বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে পড়া শৈশবস্মৃতি নিয়ে লেখা রচনাগুলো ফেলনা মনে হত। নিজে শিশু ছিলাম বলে, শিশুকাল তখন চলন্ত অধ্যায় ছিল বলেই কিনা জানি না, পাতা উলটে পালটে দেখেও লেখকের জন্য কোন সহানুভূতি তৈরি হত না। সবসময় ভেবেছি এ আর এমন কি। আমি তো ছোটই, ছোট হবার মধ্যে এমন কিছু আনন্দ তো দেখি না যেটার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে এত হাপিত্যেশ করতে হবে। সেই ছোট হবার পালা যখন শেষ হয়েই গেল তখন বুঝতে পারি লেখকের সেই আস্ফালনের মর্ম। আয়নার দিকে তাকালে নিজের চেহারাটা কেমন কেমন যেন লাগে।
একসময় ভাবতাম কেমন করে বড়রা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়? একদিন কখন যে হেসেখেলে ম্যাট্রিকটা দিয়ে দিলাম টের পেলাম না। ভাবতাম সত্যিই কি ভার্সিটিতে পড়তে পারব? একদিন তত বড়ও হব? সেশন জ্যামে পড়ে ইলাস্টিক হয়ে যাওয়া ভার্সিটির জীবনটাও যে কখ্ন সহজেই কেটে গেল সেটাও ঠাহর করার সু্যোগ হল না। সামনে জ্বলজ্বলে হয়ে বিয়ের ঘণ্টা বাজতে শুরু হল একসময়, একটা অনিশ্চয়তা, আমি কি পারব অন্যদের মত ঘরসংসার করতে? একটা অন্য বাসায় গিয়ে একটা আস্ত পুরুষমানুষের সাথে বসবাস করার কথা চিন্তা করলেই গায়ে কাঁটা দিত। দিনে দিনে দেখলাম এটাও কোন অংশে কম সহজ না। বিয়ের প্রায় ছয় মাস হতে চলল। এককালে অনেক দূরের অনেক কঠিন মনে হওয়া সব সময়গুলোর কিছু পেরিয়ে গেছি কিছু পেরোচ্ছি।
এখন জীবন অনেকটাই অন্যরকম। সাদা চোখে সেটা ধরা পড়ে না খুব একটা যদিও। হুট করে সবসময়কার জন্য সঙ্গী পেয়ে গেছি একজন। মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে, আমাকে নিয়ে এতটা ভাবার কিংবা আমার জন্য এতকিছু করার কাজটা বাবা মা ছাড়া আরও কেউ পারে? এই বয়সেও উলটা পালটা ছেলেমানুষি কথা মন দিয়ে শুনে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলার জন্য আমার একটা সার্বক্ষণিক হাসিখুশি বন্ধু আছে? এখনও আমি থাকা খাওয়া আর ঘুম নিয়ে এত বেশি যত্ম পাই? একধরণের নির্ভার বোধ হয়। এই ভাল লাগাটার তুলনা করার কোন উপায় সত্যিই নেই।
তবু ছেড়ে আসা সময়টা পিছু পিছু ডাকে। মেরুন রঙের পর্দা টাঙানো ঘরটাতে আর এখন রোজ রোজ ফিরে যাই না। রাত হলেই গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে কালসিটে পড়া পিসিটার সামনে বসা হয় না। আব্বুকে এখন আর প্রত্যেক বিকালে ঠোঙায় ভরে পুরি নিয়ে বাসায় ঢুকতে হয় না। যখনই খুশি আমি পুরানো বাসাটায় ফিরে যেতে পারি, তবু কোথাও যেন একটা অন্যরকম হয়ে যাওয়ার সুতো ঝুলতে থাকে। প্রতিবেশিরা, আত্মীয়রা জিজ্ঞেস করে, কবে এসেছ? কতদিন থাকবে? যেন আমি এই বাসার কেউ না। তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বিশাল আলোচনা করার জন্য রুমের জানালাটায় ছুটে যাওয়া লাগে না, আমার প্রিয় বন্ধুটা এখন দেশের বাইরে চলে গেছে। ওর সাথে রাত করে করিডরে হেঁটে হেঁটে গল্প করা আর কখনও হবে কিনা কে জানে। তিন বন্ধু মিলে বাসায় রাত জেগে হুটোপুটি করাটার হয়ত ইতি ঘটেই গেছে।
একা একা থাকলে হঠাৎ কখনও ফেলে আসা সময়গুলির জন্য কান্না পেয়ে যায়। ভীষণ ইচ্ছা করে কয়েক বছর আগের সময়টাতে ফিরে যাই। কিন্তু তা তো সম্ভব না। আমরা মনে হয় কখনও খালি থাকি না। নতুন ভাল লাগা গুলো যোগ করতে গিয়ে পুরানো ভাল লাগাগুলোকে বিয়োগ দিতেই হয়। আবার পুরানো ভালবাসার বস্তুগুলোকে ফিরে পাওয়ার বিনিময়ে নতুন ভালবাসার বস্তুগুলোকে বিসর্জন দেয়ার সাহসও হয় না...