অনেকদিন পর রুদ্রদার কথা খুব মনে পড়ছে। ক্যামেরাটা হাতে নেয়ার পর থেকেই। দারুণ ছবি আঁকত রুদ্রদা, বলত, তোরা ক্যামেরায় ছবি তুলিস কেন? জীবনকে হাতের কারসাজিতে ফুটিয়ে তুলতে হয়, ক্যামেরায় তোলা ছবিতে তাকে আটকে রাখায় কোন কৃতিত্ব নেই। মুগ্ধ হয়েছিলাম কথাটায়। কবিতাও লিখত খুব ভাল। হয়ত এখনও তেমনই আছে। ভাবতে অবাক লাগে আমি কিভাবে এমন একটা মানুষের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আব্বার মৃত্যুর পর যখন মুরুব্বীরা সবাই আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন, আমি চোখে আঁধার দেখছিলাম। কি করে বলি তাদের বেছে নেয়া বিলাতফেরত তরুণের চেয়ে রোগাপটকা রুদ্রদাকেই আমার অনেক বেশি পছন্দ! তখনও আমি ভার্সিটিতে পড়ি, আব্বার ইচ্ছা ছিল না মাস্টার্সের আগে আমি বিয়ে করি। কিন্তু মরে গিয়ে তিনি আমাদের পুরো পরিবারটাকে অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন। আমি দেখতে ভাল না, আমার পর আরও দুই বোন আছে, টাকাপয়সাতেও আমরা খুব একটা স্বচ্ছল না এসব কারণ হঠাৎ করে অনেক বড় হয়ে গেল। কাউকে বোঝাতে পারলাম না আমি আরো অপেক্ষা করতে চাই। অপেক্ষা নিজেকে তৈরি করার জন্য, রুদ্রদাকে আমার মনের কথা জানানোর জন্য।
বলতে বাধা নেই এটা ছিল একেবারেই একতরফা প্রেম। আমাদের কয়েক ব্যাচ সিনিয়র ছিল রুদ্রদা, বাংলা ডিপার্টমেন্টে পড়ত। বন্ধু দীপার মাধ্যমে পরিচয় হলেও খুব দ্রুত আমরাই বন্ধু হয়ে যাই। তার চাহনি, কথার ভঙ্গী, কবি কবি ভাব, গম্ভীরতা কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আত্নভোলা চুপচাপ মানুষ আমার খুব ভাল লাগে। খুব ভারিক্কি হবে, একটু অগোছালো থাকবে, হালফ্যাশনের খবর রাখবে না, রাজনীতি কিংবা স্পোর্টস নিয়ে তর্ক করবে না, আমি ঠিক যা যা চাই তার সব বৈশিষ্ট্যই আছে এই মানুষটার মধ্যে। উঠতে বসতে রুদ্রদা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। একটা বিধর্মী ভবঘুরে টাইপ ছেলের কথা আমার রক্ষণশীল আব্বা কিভাবে নিবেন একথা কখনও ভাবিওনি। আর রুদ্রদা আমাকে ফিরিয়ে দিবে না এটা নিশ্চিত ছিলাম। আমি বুঝতাম আমাকেও তার ভাল লাগে। এই ভাল লাগা খুব সাধারণ না তাও বুঝতে পারতাম। ঠিক করেছিলাম কেউ রাজি না হলে দু’জনে হাত ধরে বেরিয়ে পড়ব। ও ভাল ছাত্র ছিল, চলনসই একটা চাকরি তো জুটবেই, আর আমিও একটা কাজ খুঁজে নিব। ছোটখাটো একটা বাসায় ছবি কবিতা গল্প আর ভালবাসায় জীবনটা কেটে যাবে সুখে। নাহয় স্বপ্নের দার্জিলিং না-ই গেলাম এই জীবনে, নাহয় নিজের মত করে সাজানোর জন্য একটা ফ্ল্যাটবাড়ি না-ই হল আমার। এসব দিয়ে কি করব যদি যাকে চাই সে-ই না থাকে? একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম সেই সময়টা। পৃথিবীতে কাউকে কখনও রুদ্রদার মত এত বেশি ভালবেসেছি বলে মনে হত না। দীপার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। ওর জন্যই এই মানুষটার সাথে দেখা হল।
আমাকে জানানো হল, বড়চাচার পছন্দের ছেলে ইংল্যাণ্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছে মাস কয়েক আগে। সুদর্শন, ভদ্র, মাল্টিন্যাশনালে ভাল বেতনের চাকুরে, উঁচু বংশ এসব লোভনীয় বিশেষণযুক্ত ওই ছেলের পরিবার একদিন হুট করে আমাদের বাসায় হাজির। দরজা খুলেছিলাম আমিই। এই নিয়ে বাসায় চাচাদের কত আপত্তি। এভাবে খবর না দিয়ে আসার কি মানে? মেয়েকে কি আমরা পুতুল করে সাজিয়ে আনতাম? অন্তত পরিপাটি হয়ে তো সে থাকতে পারত। আপ্যায়ন তো ভালভাবে করতে পারতাম। এসব ওদের চালাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। দুইদিন পর ফোন এল তাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। চাচারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ছেলেপক্ষ নাকি আসলেই যেমন ভদ্রলোক তেমন বুদ্ধিমান। না জানিয়ে আসাটাই তো ভাল, কোন বাহুল্য থাকে না, সত্যিকার আন্তরিকতাটা বুঝতে পারা যায়। সবার মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গেল, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই নাকি করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে। সেই পর্যন্ত বাইরে যাওয়া বন্ধ, নিতান্তই যেতে হলে বড়চাচী অবশ্যই সঙ্গে যাবেন।
আমার ছোটবোন মিতু সবকিছু জানার পর রুদ্রদার সাথে দেখা করেছিল, কয়েকবার। রুদ্রদা নাকি সব শুনে খুব আপসেট হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় উনার মা ছিলেন হাসপাতালে মৃত্যশয্যায়। উনি সময় চেয়েছিলেন, ওই মুহূর্তে এসব চিন্তা করার সময় ছিল না তার। আমার মনে হয় না রুদ্রদা কিছু করত। সংসারধর্ম নিয়ে তার কখনো আগ্রহ ছিল না। হেসেখেলে ঘুরেফিরে চলতে পারলেই তার জন্য যথেষ্ট। মিতুর সাথে অনেক কথাই হয়েছিল ওর। মিতু শুধু আমাকে বলেছিল আমি যেন এসব ভুলে যাই, যা সামনে আছে সেটাকেই গ্রহণ করি। ও এমনটা না বললেও এটাই করতে হত। খুব ভেঙে পড়েছিলাম আমি। সেই সময়কার বিস্বাদ দিনগুলোর একটিতে আমার বিয়ে হয়ে যায়।
আমার কর্পোরেট হাজব্যান্ড আসিফ প্রথম দিন থেকেই আমার সাথে হাসিখুশি আচরণ করে আসছিল। গল্পবাজ ছটফটে ধরণের মানুষ। খুব কথা বলছে, আমার খাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখছে, পানিটা এগিয়ে আনছে, ঘুমিয়ে গেলে কাঁথাটা জড়িয়ে দিচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন সারাক্ষণ হেসেখেলে কথা বলছে। এতসব যত্নআত্তি অসহ্য লাগত আমার। একদিকে রুদ্রদাকে হারানোর শোক অন্যদিকে কাউকে কিছু বুঝতে না দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা, দুইয়ে মিলিয়ে গিঁট পাকিয়ে যাচ্ছিল। আসিফের দিকে তাকিয়ে আমি কিছু একটা খুব খুঁজতাম, পেতাম না। তবে চেষ্টা করতাম স্বাভাবিক আচরণ করার। ওর এখানে কিই বা দোষ। আমার সাথে একটা বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পেরেছিল ও। অনেক কথা বলত আসিফ। সময় খারাপ কাটত না। ওর কলেজজীবনের কাহিনী শুনতে ভাল লাগত, ইংল্যান্ডের গল্প শুনতে ভাল লাগত। স্বামীসুলভ কোন কর্তৃত্ব করতে দেখতাম না। ধীরে ধীরে কিভাবে যেন আমি আসিফের বশবর্তী হয়ে যেতে থাকি। ওর সাথে আরো বেশি সময় থাকতে চাইতে লাগলাম। ওর বাসায় ফিরতে দেরি হলে অস্থির হতে শুরু করলাম। কিছুদিন পর বাবার বাড়ি থেকে বইপত্র আনিয়ে নিলাম, সামনে পরীক্ষা।
এই বাসায় কবে যে আমার বছর পার হয়ে গেল টেরই পাইনি। উড়ে উড়ে যেন সময় চলে যাচ্ছে। ভয় হচ্ছে কবে না জানি বুড়ো হয়ে যাই। সামনের দিনগুলো নিয়ে আমরা নানা প্ল্যান করি। আসিফকে নিয়ে আমার অনেক কল্পনা অনেক ভাবনা। অসাধারণ একটা মানুষকে আমি পেয়েছি। সবারই প্রিয়পাত্র ও। আমার ছোটবড় সব ব্যাপারে মনোযোগ দেয়। সারাক্ষণই সে হৈচৈ এর মধ্যে আছে, টিভিতে ফুটবল শুরু হলে আর হুঁশ থাকে না। অন্য বউদের মত আমাকে ওর শার্ট প্যান্ট কিংবা টাই মিলিয়ে দিতে হয় না, উলটো ও-ই আমাকে স্টাইল বুঝে কাপড় পছন্দ করে দেয়। খুব গোছালো আর পরিপাটি মানুষ ও। মনে মনে ভাবি, ছোটবেলা থেকে জীবনসঙ্গীর যেসব গুণ থাকুক চাইতাম তার সব ক’টাই আছে ওর। ওর মত এত বেশি আমি কাউকে কখনো ভালবাসিনি, বাসবও না।
ক্যামেরাটা আলতো হাতে মুছে তুলে রাখলাম। আসিফের শখের জিনিস। খুব ছবি তোলার নেশা ওর। প্রায়ই বলে, প্রকৃতির কোন কিছুই তো আমরা সৃষ্টি করতে পারব না, তাই ফ্রেমে ধরে রাখতে ইচ্ছা করে; ব্যাখ্যাটা ভালই লাগে। আমাকে বলা ওর প্রথম কথাটা ছিল এমন, “দেখ মিলি আমার কোন দোষ নেই, আমার এত তাড়াতাড়ি ইচ্ছা ছিল না, তোমার বড়চাচা আর আমার দুলাভাই মিলে আমাদেরকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আমার সাথে রাগ করলে কিন্তু চলবে না।” আমরা মাঝে মাঝে এই কথা নিয়ে হাসি। সবাইকে বলতে ইচ্ছা করে আমরা খুব সুখে আছি। বড়চাচার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তিনি সেইসময় জোর না দিলে আসিফ আজ না জানি কোথায় থাকত, আমি কোথায় থাকতাম।
আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, আগামী সপ্তাহে আমরা তিনদিনের জন্য দার্জিলিং বেড়াতে যাচ্ছি। ভাবতেই ভাল লাগছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১১:১৬