somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এপ্রিল ফুল : ইতিহাস বদলের ইতিহাস (৩য় পর্ব)

১৯ শে মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রামাণ্য দলিল-২.
১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি, আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারক পর্তুগিজ নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস সেদিন উপস্থিত ছিলেন সেই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে। তিনি পর্তুগালের লোক ছিলেন এবং সমুদ্রযাত্রা করার জন্য গ্রানাডা অবস্থান করছিলেন। তিনিও অত্যন্ত বেদনাহত ভাষায় মুসলমানদের পরাজয়ের ব্যাপারটি বর্ণনা করেছেন। তিনি তার ডায়েরিতে সেদিনের সে ঘটনাটি খুব নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন-
... This present year of 1492, after Your Highnesses had brought to an end the war with the Moors who ruled in Europe and had concluded the war in the very great city of Granada, where this present year on the second day of the month of January I saw the Royal Standards of Your Highnesses placed by force of arms on the towers of the Alhambra, which is the fortress of the said city; and I saw the Moorish King come out to the gates of the city and kiss the Royal Hands of Your Highnesses and of the Prince my Lord;
(E. G. Bourne, ed., The Northmen, Columbus and Cabot (New York, 1906)

কলম্বাস বলছেন, ‘১৪৯২ সালে মহামান্য রানি গ্রানাডা শহর দখলের মাধ্যমে ‘মুর'দের হাত থেকে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনেন বিজয়। মহামান্য রানি কর্তৃক মুরদের কাছ থেকে গ্রানাডা দখলের পর আমি শহরের দুর্গ আলহামরার চূড়ায় রাজকীয় পতাকা উড়তে দেখেছি। ... এবং আমি দেখলাম মুরদের রাজা (আবু আব্দুল্লাহ) শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রানি এবং রাজকুমারের হাতে চুমু খেলেন...।’
কলম্বাসের ডায়েরিতেও পরাজয়ের দিন মসজিদে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারার কোনো তথ্য নেই। পরবর্তী কয়েকমাসের দিনপঞ্জিও পাওয়া গেছে তবে সেগুলোর মধ্যেও এধরনের কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই।
এ বছরের অক্টোবর মাসেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস ভারত উপমহাদেশ আবিস্কারের উদ্দেশে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যদিও তিনি ভারত আবিস্কার না করে আবিস্কার করেন আমেরিকা মহাদেশ। সুতরাং এ বছরটি ইতিহাসে খুবই গুরুত্ব বহন করে। তাই স্বভাবতই যেকোনো ইতিহাসবিদ কলম্বাসের প্রথম সমুদ্রযাত্রার পূর্বাপর পরিস্থিতি এবং সময়ক্রম বর্ণনা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কলম্বাসের জীবনীর কোথাও ১ এপ্রিলের কোনো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। অথচ পহেলা এপ্রিল তিনি গ্রানাডায় উপস্থিত ছিলেন। সে সময় উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটলে তার মতো একজন সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তি তা এড়িয়ে যাবেন বলে মনে করাটা বোকামি।
অনেকেই বলতে পারেন, খ্রিস্টানদের দ্বারা লিখিত ইতিহাস মেনে নেয়া যায় না। তাদের জন্য আল-মাকারির উদ্ধৃতি এবং সে সময়কার অন্যান্য মুসলিম ঐতিহাসিকদের রচনা পড়ার পরামর্শ থাকবে। সেগুলোর কোনোটিতেই এপ্রিল ফুল বা এপ্রিলের ১ তারিখের কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।

হ্যাঁ, একথা সত্য যে, পরবর্তী সময়ে স্পেনের খ্রিস্টান শাসকরা মুসলমানদের ওপর বহুবিধ নির্যাতন চালিয়েছে। এমনকি গ্রানাডায় মুসলমানদের পরাজয়ের কয়েক বছর পর যেসব মুসলমান তখনও স্পেনে ছিলো তাদের স্পেন থেকে বিতাড়িত করার জন্য খ্রিস্টানরা অমানবিক নির্যাতন চালানো শুরু করে। সেখানকার মসজিদগুলো গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়, বাজেয়াপ্ত করা হয় মুসলমানদের সম্পত্তি, অনেককে তাড়িয়ে দেয়া হয় দেশ থেকে। এছাড়াও মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করা হয় চরমভাবে।

নতুন ইতিহাস
এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, খ্রিস্টানদের এই নির্যাতনের আওতায় কেবল মুসলমানরাই ছিলো না বরং গ্রানাডার অধিবাসী প্রায় তিন লাখ ইহুদিকেও এই একই ভাগ্যবরণ করতে হয়। উপরন্তু ইহুদিদের ওপর খ্রিস্টানরা মুসলমানদের চেয়ে বেশি নির্যাতন চালায় এবং ১৪৯২ সালের ৩১ মার্চ [এই তারিখটি স্মরণ রাখা প্রয়োজন] রানি ইসাবেলা ও রাজা ফার্ডিন্যান্ড ইহুদিদের দমনে ‘আল-হামরা ডিক্রি’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। সেখানে ইহুদিদের দুটি প্রধানশর্ত দেয়া হয়। এক. যদি স্পেনে থাকতে চাও তবে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করতে হবে; দুই. অন্যথায় এ দেশ থেকে চলে যেতে হবে। ষড়যন্ত্রপ্রিয় এবং দাঙ্গাপ্রিয় ইহুদিদেরকে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে স্পেন থেকে তাড়ানো হয়।

১৪৯২ সালের মার্চে যদিও স্পেনের ইহুদিদের ৩ মাসের সময় দিয়ে আল-হামরা ডিক্রি জারি করা হয় কিন্তু এ ডিক্রির আওতায় মুসলমানরা ছিলো না। কেননা ২ জানুয়ারি ১৪৯২ সালে যে ‘ট্রিটি অব গ্রানাডা’ স্বাক্ষরিত হয় সেখানে মুসলমানদের সঙ্গে এ ধরনের কোনো আচরণ করা হবে না বলে শর্তারোপ করা ছিলো। তাই খ্রিস্টান শাসকরা কার্যত তখনো মুসলমানদের ওপর প্রত্যক্ষ কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারেনি।
কিন্তু এর কিছুদিন পর থেকেই ক্রমান্বয়ে খ্রিস্টানরা গ্রানাডাচুক্তির শর্তগুলো ভাঙতে শুরু করে এবং ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে তারা তাদের স্বরূপে আবির্ভূত হয়। ইহুদিদের মতো মুসলমানদেরকেও একই শর্ত দিয়ে নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়; হয় তোমাদের খ্রিস্টান হতে হবে নয়তো ছাড়তে হবে স্পেন।

এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত বেদনাবহ এবং করুণ। প্রাণের ভয়ে হাজার হাজার মুসলমান খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে, নিজেদের মুসলিম পরিচয় বিসর্জন দিয়ে গ্রহণ করে ক্যাথলিকিজম। যাদের সামর্থ্য ছিলো তারা মাতৃভূমি ছেড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে। আর এভাবেই একসময় সমগ্র স্পেন হয়ে পড়ে মুসলিমশূন্য এক খ্রিস্টান দেশ।
অনেকেই মনে করতে পারেন যে, এই দেশত্যাগ এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার সময়ে হয়তো এপ্রিল ফুল ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আল-মাকারি বা অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ মুসলমানদের স্পেনত্যাগের যে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন সেখানে এমন কোনো তথ্য পরিবেশিত হয়নি।
নির্ভরযোগ্য তথ্যের ওয়েবসাইট উইকিপিডিয়াতে মুসলমানদের স্পেনত্যাগের বিষয়টি অত্যন্ত নিরাবেগভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে-
সূত্র: http://en.wikipedia.org/wiki/ Morisco#Genetic_legacy_of_Moriscos _in_Spain

এ বিষয়টি নিয়ে ২০০৯ সালের ৪ সেপ্টেম্ব বিবিসি Muslim Spain (711-1492) নামে একটি ডকুমেন্টারি আর্টিকেল প্রকাশ করে। আর্টিকেলটির একদম শেষদিকে বলা হয়-
The Muslims finally lost all power in Spain in 1492. By 1502 the Christian rulers issued an order requiring all Muslims to convert to Christianity, and when this didn't work, they imposed brutal restrictions on the remaining Spanish Muslims.
“মুসলিমরা চূড়ান্তভাবে তাদের ক্ষমতা হারায় ১৪৯২ সালে। ১৫০২ সালে খ্রিস্টান সরকার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সমস্ত মুসলমানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আদেশ দেয়; সবাই সেটি মান্য না করায় তাদের ওপর নেমে আসে পাশবিক নির্যাতন।”
সূত্র : Click This Link

আমাদের এতোক্ষণের আলোচনা দ্বারা আমরা এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছি যে, স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাসে এপ্রিল ফুল বলতে কিছু নেই এবং পহেলা এপ্রিলেরও কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এবং অধুনা আমরা যে ‘এপ্রিল ফুল’ বলে বেদনাহত হই সেটাও নিতান্ত আবেগী অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে এপ্রিল ফুল বিষয়টি কোথা থেকে এলো? কেনোই বা এটি আমাদের সংস্কৃতিতে সংযোজিত হলো? সে বিষয়টিও অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক।

(চলবে)

আগামী সংখ্যায় দেখুন : তাহলে এপ্রিল ফুল আসলে কী?

২য় পর্ব - Click This Link

১ম পর্ব - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:৫৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×