৩৭ বছরের সম্পর্ক আমাদের। আর সম্পর্কের শুরুটাই ছিল চুমু দিয়ে। ভাবা যায়! তখন কতোই বয়স! নবম শ্রেনীতে পড়ি। একটা বেয়ারা বালক কেমন করে যেন ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।
ওর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ কোথায় হয়েছিল, কিভাবে হয়েছিল- কিচ্ছু মনে নেই। ওটা কি মতিঝিল কলোনীর কোনো সিড়িঘর ছিল, নাকি কমলাপুরের কোনো রেস্টুরেন্ট অথবা রেল স্টেশন! কিম্বা হতে পারে ফৌজদারহাটের রবীন্দ্র হাউজের কোনো টয়লেটের লাগোয়া কাপড় শুকোনোর জায়গাটা। এসবের যে কোনো জায়গায় ওর সঙ্গে প্রথম দেখা প্রথম চুমু এবং ভালোবাসার শুরুটা হয়েছিল। তারপর সেই প্রেম দিন দিন গভীর হয়েছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের উভয়ের সম্পর্কে ও হয়ে উঠলো নিয়ন্ত্রা।
যখন প্রথম প্রেমে পড়ি কি নাম ছিল ওর? ‘স্টার’, ‘স্টার ফিল্টার’, ক্যাপস্ট্যান! স্টার’ই হবে। হাত খরচের পয়সা বাঁচিয়ে ওর চেয়ে দামি কারো প্রেমে পড়ার ক্ষমতা ছিল না। গত ৩৭ বছরে কতো নামে ওকে ডেকেছি। আচ্ছা, ‘এরিনমোর’ বা ‘ক্যাপস্ট্যান মিক্সচার’ কেমন আছো তোমরা? এখনো তেমন আছো! ১৭/১৮ বছর বয়সে তোমাদের ভালোবাসায় এমন মুগ্ধ ছিলাম। আহ্, কি একটা ঘোর লাগা গন্ধ ছিল তোমাদের!
তারপর জীবনে কতো উত্থান-পতন। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কখনো তা হয়নি। ওটা শুধুই উত্থানের গল্প। গোল্ডলিফ ছেড়ে ফাইফ ফিফটি ফাইভ, বেনসন অ্যান্ড হেজেজ। সংখ্যা, পরিমান আর আমাদের নির্ভরতা শুধুই বেড়েছে।
তোমাকে নিয়ে কতো স্মৃতি! বালক বয়সে তোমাকে লুকিয়ে রাখতে কি যে কস্ট হতো আর কতো ‘সৃজনশীল’ ছিলাম! পাড়ার কিম্বা কলেজের বড় ভাই, অভিভাবক, শিক্ষক- দূর থেকে বয়সী কাউকে দেখেই তোমাকে নিয়ে ভয়ে লুকোতাম। কলেজে তোমাকে লুকিয়ে রাখাটা রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।
মনে আছে, একবার মাগরিব প্রেয়ার থেকে ফিরছি। হাউজের ঠিক গেইটে ঘাপটি মেরে থাকা হাউস মাস্টার ‘জিসি বড়ুয়া’ বা গোপাল স্যার ধরে ফেললেন। বললেন, চলো- আজ তোমার কাবার্ড চেক করবো। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় খেলছে, আচ্ছা ক্যাপস্ট্যান মিক্সচারের প্যাকেটটা রেখেছি কোথায়? ভেন্টিলেটরের ফাঁকে নাকি ৫ বা ৬ নম্বর টয়লেটের গোপন কুঠরিতে? তা গোপাল স্যার তন্ন তন্ন করে কাভার্ড খুঁজছেন খুঁজছেন। আর কিছুক্ষণ পর পর একটা হাসি, হুম এইতো এইতো… বলে চিৎকার দিচ্ছেন। আরে না, তোমাকে না। কিছুক্ষণ পরপর এক একটি গোপন জায়গা থেকে এক একটা ভাঙা দেয়াশলাই বের করছেন আর ভাবছেন, বাবাজান আর একটু! আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন। মহা উৎসাহে এমন করে ৬ বা ৭ টা দেয়াশলাই তিনি ‘আবিস্কার’ করলেন! কিন্তু পেলেন না তোমাকে। বললেন, দাও কোথায় রেখেছো, বের করে দাও। ভালোর জন্য বলছি, বের করো।
আমি তো ভাজা মাছও উল্টে খেতে জানি না। বললাম, কি বলেন স্যার? কি বের করবো? “ক্যান বিড়ি? যেইডা খাও। আমার কাছে খবর আছে। হুম।” আমি বললাম, স্যার আপনি ভুল খবর পেয়েছেন আমি বিড়ি সিগারেট খাই না। “হুম, তাইলে এত্তো ম্যাচ ক্যান?” বললাম, স্যার প্রায়ই তো ইলেকট্রিসিটি থাকে না। মোমবাতি তো জ্বালাতে হয়। স্যার কি বুঝলেন জানি না। তখনকার মতো খ্যামা দিলেন।
তোমার জন্য আরো কত্তো ঝুঁকি যে নিতে হয়েছে! স্টক শেষ। মধ্যরাতে হাউজ বেয়ারা কালাম ভাই শেষ ভরসা। ঘুম থেকে তুলে বলতাম, বিড়ি দ্যান কালাম ভাই। অথবা সন্ধ্যা রাতে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ফৌজদারহাট বাজার থেকে ক্যাপস্ট্যান মিক্সচার কিনে ফেরা। কতো দিন ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়া। নিষিদ্ধ সম্পর্ক বড্ড টানে!
‘আব্বা’ মানে রসায়নের নুরুল ইসলাম স্যার নিজে থেকেই পরামর্শ দিতেন, জানি তোমরা অনেকে সিগারেট খাও। কিন্তু মনে কইরা লেবু খাইবা বেশি। লেবু ‘লাঙ্গ’ পরিস্কার রাখে।
তারপর বয়স যতো বেড়েছে, তোমাকে লুকিয়ে রাখার প্রয়োজনটা কমে এসেছে। আমার প্রতিদিনের ভাবনা, পরিকল্পনায় তুমি থাকো একটা বড় অংশ জুড়ে। গভীর রাত বা ভোরেও যেন তোমার অভাব না থাকে তেমন যথেষ্ট স্টক নিয়েই সবসময় চলেছি।
তুমি আমাকে জীবনে অনেক স্বস্তি দিয়েছো। প্রথম আলো’র বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শেষ রাতে শিরোনাম নিয়ে অসন্তুস্টি দূর করতে সিড়িঘরে দাঁড়িয়ে তোমাকে চুমু খেতে খেতে কতো সব মনে রাখার মতো শীর্ষ শিরোনাম তৈরি করেছি! আহ্, সেই দিনগুলো এখনো মিস করি।
গতবছর ৬ সপ্তাহের সফরে আমেরিকা গেলাম। ঢাকা থেকে ৩ কার্টন নিলাম। দুবাই থেকে আরো ২ কার্টন যুক্ত হলো। অথচ শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্কে ৭০ ডলারে আরো ১ কার্টন কিনতে হয়েছিল! আসলে ৩৭ বছরের মধ্যে ৩৫ বা ৩৬ বছর তুমি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছো। আমাকে তোমার মতো করে বা তোমার চাহিদা মতো চলতে বাধ্য করেছো। আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা ক্রমেই অসম হয়ে উঠেছে। এমন একটা সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন চলা যায় না।
তাই একমাস আসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ১৫ সেপ্টেম্বর,২০১৩ হবে তোমার আমার বিচ্ছেদের দিন। তোমার স্বার্থে নয়, আমার স্বার্থেই এই বিচ্ছেদ প্রয়োজন। এই জগতের তাবৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি। সুরার আয়োজনে বসে চাইলে এক ফোটাও পান না করে থাকতে পারি। কিন্তু আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছো তুমি!
জানি, ৩৭ বছরের সম্পর্কে বিচ্ছেদ সহজ কাজ নয়। তোমাকে ছাড়া আমার ৩৭ ঘণ্টা এখনো পার হয়নি। তবু নিজের এই সিদ্ধান্তটা আমি সবাইকে জানিয়ে রাখতে চাই, তোমার আমার বিচ্ছেদের শুরু হলো মাত্র। এই সিদ্ধান্তে অটল থাকা কঠিন জানি তবে অসম্ভব হবে না আশা করি। কারণ আমার নিয়ন্ত্রা কেবল আমি হতে চাই। আমার রক্তে বসবাস করলেই তুমি আমার চালক হওয়ার অধিকার পেতে পারো না।
বিদায় আমার তিন যুগের ভালোবাসা, বিদায়। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
মূল লেখক- সানাউল্লাহ