা জিনিস যে, খারাপ দেখতে মানুষকেও হাসার সময় খানিকটা সুন্দর লাগে। আমাকে লাগে না। ছোটবেলায় বুঝতাম না, ভাবতাম, ভগবান আমার হাসি বানানোর সময় ‘সিলি মিসটেক’ করে ফেলেছেন। পরে বুঝেছি, ভগবানের ব্যাপার নয়, আমার দাঁতের সেটিং ঠিক নেই। গায়ের রং যেমন মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি, দাঁতের গোলমাল পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। সে দিক থেকে বলতে গেলে আমি বংশের সুসন্তান। বংশের ধারা বজায় রেখেছি। দাঁতের সেটিংয়ের চিকিৎসা আছে। হাসি ঠিক হয়ে যায়। খরচ সাপেক্ষ চিকিৎসা। আমার বাবা এক জন সামান্য চাকুরে। দামি চিকিৎসা আমাদের জন্য নয়। হাসি কান্নাকে পরিপাটি করে সাজানোর মতো বিলাসিতা আমাদের মানায় না। আশা করি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, চেহারা নিয়ে আমি হীনমন্যতায় ভুগতাম। জটিল কিছু নয়, সহজ মানসিকতা। সেই হীনমন্যতা থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম, বিয়ে করব না। চাকরি করব। নিজের পায়ে দাঁড়াব। লেখাপড়া বেশি দূর হয়নি। সাধারণ গ্র্যাজুয়েট। এতে বড় কাজ পাওয়া যায় না, তবে চেষ্টা করলে ছোট কাজ হয়ে যায়। তাই নিয়েই থাকব। আসলে আমার এই চিন্তাটা ছিল খানিকটা কমপালসনের মতো। বাধ্যতামূলক। আমার মতো খারাপ দেখতে মেয়েদের বিয়ে হওয়া কঠিন। এই সত্যটাকে আমি নিজের মনের কাছে চাপা দিয়ে বলতাম, ‘বিয়ে করব না’। ভাবটা এমন যেন, আমাকে বিয়ে করার জন্য শুণ্ডি আর হুণ্ডির দুই রাজকুমার হাপিত্যেস করে বসে আছে।
এ বার বলব গোপন কথাটা।
আমি একটা ছেলেকে ভালবাসি। ছেলেটার নাম আমার মতো আদ্দিকালের নয়, সুন্দর। অভ্রনীল। সুন্দর না? আমি তাকে মনে মনে কখনও অভ্র, কখনও নীল বলে ডাকি। যখন যেটা ইচ্ছে হয়। সকালে হয়তো ‘অভ্র’ বললাম, রাতে শোবার পর আলো নিভিয়ে ফিসফিস করে ডাকলাম ‘নীল, নীল নীল...।’ আমার ভালবাসা এতটাই গোপন যে, অন্য কেউ এ খবর জানে না, এমনকী অভ্রনীলও না। তাকে জানানোর কোনও প্রশ্নও ওঠেনি। সে সব দিক থেকে আমার অনেক দূরের মানুষ। তাকে চমৎকার দেখতে। লেখাপড়ায় ভাল। বড় চাকরি করে। ওদের বাড়ি, আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। ‘একই পাড়া’ বলা ঠিক নয়। রিকশার পথ। নেহাত আমরা খরচ বাঁচাতে লম্বা লম্বা পথ হাঁটি, তাই অনেকটা জায়গাকেই ‘এ আর কতটুকু? একই তো পাড়া’ বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিই। বড় রাস্তার গায়ে তিন তলা বাড়ি অভ্রনীলদের। বারান্দা পর্যন্ত একটা বোগেনভিলিয়া গাছ উঠে গেছে। গরমের সময় গাছ ঝাপসা করে হলুদ রঙের ফুল ফোটে। আপনি যদি দূর থেকে হঠাৎ দেখেন, মনে হবে কেউ ওপর থেকে খানিকটা হলুদ রং ঢেলে দিয়েছে। রং মাটিতে পড়তে পারেনি, মাঝপথে থমকে আছে। অভ্রনীলের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। একটা সময় পর্যন্ত আমার নামও সে জানত না। তবে প্রেম কী ভাবে হল বলতে পারি। তখন কলেজের শেষ দিক। ক’দিন পরেই ফাইনাল। হন হন করে হাঁটছি। বাস ধরে কলেজ যাব। সে-দিন হিস্ট্রি না ফিলজফি কোনও একটা পেপারের সাজেশন পাওয়ার কথা। আমার মতো উইক স্টুডেন্টদের জন্য সাজেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তিত মনে মাথা নামিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎই মুখ তুলি। মুখ তুলে অভ্রনীলকে দেখতে পাই। বোগেনভিলিয়া বাড়ির উঁচু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জিন্স আর রঙিন পাঞ্জাবিতে ঝলমল করছে যেন! এলোমেলো চুল। ভাসা ভাসা বড় দুটো চোখ। সেই চোখ ভরা মুগ্ধতা। যেন পৃথিবীর সব কিছুই তার কাছে সুন্দর! ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ কথাটা বইতে পড়েছিলাম, সেদিন হাতেকলমে বুঝতে পারলাম। এর পর এ দিক সে দিক থেকে খবরাখবর নিতে শুরু করি। ওই ছেলের নাম জানতে পারি। জানতে পারি, ওই ছেলে আমার ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরের এক জন মানুষ। আমি ওকে ভুলে যেতে চেষ্টা করি। বড় রাস্তা ছেড়ে অলিগলি ধরি। লাভ হয় না। যত দিন যেতে লাগল আমি অভ্রনীলে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। আপনি নিশ্চয় ভাবছেন, আমি একটা অতি রদ্দি প্রেমের গল্প ফেঁদেছি। ছেলেমানুষি ধরনের গল্প। হয়তো তাই। তবু অনুরোধ করব, প্লিজ, আর একটু ধৈর্য ধরুন। আর একটু সহ্য করুন।
এক সময় দেখলাম, কী ভাবে যেন আমার টার্গেট হয়ে গেছে সকাল আটটা চল্লিশ। রোজ ওই সময় গাড়ি চালিয়ে অভ্রনীল অফিসে বেরোয়। আমি তার আগেই যেটুকু পারি সেজেগুজে তৈরি হয়ে নিই। কোনও দিন শালোয়ার কামিজ, কোনও দিন শাড়ি। কোনও দিন খোঁপা, কোনও দিন বিনুনি। গালে খানিকটা পাউডার বুলিয়ে কপালে দুম করে একটা টিপ বসিয়ে নিতাম। এমনকী কোনও কোনও দিন ঠোঁটে আলতো করে যে লিপস্টিক লাগায়নি এমন নয়। তবে এতে আমার চেহারার খুব একটা কোনও হেরফের ঘটত এমন নয়। সাজগোজে সুন্দর হওয়ার বান্দা আমি নই। তবু চেষ্টা করতাম। কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে মাকে বলতাম, ‘কিছু কেনাকাটার থাকলে ঝটপট বলো। ফেরার পথে নিয়ে আসব’খন।’ মা রান্নাঘর থেকে বলত, ‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’
আমি বিরক্ত হয়ে বলতাম, ‘রোজ রোজ একই কথা বলো কেন? তুমি জানো না এই সময় আমি কোথায় যাই?’
মা বলত, ‘ও ভাবে বলছিস কেন?’
‘কী ভাবে বলব? হাত জোড় করে বলতে হবে যে আমি টিউশনে যাই?’
‘হাত জোড় করে না বলিস, অত গলা করেও বলার কিছু নেই, টিউশন করে ক’টা পয়সা পাস যে গলার জোর দেখাচ্ছিস?’ আমি রেগে বলি, ‘এক টাকা, দু’টাকা যা পাই তোমার কী?’
‘দু’টাকার জন্য সাতসকালে রংচং মেখে বেরোতে হয়!’
আমি বলি, ‘মেয়ে যদি জন্মসূত্রে মায়ের চোখ ধাঁধানো রূপ পায়, তা হলে বেরোতে হয়। এ বার বাড়িতেও পাউডার মেখে থাকব।’
মা মুখ ফিরিয়ে গজগজ করতে থাকে, ‘অমন চেহারা বলেই তো ঘাড়ের ওপর বসে খাচ্ছিস। কে বিয়ে করবে? উফ্ কবে যে ঘাড় থেকে নামবে...।’ যে কোনও মেয়ের পক্ষেই অপমানের কথা। কুশ্রী মেয়ের পক্ষে বেশি অপমানের। আমারও অপমান হত। তবে মায়ের কথায় মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করতাম না। ওই সময়টা আমার কাছে ছিল ‘সোনার চেয়ে দামি’। আটটা চল্লিশ বাজেনি তো? তার আগেই আমাকে অভ্রনীলের বাড়ির সামনে পৌঁছতে হবে। ওদের বাড়ির উল্টো দিকে একটা দোকান আছে। মুদি আর স্টেশনারি মেলানো মেশানো দোকান। সেখানে টুকটাক, হাবিজাবি জিনিস কিনতাম। সেফটিপিনের পাতা, জামার হুক, কাপড় কাচার সস্তা সাবান। রোজ রোজ আর কত কেনা যায়? পয়সাও তো লাগে। তাই কোনও কোনও দিন শুধু এটা সেটার খোঁজ করতাম, কিনতাম না। রোজ যাই বলে বুড়ো দোকানদার কিছু বলত না। অন্য কারণও আছে। বুড়োটা মাঝেমধ্যে আমার বুকের দিকে তাকাত। দেখতে যেমনই হই, কমবয়সি মেয়ের বুক বিনা আয়েসে দেখতে পাওয়া মন্দ কী? আমিও ভাব করতাম, যেন বুঝতে পারছি না। আমার চোখ থাকত বোগেনভিলিয়া বাড়ির দিকে। ঠিক সময় লাল টুকটুকে গাড়ি নিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আসত অভ্রনীল। আমি দ্রুত লুকিয়ে যেতাম। কখনও দোকানের আড়ালে, কখনও অন্য খদ্দেরদের পিছনে। দেখতাম স্টিয়ারিং ধরে জানলার পাশে বসে আছে সে। কী যে সুন্দর লাগত! কোনও দিন সাদা জামা, কোনও দিন হাল্কা নীলের ওপর ঘন নীলের স্ট্রাইপ। কোনও দিন গোলাপি। ফুরফুর করে চুল উড়ত। সেভ করা গাল দুটোতে হাল্কা সবুজ আভা। গায়ে সকালের নরম রোদ। মাথা ঝিমঝিম করে উঠত আমার। বুকের মধ্যে ড্রাম বাজত। বেশিক্ষণ নয়, কয়েকটা মিনিট মাত্র। গাড়ি বাঁক নিতে নিতে কাচ তুলত অভ্রনীল। গাঢ় বাদামি রঙের কাচের পিছনে হারিয়ে যেত। যেমন ভাবে ঘুম ভাঙলে স্বপ্ন চলে যায় সেই ভাবে। আমি টিউশন বাড়ির যাওয়ার পথে ভাবতাম, আজ কি আমায় ও দেখেছে? দেখেনি তো? আচ্ছা, একটা জিনিস আপনি কি খেয়াল করছেন? আমি চেষ্টা করতাম, অভ্রনীল যেন আমাকে না দেখতে পায়। ও গাড়ি নিয়ে বেরোবার সময় আড়ালে চলে যেতাম। অথচ বাড়ি থেকে ওর জন্যই সেজেগুজে বেরোতাম। অদ্ভুত না? যদি দেখা দিতে না চাই, তা হলে সাজব কেন! ধাঁধার মতো। আমি অনেক ভেবে ধাঁধার একটা উত্তর পেয়েছি। জানি না ঠিক কি না। আমার মনের মধ্যে দুটো ‘আমি’ কাজ করত। একটা ‘আমি’ বলত, ‘অভ্রনীল যদি তোমাকে দেখে সেও তোমার প্রেমে পড়বে।’ আর একটা ‘আমি’ বলত, ‘খবরদার। তোমাকে দেখলেই সে চোখ ফিরিয়ে নেবে। তুমি প্রত্যাখ্যাত হবে।’ এই দুই ‘আমি’ আমাকে একই সঙ্গে সাজাত, আবার আড়ালে টেনেও নিত। যুক্তিটা কেমন লাগল আপনার?
এক দিন একটা ঘটনা ঘটল। শ্যামবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ি ফিরব। বাস ধরব না অটো করে যাব ভাবছি। বাসে গেলে তিনটে টাকা বাঁচে। আকাশের অবস্থাও ভাল নয়। খুব গরম মনে হচ্ছে, ঝড়-বৃষ্টি হবে। গরম হলেও আমার ঝড়-বৃষ্টি ভাল লাগে না। বাড়ির সামনে রাস্তাটা নিচু। একটু বৃষ্টিতেই জল জমে। নর্দমা উপচে যায়। সেই নোংরা ডিঙিয়ে বাড়ি ঢুকতে হয়। ভিড়ের কারণে দুটো বাস ছেড়ে দিলাম। এমন সময় হঠাৎ একটা লাল টুকটুকে গাড়ি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। ঝকঝকে এক যুবক হেসে জানলার কাচ নামিয়ে, মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘আসুন। উঠে আসুন গাড়িতে।’
আমি চমকে উঠলাম। অভ্রনীল! ঠিক যেন সিনেমা। বিশ্বাস করা যায় না। আমি কী করব বুঝতে না পেরে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই এবং গাড়িতে উঠে বসি। এটাও অবিশ্বাস্য। আমি প্রথমেই বলেছিলাম না, গল্প বিশ্বাস করা যায় না? আলাপ নেই, কখনও কথা হয়নি, এমন একটা যুবক ডাকলে তার গাড়িতে কোনও অল্পবয়সি মেয়ে দুম করে উঠতে পারে না। খারাপ দেখতে হলেও নয়, ভাল দেখতে হলেও নয়। আসলে সেই সময় আমি আমার বুদ্ধির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলাম। গ্রহণ যেমন বুদ্ধি করে, প্রত্যাখ্যানও বুদ্ধিই করে। গাড়ি চালাতে চালাতে ছেঁড়া ছেঁড়া কথা বলল অভ্রনীল। আমি কাঠ হয়ে বসে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-তে জবাব সারতে থাকি। সেই সঙ্গে মনে মনে নিজের গালে চড় মারি। হা ভগবান, এ কী বোকামি আমি করলাম! কেন গাড়িতে উঠলাম?
‘আপনি কি একটু ভেতরের দিকে থাকেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘মেন রোড থেকে কত দূর?’
‘ষোলো, সতেরো মিনিট লাগে।’
‘গাড়িতে অতটা!’
‘না, হেঁটে। ও দিকটা গাড়ির পথ নেই, সরু গলি।’
অভ্রনীল লজ্জা পায়। বলল, ‘আসলে অত ভেতরে আমার কখনও যাওয়া হয়নি। ওহ্ নিজের নামটাই বলিনি, আমার নাম অভ্রনীল। আপনি?’
কী স্মার্ট! একটা অচেনা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে নিঃসঙ্কোচে! গলা শুকিয়ে যায়। বলি, ‘ইন্দিরা।’
অভ্রনীল চুপ করে থেকে প্রসঙ্গ পাল্টাল। বলল, ‘আজ মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।’
‘হ্যাঁ।’
আবার অভ্রনীল চুপ করে যায়। আমিও চুপ করে থাকি। গাড়ি এসি। একটু যেন কাঁপুনি লাগে। মনে হয়, স্বপ্ন দেখছি। দুঃস্বপ্ন। অভ্রনীল বলল, ‘আমি আপনার নাম জানতাম না, কিন্তু আপনাকে চিনি। সম্ভবত আপনি, আমার বাড়ির দিকে কোথাও থাকেন, সেই কারণেই গাড়িতে ওঠার অনুরোধ জানিয়েছি। আপনি সেই অনুরোধ রাখায় ধন্যবাদ।’ আমার বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে, আমি আনন্দে জ্ঞান হারাব। অভ্রনীল কি আমার প্রেমে পড়েছে? আমি বিড়বিড় করে কী বললাম, নিজেই শুনতে পেলাম না।
গাড়ি পাড়ার মোড়ে বাঁক নিলে অভ্রনীল সুন্দর করে হাসল। শান্ত গলায় বলল, ‘ইন্দিরা, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে একটা কথা বলি। ইনফ্যাক্ট আজ আপনাকে আমার গাড়িতে তোলার পিছনে সেটাই কারণ।’
আমার মনে হচ্ছে, এ বার আমি আনন্দে কেঁদে ফেলব। ভগবান, আমাকে জোর দাও। আমি যেন দুর্বল হয়ে না পড়ি। শক্ত মনে, ওর ভালবাসার কথা যেন শুনতে পারি।‘ইন্দিরা, আপনি রোজ সকালে যে আমার বাড়ির সামনে এসে আমাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন, দয়া করে এটা করবেন না। লোকে খারাপ ভাববে বলে আপনাকে আমি এই অনুরোধ করছি না। অনুরোধ করছি আপনার খারাপ লাগবে বলে। খুব শিগ্গিরই আমি একটি বিয়ে করব। সেই মেয়ের নাম ঐশিকা। আমি তাকে আপনার কথা বলেছি। কী ভাবে প্রতিদিন আটটা বেজে চল্লিশ মিনিটে আপনি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, সেই কথা। ঐশিকা খুব ভাল মেয়ে। সে বলেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলতে। আমি ওয়াজ ওয়েটিং ফর দ্য চান্স। দাঁড়ান, আপনাকে ওর ছবি দেখাই।’ অভ্রনীল ফের মিষ্টি হাসল। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে ড্যাশবোর্ডের কাগজপত্র সরিয়ে ফটো বের করে আমার হাতে দিল। সত্যি মেয়েটা খুব সুন্দর। চোখ ফেরানো যায় না এমন সুন্দর।
আকাশ কালো হয়ে থাকলেও বৃষ্টি হল না। রাতের দিকে মেঘ কেটে গিয়ে তারাও ফুটল। আমাদের নেড়া ছাদ। সেখানে বসে অনেক রাত পর্যন্ত তারা দেখলাম। নিশ্চয় ভাবছেন এখানেই আমার বিরহের গল্প শেষ। তাই তো? না, শেষ নয়। আর একটু আছে।
কলকাতা থেকে খানিকটা দূরে ছোট একটা মফস্সল শহরে আমার বিয়ে হয়ে গেল।
উজ্জ্বল মানুষ খারাপ নয়। রাশভারী টাইপ মানুষ। কথা কম বলে। বয়স একটু বেশির দিকে। চাকরিটাও একেবারে খারাপ নয়। স্কুল মাস্টারের। গ্রামে জমিটমি আছে। আমি কেমন দেখতে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাল না। মুখ তুলে ভাল করে তাকালও না। এক দিন সে তার মা আর তার এক মোটাসোটা মাসিকে নিয়ে আমাকে দেখতে এল। যাওয়ার সময় ‘হ্যাঁ’ বলে গেল। এমন একটা কালোকুলো মেয়েকে কেন তাদের পছন্দ হল, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার মতো অবকাশ আমাদের ছিল না। বাড়িতে তখন খুশির বান ডেকেছে। বাবা-মা আনন্দে আত্মহারা। বাবা বলল, ‘লেখাপড়া জানা মানুষ এমনই হয়। বাইরের রূপ তাদের কাছে তুচ্ছ। তারা দেখে অন্তরের রূপ।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ওই ছেলে আমার অন্তর কখন দেখল বাবা!’
মা এক গাল হেসে বলল, ‘দেখলি ইন্দি, মায়ের কালো রং পেলেই যে মেয়ের বিয়ে হবে না, এমন নয়। দেখলি কিনা?’
হ্যাঁ, দেখলাম। বিয়ের দু’মাসের মাথায় জানতে পারলাম, উজ্জ্বলের আরও একটা বউ আছে। গ্রামের বাড়িতে থাকে। সপ্তাহে দু’দিন করে আমার স্বামী তার কাছে যায়। শনি আর রবিবার। খবর শুনে আমি প্রথমটায় একচোট কান্নাকাটি করলাম। শাশুড়ির কাছে গিয়ে বললাম, ‘মা, খবরটা সত্যি?’
শাশুড়ি গম্ভীর গলায় বলল, ‘সত্যি মিথ্যে দিয়ে তোমার কী?’
উজ্জ্বলকে জিজ্ঞেস করলাম। সে কোনও কথা বলল না। কঠিন চোখে তাকাল। স্কুলের মাস্টাররা কঠিন চোখে ভাল তাকাতে পারে। আমি আর পারলাম না, এক দিন নিজে সেই গ্রামে গিয়ে ‘সতিন’টিকে দেখে আসলাম। ‘সতিন’ আমার থেকে দেখতে ভাল। ঢলঢলে টাইপ। খালি গায়ে শাড়ি জড়িয়ে পুকুর পাড়ে বাসন মাজছিল। বাড়ি ফিরে শুরু করলাম অশান্তি। উজ্জ্বল ঠান্ডা মাথায় বলল, ‘তোমার সমস্যা কী? সে তোমাকে মেনে নিয়েছে, তুমিও তাকে মেনে নাও।’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘আমি পুলিশের কাছে যাব।’
উজ্জ্বল আরও ঠান্ডা গলায় বলল, ‘কেন?’
‘বাঃ, তোমার দুটো বউ, আমি পুলিশের কাছে যাব না!’
‘দুটো হোক তিনটে হোক তোমার খাওয়া-পরা-থাকায় তো কোনও অসুবিধে হয়নি। সে আছে তার মতো, তুমি থাকবে তোমার মতো।’
‘আমি কোনও কথা শুনব না। পুলিশের কাছে গিয়ে তোমায় অ্যারেস্ট করাব। তোমার চাকরি যাবে। জেলে ঘানি ঘোরাতে হবে।’
‘কবে যাবে?’
‘কালই যাব।’
‘একটা দিন অপেক্ষা করা যায়?’
‘না, এক দিনও করব না।’ আমি একটা দিন অপেক্ষা করলাম। আর সেটাই কাল হল। বেশি রাতে উজ্জ্বল আর তার মা আমাকে টেনে নিয়ে গেল রান্নাঘরে। গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল। আমি চিৎকার করতে গেলাম। ওরা আমার মুখে কাপড় গুঁজে দিল। তার পর দরজার ছিটকিনি তুলে দিল বাইরে থেকে। হাসপাতালে আমি যে বাঁচার জন্য খুব চেষ্টা করেছিলাম এমন নয়। বরং মৃত্যুই কামনা করছিলাম। পর দিন সকালে যখন মারা গেলাম তখন আটটা বেজে চল্লিশ।
আপনি অবাক হচ্ছেন? হবেন না। পাড়াগাঁয়ে কেরাসিন ঢেলে বউ মারা খুব কিছু ঝামেলার বিষয় নয়। বেশি খরচাপাতি নেই। ‘আত্মহত্যা’ বলে মামলা চাপা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ‘রেট’ আছে। পুলিশে সেই রেট দিয়ে আমার স্বামী স্কুলে চলে গেল। আমার মৃত্যুতে আমার স্বামী, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, আমার বাবা-মা মুক্ত হল। এক এক জন এক এক ভাবে। মুক্ত হয়েছি আমিও। শুধু আমার চরিত্রহীন স্বামীর থেকে মুক্ত হইনি, মুক্ত হয়েছি আমার খারাপ চেহারা, আমার দারিদ্র, আমার অতি সাধারণ হয়ে থাকার হীনমন্যতা থেকে। এখন আটটা চল্লিশ। এই দেখুন আমি সময় নষ্ট না করে বোগেনভিলিয়া বাড়ির সামনে চলে এসেছি। অভ্রনীলের গাড়ি বেরোবে। আজ ওর দেরি হচ্ছে। নিশ্চয় ঐশিকা আটকে দিয়েছে। সবে বিয়ে হয়েছে, এই সময় স্বামীকে ছাড়তে মন চায় না। কে জানে হয়তো চুমুটুমু খাচ্ছে। বেশি কিছুও হতে পারে। হোক। আমার কোনও তাড়া নেই। আজ আর আমি নিজেকে লুকোব না। দরকার নেই। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে অভ্রনীলের গাড়ি থামাব। বাড়ির বাইরে আরও এক জন ঐশিকাকে দেখে সে কি খুব চমকাবে? খুব জোরে ব্রেক কষবে গাড়ির? চমকাক। একটা দিন তো মোটে। ইন্দিরা কি এক দিন ঐশিকা হয়ে আসতে পারে না? বিষয়টা কি খুব জটিল?


সৌজন্যে ABP
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:৩৫
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×