লেখকরা কেমন করে মনের কথাটা লিখে ফেলেন ভাবতে অবাক লাগে। পড়তে পড়তে দেখা যায় আরে আমি তো ভেবেছিলাম এই কথাটা শুধু আমিই ভাবি। অর্থাৎ কোন একটা ব্যাপার তাঁরা কিভাবে যেন পাঠকের মন মত করেই প্রকাশ করে ফেলেন। হতে পারে আমি একটা জিনিস যেভাবে ভাবি সেই জিনিসটাকে অনেকেই সেভাবেই ভাবে। কিন্তু প্রকাশটা সবাই করতে পারে না, পারেন আমার হাতে যেই বই তার লেখক। Aristotle এর ধারণা fiction লেখার আগে পুরো প্লট সাজিয়ে নিয়ে বসতে হয়। আসলেই কি তাই? আমি ঠিক জানি না। কেউ কেউ তো হঠাৎ করেই খুব চমৎকার একটা উপন্যাস বা গল্প বা কবিতাকে রূপ দিয়ে ফেলতে পারেন। তেমন চিন্তাভাবনা ছাড়াই। সারাজীবনে আমি কতবার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই পারি না। কেউ কেউ বলে সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। আবার কেউ কেউ বলে চেষ্টা করলে সবই হয়। ছোটকালে বেশ চেষ্টা চরিত্র করতাম, গল্প শেষও করতাম লিখে। কিন্তু পড়লেই বুঝে যেতাম প্রায় এই গল্পটাই কিছুদিন আগে কোথায় যেন পড়েছি। আবার বড়কালে খুব উৎসাহ নিয়ে যেই গল্পটা লিখতে শুরু করেছিলাম সেটা ছিল এমন...বছর চল্লিশেক বয়সের এক নারী স্বামীর সঙ্গে দেশের বাইরে থাকে। দু’জন সন্তান আছে তার। তার জীবনের একমাত্র প্রেমটা ব্যর্থ হয়। একদিন সে খালি বাসায় বসে দেশে ফেলে আসা পুরনো দিনের নানা কথা ভাবছে। বিশেষ করে এই পর্যন্ত যতজন পুরুষকে সে কাছ থেকে দেখেছে তাদের কথা। কারো জন্যই সে কোন টান অনুভব করে না এখন। জীবনে কি কি না পাওয়া আছে তাও ভাবছে। হঠাৎ করেই প্রাইমারিতে পড়ার সময়কার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথা মনে পড়ে যায়। শান্তশিষ্ট ধরণের একটা ছেলে যে খুব কম বয়সে মারা যায়। ছেলেটা মেয়েটার জন্য অনেক সময় নিয়ে একটা উপহার তৈরি করছিল। বলেছিল তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে সে একটা বিশাল সারপ্রাইজ দিবে। মেয়েটারও অধীর অপেক্ষা। এর মাঝেই ছেলেটা অসুখে পড়ে, কিছুদিন পর মারা যায়। বড় হতে হতে মৃত বন্ধুর কথা দিনে দিনে সে ভুলেই যায় অনেকটা। আজকে হঠাৎ করেই তার মনে হয় এত দামী ঘরবাড়ি গোছানো সংসার সব কিছু বৃথা। কখনোই জানা হবে না সেই সারপ্রাইজটা কি ছিল। সে প্রচন্ড অস্থির অনুভব করতে থাকে সেই উপহারটা হাতে পাওয়ার জন্য...এইরকম ছিল আমার গল্পটা যেটাকে কিছুতেই চেহারা দিতে পারিনি। দুই পৃষ্ঠা এগিয়েই শেষ।
এলেবেলে টাইপের কয়েকটা কবিতার কথা বাদ দিলে সারাজীবনে পেপারের দোর পর্যন্ত একটা গল্পই নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। দুঃখ ছিল যে সেখানে নিজের নামের আগে “সংগ্রহ” শব্দটা জুড়ে দিতে হয়েছে কারণ সেটা গ্রামে গিয়ে শোনা কাহিনীর লৈখিক রূপ, মৌলিক কিছু না। আমার হলদে রঙের খাতাটা হারিয়ে গিয়ে আমার টুকটাক ছড়া-গল্প লেখার নেশাটাকে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে। এখন হাজার কলম ঘষলেও এমনি এমনি বলা ছন্নছাড়া কথা ছাড়া আর কিছুই বেরিয়ে আসে না, যদিও এতে দুঃখ হয় না মোটেই। সেই বাচ্চাকালে কবি লেখক জাতীয় কিছু হবার বাসনা ছিল। অনেককাল পর ইচ্ছাটা আবার ফিরে এসেছে। এখন তাই মাথার মধ্য গুমরে মরছে একটা মেয়ের গল্প যে নিজের আর অন্যের সৃষ্ট প্যাঁচে বারবার আটকে যায়; একটা ছেলের গল্প যে অনেক অনেক কিছু পেয়েও সুখ হারিয়ে ফেলে; একটা বাচ্চার গল্প যার খুব একটা প্রাণঘাতী অসুখ; এক প্রৌঢ়ার গল্প, ঘর সাফ করতে গিয়ে একটা পুরানো চিঠি পেয়ে যার সব হিসাব এলোমেলো হয়ে গেল; এক বৃদ্ধের গল্প যাকে শৈশব ফিরিয়ে দেয়ার পরও জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা স্বেচ্ছায় আবার করে।
গল্প লেখার শখ হয়ত পূরণ করতে পারব না। অন্য কোন শখ পূরণ করে নেয়ার চেষ্টা করব নাহয় এর বদলে।