somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুরোটা না শুনেই রায়: আবুল সরকার বিতর্কে আমাদের বিপজ্জনক অন্ধত্ব

২৮ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পুরোটা না শুনেই রায়: আবুল সরকার বিতর্কে আমাদের বিপজ্জনক অন্ধত্ব

বাংলার বিচারগান শুধু সংগীত নয়—এটি ছিল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যুক্তিবিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে তর্ক, রসিকতা, পাল্টা যুক্তি এবং দার্শনিক অনুসন্ধান মিলেমিশে তৈরি করত সামাজিক সহিষ্ণুতার পরম্পরা। এই পরম্পরারই এক উজ্জ্বল নাম আবুল সরকার। দয়ালভক্তির গীত, রসিক ভঙ্গির পাল্টা প্রশ্ন আর শ্রোতাদের টেনে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা—এসব মিলিয়ে তিনি বিচারগানের কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু এই মানুষটিকেই ‘ইসলাম অবমাননা’ ও ‘উসকানির’ অভিযোগে রাতারাতি গ্রেফতার করা হলো—যে অভিযোগের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে একটি অধ-শোনা, খণ্ডিত, প্রসঙ্গচ্যুত ভিডিও ক্লিপের ওপর।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হলো—
যারা অভিযোগ তুলেছেন, তাদের বড় অংশই আবুল সরকারের পুরো পালাটা শোনেননি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু কাটছাঁট করা ভিডিও, উন্মাদ মন্তব্য আর উত্তেজিত জনমত—এই তিন মিশ্রণে একজন শিল্পীকে জামিনবঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ বিচারগানের মতো ধারায় প্রসঙ্গ বিচ্ছিন্ন করলেই অর্থ বিকৃত হয়—এটা কোনো আলেম, কোনো শিল্পপ্রেমী, কোনো বুদ্ধিজীবীর অজানা নয়।

প্রমাণ?
দুজন আলেম—যাদের একজন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক—পুরো পালা শুনে স্পষ্ট বলেছেন,
“এতে ইসলামবিরোধী কোনো গুরুতর বক্তব্য নেই।”
বরং তারা অনুরোধ করেছেন, পালাটা নিয়ে মানিকগঞ্জের সংশ্লিষ্ট আলেমদের বসানো হোক, কারণ তাদেরও মনে হয়েছে—এটি সরাসরি ভুল–বোঝাবুঝি।

তাহলে প্রশ্ন উঠছে—
যখন ধর্মপ্রাণ সাধারণ শ্রোতা, এমনকি আলেমেরাও অবমাননা খুঁজে পান না, তখন পুলিশ–প্রশাসন কার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে একজন শিল্পীকে গ্রেফতার করল?

সাম্প্রতিক বাস্তবতা আরও অন্ধকার।
একদিকে বিচারগানের শিল্পীদের ওপর ডাকাডাকি—“একটা একটা বাউল ধর”, “জবাই কর”—এমন স্লোগান দেওয়া মিছিল। মানিকগঞ্জে বাউলদের ওপর হামলা। অন্যদিকে প্রশাসনের নিরবতা—এক ধরনের অনুমোদন।
অপরদিকে ‘অট্টহাসির অভিযোগে’ আবুল সরকারকে রাতারাতি গ্রেফতার।
এই বৈপরীত্য কেবল আইনি নয়—এটি সাংস্কৃতিক নিধনের ইঙ্গিত।

এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কিছু উগ্র গোষ্ঠী বুঝে ফেলেছে—
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দারুণ কার্যকর।
বাউল, ফকির, তরিকতপন্থীরা আজ তাদের প্রিয় লক্ষ্য। তারা রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, সংগঠিত নয়, তাই সহজ শিকার।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মতোই—বাংলাদেশেও দঙ্গলবাজিকে নির্বাচনী শক্তির প্রদর্শনী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এই বাস্তবতায় আবুল সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো একটি লক্ষণ—রোগটি আরও গভীরে।
এটি সংস্কৃতির দুই প্রান্তের ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ:
একদিকে আধুনিক মধ্যবিত্তের একরৈখিক ধর্ম–বোধ, অন্যদিকে উগ্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক উচ্চাশা। তাদের মাঝখানে পড়ে গেছে বিচারগান, পালাগান, হাজার বছরের লোকঐতিহ্য।

কিন্তু একটি সহজ প্রশ্নেই পুরো মামলার আসল চরিত্র প্রকাশ পায়—
পুরোটা না শুনে একজন শিল্পীকে গ্রেফতার—এটাই কি ন্যায়বিচার?

ধর্ম অবমাননার মামলায় অভিযোগ তো যে কেউ করতে পারে; কিন্তু গ্রেফতার, জামিনবঞ্চনা—এগুলো রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্র যখন এসব সিদ্ধান্ত নেয় অশোনা প্রমাণ ও উত্তেজিত জনমত দেখে, তখন সেটিই প্রকৃত ‘অট্টহাস্য’।

আরও গভীর বিপদ হলো—
আজ আবুল সরকার, কাল আরেকজন শিল্পী, পরিচালক, লেখক—কারও অধিকারই নিরাপদ থাকবে না।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব—কেউই এ দায় এড়াতে পারবেন না।
কারণ এটি ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার বিষয় নয়; এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বহুত্বের অস্তিত্বসংকট।

শেষ কথা—
পালা না শুনে রায় দেওয়া শুধু অন্যায় নয়—এটি মূর্খতা।
এটি বিচারগান নয়, এটি বিচারহীনতা।
গান গাইবার অধিকার কোনো গোষ্ঠীর ‘বোঝা–না–বোঝা’র ওপর নির্ভর করতে পারে না।
এ অধিকার রাষ্ট্রকে সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে—না হলে লালনের দেশেই লালনের উত্তরসূরিরা নিঃশেষ হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২১
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×