somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামী রাজনীতি/ইসলামী রাষ্ট্র বিহীন ইসলাম কোন ইসলামই নয় : পর্ব-৩৫ - দাজ্জালের পরিচিতি

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৫:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের কথা বলার পর আল্লাহর রসুল তার সম্বন্ধে বেশ কতকগুলি চিহ্ন বোলে গেছেন যাতে তাঁর উম্মাহ দাজ্জাল (Dajjal)কে দাজ্জাল (Dajjal) বোলে চিনতে পারে ও সতর্ক হয়, তাকে গ্রহণ না করে এবং তার বিরোধিতা করে, তাকে প্রতিরোধ করে। এগুলো একটা একটা কোরে পেশ কোরছি। এক দিক দিয়ে বইয়ের এই অধ্যায়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দাজ্জাল (Dajjal)কে দাজ্জাল (Dajjal) বোলে আমরা যদি চিনতেই না পারি তবে আমাদের বিপদের সম্ভাবনা বহু বেশী হোয়ে যায়। এ অনেকটা এমন যে শত্রু যদি বন্ধু সেজে আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে এবং আমরা তাকে শত্রু বোলে না চিনি তবে বিপদের ঝুঁকি কত বেশী হোয়ে যায়। এ জন্যই বোধহয় আল্লাহর রসুল দাজ্জাল (Dajjal)কে যাতে আমরা সহজেই চিনতে পারি সেজন্য অনেকগুলি চিহ্ন বোলে গেছেন। কিন্তু ঐসঙ্গে এ কথাও বোলে গেছেন যে প্রকৃত মো’মেন ছাড়া, মহাপণ্ডিত হোলেও দাজ্জাল (Dajjal)কে দাজ্জাল (Dajjal) বোলে চিনতে পারবে না, যদিও দাজ্জালের কপালে “কাফের” শব্দটি লেখা থাকবে। আর মো’মেন নিরক্ষর হোলেও দাজ্জাল (Dajjal)কে দাজ্জাল (Dajjal) বোলে চিনতে পারবে (এই অধ্যায়েরই ১১ নং হাদীস)।



এক ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জাল (Dajjal) ইহুদী জাতির মধ্যে থেকে উত্থিত হবে এবং ইহুদী ও মোনাফেকরা তার অনুসারী হবে। [ইবনে হানবাল (রাঃ) থেকে মোসলেম]


এই হাদীসটির বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না কারণ বর্ত্তমানের জড়বাদী (Materialistic) সভ্যতা যে ইহুদী জাতি থেকে জন্মেছে তা দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের এক নম্বর হাদীসেই বিশ্লেষণ কোরেছি। তাছাড়া এই সভ্যতার প্রচলিত নামই হোচ্ছে ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতা (Judeo-Christian Technological Civilization)। নামকরণেই বংশ পরিচয় স্বীকার কোরে নেয়া হোয়েছে। ইহুদী ও খৃষ্টানরা যে এর অনুসারী হবে তা তো স্বাভাবিক কিন্তু মহানবী যে মোনাফেকদের অন্তর্ভুক্ত কোরলেন তার অর্থ হোচ্ছে এই যে, মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতিটি প্রায় সম্পূর্ণটাই দাজ্জাল (Dajjal)কে তার দাবি মোতাবেক রব অর্থাৎ প্রভু বোলে মেনে নেবে এবং নিয়েছে। মোনাফেকদের সংজ্ঞা অর্থাৎ ‘মুখে এক কথা বলা আর কাজে অন্যটা করা’ অনুযায়ী এরা মোনাফেকের পর্যায়ে পড়ে। নিজেদের মোসলেম বোলে পরিচয় দিয়ে, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাহ ও নানাবিধ এবাদত কোরেও আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান কোরে দাজ্জালের শেখানো মানুষের সার্বভৌমত্বকে জাতীয় জীবনে স্বীকার কোরে নেয়া যদি মোনাফেকী না হয় তবে আর মোনাফেকী কি?



দুই ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জাল (Dajjal) নিজেকে মানুষের রব, প্রভু বোলে ঘোষণা কোরবে এবং মানবজাতিকে বোলবে তাকে রব বোলে স্বীকার কোরে নিতে। [বোখারী]


দাজ্জালের এই দাবী “আমাকে প্রভু বোলে স্বীকার করো” এর অর্থ কি? এর অর্থ হোচ্ছে এই যে দাজ্জাল (Dajjal) পৃথিবীর মানুষকে বোলবে যে, আমি মানুষের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা দিচ্ছি, যে আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, শিক্ষা-ব্যবস্থা দিচ্ছি তা তোমরা গ্রহণ ও প্রয়োগ করো। তোমরা বহু পুরাতন বেদ, মনু-সংহিতা ও কোরান-হাদীস নিঃসৃত যে আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি ইত্যাদি জীবনে প্রয়োগ কোরছিলে তা পুরানো, অচল ও বর্বর; ওগুলো ত্যাগ কোরে আমি যে অতি আধুনিক আইন-কানুন দিচ্ছি তা গ্রহণ করো ও তোমাদের সমষ্টিগত জীবনে প্রয়োগ করো। তা হোলে তোমরা আমাদের মত সভ্য হবে, সমৃদ্ধিশালী, ধনী ও শক্তিশালী হবে। তোমাদেও জীবন যাত্রার মান আমাদের মত উন্নত হবে। আমরা যেমন স্বর্গসুখে আছি তোমরাও এমনি স্বর্গসুখ ভোগ কোরবে। দাজ্জাল (Dajjal) রব, প্রভু হবার দাবী কোরছে কিন্তু স্রষ্টা হবার দাবী কোরছে না। পাশ্চাত্যের ইহুদী খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতা ও শক্তি ঠিক এই প্রভুত্বের, রবুবিয়াতের দাবিই কোরছে, মানুষের স্রষ্টা হবার দাবি কোরছে না। সে বোলছে ব্যক্তিগত জীবনে তোমরা হিন্দু, মোসলেম, খৃষ্টান, ইহুদী, জৈন, বৌদ্ধ যা থাকতে চাও থাকো এবং যত খুশি তোমাদের আল্লাহকে, ঈশ্বরকে, গডকে, এলীকে ডাকো। যত খুশি নামাজ পড়ো, রোযা করো, হজ্ব করো, প্রার্থনা করো আমার কোন আপত্তি নেই কিন্তু সমষ্টিগত জীবনে আমার রবুবিয়াহ্‌, প্রভুত্ব মেনে নাও। এখানে তোমাদের স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান কোরে আমি যে জনগণের, একনায়কের, কোন বিশেষ শ্রেণীর, সংখ্যাগরিষ্ঠের অর্থাৎ এক কথায় মানুষের সার্বভৌমত্ব সৃষ্টি কোরেছি, তার যে কোন একটাকে মেনে নাও।

আজ মানবজাতি দাজ্জালের ঐ দাবি মেনে নিয়েছে এবং মেনে নেয়ায় দাজ্জাল (Dajjal) মানবজাতিকে তার কাছে যে জান্নাতের মত জিনিসটি আছে তাতে প্রবেশ কোরিয়েছে। তাই আজ সমস্ত মানবজাতি জাহান্নামের আগুনে পুড়ছে। সমস্ত পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নেই। একটি মাত্র দম্পতি থেকে সৃষ্ট হোয়েও, একটিমাত্র জাতির অন্তর্ভুক্ত হোয়েও (কোরান সুরা বাকারা, আয়াত ২১৩; সুরা ইউনুস, আয়াত ১৯; সুরা নেসা, আয়াত ১) মানুষ একে অপরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা কোরছে, আগুনে পুড়িয়ে মারছে, তাদের বাড়ী ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ কোরছে। দাজ্জালের অর্থনীতি গ্রহণ করার ফলে মানুষের মধ্যে কেউ কোটি কোটি মুদ্রার মালিক হোয়ে জঘন্য বিলাস-ব্যাসনের মধে ডুবে আছে আর কেউ না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে, খেতে পরতে দিতে না পেরে নিজেদের ছোট ছোট বাচ্চা সন্তানদের হত্যা কোরে নিজেরা আত্মহত্যা কোরছে, মা গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা কোরছে, পেটের সন্তান অন্যের কাছে বিক্রি কোরে দিচ্ছে; আল্লাহর দেয়া দণ্ডবিধি প্রত্যাখ্যান কোরে দাজ্জালের দণ্ডবিধি গ্রহণ করায় সর্বরকম অপরাধ চুরিডাকাতি, হাইজ্যাক, অপহরণ, ছিনতাই, খুনজখম, ধর্ষণ প্রতি দেশে, প্রতি জাতিতে ধাঁ ধাঁ কোরে বেড়ে চোলেছে; আল্লাহর দেয়া শিক্ষা ব্যবস্থা ত্যাগ কোরে দাজ্জালের দেয়া আত্মাহীন, আল্লাহহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে মানুষ তার নৈতিক চরিত্র হারিয়ে পশুর পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে।

সাজদা অর্থ আত্মসমর্পণ, কাউকে সাজদা করার অর্থ তার কাছে আত্মসমর্পণ কোরে তার আদেশ নির্দেশ মেনে চলা- তাই আল্লাহ তাঁকে ছাড়া আর কাউকে সাজদা করা নিষেধ কোরেছেন। কিন্তু মোসলেমসহ সমস্ত মানবজাতি আজ দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদী খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার পায়ে আত্মসমর্পণ কোরেছে, তার পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে। এক কথায় এবলিস মানবজাতিকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব থেকে, তওহীদ থেকে বিচ্যুত কোরে তাকে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় পতিত করার যে চ্যালেঞ্জ আল্লাহকে দিয়েছিলো আজ তাতে সে সক্ষম হোয়েছে, আজ সে জয়ী অবস্থায় আছে।



তিন ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের বাহনের দুই কানের মধ্যে দূরত্ব হবে সত্তর হাত। [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বায়হাকী, মেশকাত]


আরবী ভাষায় সত্তর বোলতে সাতের পিঠে শুন্য দিলে যেমন ৭০ বোঝায় তেমনি এর আরও একটা ব্যবহার আছে। সেটা হোল কোন সংখ্যাকে বহু বা অসংখ্য বোঝাবার জন্যও ঐ সত্তর সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। এটা শুধু ঐ সত্তর সংখ্যা দিয়েই করা হয়, অন্য কোন সংখ্যা, যেমন পঞ্চাশ বা একশ’ দিয়ে করা হয় না। এই হাদীসটায় বিশ্বনবী দাজ্জাল (Dajjal) যে বিশাল, বিরাট কিছু এই কথাটা রূপকের মাধ্যমে বোলেছেন। বাহনের দুই কানের মধ্যকার দূরত্ব বহু হাত হোলে, বাহনটা কত বড় এবং তাহোলে সেই বাহনের আরোহী কত বড়। এই প্রসঙ্গে এখানে আরেকটি হাদীস পেশ কোরতে চাই। এ হাদীসটি আমি ছাত্রজীবনে ভারতের মধ্যপ্রদেশের একজন বড় আলেমের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তখন ওটার উৎস লিখে রাখি নি এবং এখন আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। হাদীসটি হোল, আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের ঘোড়ার বা গাধার (বাহনের) এক পা পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে, অন্য পা পশ্চিমপ্রান্তে হবে। এ হাদীসটি আমি সহিহ বোলে বিশ্বাস কোরি, কারণ ওপরে আবু হোরায়রার (রাঃ) ঐ হাদীসটির এটি পরিপূরক ও একার্থবোধক। দু’টোরই অর্থ দাজ্জাল (Dajjal) ও তার বাহন উভয়ই বিরাট, বিশাল ও পৃথিবীব্যাপী।

বর্ত্তমানে পৃথিবীতে ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার চেয়ে বড়, এর চেয়ে শক্তিধর কিছুই নেই, এ কথায় কেউ দ্বিমত কোরতে পারবেন না, এটা সন্দেহাতীত সত্য। এই শক্তির কাছে সমস্ত পৃথিবী নতজানু হোয়ে আছে, এর পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে। কারো সাধ্য নেই এই সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার বা একে প্রতিরোধ করার। আরোহী দাজ্জাল (Dajjal) হোচ্ছে ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা আর তার ঘোড়া বা বাহন হোচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত যন্ত্র (Scientific Technology)। এই বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত যন্ত্রই হোচ্ছে এর মহাশক্তি। এই সভ্যতার যন্ত্র আজ পৃথিবীর সর্বত্র। এ এত শক্তিশালী যে এর পারমাণবিক অস্ত্র (Nuclear weapons) আজ এই পৃথিবীকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে। বিশ্বনবীর রূপক বর্ণনার শাব্দিক অর্থ নিয়ে যারা বিরাট এক ঘোড়ায় উপবিষ্ট একচক্ষু এক দানবের অপেক্ষায় আছেন, এই দুইটি হাদীসই তাদের ভুল ধারণা শোধরাবার জন্য যথেষ্ট মনে কোরি। দুই কানের মধ্যে শত শত বা হাজার হাজার হাত দূরত্ব বা পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই পা, এমন বাহন কি সম্ভব বা বাস্তব? এটা নড়াচড়া কোরবে কোথায়? এরপরও যারা ঐ ধারণা নিয়ে থাকবেন তারা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের ধারণার (আকীদার) দাজ্জালের জন্য অপেক্ষা কোরতে পারেন।



চার ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের গতি হবে অতি দ্রুত। সে বায়ুতাড়িত মেঘের মত আকাশ দিয়ে উড়ে চোলবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রাঃ) থেকে মোসলেম, তিরমিযি]


এই হাদীসের বেশী ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না। দাজ্জাল (Dajjal) অর্থাৎ পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতার তৈরী এরোপ্লেন যখন আকাশ দিয়ে উড়ে যায় তখন যে সেটাকে বায়ুতাড়িত অর্থাৎ জোর বাতাসে চালিত মেঘের টুকরোর মত দেখায় তা কেউ অস্বীকার কোরতে পারবেন কি?



পাঁচ ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের আদেশে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ হবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রাঃ) থেকে মোসলেম, তিরমিযি]


বর্ত্তমান ইহুদী খৃষ্টান সভ্যতার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি (Scientific Technology) আকাশে হালকা মেঘের ওপর রোপ্লেন দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ (Chemicals) ছিটিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারে এ কথা তথ্যাভিজ্ঞ প্রত্যেক লোকই জানেন। পৃথিবীর বিভিন স্থানে ঐ প্রক্রিয়ায় কৃষি কাজের জন্য বৃষ্টি নামানো হোচ্ছে। সন্দেহ হোলে যে কোন আবহাওয়া বিজ্ঞানীর (Meterologist) বা কৃষিবিদের (Agriculturist) কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।



ছয় ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের গরু-গাভী, মহিষ, বকরি, ভেড়া, মেষ, ইত্যাদি বড় বড় আকারের হবে এবং সেগুলোর স্তনের বোটা বড় বড় হবে (যা থেকে প্রচুর পরিমাণে দুধ হবে)। [নাওয়াস বিন সা’মান (রাঃ) থেকে মোসলেম, তিরমিযি]।


তথ্যাভিজ্ঞ প্রতিটি লোকই জানেন যে ইউরোপ, আমেরিকার অর্থাৎ পাশ্চাত জগতের Cattle অর্থাৎ গরু মহিষ, বকরী ভেড়া ইত্যাদি প্রাণীর আকার বাকি দুনিয়ার ঐসব গৃহপালিত পশুর চেয়ে অনেক বড়, কোন কোনটা একেবারে দ্বিগুণ এবং ওগুলো প্রাচ্যের পশুগুলির চেয়ে চারপাঁচ গুণ বেশী দুধ দেয়। ও দু’টোই ওরা সম্ভব কোরেছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে।



সাত ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জাল (Dajjal) মাটির নিচের সম্পদকে আদেশ কোরবে ওপরে উঠে আসার জন্য এবং সম্পদগুলি ওপরে উঠে আসবে এবং দাজ্জালের অনুসরণ কোরবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রাঃ) থেকে মোসলেম, তিরমিযি]


দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার জন্মের আগে ভূগর্ভস্থ অর্থাৎ মাটির গভীর নীচের খনিজ সম্পদ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত ছিলো। মাটির সামান্য নিচের কিছু কিছু সম্পদ মানুষ কখনো কখনো আহরণ কোরতে পারতো। এই সভ্যতার সৃষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির উন্নতির ফলে দাজ্জাল (Dajjal) মাটির গভীর নীচ থেকে, এমনকি সমুদ্রের তলদেশ থেকে তেল, গ্যাস ইত্যাদি নানা রকমের খনিজ সম্পদ ওপরে উঠিয়ে আনতে সক্ষম হোয়েছে ও পৃথিবীময় তা ওঠাচ্ছে। এটাকেই মহানবী বোলেছেন যে, দাজ্জালের আদেশে মাটির নিচের সম্পদ ওপরে উঠে আসবে। তারপর ঐ সম্পদ দাজ্জাল (Dajjal)কে অনুসরণ কোরবে তার অর্থ হোল এই যে, মাটির নিচ থেকে ওপরে উঠে আসার পর দাজ্জাল (Dajjal) তা পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যাবে, যেখানে ইচ্ছা পাঠাবে, ঐ সম্পদ দাজ্জালের যন্ত্রপাতি, কল-কারখানা, জাহাজ, গাড়ী, যুদ্ধের যানবাহন ইত্যাদি সমস্ত কিছুতে ব্যবহার কোরবে। আজ বিশ্বনবীর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যায়িত হোয়েছে।



আট ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের কাছে রেযেকের বিশাল ভাণ্ডার থাকবে। সেখান থেকে সে যাকে ইচ্ছা তাকে দেবে। যারা তার বিরোধিতা কোরবে তাদের সে ঐ ভাণ্ডার থেকে রেযেক দেবে না। এইভাবে সে মোসলেমদের অত্যন্ত কষ্ট দেবে। যারা দাজ্জাল (Dajjal)কে অনুসরণ কোরবে তারা আরামে থাকবে আর যারা তা কোরবে না তারা কষ্টে থাকবে। [বোখারী ও মোসলেম]


এখানে প্রথমেই পরিষ্কার কোরে নেয়া দরকার যে রেযেক শব্দের অর্থ শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়। রেযেক বোলতে খাদ্যদ্রব্য, বাড়ী-ঘর, গাড়ি-ঘোড়া, টাকা-পয়সা সবই বোঝায়। এক কথায় পার্থিব সম্পদ বোলতে যা বোঝায় তা সবই রেযেক। দাজ্জালের কাছে অর্থাৎ পাশ্চাত্যের ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে যে রেযেকের বিপুল ভাণ্ডার আছে এ কথা ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর সম্পদের সিংহভাগই তাদের দখলে। এই সম্পদ থেকে দাজ্জাল (Dajjal) কাদের দেয়? শুধু তাদের দেয় যারা তাকে মেনে নিয়েছে, তাকে স্বীকার কোরেছে, স্রষ্টার দেয়া জীবন-বিধান ত্যাগ কোরে দাজ্জালের সৃষ্ট তন্ত্রমন্ত্র, বাদ, নীতি গ্রহণ কোরেছে। যারা দাজ্জাল (Dajjal)কে প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জাল (Dajjal) তাদের দেয় না, যদিও আজ দাজ্জাল (Dajjal)কে প্রত্যাখ্যান করার প্রায় কেউ নেই। সমস্ত পৃথিবীতে তার একক আধিপত্য ও প্রভুত্ব বিরাজ কোরছে।

আজ যদি কোন দেশ, জাতি বা জনগোষ্ঠী দাজ্জাল (Dajjal)কে অস্বীকার কোরে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে ও কোরান হাদীসের ব্যবস্থায় সমষ্টিগত জীবন যাপন কোরতে চেষ্টা করে তবে কি হবে? নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতার কাছ থেকে শুধু সর্বপ্রকার সাহায্যই বন্ধ হোয়ে যাবে না, সমস্ত পাশ্চাত্য জগতের বিরোধিতা আরম্ভ হোয়ে যাবে। এ বিরোধিতা শুধু দাজ্জাল (Dajjal) নয়, দাজ্জালের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার কোরে নিয়ে দাজ্জালের পায়ে সাজদায় অবনত অন্যান্য জাতিগুলির মানুষও, যার মধ্যে ‘মোসলেম’ নামধারীরাও আছেন, তাদের কাছ থেকেও আসবে। পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতার উদ্ভাবক ইহুদী খৃষ্টান জগতের বাইরে পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতি ও দেশ দাজ্জালের মুখাপেক্ষী, তার কাছে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে যারা দাজ্জালের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি সমষ্টিগত ব্যবস্থা স্বীকার কোরে নিয়েছে তাদের সে ভিক্ষা ও ঋণ দিয়ে কৃতার্থ কোরছে, বাঁচিয়ে রাখছে। দাজ্জাল (Dajjal) ভিক্ষা না দিলে তারা না খেয়ে থাকে, দাজ্জাল (Dajjal) ঋণ না দিলে তাদের সরকার অচল হোয়ে যায়, সমস্ত উন্নয়নমূলক (দাজ্জালের দৃষ্টিতে উন্নয়নমূলক) কর্মকাণ্ড বন্ধ হোয়ে যায়। পৃথিবীর যে কোন দেশ বা জাতি দাজ্জালের একটু অবাধ্যতা কোরলেই তাকে সব রকম সাহায্য দেয়া বন্ধ (Economic Sanction) কোরে দেয়, তার ওপর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক অবরোধ (Embargo) স্থাপন করে। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিল (Consortium) ইত্যাদি, এক কথায় দাজ্জালের অধীনে যত কিছু আছে তার কোন কিছু থেকেই কোন সাহায্য পাওয়া যায় না। ভাবতে আশ্চর্য্য লাগে যে বর্ত্তমানে দাজ্জাল (Dajjal) যে Sanction ও Embargo আরোপ কোরে তার অবাধ্য জাতিগুলিকে শাস্তি দিয়ে বশে আনতে চেষ্টা করে ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর রসুল ঠিক সেটাই ভবিষ্যদ্বাণী কোরে গেছেন- শুধু আক্ষরিকভাবে ঐ Sanction ও Embargo শব্দ দু’টি ব্যবহার না কোরে।



নয় ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের ডান চোখ অন্ধ হবে। [আব্দুলাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে বোখারী ও মোসলেম]


দাজ্জালের ডান চক্ষু অন্ধ হবে অর্থ সে ডান চোখ দিয়ে কিছুই দেখতে পাবে না, যা দেখবে সবই বাঁ চোখ দিয়ে। আল্লাহ যা কিছু তৈরী কোরেছেন সব কিছুরই দু’টো বিপরীত দিক আছে। এই মহাসৃষ্টিও দৃশ্য ও অদৃশ্য, কঠিন ও বায়বীয়, আলো ও অন্ধকার, আগুন ও পানি, দিন ও রাত্রি ইত্যাদি বিপরীত জিনিসের ভারসাম্যযুক্ত মিশ্রণ। এই পৃথিবীতে আল্লাহ তাঁর যে খলীফা পাঠালেন সেই মানুষের জন্যও তিনি নির্দ্ধারিত কোরলেন বিপরীতমুখী বিষয়। তার জন্যও তিনি নির্দিষ্ট কোরলেন দেহ ও আত্মা, জড় ও আধ্যাত্মিক, সত্য ও মিথ্যা, সওয়াব ও গোনাহ, ভালো ও মন্দ, ইহকাল ও পরকালের ভারসাম্যযুক্ত সমন্বয়। এই দুইয়ের ভারসাম্যই হোচ্ছে স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক। তাঁর এই খলীফার জন্য যে দীন, জীবন-বিধান তিনি তাঁর নবী রসুলের মাধ্যমে প্রেরণ কোরলেন সেটার এক নাম দীনুল ফিতরাহ, প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক জীবন-ব্যবস্থা এবং সেই দীন যারা মেনে চোলবে আল্লাহ তাদের নাম দিলেন মিল্লাতান ওয়াসাতা, ভারসাম্যযুক্ত জাতি (কোরান- সুরা বাকারা, আয়াত ১৪৩)। এই ভারসাম্যের দু’দিকের যে কোন দিককে বাদ দিলেই ভারসাম্য নষ্ট হোয়ে যাবে ও অস্বাভাবিক অপ্রাকৃতিক অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং আল্লাহ তাঁর খলীফা, মানুষ সৃষ্টি কোরে যে পরীক্ষা কোরতে চান তা ব্যর্থ হোয়ে যাবে।

পথভ্রষ্ট বনি-এসরাঈল জাতিকে হেদায়াত করার জন্য প্রেরিত আল্লাহর নবী ঈসার (আঃ) প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর তাঁর শিক্ষাকে ইউরোপের সমষ্টিগত জীবনে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা একটা অচল অবস্থার সৃষ্টি কোরলো। রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাবিহীন একটা ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা, যেটার উদ্দেশ্যই ছিলো শুধু আত্মশুদ্ধির পরিত্যক্ত প্রক্রিয়াকে (তরিকা) পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সেটা মানুষের সার্বিক জীবনে অচল এটা সাধারণ জ্ঞানেই (Common sense) বোঝা যায়। এই অচল ব্যবস্থাকে চালু করার চেষ্টা ব্যর্থ হোলে ইউরোপ যখন মানুষের সমষ্টিগত জীবনের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে সংবিধান, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি তৈরী কোরে নিলো তখন তারা জীবনের ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস কোরে ফেললো। দু’চোখ দিয়ে না দেখে এক চোখ অন্ধ কোরে শুধু এক চোখ দিয়ে দেখতে শুরু কোরলো। অন্ধ কোরলো ডান অর্থাৎ দক্ষিণ চোখটাকে।

ডান এবং বামের মধ্যে ডানকে নেয়া হয় উত্তম ও বামকে নেয় হয় অধম হিসাবে। কেয়ামতের দিন জান্নাতিদের আমলনামা, তাদের কাজের রেকর্ড বই দেয়া হবে ডান হাতে, জাহান্নামীদের দেয়া হবে বাম হাতে (কোরান- সুরা হাক্কাহ্‌, আয়াত ১৯, ২৫ ও সুরা ইনশিকাক, আয়াত ৭)। দেহ ও আত্মার মধ্যে আত্মা ডান দেহ বাম, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সত্য ডান মিথ্যা বাম, ইহকাল ও পরকালের মধ্যে পরকাল ডান, ইহকাল বাম, জড় ও আধ্যাত্মের মধ্যে আধ্যাত্ম ডান, জড় বাম ইত্যাদি। ইহুদী-খৃষ্টান বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার (Judeo-Christian Materialistic Civilization) ডান চোখ অন্ধ অর্থাৎ জীবনের ভারসাম্যের একটা দিক, আত্মার দিক, পরকালের দিক, অদৃশ্যের (গায়েব) দিক, সত্যের দিক সে দেখতে পায় না, তার সমস্ত কর্মকাণ্ড জীবনের শুধু একটা দিক নিয়ে, দেহের দিক, জড় ও বস্তুর দিক, যন্ত্র ও যন্ত্রের প্রযুক্তির দিক, ইহকালের দিক, কারণ শুধু বাম চোখ দিয়ে সে জীবনের ঐ একটা দিকই দেখতে পায়। তাই বিশ্বনবী বোলেছেন, দাজ্জালের ডান চোখ অন্ধ হবে। এই ইহুদী-খৃষ্টান বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে তার বাঁ চোখ দিয়ে এই মহাবিশ্ব, এই বিশাল সৃষ্টিকে দেখতে পায়। কিন্তু তার ডান চোখ অন্ধ বোলে এই সৃষ্টির স্রষ্টাকে দেখতে পায় না; অণু-পরমাণু থেকে শুরু কোরে বিশাল মহাকাশ পর্যন্ত প্রত্যেকটি বস্তু যে এক অলংঘনীয় বিধানে বাঁধা আছে তা দাজ্জাল (Dajjal) তার বাঁ চোখ দিয়ে দেখতে পায়, কিন্তু ডান চোখ নেই বোলে এই মহাবিধানের বিধাতাকে দেখতে পায় না। শিশুর জন্মের আগেই মায়ের বুকে তার খাবারের ব্যবস্থা করা আছে তা দাজ্জালের চিকিৎসা বিজ্ঞান তার বাঁ চোখ দিয়ে দেখতে পায়, কিন্তু যিনি এ ব্যবস্থা কোরে রেখেছেন সেই মহাব্যবস্থাপককে সে দেখতে পায় না, কারণ তার ডান চোখ অন্ধ।



দশ ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামের মত দুইটি জিনিস থাকবে। সে যেটাকে জান্নাত বোলবে সেটা আসলে হবে জাহান্নাম, আর সে যেটাকে জাহান্নাম বোলবে সেটা আসলে হবে জান্নাত। তোমরা যদি তার (দাজ্জালের) সময় পাও তবে দাজ্জাল (Dajjal) যেটাকে জাহান্নাম বোলবে তাতে পতিত হয়ো, সেটা তোমাদের জন্য জান্নাত হবে। [আবু হোরায়রা (রাঃ) এবং আবু হোযায়ফা (রাঃ) থেকে বোখারী ও মোসলেম]


খৃষ্টধর্ম মোতাবেক সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা ব্যর্থ হওয়ার পর সার্বভৌমত্ব আল্লাহর হাত থেকে মানুষের হাতে তুলে নেবার পর সংবিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি তৈরী কোরে মানব জীবন পরিচালনা আরম্ভ হোল, যার নাম দেয়া হোল ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র (Secular Democracy)। এই গণতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব রোইলো মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে। অর্থাৎ মানুষ তার সমষ্টিগত, জাতীয় জীবন পরিচালনার জন্য সংবিধান ও সেই সংবিধান নিঃসৃত আইন-কানুন প্রণয়ন কোরবে শতকরা ৫১ জন বা তার বেশী। যেহেতু মানুষকে আল্লাহ সামান্য জ্ঞানই দিয়েছেন সেহেতু সে এমন সংবিধান, আইন-কানুন দণ্ডবিধি, অর্থনীতি তৈরী কোরতে পারে না যা নিখুঁত, নির্ভুল ও ত্রুটিহীন, যা মানুষের মধ্যকার সমস্ত অন্যায়, অবিচার দূর কোরে মানুষকে প্রকৃত শান্তি (এসলাম) দিতে পারে। কাজেই ইউরোপের মানুষের তৈরী ত্রুটিপূর্ণ ও ভুল আইন-কানুনের ফলে জীবনের প্রতিক্ষেত্রে অন্যায় ও অবিচার প্রকট হোয়ে উঠলো। বিশেষ কোরে অর্থনৈতিক জীবনে সুদভিত্তিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করায় সেখানে চরম অবিচার ও অন্যায় আরম্ভ হোয়ে গেলো। মুষ্টিমেয় মানুষ ধনকুবের হোয়ে সীমাহীন প্রাচুর্য্য ও ভোগবিলাসের মধ্যে ডুবে গেলো আর অধিকাংশ মানুষ শোষিত হোয়ে দারিদ্র্যের চরম সীমায় নেমে গেলো। স্বাভাবিক নিয়মেই ঐ অর্থনৈতিক অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ইউরোপের মানুষের এক অংশ বিদ্রোহ কোরলো ও গণতান্ত্রিক ধনতন্ত্রকে বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা কোরলো। ইউরোপের মানুষের অন্য একটা অংশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্যান্য দিকের ব্যর্থতা দেখে সেটা বাদ দিয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কোরলো। অর্থাৎ গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্র, ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এগুলো সবই অন্ধকারে হাতড়ানো, এক ব্যবস্থার ব্যর্থতায় অন্য নতুন আরেকটি ব্যবস্থা তৈরী করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রকৃতপক্ষে সমষ্টিগত জীবনের ধর্মহীনতা অবলম্বন করার পর থেকে যত তন্ত্র (-cracy), যত বাদই (-ism) চালু করার চেষ্টা ইউরোপের মানুষ কোরেছে সবগুলির সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে রোয়েছে। অর্থাৎ রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, এসবগুলিই মানুষের সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন ধাপ, বিভিন্ন পর্যায় (Phase, step) মাত্র। এই সবগুলি তন্ত্র বা বাদের সমষ্টিই হোচ্ছে এই ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা, দাজ্জাল (Dajjal)।

এই দাজ্জাল (Dajjal) অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা পৃথিবীর মানবজাতিকে বোলছে মানুষের সমষ্টিগত জীবন যাপনের জন্য আমাদের এই ধর্মনিরপেক্ষ প্রণালীই হোচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। মানুষের তৈরী করা সংবিধান, সেই সংবিধানের ওপর ভিত্তি করা মানুষের তৈরী করা আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা-ব্যাবস্থা ইত্যাদিই সর্বশ্রেষ্ঠ, আধুনিক। তোমরা এই ব্যবস্থা মেনে নাও, গ্রহণ করো তাহোলে তোমরা স্বর্গসুখে বাস কোরবে, তোমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা-দীক্ষা, চিকিৎসা, জীবনযাত্রার মান এমন উন্নীত হবে, এমন ভোগবিলাসে বাস কোরতে পারবে যে তা জান্নাতের সুখের সমান। আর যদি আমাদের এই নীতি তোমরা গ্রহণ না করো, তবে তোমরা দারিদ্র্য, ক্ষুধা অশিক্ষার মধ্যে জাহান্নামের কষ্ট ভোগ কোরতে থাকবে। যারা দাজ্জালের কথায় বিশ্বাস কোরে ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতার ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বহীন জীবন-ব্যবস্থা মেনে নেবে তাদের সে গ্রহণ কোরে তার জান্নাতে স্থান দেবে, তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি সর্বতোভাবে সাহায্য কোরবে। আর যারা দাজ্জালের জীবন-ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান কোরবে তাদের সে তার বিরাট ধন ভাণ্ডার থেকে কোন অর্থনৈতিক সাহায্য দেবে না, তাদের সে রাজনৈতিক, সামরিকভাবে বিরোধিতা কোরবে অর্থাৎ সে তাদের তার জাহান্নামে নিক্ষেপ কোরবে।

দাজ্জাল (Dajjal) যে মানবজাতিকে উপরোক্ত কথা বোলছে তা নির্দিষ্ট ঘটনাবলী দিয়ে প্রমাণ করার দরকার করে না। পাশ্চাত্যের সমস্ত প্রচার যন্ত্রগুলি এই কথা প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে, স্থুল ও সুক্ষ্মভাবে বোলে যাচ্ছে যে তাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা (যার মধ্যে গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও সাম্যবাদ অন্তর্ভুক্ত), তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (যার মধ্যে ধনতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত), তাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা (যেটা সম্পূর্ণভাবে জড়বাদী, বস্তুবাদী, যেখানে আত্মার শিক্ষার কোন স্থান নেই), তাদের সামাজিক ব্যবস্থা (যেখানে অবৈধ যৌন কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বোলে গৃহীত, যেখানে সমকামিতা আইনসঙ্গত), তাদের তৈরী করা দণ্ডবিধি সবই সর্বোত্তম, প্রগতিশীল, আধুনিক। ওর চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কিছু হোতে পারে না। ওর বাইরে যত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাব্যবস্থা আছে সব গোঁড়া, পশ্চাৎমুখী, প্রতিক্রিয়াশীল, সেকেলে ও হাস্যকর ব্যবস্থা। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- যারা দাজ্জালের জীবন-ব্যবস্থা স্বীকার কোরে নেবার ফলে দাজ্জালের জান্নাতে স্থান পাবে তারা দেখবে প্রকৃতপক্ষে তা জাহান্নাম। আর যারা দাজ্জাল (Dajjal)কে অস্বীকার করার দরুন তার জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে দেখবে তারা জান্নাতে আছে। আল্লাহর রসুলের কথা সত্য কিনা যাচাই কোরে দেখা যাক। এই যাচাইয়ের সময় এ কথা মনে রাখতে হবে যে গণতন্ত্র থেকে ধাপে ধাপে ও পর্যায়ক্রমে সাম্যবাদ (Communism) পর্যন্ত পৌঁছলেও প্রকৃতপক্ষে সমগ্রটা মিলিয়ে একটাই বিষয় ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা, দাজ্জাল (Dajjal) এবং দাজ্জালের মৃদু থেকে উগ্রতম রূপ। অন্যভাবে বলা যায় জন্ম থেকে দাজ্জালের ক্রমে ক্রমে বড় হওয়া।

দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতাই মানুষের একমাত্র গ্রহণযোগ্য সভ্যতা, জীবন-ব্যবস্থা এই প্রচারণায় বিশ্বাস কোরে যে জনসমষ্টি, জাতি বা দেশ তা গ্রহণ কোরেছে অর্থাৎ দাজ্জালের জান্নাতে, স্বর্গে প্রবেশ কোরেছে তাদের অবস্থা পর্যালোচনা কোরলে দেখা যায় প্রতারিত হোয়ে প্রবেশ করার পর অতি শীঘ্রই তারা বুঝতে পেরেছে যে তারা আসলে জাহান্নামে, নরকে প্রবেশ কোরেছে। কথাটা ভালো কোরে বোঝার জন্য দাজ্জালের উগ্রতম রূপ সাম্যবাদ (কমিউনিজমকে) বিবেচনায় নেয়া যাক।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে অর্থাৎ রেডিও, টেলিভিশনে-এ কথা লক্ষ কোটি বার বলা হোয়েছে যে সাম্যবাদী সমাজে, দেশে থাকা স্বর্গের সুখে থাকার সমান। যারা ঐ দেশগুলোর রেডিও মোটামুটি নিয়মিতভাবে শুনে এসেছেন তাদের এ কথা বোলে দেবার দরকার নেই। এখানে লক্ষণীয় যে, তারা তাদের সমাজটাকে সর্বদাই স্বর্গ (Paradise) বোলে বাকি পৃথিবীকে সাম্যবাদ গ্রহণ কোরে স্বর্গে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং বিশ্বনবী ঠিক ঐ জান্নাত অর্থাৎ Paradise শব্দটাই ব্যবহার কোরেছেন। দাজ্জালের স্বর্গ Paradise যদি সত্যই স্বর্গ হোয়ে থাকে তবে যারা সেখানে প্রবেশ কোরবে তারা নিশ্চয়ই আর কখনই সেখান থেকে বের হোয়ে আসার চিন্তাও কোরবে না, এ কথা তো আর মিথ্যা হোতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি হোয়েছে? কমিউনিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ ও কার্য্যকরী করার কিছু পরই সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেকে বাকি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন কোরে ফেললো।

সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরে কি হোচ্ছে না হোচ্ছে সে সম্বন্ধে শাসকরা যেটুকু খবর বাইরে যেতে দিতো তার বেশী আর কোন খবর বাকি পৃথিবীর কেউ পেতো না। এই বিচ্ছিন্নতা অতি শিগ্‌গিরই এমন পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছলো যে বাকি দুনিয়ায় এর নাম হোয়ে গেলো Iron Curtain, লোহার পর্দা। এ পর্দা এমন দুর্ভেদ্য হোয়ে দাঁড়ালো যে, বিরাট দেশটার সাধারণ সড়ক বা বিমান দুর্ঘটনার খবর পর্যন্ত বাকি দুনিয়ার মানুষ জানতে পারতো না। পরবর্ত্তীতে যখন চীন ঐ জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ কোরলো, দাজ্জাল (Dajjal)কে রব স্বীকার কোরে দাজ্জালের উগ্রতম পর্যায় সাম্যবাদী জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ কোরলো তখন সেখানেও সেই একই ব্যাপার দাঁড়ালো, চীন বাকি দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন কোরে ফেললো এবং এর নাম হোয়ে গেলো Bamboo Curtain, বাঁশের পর্দা।

এই দুই বিরাট দেশের শাসকরা এই বিচ্ছিন্নতার নীতি কেন গ্রহণ কোরলেন? একটা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োগের ফলে কোন দেশ জাতি বা সমাজ যদি স্বর্গে পরিণত হয় তবে তো সেই জাতির শাসকদের ঠিক উলটো করা উচিত। পর্দা দেবার বদলে তাদের জন্য অবশ্য কর্ত্তব্য ছিলো সমস্ত দ্বার খুলে দেয়া; বাকি পৃথিবীকে বলা যে- দ্যাখো! আমরা বোলছি আমরা স্বর্গসুখে আছি এ কথা সত্য কিনা। তাদের কর্ত্তব্য ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণকে বলা যে, আমরা পাসপোর্ট প্রথা উঠিয়ে দিচ্ছি, তোমরা এ স্বর্গ ছেড়ে যদি কোথাও যেতে চাও যাও, কোন বাধা দেবো না। তাদের কর্ত্তব্য ছিলো বাকি পৃথিবীর মানুষকে ডেকে বলা- আমরা ভিসা প্রথা উঠিয়ে দিচ্ছি, তোমরা এসে দেখে যাও আমরা জান্নাতে (Paradise) আছি কিনা। পরবর্ত্তীতে ঠিক ঐ ব্যাপার চীনেও হোল। সাম্যবাদ, কমিউনিজমের জন্মের পর থেকে এই সেদিন পর্যন্ত অর্থাৎ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান পর্যন্ত কমিউনিষ্ট দেশগুলি যে নিজেদের বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোরে রেখেছিলো, তাদের জনগণের সাথে বাইরের পৃথিবীর জনগণের সামান্যতম সংযোগ ছিলো না এ কথা কোন তথ্যাভিজ্ঞ (Informed) মানুষই অস্বীকার কোরতে পারবেন না, এটা ঐতিহাসিক সত্য। ঐ দেশগুলির বাইরের দুনিয়ার সাথে সংযোগ ছিলো শুধুমাত্র ওপরের তলার শাসকদের সঙ্গে, আর কারো সঙ্গে নয়।

শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের ব্যাপারেই নয়, যখনই যে দেশ দাজ্জালের উগ্রতম রূপ কমিউনিজমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার স্বর্গে প্রবেশ কোরেছে, তখনই সে দেশকে সোভিয়েত ও চীনের মত বাকি পৃথিবী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন কোরে ফেলতে হোয়েছে।

‘স্বর্গে’ প্রবেশ কোরেও ঐ উল্টো নীতি গ্রহণ করা ছাড়া ঐ সব দেশের শাসকদের আর কোন নীতি গ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। তার কারণ হোল এই যে, স্বর্গের প্রতিশ্রুতি পেয়ে সেই স্বর্গে প্রবেশ করার পর সেসব দেশের জনসাধারণ অতি শীঘ্রই বুঝতে পারলো যে এ তো স্বর্গ নয়, এ তো নরক। কিন্তু তখন বেশী দেরী হোয়ে গেছে। তবুও তারা প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে লাগলো ঐ স্বর্গ থেকে বের হোয়ে আসার জন্য। সহজ কথা নয়, কারণ ও স্বর্গ থেকে বের হবার অর্থ নিজেদের দেশ, লক্ষ স্মৃতি জড়ানো প্রিয় জন্মভূমি চিরদিনের জন্য ত্যাগ কোরে সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশে, অচেনা সমাজে বাস করা, যাদের ভাষা পর্যন্ত তাদের অজানা। কিন্তু অনস্বীকার্য্য ইতিহাস এই যে ঐসব দেশের জনসাধারণ তাদের জন্মভূমি থেকে পালিয়ে অজানা দেশে চোলে যাবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এই চেষ্টায় তারা পরিবারের অন্যদের প্রাণও বিপন্ন কোরেছে, সহায়-সম্পদ বিসর্জন তো ছোট কথা।

কমিউনিষ্ট পূর্ব বার্লিন থেকে পশ্চিম বার্লিনে লোক পালিয়ে যাওয়া বন্ধ কোরতে রাশিয়ানরা বিখ্যাত বা কুখ্যাত বার্লিন দেয়াল তৈরী কোরলো। তবুও মানুষ পালানো বন্ধ করা যায় না দেখে দেয়ালের ওপর প্রতি পঞ্চাশ গজ অন্তর স্তম্ভ (Watch tower) তৈরী কোরে সেখানে মেশিনগান বসানো হোল। হুকুম দেয়া হোল কাউকে দেয়াল টপকে পালাতে দেখলেই গুলী কোরে হত্যা কোরতে। তবু লোক পালানো বন্ধ হয় না দেখে পরিখা খোড়া হোল, কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হোল ও নানা রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বসানো হোল পলায়নকারীদের খুঁজে বের কোরে হত্যা বা বন্দী করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই ‘স্বর্গ’ থেকে পালানো বন্ধ করা গেলো না। ঐ সময়ের খবরের কাগজ যারা নিয়মিত পড়েছেন, রেডিও শুনেছেন তাদের কাছে ‘স্বর্গ’ থেকে পালানোর চেষ্টায় গ্রেফতার, গুলী কোরে হত্যা ইত্যাদি দৈনন্দিন খবর ছিলো। ১৯৪৯ সন থেকে ১৯৬১ সন পর্যন্ত ২৭ লাখ নর-নারী, শিশু কমিউনিষ্ট স্বর্গ থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয় এবং ঐ সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ ঐ পালাবার চেষ্টায় নিহত হয়, বন্দী হয়।

‘স্বর্গ’ থেকে পালানোর চেষ্টায় বহু লোক সফল হোয়েছে, বহু লোক বিফল হোয়েছে, বন্দী হোয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে। শাসকরা পালানোটা প্রায় অসম্ভব কোরে তোলার পর মানুষ মরিয়া হোয়ে বিকল্প পথ ধরলো। একদল বেলুনে চড়ে রাশিয়ার সীমান্ত পার হোল, অনেকে নদী ও পরিখা সাঁতরে পার হোল, অবশ্য পরিখাগুলি সাঁতরে পার হোতে যেয়ে অনেকে গুলী খেয়ে মারা পড়লো। দু’টি পরিবার এক অভিনব পন্থায় পূর্ব জার্মানী থেকে পশ্চিম জার্মানীতে পালিয়ে এসে সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগিয়েছিলো।

পূর্ব ও পশ্চিম ভাগ হোয়ে পূর্ব জার্মানী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবাধীন একটি কমিউনিস্ট দেশে পরিণত হওয়ার পর রেল লাইনগুলিকে নতুন সীমান্তে দেয়াল দিয়ে বন্ধ কোরে দেয়া হোয়েছিলে। ঐ দু’টি পরিবার অতি কৌশল ও চেষ্টায় একটি রেলওয়ে ইঞ্জিন যোগাড় করে। তারপর ঐ দুই পরিবারের নারী ও শিশুদের তাতে উঠিয়ে পুরুষরা তীব্রগতিতে ঐ ইঞ্জিনটি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দেয়াল ভেঙ্গে পশ্চিম জার্মানীতে চোলে আসে। আরও বিভিন্ন উপায়ে বহু নারী-পুরুষ শিশু তাদের প্রিয় জন্মভূমি, দেশ, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমস্তের মায়া ত্যাগ কোরে প্রাণ হাতে নিয়ে একদিন যেটাকে স্বর্গ ভেবেছিলো তা থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা কোরেছে।

এটা শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারেই নয়, যে জনসমষ্টিই ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার উগ্রতম রূপ কমিউনিজমের স্বর্গে প্রবেশ করার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেটাকে গ্রহণ কোরেছে, তারা অচিরেই বুঝতে পেরেছে যে, তারা নরককে স্বর্গ মনে কোরে তাতে প্রবেশ কোরেছে।

চীনেও ঐ একই ব্যাপার হোয়েছে। মোহভঙ্গের পর হাজার হাজার চীনা তাদের দেশ থেকে বাইরের জগতে পালিয়ে যাবার চেষ্টায় প্রাণ হারিয়েছে, বন্দী হোয়েছে। মূল চীন ভূখণ্ড থেকে সমুদ্র প্রণালী সাঁতরে পার হোয়ে বৃটিশ শাসিত হংকং-এ পালিয়ে যাবার চেষ্টায় বহু চীনা ডুবে মারা গেছে। যুদ্ধে আমেরিকানরা হেরে যাবার পর সম্পূর্ণ ভিয়েতনাম কমিউনিষ্টদের হাতে চোলে যাবার পর সে দেশ থেকে মানুষ পালানোর যে বিরাট হিড়িক পোড়ে গিয়েছিলো ও তা বহু বছর পর্যন্ত চলেছে সে খবর জানা নেই এমন লোক পৃথিবীতে বিরল। ছোট বড় নৌকা বোঝাই কোরে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ মানুষ সমুদ্রে ভেসেছে। তারা কোথায় পৌঁছবে, কোন্‌ দেশে আশ্রয় পাবে কিছুই না জেনেও তারা শুধু দাজ্জালের ‘স্বর্গ’ থেকে পালাবার জন্য মরিয়া হোয়ে যে নৌকায় একশ’ জনের স্থান হবে সে নৌকায় পাঁচ সাতশ’ মানুষ ভর্ত্তি হোয়ে সমুদ্রে ভেসেছে। হাজার হাজার নৌকা জোর বাতাসে, ঝড়ে ডুবে গেছে, হাজার হাজার নৌকা জলদস্যুরা (Pirates) আক্রমণ কোরে লুটে নিয়েছে, মানুষদের হত্যা কোরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে, মেয়েদের ধর্ষণ কোরেছে, তাদের বিদেশে বিক্রি কোরে দিয়েছে।

এ সমস্ত খবর হাজার হাজার বার সমস্ত পৃথিবীর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হোয়েছে, বহু ছবি ওগুলিতে ছাপা হোয়েছে। সেই সব লোমহর্ষক খবর পড়ে, ছবি দেখে পৃথিবীর মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠেছে। এতো সংখ্যায় এতো বার এই পালানোর চেষ্টা হোয়েছে যে এদের জন্য একটা আলাদা শব্দই সৃষ্টি হোয়েছে- The Boat People - নৌকার মানুষ। পৃথিবীর সমস্ত সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এখন এদের এই নামেই উল্লেখ করে। ভিয়েতনামেও এসব খবর পৌঁছেছে, কিন্তু তাতেও ঐ স্বর্গের অধিবাসীদের ফেরাতে পারে নি। তারপরও তারা স্ত্রী পুরুষ, নারী ও শিশুদের দিয়ে নৌকা অতিরিক্ত বোঝাই কোরে প্রাণ হাতে নিয়ে অজানা সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়েছে।

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এমন একটাও দেশ নেই যেখানে ‘স্বর্গ’ থেকে পলায়নকারী আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য বড় বড় শিবির (Camp) খুলতে না হোয়েছে। এই সেদিন হংকং- এর আশ্রয় শিবির থেকে লোকজনকে ভিয়েতনামের ‘স্বর্গে’ ফেরত পাঠাবার চেষ্টায় আশ্রয়প্রার্থীদের সাথে হংকং পুলিশের যে তুমুল সংঘর্ষ হোয়ে গেলো, যাতে পুলিশসহ ‘স্বর্গের’ ভূতপূর্ব বাসিন্দাদের কয়েকজন মারা গেলো সে সংবাদ ও ছবি আমাদের দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রেই ছাপা হোয়েছিলো (এটি নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের অর্থাৎ বইটি প্রথমবার প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পূর্বের ঘটনা)। ঐ একই অবস্থা প্রতিটি সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী দেশের। কমিউনিষ্ট কিউবার একটি উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অস্থায়ীভাবে বাস কোরছে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে।

দাজ্জালের ঘোষিত জান্নাত যে সেটার অধিবাসীদের জন্য প্রকৃতপক্ষে জাহান্নাম তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমার মনে হয় কোরিয়ার যুদ্ধের একটি ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়া দেশটি দু’টি ভাগে ভাগ হোয়ে যায়। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং এ ভাগ আজও আছে। দু’টোই দাজ্জালের পূজারী। শুধু তফাৎ হোচ্ছে এই যে দক্ষিণ কোরিয়া দাজ্জালের পূর্বতন পর্যায়ের গণতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে আছে আর উত্তর কোরিয়া দাজ্জালের উগ্রতর পর্যায়ের সাম্যবাদী একনায়কতান্ত্রিক অর্থাৎ কমিউনিষ্ট ব্যবস্থার অধীনে আছে।

১৯৫২ সালে এই দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলো। উত্তর কোরিয়ার সাহায্যে এগিয়ে এলো কমিউনিষ্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন আর দক্ষিণ কোরিয়ার সাহায্যে এগিয়ে এলো জাতিসংঘের (United Nations) অধীনে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি অনেকগুলো অ-কমিউনিস্ট দেশ। যুদ্ধ চললো তিন বছর। তারপর সন্ধি হোল। সন্ধির অনেকগুলো শর্ত্তের মধ্যে একটি শর্ত্ত হোল যুদ্ধবন্দী বিনিময়। এ বিনিময়ের শর্ত্তের মধ্যে একটি শর্ত্ত হোল এই যে, কোন পক্ষই যুদ্ধবন্দীদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর কোরে ফেরত পাঠাতে পারবে না, যারা নিজেদের ইচ্ছায় তাদের দেশে ফিরে যেতে চাইবে শুধু তাদেরই ফেরত পাঠানো যাবে। যুদ্ধবন্দী বিনিময় হোয়ে যাবার পর দেখা গেলো যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও উত্তর কোরিয়ার অর্থাৎ কমিউনিষ্টদের হাতে অ-কমিউনিস্টদের অর্থাৎ আমেরিকান ও অন্যান্য দেশের ১২,৭৬০ (বার হাজার সাতশ’ ষাট) জন যুদ্ধবন্দীর মধ্যে ৩৪৭ (তিনশ’ সাতচলিশ) জন ফিরে আসতে অস্বীকার কোরলো, অর্থাৎ তারা কমিউনিস্ট দেশেই থেকে গেলো। এদের মধ্যে ২১ (একুশ) জন আমেরিকানও ছিলো।

অপরদিকে জাতিসংঘের অধীনে দেশগুলোর অর্থাৎ অ-কমিউনিস্টদের হাতে কমিউনিস্টদের ৭৫,৭৯৭ (পঁচাত্তর হাজার সাতশ’ সাতানব্বই) জন যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে থেকে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে অস্বীকার কোরলো ৪৮,৮১৪ (আটচলিশ হাজার আটশ’ চৌদ্দ) জন। এত বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দী তাদের নিজ দেশে ফেরত না যাওয়ায় জাতিসংঘ এক সমস্যার সম্মুখীন হোয়ে পোড়েছিলো। পরে এদের ফিলিপাইনে, ফরমোসা ও অন্যান্য স্থানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কোরে দেয়া হয়। যাদের মনে এই সংখ্যা সম্বন্ধে সন্দেহ বা অবিশ্বাস আসবে তারা কোরিয়ান যুদ্ধের ইতিহাস, বৃটিশ বিশ্বজ্ঞান কোষ (Encyclopedia Britannica) দেখে নিতে পারেন বা সরাসরি জাতিসংঘে চিঠি লিখে জেনে নিতে পারেন।

এই ঘটনার পর আর কোন সন্দেহ কি থাকতে পারে যে কমিউনিস্টদের বহু ঘোষিত ‘স্বর্গ’ (Paradise) প্রকৃতপক্ষে সেটার অধিবাসীদের জন্য নরক? ওটা যদি নরক নাও হোয়ে শুধু বাইরের দুনিয়ার অর্থাৎ অ-কমিউনিস্ট দেশ ও জাতিগুলোর অবস্থার মত হতো তবে ঐ হাজার হাজার যুদ্ধবন্দীরা সকলেই অবশ্যই তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যেতো। কারণ উভয় স্থানের অবস্থা সমান বা মোটামুটি সমান হলেও একদিকের পালায় রোয়েছে তাদের প্রিয় দেশ, জন্মভূমি, বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে, বন্ধু-বান্ধব, শৈশবের স্মৃতি জড়ানো বাসস্থান। ঐ সমস্ত বিসর্জন দিয়ে যদি হাজার হাজার মানুষ অজানা দেশের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঝুঁকির সিদ্ধান্ত নেয়, তাহোলে নিশ্চিতই বলা যায় যে, ঐ লোকগুলো তাদের দেশকে জাহান্নাম বা নরক বোলে বিশ্বাস করে। ফেরত না যাওয়া ঐ সংখ্যা থেকেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, যে ২৬,৯৮৩ (প্রায় সাতাশ হাজার) যুদ্ধবন্দী নিজেদের কমিউনিস্ট দেশে ফিরে গেলো তারা ফিরে গেছে দাজ্জালের স্বর্গের জন্য নয়, গেছে তাদের স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, বাপ-মা’র, বন্ধু-বান্ধবের, আত্মার সাথে জড়ানো, মায়া মমতায় ঘেরা জন্মভূমিকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ কোরতে না পেরে। ঐগুলোর মায়া ত্যাগ কোরতে না পেরে তারা জেনে-শুনেই নরকই বেছে নিয়েছে। সন্ধির শর্ত্তের মধ্যে যদি এই শর্ত্তও যোগ করা হতো যে, যেসব যুদ্ধবন্দী স্বেচ্ছায় নিজেদের দেশে ফিরে যাবে না তাদের পরিবারকেও এনে তাদের কাছে দেয়া হবে তবে এ সাতাশ হাজারের মধ্যে সাতশ’ জনও ফিরে যেতো কিনা সন্দেহ আছে।

এখন প্রশ্ন হোল- এ কী রকম ‘স্বর্গ’ যে স্বর্গের অধিবাসীরা সেখান থেকে পালানোর জন্য প্রাণ হাতে নেয়, সমুদ্র সাঁতরে পার হবার চেষ্টায় ডুবে মরে, ছোট ছোট নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেবার চেষ্টা করে, ইলেকট্রিক কাঁটা তারের শক্‌ খেয়ে মরে, ‘স্বর্গরক্ষীদের’ গুলী খেয়ে মরে এবং শত্রুর হাতে বন্দী হোলে জন্মভূমি, স্ত্রী-পুত্রের মায়া ত্যাগ কোরে আবার ‘স্বর্গে’ ফিরে যেতে অস্বীকার করে! এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসে। সেটা হোল- তবে কি যেসব দেশ কমিউনিজম গ্রহণ কোরেছে শুধু সেইসব দেশ জাহান্নামের মত, আর যে সব দেশ করে নি সেগুলো জান্নাতের মত? না, তা নয়। আমি পেছনে বোলে এসেছি যে- জাতীয়, রাষ্ট্রীয়, সামরিক, আর্থ-সামাজিক ইত্যাদি কোন বিষয়েই খৃষ্টান ধর্মের কোন নির্দেশনা, এমনকি বক্তব্য পর্যন্ত না থাকা সত্ত্বেও ওটাকে সামগ্রিক জীবনে প্রয়োগের চেষ্টায় অবধারিত ব্যর্থতা যখন ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম দিলো, স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে এলো তখনই দাজ্জালের জন্ম হোল।

তারপর জন্মের পর যেমন কোন প্রাণী ক্রমে বড় হয়, তার জীবনে একটার পর একটা ধাপ বা পর্ব আসে, তেমনি দাজ্জালের জীবনেও ধাপ, পর্ব (Phase) এসেছে। প্রথমে গণতন্ত্র ও তার অপূর্ণতা ও ত্রুটির কারণে উদয় হোয়েছে একনায়কতন্ত্র (Dictatorship)। ধনতন্ত্রের কুফল ও অবিচারের ফলে এসেছে সমাজতন্ত্র ও তার উগ্রতর রূপ সাম্যবাদ, কমিউনিজম। সময়ে সময়ে ঐ বিভিন্ন পর্যায়ের, ধাপের অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হোয়েছে, যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র জোট বেঁধে একনায়কতন্ত্রকে ধ্বংস কোরলো। কিন্তু তার পরপরই গণতান্ত্রিক ধনতন্ত্রের সাথে সমাজতান্ত্রিক কমিউনিজমের স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা লড়াই (Cold war) শুরু হোয়ে গেলো। এই ঠাণ্ডা লড়াই কোরিয়ায়, ভিয়েতনাম ও আরও ছোট খাটো দু’চার জায়াগায় প্রকৃত যুদ্ধের (Shooting war) রূপ নিলেও ব্যাপক আকারে হয় নি শুধু একটি মাত্র কারণে। সেটা হোল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই গণতান্ত্রিক ধনতন্ত্রের ও সমাজতান্ত্রিক কমিউনিজমের উভয়ের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র ছিলো। উভয়েই জানতো যে এ অস্ত্র ব্যবহার কোরলে উভয়কেই ধ্বংস হোতে হবে। এই পরিস্থিতিই Deterent হিসেবে কাজ কোরে তখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধতে দেয় নি। নিজেদের পরিণামের এই ভয়ই শুধু পৃথিবী ধ্বংসকারী অস্ত্রগুলোকে ব্যবহার করা থেকে উভয়পক্ষকে বিরত রেখেছে।যান্ত্রিক ‘সভ্য’ ভাষায় এরই নাম Deterent, দা’তাত। কিন্তু মনে রাখতে হবে দাজ্জালের জীবনে শৈশব, কৈশোর, যৌবনের মত পর্যায় আসলেও এবং কখনো কখনো ঐ পর্যায়গুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হোলেও দাজ্জাল (Dajjal) একটিই মহাশক্তিধর আত্মাহীন দানব ইহুদী-খৃষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতা, Judeo-Christian Materialistic Civilization।

কাজেই কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার যেসব যুদ্ধবন্দী দেশে ফিরে গেলো না তারা শুধু দাজ্জালের স্বর্গের উগ্রতম অবস্থা থেকে কিছু নম্রতর অবস্থায় ফিরে এলো মাত্র। কোরিয়ার যুদ্ধোত্তর বন্দী বিনিময় অংকের হিসাব প্রমাণ কোরে দিয়েছে মহানবীর সেই ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা যেটায় তিনি বোলছেন দাজ্জালের সঙ্গে একটি জান্নাতের মত আরেকটি জাহান্নামের মত জিনিস থাকবে। সে মানবজাতিকে আহ্বান কোরে বোলবে আমাকে তোমরা রব (প্রভু) বোলে মেনে নাও (আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ত্যাগ কোরে আমার সার্বভৌমত্ব মেনে নাও)। যারা তাকে রব বোলে মেনে নেবে (ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি গ্রহণ কোরবে) সে তাদের তার জান্নাতে স্থান দেবে এবং সেটা তাদের জন্য জাহান্নাম হবে, আর যারা তাকে রব বোলে স্বীকার কোরবে না সে তাদের তার জাহান্নামে দেবে এবং সেটাই তাদের জন্য জান্নাত হবে। আজ শুধুমাত্র মক্কা ও মদীনা ছাড়া বাকি সমস্ত পৃথিবী দাজ্জালের জান্নাত, প্রকৃতপক্ষে জাহান্নাম।



এগারো ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের দুই চোখের মাঝখানে (অর্থাৎ কপালে) কাফের লেখা থাকবে। শুধু মো’মেন, বিশ্বাসীরাই তা দেখতে এবং পড়তে পারবে; যারা মো’মেন নয়, তারা পড়তে পারবে না। [আবু হোরায়রা (রাঃ), আবু হোযায়ফা (রাঃ) এবং আনাস (রাঃ) থেকে বোখারী ও মোসলেম]


এই হাদীসটি শুধু অর্থবহ এবং আকর্ষণীয় নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। মো’মেন হোলে লেখাপড়া না জানলেও, নিরক্ষর হোলেও তারা পড়তে পারবেন আর মো’মেন না হোলে, শিক্ষিত হোলেও, পণ্ডিত হোলেও দাজ্জালের কপালে কাফের লেখা দেখতে ও পড়তে পারবেন না, এই কথা থেকেই এটা পরিষ্কার যে, দাজ্জালের কপালের ঐ লেখা কাফ্‌, ফে, রে এই অক্ষরগুলো দিয়ে লেখা নয়। মো’মেনরা নিরক্ষর হলেও ঐ লেখা দেখতে ও পড়তে পারবেন। মো’মেন কারা? আল্লাহ কোরআনে বোলেছেন- শুধু তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে বিশ্বাস করে, তারপর আর তাতে কোন সন্দেহ করে না, এবং তাদের প্রাণ ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে; তারাই হোল খাঁটি (কোরান- সুরা হুজরাত, আয়াত ১৫)।

এখানে মনে রাখতে হবে যে ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে বিশ্বাস করে’ এ কথার অর্থ যারা আল্লাহর সর্বব্যাপী সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে, জীবনের প্রতি বিভাগে, প্রতি অঙ্গনে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে স্বীকার করে না। দাজ্জাল (Dajjal)কে রব বোলে স্বীকার কোরে নেয়ায় প্রায় সম্পূর্ণ মোসলেম দুনিয়া আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে ব্যক্তি জীবনে কোণঠাসা কোরে রেখে আকীদার (Comprehensive Concept) বিকৃতির কারণে কার্য্যতঃ মোশরেক ও কাফের হোয়ে গেছে। কাজেই বৃহত্তর জীবনে দাজ্জালের কপালে কাফের লেখা অর্থাৎ দাজ্জাল (Dajjal) যে সমষ্টিগত জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকারকারী কাফের এটা তারা দেখতেও পান না সুতরাং পড়তেও পারেন না। কিন্তু জীবনের প্রতি অঙ্গনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বে যিনি বিশ্বাসী, অর্থাৎ মো’মেন তিনি নিরক্ষর হোলেও দাজ্জাল (Dajjal) যে কাফের তা দেখতে ও বুঝতে পারেন অর্থাৎ তার কপালে কাফের লেখা পড়তে পারেন।

বিশাল বাহনে (যান্ত্রিক প্রযুক্তি) আসীন দানব বোলে দাজ্জাল (Dajjal)কে (ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা) যেমন রসুলাল্লাহ রূপকভাবে বর্ণনা কোরেছেন দাজ্জালের কপালে লেখাও তেমনি রূপক বর্ণনা, অক্ষর দিয়ে লেখা নয়। অন্য হাদীসে বিশ্বনবী বোলেছেন- সমস্ত পৃথিবী দাজ্জালের পদতলে আসবে (হাদীস- ফাতেমা বিনতে কায়েস (রাঃ) থেকে বোখারী ও মোসলেম, মুসনাদে আহমদ, হাকীম, দারউন নশুর)। পৃথিবীর লোকসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ পাঁচ ভাগের এক ভাগ মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতিটির সামান্য অংশ বাদে সবটাই দাজ্জাল (Dajjal)কে (ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা) দাজ্জাল (Dajjal) বোলে চিনতে না পেরে তাকে বন্ধুভাবে নিয়ে তার আদেশ অনুসারে চোলবে, তার পায়ে সাজদায় পতিত হবে। মহানবীর কথায় বোঝা যায়, যেহেতু সমস্ত পৃথিবী দাজ্জালের নিয়ন্ত্রণে আসবে সেহেতু এই জাতিটিও দাজ্জালের পদতলে, নিয়ন্ত্রণে আসবে, অর্থাৎ তাকে রব বোলে স্বীকার কোরে নেবে। তাই আমরা দেখি মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতিটির প্রায় সমস্ত মানুষ দাজ্জাল (Dajjal)কে রব বোলে স্বীকার কোরে নিয়েছে কিন্তু ওদিকে মহা-পরহেযগার, মুত্তাকী। এমন কি এই জাতির মধ্যে কয়েকটি দেশ আছে যাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কপালে সাজদার কালো দাগ আছে কিন্তু তারা দাজ্জালের আশ্রয়ে থেকে, দাজ্জালের কাছ থেকে অস্ত্রসহ সবরকম সাহায্য নিয়ে তাদের দেশের মধ্যে যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ প্রতিষ্ঠা কোরতে চান তাদের বন্দী কোরছেন, নির্যাতন কোরছেন, গুলী কোরে ফাঁসি দিয়ে হত্যা কোরছেন। এর কারণ এসব নেতাসহ মোসলেমবিশ্ব দাজ্জালের শেখানো এই কথা বিশ্বাস কোরে নিয়েছেন যে ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, সমষ্টিগত নয়, তাই তারা দাজ্জালের কপালে কাফের লেখা দেখতে ও পড়তে পারেন না।



বারো ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- আমার উম্মতের সত্তর হাজার লোক দাজ্জালের অনুসরণ কোরবে। [আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে শারহে সুন্নাহ]


সমস্ত পৃথিবীর মানুষ যেমন দাজ্জাল (Dajjal)কে প্রভু বোলে স্বীকার কোরে নেবে মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতিটিও তেমনি দাজ্জাল (Dajjal)কে রব বোলে স্বীকৃতি দেবে এ কথা পেছনে স্থানে স্থানে বোলে এসেছি। এবার রসুলাল্লাহর হাদীস দিয়ে এ কথার প্রমাণ হোচ্ছে। পেছনে বোলে এসেছি আরবী ভাষায় কোন কিছু বহু, অসংখ্য, অগণিত বোঝাতে ঐ সত্তর সংখ্যা ব্যবহার হয়। ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাকে সমস্ত ইহুদীরা যে সমর্থন কোরবে তার স্বাভাবিক কারণ ওটা তাদেরই সৃষ্টি। তাদের সমর্থনকে বর্ণনা করার সময়ও রসুলাল্লাহ ঐ সত্তর সংখ্যাই ব্যবহার কোরেছেন, বোলেছেন- সত্তর হাজার ইহুদী দাজ্জাল (Dajjal)কে অনুসরণ কোরবে(হাদীস- আনাস (রাঃ) থেকে মোসলেম)। দু’টো হাদীসেই কি পরিমাণ মানুষ দাজ্জাল (Dajjal)কে রব বোলে মেনে তাকে অনুসরণ কোরবে তা বোলতে যেয়ে বিশ্বনবী ইহুদী এবং তাঁর উম্মাহ অর্থাৎ মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতি, উভয়টার সম্বন্ধেই একই শব্দ ব্যবহার কোরেছেন- সত্তর হাজার। তাহোলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ইহুদী খৃষ্টানরা যেমন সবাই তাদের নিজেদের সৃষ্ট ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাকে, দাজ্জাল (Dajjal)কে রব বোলে স্বীকার কোরে নেবে ঠিক তেমনি মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতিটিও তাই নেবে। প্রকৃত অবস্থাও তাই। আরবের একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া সমস্ত মোসলেম বিশ্ব দাজ্জালের, ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতার তৈরী রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হোচ্ছে। আল্লাহর দেয়া আইন, দণ্ডবিধি প্রত্যাখ্যান কোরে দাজ্জালের তৈরী আইন দণ্ডবিধি অনুযায়ী মোসলেম বিশ্বের আদালতগুলোতে বিচার হোচ্ছে, শাস্তি দেয়া হোচ্ছে। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের, নৈতিকতার আল্লাহর দেয়া মানদণ্ড পরিত্যাগ কোরে এই জাতি এখন দাজ্জালের দেয়া মানদণ্ড ও মূল্যবোধ গ্রহণ কোরেছে।

দাজ্জালের নাম উল্লেখ না কোরেও তাকে ইহুদী-খৃষ্টান বোলে মহানবী কয়েকটি হাদীসে তাঁর উম্মাহর দাজ্জাল (Dajjal)কে স্বীকার কোরে নেবার কথা বোলেছেন। তিনি বোলেছেন- ভবিষ্যতে তোমরা তোমাদের পূর্ববর্ত্তীদের পদে পদে অনুসরণ কোরবে, এমন কি তারা যদি গুইসাপের (সরীসৃপের) গর্ত্তেও প্রবেশ করে তবে তোমরাও তাদের অনুসরণ কোরে সেখানেও প্রবেশ কোরবে। তাঁকে প্রশ্ন করা হোল- হে রসুলাল্লাহ! (যাদের অনুসরণ করা হবে) তারা কি ইহুদী ও খৃষ্টান? তিনি জবাব দিলেন- (তারা ছাড়া) আর কারা (হাদীস- আবদুলাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে তিরমিযি এবং মুয়াবিয়াহ (রাঃ) থেকে আহমদ ও আবু দাউদ)! অন্য একটি হাদীসে মহানবী বোলেছেন- ভবিষ্যতে এমন সময় আসবে যখন আমার উম্মত ইহুদীদের অনুসরণ ও অনুকরণ কোরতে কোরতে এমন পর্যায়েও যাবে যে তাদের কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করে তবে আমার উম্মতের মধ্য থেকে তাও করা হবে (হাদীস- আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বোখারী ও মোসলেম)।

এই দুইটি ভবিষ্যদ্বাণীতে রসুলাল্লাহ ইহুদী ও খৃষ্টান বোলেছেন, দাজ্জাল (Dajjal) শব্দটা ব্যবহার করেন নি। কিন্তু এই বিষয়ে অন্যান্য হাদীসগুলো পর্যালোচনা কোরলে এবং তাঁর উম্মতের সত্তর হাজার লোক দাজ্জাল (Dajjal)কে অনুসরণ করার হাদীসকে যোগ কোরলে কোন সন্দেহ থাকে না যে, বর্ত্তমান ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতা হোচ্ছে দাজ্জাল (Dajjal) আর মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতি শুধু ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া আর সর্বতোভাবে দাজ্জাল (Dajjal)কে রব, প্রভু বোলে স্বীকার কোরে নিয়েছে, তার পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে। জাতীয় জীবনে, যেটা আসল জীবন, সেই সমষ্টিগত জীবনের প্রতি বিষয়ে কপালে কাফের লেখা দাজ্জাল (Dajjal)কে অনুসরণ কোরেও আকীদার বিকৃতির কারণে নামায, রোযা, ইত্যাদি নানা রকম নিষ্ফল এবাদত কোরে যাচ্ছে।

দাজ্জালের আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে জাতীয় জীবন থেকে ব্যক্তি জীবনে নির্বাসন দেয়াকে অর্থাৎ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে যারা স্বীকার কোরে নিয়েও মহা এবাদতে ব্যস্ত আছেন তারা “জাতীয় জীবনই এসলামে মুখ্য ও প্রধান, ব্যক্তি জীবন গৌণ”, আমার এ অভিমতের বিরোধিতা কোরবেন তা জানি। এ কথা আমি কোরান এবং হাদীস থেকে হাজার বার প্রমাণ কোরতে পারি। কিন্তু তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক বোলে শুধু একটা কথা তাদের কাছে পেশ কোরবো। এই দীনের পাঁচটি ফরদে আইন, অবশ্য কর্ত্তব্যের মধ্যে চারটিই সমষ্টিগত, জাতিগত, মাত্র একটি ব্যক্তিগত। ঈমান (আল্লাহর সার্বভৌমত্ব) অর্থাৎ তওহীদ, সালাহ (নামায), হজ্ব ও যাকাহ- সব ক’টিই সমষ্টিগত শুধুমাত্র রোযা ব্যক্তিগত। এ জাতির একটি অংশ এমন কি ব্যক্তিগত জীবনেও দাজ্জাল (Dajjal)কে রব বোলে মেনে নিয়েছে।



তেরো ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জালের শক্তি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি পৃথিবীর সমস্ত মাটি ও পানি (ভূ-ভাগ ও সমুদ্র) আচ্ছন্ন কোরবে। সমস্ত পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ চামড়া দিয়ে জড়ানো একটি বস্তুর মত তার করায়ত্ত হবে। [মুসনাদে আহমদ, হাকীম, দারউন নশুর]


বর্ত্তমানের ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতাই (Judeo Christian Technological Civilization) যে দাজ্জাল (Dajjal) এ সিদ্ধান্ত যারা অস্বীকার কোরবেন বা তাতে সন্দেহ কোরবেন তারা মেহেরবানী কোরে আমাদের বোলে দেবেন কি তাহোলে রসুলাল্লাহ তাঁর ঐ হাদীসে কাকে বা কি বোঝাচ্ছেন? সমস্ত পৃথিবীর মাটি ও পানি (Land and Sea) অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীটাকে আজ কোন্‌ মহাশক্তি আচ্ছন্ন কোরে আছে? তারা একটু চিন্তা কোরলেই দেখতে পাবেন যে, ঐ শক্তি অবশ্যই পাশ্চাত্যের ঐ ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতা। সমস্ত পৃথিবীতে আজ এর শক্তি অপ্রতিরোধ্য। কিছুদিন আগ পর্যন্তও দাজ্জালের দু’টি প্রধান ভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিলো, আজ নেই, এখন দাজ্জাল (Dajjal) নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী। পৃথিবীর পৃষ্ঠে কোন ভূ-ভাগ, মাটি নেই, কোন সমুদ্র নেই যেখানে এই মহাশক্তি যা ইচ্ছা তা কোরতে না পারে। এই হাদীসটিতে বিশ্বনবী যে উপমা দিয়েছেন তা সত্যই প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে- কোন কিছু দিয়ে (এখানে তিনি চামড়া শব্দ ব্যবহার কোরেছেন) একটা বস্তুকে (এখানে এই পৃথিবীকে) সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে ফেলা, পেঁচিয়ে ফেলা। ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতার যান্ত্রিক শক্তি যেভাবে সমস্ত পৃথিবীটাকে পদানত কোরে রেখেছে তার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নবী। পৃথিবীর ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, তা থেকে বলা যায় যে, অতীতে কখনও পৃথিবীতে এমন একটি মহাশক্তির আবির্ভাব হয় নি যে শক্তি সমস্ত পৃথিবীকে পদানত ও নিয়ন্ত্রণ কোরতে পেরেছে। এটা সম্ভবও ছিলো না। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, যানবাহন ইত্যাদি এমন ছিলো না যে অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যে কোন স্থানের সাথে যোগযোগ করা যায় বা অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে যাওয়া যায়। ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি (Scientific Technology) সেটা সম্ভব কোরেছে। আর কোরেছে বোলেই মানব ইতিহাসে এই প্রথম এমন একটি মহাশক্তিধর দৈত্য-দানবের আবির্ভাব হোয়েছে যেটা সমস্ত পৃথিবীকে পদানত কোরেছে।

এক সময় রোমান সাম্রাজ্য পৃথিবীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ শাসন কোরতো, অন্য সময় পারসিক শক্তি বিরাট এলাকার অধিপতি ছিলো। তারও আগে বর্ত্তমানের আফগানিস্তান থেকে পূর্বে বোর্ণিও পর্যন্ত বিশাল এলাকা ভারতীয় সভ্যতার অধীনে ছিলো। কিন্তু কোন একক মহাশক্তিই কখনো সমস্ত পৃথিবীতে আধিপত্য কোরতে পারে নি।

তার উম্মতও যে দাজ্জালের পদানত হবে তা এই হাদীসের অর্থের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। তা যদি না হতো তবে তিনি যেভাবে পৃথিবীতে দাজ্জালের আধিপত্য হবে সেখানে না বোলে বোলতেন- আমার উম্মত তাকে স্বীকার বা অনুসরণ কোরবে না, বা ‘আমার উম্মত’ না বোলে বোলতেন- মানবজাতির এক পঞ্চমাংশ (মোসলেম জাতি পৃথিবীর লোকসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ) দাজ্জাল (Dajjal)কে স্বীকার কোরবে না। তা তিনি বলেন নি এবং তার অর্থ তাঁর উম্মতও দাজ্জালের অধীন হবে। প্রকৃত অবস্থাও তাই।



চৌদ্দ ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- আরবে এমন কোন স্থান থাকবে না যা দাজ্জালের পদতলে না আসবে বা সেখানে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি না থাকবে। [বোখারী ও মোসলেম]


দাজ্জালের প্রভাব, প্রতিপত্তি যে সমস্ত পৃথিবীময় হবে অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীকে সে নেতৃত্ব দেবে এ কথা রসুলাল্লাহ বেশ কয়েকটি হাদীসে বোলেছেন। এবার এই হাদীসটিতে তিনি নির্দিষ্ট কোরে আরবের কথা, তাঁর মাধ্যমে এসলামের যে শেষ সংস্করণটি আল্লাহ যে দেশে পাঠিয়েছিলেন সেই আরব দেশের কথা বোলছেন। তিনি বোলছেন- সেই আরবও দাজ্জালের হাত থেকে রক্ষা পাবে না, তার পদতলে চোলে যাবে। আরবে যদিও আল্লাহর দেয়া আইন-কানুন ও দণ্ডবিধি মোটামুটি চালু আছে, অর্থাৎ ও ব্যাপারে দাজ্জাল (Dajjal)কে স্বীকার করে নাই, কিন্তু অন্যান্য সমস্ত ব্যাপারে আরবের শাসকরা দাজ্জালের অর্থাৎ পাশ্চাত্য শক্তির কাছে নতজানু হোয়ে তার আদেশ নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন। শুধুমাত্র আইন-কানুন ও দণ্ডবিধি ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে আরব নেতারা পাশ্চাত্যের আদেশ-নির্দেশের অধীন এ কথা যারাই ওদের সম্বন্ধে খবর রাখেন তারাই স্বীকার কোরবেন। কারণও আছে। নেতারা, শাসকরা জানেন যে, মহাশক্তিধর পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে গেলে তাদের সিংহাসন, আমীরত্ব থাকবে না। দাজ্জাল (Dajjal) তাদের সরিয়ে দিয়ে তার পছন্দমত শাসক নিয়োগ কোরবে। কাজেই বিশ্বনবী বোলেছেন- সমস্ত পৃথিবীতো বটেই, এমনকি সমস্ত আরবও দাজ্জালের পদানত হবে।



পনেরো ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- দাজ্জাল (Dajjal) পৃথিবীর সর্বত্র যেতে পারবে ও যাবে কিন্তু মক্কা ও মদীনায় প্রবেশ কোরতে পারবে না। মদীনায় প্রবেশের প্রত্যেক দরজায় দু’জন কোরে মালায়েক (ফেরেশতা) পাহারা দেবে যারা দাজ্জাল (Dajjal)কে সেখানে প্রবেশ কোরতে দেবে না। [আবু বাকরাহ (রাঃ) ও ফাতেমা বিনতে কায়েস (রাঃ) থেকে- বোখারী ও মোসলেম]


আজ সমস্ত পৃথিবীর দিকে একবার তাকালেই বিশ্বনবীর এই কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। মোসলেম বোলে পরিচিত জাতিটিসহ অন্যান্য সমস্ত জাতিগুলি দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতার তৈরী গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি নীতি ও তার তৈরী আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি ইত্যাদি গ্রহণ কোরে সেই মোতাবেক তাদের সমষ্টিগত অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনা কোরছে। পৃথিবীতে যে মোসলেম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো আছে সেগুলোর সরকার ও জনসাধারণ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান কোরে দাজ্জাল (Dajjal)কে রব, প্রভু মেনে নিয়ে তার শেখানো মানুষের সার্বভৌমত্বকে গ্রহণ ও প্রয়োগ কোরছে।

কাজেই দাজ্জালের প্রভুত্ব আজ সর্বময়। দাজ্জাল (Dajjal) পৃথিবীর সর্বত্র যেতে পারবে অর্থ সমস্ত পৃথিবীটাই তার প্রভুত্বের অধীন হবে। শুধুমাত্র মক্কা ও মদীনায় সে প্রবেশ কোরতে পারবে না। মনে রাখতে হবে রসুলাল্লাহ এক হাদীসে বোলেছেন (‘দাজ্জালের পরিচিতি’ অধ্যায়ের চৌদ্দ নম্বর হাদীস) সমস্ত আরব দাজ্জালের পদানত হবে আর এই হাদীসে বোলছেন- শুধু মক্কা ও মদীনায় এর ব্যতিক্রম হবে। এর অর্থ হোল মক্কা ও মদীনা এই দু’টি শহর ছাড়া বাকি আরব দেশও দাজ্জালের পদানত হবে। আজ বিশ্বনবীর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হোয়েছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর খোদ আরব উপদ্বীপে ইহুদী-খৃষ্টান সামরিক বাহিনী প্রবেশ কোরেছে ও স্থায়ী আসন গেঁড়ে বোসেছে এবং এখন সমগ্র অঞ্চলে ঐ দাজ্জালী সামরিক শক্তিই সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু আজও তারা অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টানরা মক্কা ও মদীনায় প্রবেশ কোরতে পারে নি এবং ইনশাল্লাহ কখনও পারবে না। পারবে না এ কারণে নয় যে মোসলেম নামধারী কিন্তু দাজ্জালের পায়ে সাজদায় পতিত এই জাতির বাধার কারণে। কারণ বিশ্বনবী তাঁর হাদীসেই বোলে দিয়েছেন- সেটা হোচ্ছে মালায়েকদের দিয়ে পাহারা দেয়া।



ষোল ॥

আল্লাহর রসুল দাজ্জাল (Dajjal)কে কখনো কখনো মাসীহ উল-কায্‌যাব বোলে আখ্যায়িত কোরেছেন [আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে মোসলেম]। আবার কখনো কখনো তাকে মাসীহ উদ্‌-দাজ্জাল (Dajjal) বোলেও বর্ণনা কোরেছেন [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বোখারী ও মোসলেম, আবু বাকরাহ (রাঃ) ও ওবাদাহ বিন্‌ সোয়ামেত (রাঃ) থেকে আবু দাউদ]। ঐ একই শব্দ ‘মাসীহ’ রসুলাল্লাহ আল্লাহর অন্য নবী ঈসা (আঃ) সম্বন্ধেও ব্যবহার কোরেছেন [বোখারী, মোসলেম, তিরমিযি]।


আল্লাহও কোরানে এই মাসীহ শব্দটি কয়েকবার তাঁর নবী ঈসা (আঃ) সম্বন্ধে ব্যবহার কোরেছেন। একই শব্দ আল্লাহর একজন নবী ও তার ঠিক বিপরীত, আল্লাহকে অস্বীকারকারী, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অপহরণকারী কাফের, উভয়ের ওপর ব্যবহার আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী ও অসঙ্গত মনে হয় না কি? দাজ্জাল (Dajjal)কে কায্‌যাব অর্থাৎ মিথ্যাবাদী বলার অর্থ সহজ, সে তো অতি অবশ্যই মিথ্যাবাদী, কারণ যে মানবজাতিকে বোলবে আমি রব, প্রভু, সে যে বৃহত্তম মিথ্যাবাদী তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, এবং সে যে দাজ্জাল (Dajjal) অর্থাৎ চাকচিক্যময়, চোখ-মন ধাঁধানো প্রতারক তাতেও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে ও নিজের পূর্ববর্ত্তী নবীকে একই মাসীহ শব্দ প্রয়োগ চিত্তাকর্ষক। এর জবাব পাওয়া যাবে মাসীহ শব্দটির অর্থ পরিষ্কার হোলেই।

‘মাসীহ’ শব্দের অর্থ হোচ্ছে লেপন করা, আবৃত করা, কোন কিছুর ওপর হাত বুলানো, জড়িয়ে ফেলা, আচ্ছন্ন বা অন্তর্ভুক্ত করা। এই অর্থে এ দৃষ্টিতে ঈসা (আঃ) ও দাজ্জাল (Dajjal) দু’জনেই মাসীহ। যদিও ঈসা (আঃ) প্রেরিত হোয়েছিলেন শুধু বনি-এসরাঈলীদের হেদায়াতের জন্য। কিন্তু তার সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার কোরে পল প্রমুখ শিষ্যরা কেমন কোরে তার শিক্ষাকে খৃষ্টান নামে এক ধর্মে রূপান্তরিত কোরে ঐ ধর্ম ইউরোপে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা কোরলেন ও যার ফলে দাজ্জালের জন্ম হোল তা পেছনে লিখে এসেছি (‘দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরত্ব’ অধ্যায়ের এক নং হাদীস)। পরবর্ত্তীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে মহা শক্তিশালী হোয়ে ইউরোপের বিভিন্ন খৃষ্টান জাতি ও রাষ্ট্রগুলো তাদের সামরিক শক্তিবলে পৃথিবীর প্রায় সবটাই দখল কোরে নিলো। তাদের প্রভাবে ও তাদের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার ফলে ও খৃষ্টান প্রচারকদের (Missionary) অক্লান্ত চেষ্টা ও প্রচুর অর্থ ব্যয়ের ফলে এ বিজিত পৃথিবীর বহু মানুষ ঐ খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ কোরলো। বর্ত্তমানে খৃষ্টানরা পৃথিবীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ, পৃথিবীর এমন স্থান কমই আছে যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় খৃষ্টান নেই। অর্থাৎ খৃষ্টান ধর্ম সমস্ত পৃথিবীটাকে লেপন, আবৃত কোরে আছে। বিকৃত হোলেও এই ধর্ম ঈসা (আঃ) থেকেই উদ্ভুত হোয়েছে এবং সমস্ত পৃথিবীকে মাস্‌হ অর্থাৎ লেপন, আবৃত করার কারণেই তার উপাধি মাসীহ। পক্ষান্তরে সেই ঈসা (আঃ) থেকেই উদ্ভুত ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতাও আজ সমস্ত পৃথিবীকে শুধু লেপন ও আবৃত নয়, পদদলিত কোরে আছে। কাজেই এরও উপাধি মাসীহ, লেপনকারী, আচ্ছন্নকারী। দাজ্জাল (Dajjal)কে রসুলাল্লাহ মাসীহ উল কায্‌যাব বোলেও অভিহিত কোরেছেন। কায্‌যাব শব্দের অর্থ মিথ্যাবাদী। দাজ্জাল (Dajjal) চাকচিক্যময় বিরাট মিথ্যা দিয়ে সমস্ত পৃথিবীকে আবৃত, আচ্ছন্ন কোরে আছে, তাই একে বিশ্বনবী নাম দিয়েছেন মাসীহ উল কায্‌যাব।



সতেরো ॥

আল্লাহর রসুল বোলেছেন- ঈসা (আঃ) দাজ্জাল (Dajjal)কে হত্যা কোরবেন। [আব্দুলাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে মোসলেম এবং নাওয়াস বিন সা’মান (রাঃ) থেকে মোসলেম ও তিরমিযি]


এ সম্বন্ধে হাদীসসমূহে যে বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলো একত্র কোরে সাজালে দেখা যায় এমাম মাহ্‌দী (আঃ) প্রকাশ হবার পর একদিন আসরের সালাতের ঠিক আগে ঈসা (আঃ) দু’টি মালায়েকের কাঁধে ভর কোরে দামেশকের এক মসজিদের পূর্ব দিকের মিনারের ওপর এসে নামবেন। তিনি ঘোষণা কোরবেন যে তিনি দাজ্জাল (Dajjal)কে হত্যা কোরতে প্রেরিত হোয়েছেন। পরে এমাম মাহ্‌দীর (আঃ) নেতৃত্বে দাজ্জালের শক্তিগুলোর সঙ্গে যখন মোসলেমদের জেহাদ হবে তখন ঈসা (আঃ) দাজ্জাল (Dajjal)কে নিজে হত্যা কোরবেন। রসুলাল্লাহর বর্ণিত ভবিষ্যতের এই ঘটনাগুলি সম্বন্ধে সহিহ হাদীসগুলি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দেয়। দাজ্জাল (Dajjal)কে হত্যার করার জন্য দুই হাজার বছর আগের একজন নবীকে নির্দিষ্ট করার কারণ কি? দুই হাজার বছর আগে একজন নবীকে আল্লাহ সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে তাঁকে বোসিয়ে রেখে দিলেন। তারপর হাজার হাজার বছর পরে [ঈসা (আঃ) কবে আসবেন আমরা জানি না, তবে ইতোমধ্যেই দুই হাজার বছর পার হোয়ে গেছে।] তাঁকে সশরীরে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হবে দাজ্জাল (Dajjal)কে ধ্বংস করার জন্য। কেন? আল্লাহ কি দাজ্জালের সমসাময়িক এমাম মাহ্‌দীকে (আঃ) দিয়ে বা অন্য যে কোন লোক দিয়ে দাজ্জাল (Dajjal)কে হত্যা করাতে পারবেন না? বা তাঁর কি আর মানুষ সৃষ্টি করার ক্ষমতা শেষ হোয়ে যাবে? (নাউযুবিল্লাহ মিন-যালেক)। আদম থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত যিনি অসংখ্য মানুষ সৃষ্টি কোরেছেন ও কোরবেন তাঁর জন্য দাজ্জাল (Dajjal)কে হত্যা করার জন্য আর একটিমাত্র মানুষ সৃষ্টি করা কি কঠিন কাজ ছিলো? এক ইদরিস্‌ (আঃ) ছাড়া আর কোন মানুষ সশরীরে আসমানে যেতে পারেন নি এবং ইদরিস্‌ (আঃ) আর কখনও পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না, অথচ একমাত্র ঈসাকে (আঃ) সশরীরে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হবে দাজ্জাল (Dajjal)কে হত্যা করার জন্য। আল্লাহর এই ব্যতিক্রমধর্মী অদ্ভুত কাজের কারণ কি?

কারণ আছে। এ কথা সন্দেহাতীত এবং কেউ অস্বীকার কোরতে পারবেন না যে, দু’হাজার বছর আগের ঈসার (আঃ) সঙ্গে অন্ততপক্ষে দু’ হাজার বছর পরের (বেশীও হোতে পারে) দাজ্জালের এক ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক আছে। তা না থাকলে, আর কেউ নয়, অন্য কোন নবীও নয়, এমাম মাহ্‌দীও (আঃ) নয়, শুধু ঈসাকেই (আঃ) নির্দিষ্ট কোরে আসমানে রেখে দেয়া হোয়েছে কেন দাজ্জাল (Dajjal)কে হত্যা বা ধ্বংস করার জন্য, যে দাজ্জাল (Dajjal) ঈসার (আঃ) জীবনের হাজার হাজার বছর পর জন্ম নেবে?

যদি আমরা দাজ্জাল (Dajjal) সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণাকে (আকীদা) স্বীকার কোরে নেই- অর্থাৎ দাজ্জাল (Dajjal) শারীরিকভাবে পৃথিবীর মত বিরাট ঘোড়ায় আসীন এক চক্ষু বিশিষ্ট একটা দানব দৈত্য হবে, তবে প্রশ্ন এই যে, তাকে হত্যা করার জন্য হাজার হাজার বছর আগের একজন বিশেষ, নির্দিষ্ট নবীকে অতীত থেকে ভবিষ্যতে ফিরে আসতে হবে কেন? এ প্রশ্নের সহজ জবাব মিলে যাবে যদি আমরা বর্ত্তমানের ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতাকে দাজ্জাল (Dajjal) বোলে চিহ্নিত কোরি। প্রকৃতপক্ষে এটাই হোচ্ছে এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর এবং এ উত্তর ছাড়া আর কোন উত্তরের যথার্থতা নেই।

ঈসা (আঃ) ধর্মে ছিলেন মো’মেন ও মোসলেম, অন্যান্য সব নবীর মতই, এবং জাতিতে ছিলেন বনি-এসরাঈল, ইহুদী। তাঁর জাতির বিকৃত দীনকে সংস্কার করার চেষ্টা বিফল হবার ফলে তাঁর শিষ্যরা বিপথগামী হোয়ে যে জড়বাদী যান্ত্রিক সভ্যতার মহাশক্তিশালী দানব সৃষ্টি কোরলো, যে দানব স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব অস্বীকার কোরে নিজেকে রব, প্রভু হবার দাবী কোরলো এবং মানবজাতিকে দিয়ে তা স্বীকার করালো, সে দানবকে হত্যা, ধ্বংস করার দায়িত্ব আর কারো নয়, শুধু ঈসারই (আঃ)। ঈসাকে (আঃ) আল্লাহর নবী বোলে অস্বীকার কোরে জুডাই ধর্মের আলেমরা অর্থাৎ রাব্বাই, সাদ্দুসাই এবং ফারিসীরা যখন তাদের শাসক রোমানদের দিয়ে তাঁকে ক্রুশে উঠিয়ে হত্যা করার চেষ্টা কোরলো তখন আল্লাহ তাঁর নবীকে মালায়েক দিয়ে আসমানে উঠিয়ে নিলেন এবং তাঁর যে শিষ্য মাত্র তিরিশটি মুদ্রার জন্য তাঁকে আলেম ও রোমানদের হাতে ধোরিয়ে দিয়েছিলো সেই জুডাস ইস্‌কারিয়াসের চেহারা ও আকৃতি অবিকল ঈসার (আঃ) মতো কোরে দিলেন। ইহুদী ধর্মের আলেমরা ও রোমানরা তাকেই ঈসা (আঃ) মনে কোরে ক্রুশে উঠিয়ে হত্যা কোরলো। এমন হোতে পারে যে, আসমানে উঠিয়ে নেবার পর আল্লাহ ঈসাকে (আঃ) ভবিষ্যতে তাঁর উম্মাহর কাজের ফলে যে দাজ্জালের জন্ম হবে তা দেখিয়ে দিলেন, যা দেখে ঈসা (আঃ) আল্লাহকে বোললেন- ইয়া আল্লাহ! আমার উম্মতের কাজের ফলের জন্য আমিও অন্তত আংশিকভাবে দায়ী। কাজেই আমার উম্মতের সৃষ্ট দানবকে ধ্বংস করার দায়িত্ব আমাকেই দাও। অথবা এমনও হোতে পারে যে, আল্লাহই ঈসাকে (আঃ) বোললেন- ঈসা! দ্যাখো, তোমরা উম্মতের ভুলের, বিপথগামীতার ফলে কেমন মহাশক্তিধর দানব সৃষ্টি হোয়েছে যে আমার সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার কোরে নিজেকে রব, প্রভু বোলে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরেছে এবং আমার শেষ নবীর উম্মতসহ মানবজাতি তাকে রব বোলে মেনে নিয়েছে। যেহেতু তোমার উম্মত থেকেই এই কাফের দানবের জন্ম, কাজেই তোমাকেই আমি দায়িত্ব দিচ্ছি একে ধ্বংস করার জন্য। দাজ্জাল (Dajjal)কে হত্যা বা ধ্বংস করার জন্য আল্লাহর প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে আসমান থেকে হাজার হাজার বছরের অতীতের একজন নির্দিষ্ট নবীকে পৃথিবীতে পাঠাবার অন্য কোন কারণ আমি দেখি না। যদি কেউ অন্য কারণ বের কোরতে পারেন তবে তা প্রকাশ কোরলে আমার ভুল সংশোধন কোরবো।

এ পর্যন্ত যে হাদীসগুলি পেশ কোরলাম সবগুলিতেই রসুলাল্লাহ দাজ্জাল (Dajjal)কে সরাসরি উল্লেখ কোরেছেন। এবার কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন কোরছি যেগুলিতে মহানবী দাজ্জাল (Dajjal) শব্দটি ব্যবহার না কোরেও ঐ দাজ্জাল (Dajjal)কেই বুঝিয়েছেন। পেছনে আমি প্রমাণ কোরে এসেছি যে মোসলেম, মো’মেন ও উম্মতে মোহাম্মদী হবার দাবীদার এই জাতিটিসহ সমস্ত মানবজাতি আজ কয়েকশ’ বছর থেকে দাজ্জাল (Dajjal)কে অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতাকে প্রভু, রব বোলে মেনে নিয়ে তার পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে, শুধু ব্যক্তিগত জীবনের উপাসনা, এবাদত ছাড়া আর সর্ববিষয়ে তার অনুসরণ ও অনুকরণ কোরছে। এমন কি এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যক্তিজীবনেও ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতার নকল করার প্রাণান্ত প্রয়াস কোরছে। এরই ভবিষ্যদ্বাণী কোরেছেন বিশ্বনবী এই হাদীসগুলিতে।


ক) আল্লাহর রসুল বোলেছেন- তোমরা (ভবিষ্যতে) তোমাদের পূর্ববর্ত্তীদের অনুসরণ, অনুকরণ কোরবে, এমন কি তারা যদি সরীসৃপের গর্ত্তে প্রবেশ করে তবে তোমরাও তাই কোরবে। তাঁকে প্রশ্ন করা হোল- হে আল্লাহর রসুল- (যাদের অনুসরণ করা হবে) তারা কি ইহুদী ও খৃষ্টান? তিনি জবাব দিলেন- আর কারা (হাদীস- আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে- বোখারী, মোসলেম, মেশকাত)?


খ) আল্লাহর রসুল বোলেছেন- নিশ্চয়ই এমন সময় আসছে যখন বনি এসরাঈলীদের এমন পদে পদে অনুকরণ করা হবে যে তাদের কেউ যদি তার মায়ের সঙ্গে প্রকাশ্যে ব্যভিচার করে তবে আমার উম্মাহর মধ্য হোতেও কেউ তাই কোরবে (হাদীস- আব্দুলাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে- বোখারী, মোসলেম, মেশকাত)। এই হাদীসটিতে বিশ্বনবী শুধু বনি-এসরাঈল উল্লেখ কোরেছেন, খৃষ্টান উল্লেখ করেন নি, কিন্তু আমি পেছনে দেখিয়ে এসেছি (‘দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্ব’ অধ্যায়ের এক নম্বর হাদীসের ব্যাখ্যা) আসলে ইহুদী বোলতে ইহুদী খৃষ্টান উভয়কেই বোঝায় এবং সে জন্য বিভিন্ন হাদীসেও আল্লাহর রসুল শুধু ইহুদী বোলে উভয়কেই বুঝিয়েছেন। এই দুইটি হাদীসেও দাজ্জাল (Dajjal) শব্দ উল্লেখ না কোরেও বিশ্বনবী নিঃসন্দেহে দাজ্জাল (Dajjal)কেই বুঝিয়েছেন।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×