somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় মানুষ

২৯ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেই কলেজ-লাইফ থেকেই আমাদের তিন বন্ধুর আড্ডা দেওয়ার আদর্শ জায়গা হল বেচুদার মুদির দোকান। আমরা কেউই এখন আর বেকার নই। আমি সরকারি অফিসের কেরানি। বেণু কমার্স গ্র্যাজুয়েট। একটা বেসরকারি অফিসের অ্যাকাউনট্যান্ট। আর রজত অঙ্কে অনার্স হলেও চাকরি-বাকরির ধার ধারেনি, নিজেই বাড়িতে কোচিং খুলেছে।
প্রায় প্রতিদিনই সন্ধে সাতটা নাগাদ আমরা হাজির হই বেচুদার দোকানে। দোকানঘরটা আয়তনে অনেক বড়। ঢালাই ছাদ। চাল, ডাল, তেল, মশলাপাতি ইত্যাদি গৃহস্থের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব রকম জিনিসপত্র এখানে পাওয়া যায়। আমাদের পাড়ায় এই দোকান বহু দিন আগে শুরু করেছিলেন বেচুদার বাবা। তাঁর দুই ছেলে। বেচারাম। আর অভিরাম। বেচুদার যখন পনেরো চলছে, আর অভির দশ, তারা মাতৃহারা হয়। বেচুদার পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। ক্লাস এইট পাশ করে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল। দোকানে বাবার সঙ্গে বসত। ছোট ভাই কিন্তু পড়াশোনায় ভাল ছিল। কেমিস্ট্রি নিয়ে অনার্স পাশ করার পর একটা ব্যাঙ্কের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে। বছরখানেক আগে বেচুদার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎই মারা যান। তখন থেকে বেচুদাই এই দোকান টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পৈতৃক সূত্রে দু’ভাই যেমন এই চালু দোকানটার উত্তরাধিকারী; তেমনই একটা দোতলা বাড়িও তারা পেয়েছে। সেই বাড়ির দোতলায় অভি (যে তার নাম থেকে ‘রাম’ শব্দটা অফিশিয়ালি বাদ দিয়েছে) তার স্ত্রীকে নিয়ে সংসার পেতেছে। আর একতলাতে দুটো ঘর, রান্নাঘর, চানঘর, পাতকুয়ো, উঠোন এ সব বেচুদার ভাগে। বাড়ির এন্ট্রান্স এখনও একটাই। সিঁড়ি দিয়ে অভিরা দোতলায় যাতায়াত করে। তবে হাঁড়ি আলাদা। বেচুদা হাত পুড়িয়ে নিজের রান্নাটুকু দু’বেলা করে নেয়।
চাকরি পাওয়ার পর (এবং বাবা মারা যাওয়ার বছরখানেক পর) অভি নিজেই বিয়ে করেছিল অফিসের এক সহকর্মীকে। দাদাকে আগে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। একেবারে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে বউকে ঘরে এনেছিল। বেচুদা তাতে কোনও আপত্তি করেনি। বরং ধুমধাম করে ভাইয়ের বউভাতের আয়োজন করেছিল নিজেই। পাড়ার প্রায় সব লোকই সেই বউভাতের আসরে নিমন্ত্রিত ছিল। আমরা তিন জন তো বটেই। বলতে ভুলে গিয়েছি, আমরা মফস্সলবাসী। হাওড়া থেকে ট্রেনে মিনিট পঞ্চাশের জার্নি। আমাদের অঞ্চলে এখনও পাড়া-প্রতিবেশী, কাউকে কোনও কারণে একঘরে করে রাখা, এর-ওর হাঁড়ির খবর নেওয়া, এ সব ব্যাপারগুলো বেশ চালু আছে। দেখে মনে হয়, বেচুদার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। এখনও অবিবাহিত। সব থেকে যেটা উল্লেখযোগ্য, সেটা হল ওর পোশাক। খাকি হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। শীতকালে বড়জোর একটা চাদর। মাথায় লম্বা। বিশাল বপু। চর্বি-সমৃদ্ধ শরীর। মিলিটারি ছাঁট।
দোকানঘরটা আয়তনে অনেক বড় আর চওড়া বলেই এক কোণে কবে থেকে যেন আমাদের জন্যে একটা টেবিলের ওপর ক্যারম বোর্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বেচুদা। এ দিকে আলোর ব্যবস্থাও আছে। আমরা আরামসে ক্যারম পিটি। বেচুদা কখনও খেলায় অংশগ্রহণ করে না। খদ্দেরদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে তার মধ্যেই কথাবার্তা চালিয়ে যায় আমাদের সঙ্গে। সেটাই আড্ডা। রাত দশটায় দোকান বন্ধ হয়। আমরা চার জন একসঙ্গে বাড়ি ফিরি। আমরা একই পাড়ায় কাছাকাছি থাকি। সে দিনও রাত দশটার পর দোকান বন্ধ করল বেচুদা। আমরা বাড়ি ফিরছি। পঞ্চায়েত এলাকা। রাস্তায় আলোর বালাই নেই। আকাশে আধকপালে চাঁদ। তারই আলোয়, আধো-অন্ধকারে, হাড়গিলে রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছি। রাস্তার দু’ধারে বুনো ঝোপঝাড়। হঠাৎ একটা অস্ফুট আর্তনাদ কানে এল আঁ... আঁ... আঁ... আঁ! মেয়েলি কণ্ঠস্বর! বেচুদা দাঁড়িয়ে গেল। আমরাও।
কী ব্যাপার বল তো? বেচুদা বলল।
ঝোপের মধ্যে ঢুকে দেখতে হচ্ছে... আমার প্রস্তাব।
আমার পকেটে ছোট টর্চ আছে। রজত জানাল।
রজতের টর্চে যতটা আলো হয়, তাতেই নির্ভর করে আওয়াজটা যে দিক থেকে আসছিল, সে দিকের ঝোপের ডালপালা সরিয়ে আমরা ভেতর দিকে ঢুকলাম। সামনে দেখলাম।... কী দেখলাম? এক নারীশরীর। সম্ভবত যন্ত্রণায় কী রকম বেঁকে শুয়ে আছে আর কাতরে যাচ্ছে আঁ... আঁ... আঁ! পরনের ঘি-রং ব্লাউজ হাতের কাছে ছেঁড়া আর হলুদ শাড়িটাও যেন শরীরের ওপর কোনও রকমে জড়িয়ে আছে। কী করব ইতস্তত করছিলাম। দেখলাম, বেচুদা নিচু হয়ে মেয়েটিকে দু’হাতে পাঁজাকোল করে তুলে, ঝোপ থেকে বাইরে নিয়ে এসে রাস্তার পাশে ঘাসজমির ওপর শুইয়ে দিল। ডান গালে ছোট, টাটকা ক্ষতচিহ্ন; সম্ভবত কামড়ের দাগ; সেটা নজর এড়াল না আমাদের। মেয়েটির জ্ঞান আছে। বেচুদা জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়? কী হয়েছিল? শুধুই উত্তর এল আঁ... আঁ... আঁ... আঁ...; ওর দু’চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল, আর হাতের নানা রকম মুদ্রায় বোঝাতে চেষ্টা করছিল...। আমরা বুঝলাম কী ঘটেছে। আমরা বুঝলাম, মেয়েটি বাক্শক্তিরহিত।
বেচুদা বলল, রজত আর সুদীপ, তোরা মোড় থেকে তাড়াতাড়ি একটা ভ্যান-রিকশা ডেকে নিয়ে আয়...
বেণু বলল, একে আগে কোথায় নিয়ে যাবে? হেল্থ সেন্টারে? না থানায়?
বেচুদা বলল, আমার বাড়িতে।
আমরা তিন জন এ-ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। সে দিন রাতে মেয়েটিকে বেচুদার বাড়িতেই তুলেছিলাম। বেচুদার ঘরে তক্তপোশের বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। চোখে-মুখে জল ছিটোনো হয়েছিল। দু’গ্লাস জল পান করেছিল মেয়েটা। তার পর বিছানা পেয়েই বোধ হয় কী রকম নেতিয়ে পড়েছিল।
বেচুদা নিজে গিয়ে ডেকে এনেছিল পাড়ার সাধন ডাক্তারকে। এম বি বি এস। তবে পসার খুব। বেচুদার মুখে বোধ হয় শুনে নিয়েছিল রোগীর বর্ণনা। ঘরে ঢুকেই ঘোষণা করে দিল, সবাইকে বাইরে যেতে হবে...।
বেচুদা এবং আমরা সবাই ঘরের বাইরে। ঘরের দরজা বন্ধ করে ডাক্তার মেয়েটাকে পরীক্ষা করছে। দশ মিনিট বাদে ঘরের দরজা খুলে, সাবান চেয়ে নিয়ে হাত ধুয়ে বেচুদার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল এ কারে ঘরে তুলে এনেছ?
কেন? একটা বোবা মেয়ে। রেপড হয়েছে। থানায় নিয়ে যাও। না হলে ঝামেলায় পড়বে...।
কিন্তু এখানে কী করে এল মেয়েটা? বেচুদা জিজ্ঞেস করল।
তা কী ভাবে বলব? হয়তো কোনও সরকারি হোমে ছিল। সেখানেই কেউ অত্যাচার করেছে। ভয়ে পালাচ্ছিল। দিশাহারা হয়ে এখানে এসে পড়েছে। আবার এ রকমও হতে পারে হোম থেকে তুলে নিয়ে এসে ওই ঝোপের মধ্যেই অন্ধকারে ওকে...। যা-ই হোক, সেটা পুলিশ বুঝবেখন। তুমি ওকে থানায় ডেসপ্যাচ করো বেচু। না হলে ভীষণ ঝামেলায় পড়বে।
থানায় নিয়ে গেলে ওকে কী করবে ডাক্তারবাবু? বেচুদা জিজ্ঞেস করল। একটা ডায়েরি করবে। তোমাদের সাক্ষীসাবুদ রাখবে। তার পর হসপিটালে রেফার করবে।
তার পর?
তার পর আর কী? আবার হসপিটাল থেকে হোম। এ রকমই তো হয়।
অর্থাৎ, দোষী ব্যক্তিরা কেউ ধরা পড়বে না। মেয়েটার পেট খালাস হলে আবার ওর ওপর একই অত্যাচার হবে। ও যে বোবা। কিছু বলতে পারে না। তার থেকে থানায় না যাওয়া ভাল। বেচুদা বলল।
থানায় যাবে না? তা হলে ওই ঘেয়ো মেয়েটাকে নিয়ে কী করবে? আমার কাছেই থাকবে ও।
তোমার মাথা কি খারাপ হয়েছে, বেচু? সমাজের কথাটা ভেবে দেখেছ? পাড়ায় ঢি-ঢি পড়ে যাবে। সবাই তোমাকে চরিত্রহীন বলবে। একঘরে করবে।
কেন তা করবে ডাক্তারবাবু? আমি তো একটা ভাল কাজ করছি।
ও সব গল্প-উপন্যাসে চলে বেচু। বাস্তবে সম্ভব নয়। তোমার মাথায় শয়তান ভর করেছে। আমি ওতে নেই। তুমি আমার টাকাটা মিটিয়ে দাও তো বাপধন। পঞ্চাশ টাকার নোট আর ক্যাম্বিসের ব্যাগটা তুলে নিয়ে সাধন ডাক্তার চলে গেল।
বেচুদা বলল, তোরাও বাড়ি যা। রাত হয়েছে। দেখি মেয়েটাকে কিছু খাওয়াতে পারি কি না।

পরের দিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল সারা পাড়ায় যে, বেচুদা এক ধর্ষিতা, বোবা মেয়েকে রাস্তা থেকে বাড়িতে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছে। সবাই ছি ছি করতে লাগল। এ রকম অধঃপতন কি ভাবা যায়? কেউ কেউ বলল, অধঃপতন না বোকামি? বেচুটা স্রেফ একটা বোকচন্দর...।
সন্ধেবেলা দোকান বন্ধ দেখে আমরা তিন জন বেচুদার বাড়িতে গিয়ে হাজির। শুনলাম ‘কুড়ানি’ ভাল আছে। শুধু যা একটু বেশি ঘুমোচ্ছে। শরীরের ওপর ধকল গিয়েছে তো! রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া, তার ওপর নিজের নামটাও বলতে পারে না; তাই বেচুদা নিজেই মেয়েটার নাম রেখেছে কুড়ানি। কারও আপত্তিই গ্রাহ্য করল না বেচুদা। পাড়ার পুরোহিত দ্বিজেন ভটচায্যির সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেই বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলল। সব থেকে বেশি গণ্ডগোল বাধল ভাই অভির সঙ্গে। সে দাদার এই ‘জঘন্য স্বেচ্ছাচার’ কিছুতেই মেনে নেবে না। বিয়ের আসরে তো এলই না। উপরন্তু রাতারাতি দোতলায় ওঠার সিঁড়ি সেপারেট বানিয়ে নিল। বেচুদার সঙ্গে তার মুখ দেখাদেখির সম্পর্ক থাকল না আর।
বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা তিন জন অবশ্যই হাজির। এই বিয়েতে বলা যায়, বেচুদা পাত্রপক্ষ এবং কন্যাপক্ষ দুটো ভূমিকাই পালন করছে। পুরোহিতের ফর্দ অনুযায়ী বিয়ের উপচার সবই কেনা হয়েছে। এমনকী দানসমগ্রী পর্যন্ত। কুড়ানিকে দেখলাম একটা লাল বেনারসি পরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। এই প্রথম তাকে ভাল করে লক্ষ করলাম। বয়স মনে হল, পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। গায়ের রং বেশ ফর্সা। মুখশ্রীও খারাপ নয়। গলায় সরু সোনার হার। কানে দুটো সোনার রিং। দু’হাতে কয়েক গাছি চুড়ি। রজত আমার কানে কানে বলল, সব গয়না বেচুদারই দেওয়া...। জীবনে প্রথম বার দেখলাম বেচুদার পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। মাথায় টোপর। কুড়ানির মাথাতেও ফুলের মুকুট। পাড়ার প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িতে বেচুদা নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছিল। কেউ এল না। শুধু আমাদের তিন জনের উপস্থিতিতে, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে বেচুদা আর কুড়ানির বিয়ে হয়ে গেল। প্রায় তিনশো জন নিমন্ত্রিতের খাবার নষ্ট হল।

আশ্চর্য ভাবে বিয়ের পর দিন থেকেই বেচুদার দোকানে খদ্দের কমতে শুরু করল। ক্রমশ অবস্থাটা এমন পর্যায়ে দাঁড়াল যে, সারা দিন বেচুদা দোকান খুলে বসে থাকে, অথচ একটা খদ্দেরেরও দেখা নেই। বেচুদা ম্লান হেসে আমাদের জানাল, পাড়ার লোক সত্যিসত্যিই আমাকে বয়কট করেছে রে! তাতে আমি ভয় খাব না। এ দোকান আমি বিক্রি করে দেব...।
খদ্দের পেতে অবশ্য অসুবিধে হল না। মাড়োয়ারি খদ্দের। ছ লাখ টাকায় মালপত্রসমেত দোকানঘর বিক্রি হয়ে গেল। পাড়ার উকিল বিকাশবাবুর মধ্যস্থতায় আইনগত ব্যাপারে কোনও খুঁত রইল না। অভির বৈষয়িক ব্যাপারে জ্ঞান খুব টনটনে। দোকানে তার ৫০ শতাংশ শেয়ার আছে। নিজের তিন লাখ টাকা সে ঠিক বুঝে নিল। শুনলাম, মাড়োয়ারি ভদ্রলোক দোকানের এক ধারে এস টি ডি বুথ আর অন্য ধারে ফাস্ট ফুড সেন্টার করবেন।
কিন্তু বেচুদার পরবর্তী পরিকল্পনা কী? তিন লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রেখে বাড়িতে বসে সুদ ভাঙিয়ে খাবে? কিছুই বুঝতে পারি না। আমাদের আড্ডা তো উঠে গিয়েছে। বেচুদা বোধ হয় বাড়িতেই থাকে। আমরা সন্ধেটা যে যার মতো সময় কাটাই। এক দিন রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে সন্ধেবেলা বেচুদাকে দেখে চমকে উঠলাম। চার চাকার গাড়ি ঠেলে চলেছে। মুভিং স্টল। ‘কুড়ানি স্ন্যাক স্টল’। টিনের পাতে সাইনবোর্ড। এগরোল, চাউমিন, ভেজিটেবল চপ বিক্রি চলছে। আমাদের তিন জনকে দেখে বেচুদা জানাল, অনেক ভেবে-চিন্তে এই ব্যবসাটাই শুরু করলাম। রান্নার হাত আমার খারাপ নয় জানিস। লোকে খাচ্ছেও ভাল। পাড়ার লোক আমাকে চেনে। তাই বয়কট করতে পারে। কিন্তু রেলস্টেশনে তো কত রকম মানুষের যাতায়াত। কে আর আমার ব্যক্তিগত জীবন জেনে বসে আছে। তবে কিছু হ্যাপা সামলাতে হল। প্ল্যাটফর্মে হকারি করব বলে দুটো ইউনিয়নকে মোটা টাকা ডোনেশন দিতে হল। এ ছাড়াও মাসে মাসে চাঁদা তো আছেই।
আমাদের সান্ধ্য-আড্ডা এখন প্ল্যাটফর্মে বেচুদার স্টল ঘিরে। কী খদ্দের! কী খদ্দের! সামলে উঠতে পারে না বেচুদা। অনেক সময় আমাদেরও হাত লাগিয়ে সাহায্য করতে হয়।

বিয়ের ঠিক দশ মাস বাদে কুড়ানি-বউদি একটা পুত্রসন্তান প্রসব করল। আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। বেচুদারই সন্তান তো? বেচুদার অবশ্য কোনও ভাবান্তর নেই। নার্সিংহোমে সিজার বেবি হয়েছে। বেশ ভালই খরচ হল বেচুদার। বাড়িতে একটা আয়া রাখতে হল। স্ত্রীর দেখা-শোনার জন্যে। আমাকে বেচুদা এক দিন বলল, সুদীপ বাচ্চাটার একটা নাম ভেবেছি, শুনবি?
কী নাম?
শুভব্রত।
বাহ্, বেশ নাম।
ওকে এমন শিক্ষা দিতে হবে, বড় হয়ে যেন ওর ব্রতই হয় শুভ কাজ করার। তাই শুভব্রত। কীরে হবে না?
চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই হবে বেচুদা।
দেখতে দেখতে ছ’মাস কেটে গেল।
এক দিন দ্বিজেন পুরোহিতের কাছে বেচুদা হাজির। শুভর অন্নপ্রাশনের দিন ঠিক করতে হবে। বেচুদার সঙ্গে আমিও ছিলাম।
দ্বিজেন পুরোহিত মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, কার অন্নপ্রাশন দিচ্ছ বেচু? ছেলে কি তোমার? সত্যিই কি তুমি ওর বাবা? পাড়ায় যে সবাই ছি ছি করছে!
বেচুদা বলেছিল, বাবা না হতে পারি ওই ছেলের জনক হতে দোষ কোথায় কাকা? কাজটা কি আপনি করতে চাইছেন না?
নাহ্, করব না কেন? তুমি পয়সা ফেলবে আমি কাজ করে দেব...।
এ বারে বেচুদা তেমন কাউকে নেমন্তন্ন করেনি। শুধু আমরা তিন জন বন্ধু। তাও আমার অফিসে কাজের চাপ থাকায় সকালের অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। শুনলাম, বেণু, শুভর মামা হয়ে, তাকে মুখে ভাত খাইয়েছে।
সন্ধের দিকে যখন গেলাম বেচুদা বাড়ির উঠোনে খাটিয়া পেতে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়েছিল। আমাকে দেখে উঠে বসল। বলল, আয়, তোর কথাই ভাবছিলাম। চল ঘরের ভেতরে। শ্রীমানকে দেখবি। ঘরে ঢুকে দেখলাম, বাচ্চাটার পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, কপালে চন্দনের ফোঁটা; তবে ঘুমিয়ে পড়েছে। কুড়ানি-বউদি বাচ্চার মাথার কাছে বসে আছে। পরনে মেরুন রং তাঁতের শাড়ি। ঘি রং ব্লাউজ। সিঁথিতে সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। বেশ অভিজাত দেখতে লাগছিল। আমাকে দেখে বলল, আঁ আঁ আঁ আঁ! আনন্দের অভিব্যক্তি। ছোট্ট, লাল বাক্সে বাচ্চাটার জন্যে একটা আংটি এনেছিলাম। সেটা কুড়ানি-বউদির হাতে তুলে দিলাম। ও হাসছে। নিঃশব্দে। হাসলে ওকে সত্যিই দারুণ দেখায়।
খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ি ফিরব। বেচুদা দরজার কাছে। আশেপাশে আর কেউ নেই। হঠাৎ আমি নিচু হয়ে বেচুদার পায়ের ধুলো নিলাম। বেচুদা বলল, আরে করিস কী! তুই হলি সাক্ষাৎ বামুনের ছেলে। আর আমি ছোট জাত...
জাতপাত চুলোয় যাক বেচুদা! আমার চোখে তুমি অনেক বড় এক জন মানুষ। মানুষ যে কোথায় বড়, আমাদের সমাজ তো এখনও সেটাই বুঝতে শিখল না...।

সৌজন্যে : ABP
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ১:৪১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×