somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্থান পরিবর্তন !

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিচের ছবিটি গত বছর আমার বারান্দার ব্যালকনি থেকে তোলা । তখনো শীত শুরু হয় নি । সবে মাত্র হালকা স্নো পড়া শুরু হয়েছিল ।
কুমিল্লা শহর !
২০০৩ সাল ডিসেম্বর মাস ! মফস্বল থেকে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ডিসেম্বরে ই মাসেই বাবা আমাকে শহরে নিয়ে আসে । বাবার উদ্দেশ্য আমাকে জিলা স্কুলে পরীক্ষা দেওয়াবে । নিকট আত্মীয় একজনের বাসায় উঠলাম । এক জন শিক্ষক ঠিক করে , রাস্তা চিনিয়ে পরদিন বাবা গ্রামে ফিরে গেলেন ।
ওত টুকু বয়সে শহরের দালান কোঠায় আবদ্ধ জীবন আমার ভালো লাগে নি । সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে ৭ টায় স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়া । পড়া শেষ করে বাসায় ফিরে আসা । প্রথম প্রথম স্যার কে খুব ভয় পেতাম । সব সময় স্যার সিরিয়াস থাকতেন । গ্রামের শিক্ষকদের মত হাসি-তামাশা করে পড়া শুরু করার মত নয় ।
বিকেল হলেই খুব খারাপ লাগতো । কারণ , শহরের নিয়ম হলো বিকেল ঘুমানো । কিন্তু আমাদের গ্রামের নিয়ম হলো বিকেল বেলা , স্কুল থেকে এসে ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খেলার মাঠে যাওয়া । ক্রিকেট , গোল্লাছুট , লুকোচুরি আরো কত কি খেলা । কিন্তু , শহরের আমার বন্ধি জীবন সেটার সুযোগ যে আমার নেই । বাসার সবাই ঘুমিয়ে পরতো কিন্তু কোনদিন আমার ঘুম আসে নি । আত্মীয়ের বাসায় তখন রঙিন টেলিভিশন ও ডিশ আছে । লুকিয়ে লুকিয়ে টিভি দেখতে চাইতাম কিন্তু আত্মীয়ের ধমক খেয়ে আবার ফিরে যেতাম । তখন গ্রামে টেলিভিশন থাকা যে কি সেটার বলে বোঝানোর মত না । এক গ্রামে ২/১ টা বাড়িতে মাত্র টেলিভিশন থাকত । আবার কোন কোন গ্রামে টেলিভিশন ই থাকতো না । তখন , শুক্রবার মানেই পিঁড়ি , পাটী বিছিয়ে বসে যেতাম সিনেমা দেখতে । আগে গেলে আগে জায়গা পাওয়া যাবে এটাই নিয়ম ছিলো । আবার কখনো কখনো লোকজন বেশি হওয়ার কারনে টেলিভিশনের মালিক ইচ্ছা করেই টেলিভিশন বন্ধ করে দিত । সেখান থেকে এসে শহরের রঙিন টেলিভিশন এর প্রতি সেই জন্যই একটু আগ্রহ বেশি ছিলো ।
ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করলাম । বুঝতে পারছিলাম , বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলো । তারপর শহরের অন্য একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো । কিন্তু বাবা আমাকে গ্রামে ফিরে নিয়ে যায় নি । তখন , আত্মীয়ের বাসায় ছেড়ে বাবা আমাকে হোস্টেলে উঠিয়ে দিলো । সেখানে তো বন্ধি জীবন । রটিন- মাফিক সব কিছু করতে হয় । কিছুই ভালো লাগে নি তখন । সারা দিন কান্না করতাম । কখনো বা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পরতাম । প্রতি সপ্তাহে বা পনের দিন পরে বাবা এসে দেখা করে যেত । অনেক কিছু কিনে দিত । কিন্তু , আমি গ্রামে যাব বাবাকে এই কথা বলার সাহস তখন আমার হয় নি । মাঝে মাঝে বাবা আসতে না পারলে অন্য কোন আত্মীয় পাঠাত আমার সাথে দেখা করতে তখন আত্মীয় কে খুব কান্নাকাটি করে বলতাম আমাকে বাড়ি নিয়ে । কিন্তু কোন আত্মীয় আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায় নি । এখনো মনে পড়ে , বাবার সাথে বড় ভাই আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো । আমার কান্না দেখে বড় ভাই নিজেই কান্না করতে করতে বাবাকে বললো আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে কিন্তু বাবা নেয় নি । এইসব ঘটনা যখন পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে তখন বাবা এক সময় জেদ করে আবার গ্রামের স্কুলে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয় । আবার আমার গ্রামে ফিরে চলা । এক সময় গ্রাম থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিলাম ।
ঢাকা শহর !
২০১০ সালের জুলাই ।
আবার শহরে ফিরে আসা । এইবার আমার ইচ্ছাতেই ফিরে আসা । নটরডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয়েছি । প্রবল ইচ্ছার টানে শহরের জীবন শুরু করি ।কিছুদিন পর বুঝতে পারি শহর আমার জন্য নয় । তখন মেসে উঠেছিলাম গার্মেন্টস চাকরি জীবিদের সাথে । কারণ , কোন নিকট আত্মীয় তাদের বাসায় জায়গা নেই বলে রাখে নি । কলেজ থেকে এসে আমার মত করে ঘুমিয়ে পরতাম । সন্ধ্যায় রুমমেট রা চাকরি থেকে এসে হাসি -ঠাট্টা , তাস খেলা আরো কত কি করতো । তখন ঐ পরিবেশ টা আমার পড়ার জন্য উপযুক্ত ছিলো না সেটা আসতে আসতে বুঝতে পারি । এক নিকট আত্মীয় পরামর্শ দিলো ," তুই যদি কলেজ পাশ করে ভালো কোন ভার্সিটিতে সুযোগ না পাস তাহলে ন্যাশনাল ভার্সিটিতে পড়ে ৭/৮ বছর লেগে যাবে অনার্স পাস করতে । তার চেয়ে তুই পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে যা । ঐখান থেকে ৪ বছরে পাশ করে একটা চাকরি পেয়ে যাবি " । ওনার এই কথাটা আমার খুব মনে ধরেছিলো ।
কিছুদিন পর পলিটেকনিকে পরীক্ষা দিলাম । রেজাল্টে জানতে পারলাম আমি কুমিল্লায় সুযোগ পেয়েছি । বাবাকে বললাম , আমি নটরডেম ছেড়ে দিব । বাবার উত্তর বলে বোঝানোর মত না । অনেকটা বাবার অ-মতে নটরডেম কলেজ ছেড়ে আমার কুমিল্লায় ফিরে যাই । সে খানেই আমার ঢাকার জীবন সমাপ্তি হয় ।
পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে ঐ এলাকার একজন আমাকে লজিং করে দেয় । তিন বেলা থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে তাদের একজনকে পড়ানো । খুব নিকট লোকজন ছাড়া কাউকেই আজ পর্যন্ত এই লজিং কথা কাউকেই বলি নাই । কেন বলতে চাইতাম না সেটা সত্যি আমি জানি না । হয়ত ব্যাপারটা তখন অন্য ভাবে নিত । পলিটেনিক শেষ করলাম । অনেক টা নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেলাম আরএফএল কোম্পানিতে । পোস্টিং ,হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক , সিলেট । তল্পিতল্পা সহ চলে যাই হবিগঞ্জে । যেখানে কোম্পানি থেকে আমাকে কোয়ার্টারে থাকতে দেওয়ার হয় । ভাল ভাবেই দিন গুলো চলে যাচ্ছিলো । অল্প কিছু দিনে খুব ভালো কিছু কলিগ পেয়ে যাই । এবং আমার সিনিয়র বস আমাকে খুব ভালো ভাবেই দেখতেন । সব সময় বলতেন , কম চাপ দিতে । কিন্তু কিছু দিন চাপ বাড়তে থাকলো । কারণ, ইন্ডাস্ট্রি এর ভিতরে যে কোন জায়গায় যে কোন কন্সট্রাকশান কাজে দরকার হলে একমাত্র আমাদের দু-জন কেই ডাক দিত । কারণ , আমরা কমন ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনিয়ার । সবার কমন সমস্যা গুলোই সল্ভ করাই আমাদের দায়িত্ত ছিলো । কিছুদিন পর অফিসিয়াল নোটিশ এলো , আমাকে অন্য আরেকটা কোয়ার্টারে ট্রান্সফার করে দিসে । দুই দিনের মধ্যে আমাকে সেখানে যেতে হবে । খুব খারাপ লেগেছিলো । কারণ , যে জায়গাটা দিয়ে আমি প্রথম শুরু করি সে জায়গা টার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে গেসি । কেন জানি তখন মনে হয়েছিলো , অন্য জায়গায় গেলে আমার কোনভাবেই ভালো লাগবে না । এবং সেটাই হলো , অফিসিয়াল নোটিশে নতুন জায়গায় গেলাম । কিন্তু কোন ভাবেই ভালো লাগে নি । কিন্তু কাউকেই কিছু বলার মত ছিলো না । কাউকে বোঝাতেও পারছি না । আমি বুঝতে পারি , এটা কর্পোরেট লাইফ যে কোন পরিস্থিতিতে আমাকে যে ভাবেই সামাল দিতে । অতটুকু জ্ঞান আমার ছিলো । কিন্তু মন থেকে জায়গা পরিবর্তন করার ব্যাপারটি মানতে পারলাম না । কিন্তু , কাউকে বিষয় টি বুঝতেও দিচ্ছি না । একটা সময় রাগ করে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে চলে আসি । কিন্তু সেটা যে শুধু আমার জায়গা পরিবর্তন করার জন্য সেটা আজো কাউকে বলি নি । আমি জানি , এই কথাটা কাউকে বললে , সে হয়ত আমাকে রোগী ছাড়া আর কিছুই বলবে না । কিন্তু , আমি জানি এই ছোট ব্যাপারটা আমার মনে কতটুকু দাগ কেটে ছিলো ।
মস্কো , রাশিয়া !
২০১৬ সাল অক্টোবর মাস ।
চাকরীর ঘুছিয়ে গত বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ান ফেডারেশন বৃত্তি নিয়ে মস্কো তে চলে আসি । খুব ভালো ভাবেই শুরু টা হয়েছিলো । খুব ভালো ভাবে সব কিছু পাই । যেমন টা আমি মন থেকে চেয়েছিলাম । কিন্তু ইউনিভার্সিটির নিয়ম অনুযায়ী প্রথম বছরের বছরের পর প্রত্যেক ছাত্রকে তার জায়গা পরিবর্তন করতে হয় । কিছুদিন আগে আমাকে ব্যাপারটি জানিয়ে দেয় । কথাটা শোনার পর বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে । এই স্থান পরিবর্তন নিয়ে জীবনে অনেক কিছু আমি হারিয়েছি । অনেক মানুষ কে হারিয়েছি । অনেক ভালো কিছু সুযোগ হারিয়েছি । কিন্তু , কেউ কি বুঝতে পারে এই ছোট্ট একটা বিষয় আমার জীবনে কত বড় পরিবর্তন , ব্যবধান তৈরি করে । আমার ভিতরে কত বড় দাগ কাটে !!!

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৫৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×