দাজ্জাল (Dajjal) ও বর্ত্তমান ইহুদী-খৃষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতা একই বস্তু ও যান্ত্রিক শক্তিই এর বাহন কিন্তু তাই বোলে বৈজ্ঞানিক যান্ত্রিক প্রযুক্তিটাই খারাপ বা বর্জনীয়, এই বই পড়ে এ ধারণা যেন কারো মনে না আসে। কোন জিনিস ভালো কি মন্দ তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে সেই জিনিসের ব্যবহারের ওপর। একটা অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি বা খুন করা যায়, সেই অস্ত্র দিয়েই আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করা যায়, খুনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার কোরে অসহায়কে রক্ষা করা যায়। অস্ত্র নিজে দায়ী নয়, যে সেটাকে ব্যবহার কোরবে দায়ী সে। দাজ্জাল (Dajjal) বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার কোরছে অন্যায়ভাবে। চিকিৎসা, কৃষি, আবহাওয়া ইত্যাদি কতকগুলি বিষয়ে ঐ প্রযুক্তি ব্যবহার কোরলেও তার প্রধান অংশই ব্যবহৃত হোচ্ছে সামরিক ক্ষেত্রে। এ কথা প্রমাণ করার দরকার করে না, পাশ্চাত্য সভ্যতার সরকারগুলির সামরিক খাতে ব্যয়ের সাথে অন্যান্য খাতে ব্যয়ের একটি তুলনাই এ কথা পরিষ্কার কোরে দেবে। সামরিক খাতে ঐ ব্যয়ের প্রধান উদ্দেশ্যই হোচ্ছে বাকি পৃথিবীকে পদানত কোরে রাখা। তেমনিভাবে দাজ্জালের সৃষ্ট রেডিও টেলিভিশন মানুষকে ভালো অনেক কিছু শিক্ষা দেবার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা, সহিংসতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অপরাধ, নগ্ন যৌনতা ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে তাকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে দিচ্ছে।
আল্লাহ যে বিরাট, বিশাল বিশ্বজগৎ সৃষ্টি কোরেছেন তা তিনি বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি কোরেই কোরেছেন। আদম (আঃ) কে সৃষ্টি কোরে তিনি তাকে সব জিনিসের নাম শেখালেন (কোরান- সুরা বাকারা, আয়াত ৩১)। সব জিনিসের নাম শেখানোর অর্থ কি? এর অর্থ হোচ্ছে কোন্ জিনিসের কি কাজ, কোন্ জিনিস দিয়ে কি কাজ হয় তা শেখানো, এক কথায় বিজ্ঞান, কারণ সমস্ত সৃষ্টিটাই বৈজ্ঞানিক। আর আদমকে (আঃ) শেখালেন অর্থ মানুষ জাতিকে শেখালেন। কোরানের এই আয়াত এই অর্থ বহন করে যে, মানুষ অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে এই বৈজ্ঞানিক মহাসৃষ্টির অনেক তথ্য, অনেক রহস্য জানতে পারবে। মানুষ জাতির বিজ্ঞানীরা গবেষণা কোরে আবিষ্কার কোরছেন আল্লাহর সৃষ্ট কোন জিনিস দিয়ে কী হয়, আর তা প্রযুক্তিতে ব্যবহার কোরছেন। আল্লাহ তাঁর কোরানে তাঁর বিরাট সৃষ্টি সম্বন্ধে ভাববার, গবেষণা করার জন্য বারবার বোলেছেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে নফল এবাদতের চেয়ে অনেক ঊর্দ্ধে স্থান দিয়েছেন।
আল্লাহর ঐ আদেশ অনুযায়ী কাজ করার ফলে এই মোসলেম জাতিতে অতীতে বিরাট বিরাট জ্ঞানী, বিজ্ঞানীর জন্ম হোয়েছে, যাদের কাজের ওপর, গবেষণার ফলের ওপর ভিত্তি কোরে বর্ত্তমান বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সম্ভব হোয়েছে। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মোসলেম বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে বিজ্ঞানে, চিকিৎসায়, দর্শনে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, রসায়নে, এক কথায় বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় বিরাট অগ্রগতি করার পর আকীদার বিকৃতিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছেড়ে, অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ অমান্য কোরে এই জাতি যখন ফতোয়াবাজী শুরু কোরলো তখন স্বভাবতঃই সেটা অজ্ঞানতার ও অশিক্ষা-কুশিক্ষার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হোল। আর তাদের কাজের, গবেষণার পরিত্যক্ত ভিত্তির ওপর অগ্রগতি কোরে দাজ্জাল (Dajjal) তার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির বিশাল ইমারত গড়ে তুললো। পদার্থ বিজ্ঞানে ইবনে হাইসাম, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইবনে সিনা, আল নাফীস, আল রাজী, অংক শাস্ত্রে আল খাওয়ারিযমী, আলকিন্দী, আল ফরগানী, সাধারণ বিজ্ঞানে ওমর খাইয়াম, বিবর্ত্তনবাদে ইবনে খালদুন প্রমুখ মনীষীরা বিজ্ঞানে প্রতি অঙ্গনে গবেষণা কোরে যে ভিত্তি স্থাপন কোরেছিলেন, আজ দাজ্জালের বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির শক্তি তারই ফল। দাজ্জাল (Dajjal) অন্যায় ও অপব্যবহার কোরছে বোলেই বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও যন্ত্র বর্জনীয় হোতে পারে না- বর্জনীয় হোচ্ছে ওর অপব্যবহার।
যেহেতু আল্লাহ তাঁর খলীফা আদমকে (আঃ) নিজ হাতে সৃষ্টি কোরে তাকে জ্ঞান বিজ্ঞান শেখালেন, সেহেতু মনে রাখতে হবে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান কোন বিশেষ জাতির বা বিশেষ সভ্যতার সম্পদ নয়। সৃষ্টির পর থেকেই মানবজাতি এই জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রগতি কোরে আসছে। অতীতে যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, গবেষণা কোরে ভিত্তি স্থাপন কোরে গেছেন তাদের সেই ভিত্তির ওপর বর্ত্তমানের গবেষক, বিজ্ঞানীরা নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ কোরছেন এবং আজকের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলকে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা আরও সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এতে কোন জাতির, কোন সভ্যতার মালিকানা নেই, এর মালিকানা সমগ্র মানবজাতির। বীজগণিত (Algebra) আল খাওয়ারিযমী এবং ত্রিকোণমিতি (Trigonometry) আল বাত্তানী আবিষ্কার কোরেছেন বোলেই যেমন ঐ বিজ্ঞান মোসলেম জাতির সম্পদ নয় তেমনি আপেক্ষিক তত্ত্ব (Theory of Relativity) যালবার্ট আইনষ্টাইন আবিষ্কার কোরেছেন বোলেই তা ইহুদী জাতির সম্পদ নয়- সবগুলোই সমগ্র মানবজাতির সম্পদ।
মানুষের ইতিহাসে দেখা যায় যে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, গবেষণা কোরে তাকে অগ্রগতির পথে নিয়ে গেছে। যখন যে জাতি বা সভ্যতার প্রাণশক্তি (Dynamism) বৃদ্ধি পেয়েছে সেই জাতি বা সভ্যতা জ্ঞান, বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ কোরেছে এবং সমগ্র মানবজাতি তা থেকে উপকৃত হোয়েছে। এখানে আল্লাহর রসুল একটি হাদীসের উল্লেখ প্রয়োজন। তিনি বোলেছেন- জ্ঞান আহরণের জন্য চীনেও যাও (হাদীস- আনাস (রাঃ) থেকে বায়হাকী, মেশকাত)। বিশ্বনবীর সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে (Science and Technology) চীনদেশ ছিলো পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত, তাই তিনি তাঁর অনুসারীদের (উম্মাহ) তদানিন্তন পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র চীনে যেয়ে ঐ জ্ঞান আহরণের আদেশ দিয়েছেন।
এ কথা আহাম্মকেও বুঝবে যে এই হাদীসে ‘জ্ঞান’ শব্দ দিয়ে তিনি দীনের জ্ঞান বোঝান নি, কারণ আল্লাহর রসুলকে মদীনায় রেখে দীনের জ্ঞান শেখার জন্য চীনে যাওয়ার, যে চীন তখনও এসলামের নামই শোনে নি, কোন অর্থই হয় না। বিশ্বনবী এখানে ‘জ্ঞান’ বোলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বুঝিয়েছেন। মহানবীর ঐ আদেশের সময় এই জাতিটি, যেটা বর্ত্তমানে মোসলেম বোলে পরিচয় দেয়, সেটা জীবিত (Dynamic) ছিলো, এবং জীবিত ছিলো বোলেই সেটা নেতার আদেশ শিরোধার্য্য কোরে জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পৃথিবীর শিক্ষকের আসন অধিকার কোরে নিয়েছিলো। তারপর আল্লাহ ও রসুল জ্ঞান বোলতে যা বুঝিয়েছেন তা থেকে ভ্রষ্ট হোয়ে যখন এ জাতি ‘জ্ঞান’ কে শুধু ফতোয়ার জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোরলো তখন এটা অশিক্ষা-কুশিক্ষায় পতিত হোয়ে মৃত হোয়ে গেলো এবং আজও সেই মৃতই আছে।
আল্লাহ ‘জ্ঞান’ বোলতে কি বুঝেন? মুসা (আঃ) একবার আল্লাহকে সাতটি প্রশ্ন কোরেছিলেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিলো- আল্লাহ! আপনার বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানী কে? আল্লাহ বোললেন যে জ্ঞানার্জনে কখনো তৃপ্ত হয় না এবং মানুষের অর্জিত জ্ঞানকেও যে ব্যক্তি নিজের জ্ঞানের মধ্যে জমা কোরতে থাকে (হাদীসে কুদসী- আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বায়হাকী ও ইবনে আসাকির; আল্লামা মুহাম্মদ মাদানী (রঃ) এর ‘হাদীসে কুদসী’ গ্রন্থের ৩৪৪ নং হাদীস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে আল্লাহ জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ কোরেছেন। প্রথমটি তাঁর দেয়া জ্ঞান যা তিনি সৃষ্টির প্রথম থেকে তাঁর নবী-রসুলদের মাধ্যমে তাঁর কেতাবসমূহে মানবজাতিকে অর্পণ কোরে আসছেন, যার শেষ কেতাব বা বই হোচ্ছে আল-কোরান। এটা হোচ্ছে অর্পিত জ্ঞান। আর মানুষ পড়াশোনা, চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোরে যে জ্ঞান অর্জন করে তা হোল অর্জিত জ্ঞান। মুসার (আঃ) প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ নির্দিষ্ট কোরে ‘মানুষের অর্জিত জ্ঞান’ বোললেন, শব্দ ব্যবহার কোরলেন ‘আন্নাসু’, মানুষ। অর্থাৎ যে আল্লাহর অর্পিত জ্ঞান, অর্থাৎ দীন সম্বন্ধে জ্ঞান, এবং মানুষের অর্জিত জ্ঞান- এই উভয় প্রকার জ্ঞান অর্জন কোরতে থাকে এবং কখনোই তৃপ্ত হয় না অর্থাৎ মনে করে না যে তার জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ হোয়েছে, আর প্রয়োজন নেই, সেই হোচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানী, আলেম। বর্ত্তমানে যারা নিজেদের আলেম, অর্থাৎ জ্ঞানী মনে করেন, আল্লাহর দেয়া জ্ঞানীর সংজ্ঞায় তারা আলেম নন, কারণ শুধু দীনের জ্ঞানের বাইরে মানুষের অর্জিত জ্ঞানের সম্বন্ধে তাদের সামান্যতম জ্ঞানও নেই এবং সেই জ্ঞান সম্বন্ধে পিপাসাও নেই।
আমি পেছনে একাধিকবার বোলে এসেছি যে আজ মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতিটি, যেটি নিষ্ঠাভরে সালাহ, যাকাহ, হজ্ব, সওম (রোযা) ছাড়াও হাজারো নফল এবাদত ও তাকওয়া অবলম্বন করে সেটি তার আকীদার বিকৃতিতে এলাহ শব্দের অর্থ যে সার্বভৌমত্ব তা না বুঝে, সেটাকে মা’বুদ অর্থাৎ উপাস্য মনে কোরে, অজ্ঞানতার অন্ধত্বের কারণে দাজ্জালের পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে।
কোন সন্দেহ নেই যে অনেকেই আমার এ কথায় বিব্রত হবেন, অনেকে ঘোর আপত্তি কোরবেন তারা বোলবেন- কখনোই না! আমরা দাজ্জাল (Dajjal)কে সাজদা কোরি না। আমরা শুধু আল্লাহকে সাজদা কোরি। সাজদা করার অর্থ কি? সাজদার প্রকৃত অর্থ হোল কাউকে, কোন শক্তিকে সর্বতোভাবে স্বীকার কোরে নেয়া, তার তৈরী করা আইন-কানুন, তার আকীদাকে মেনে নেয়া, তার দেয়া মূল্যবোধকে, ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডকে স্বীকার কোরে তা জীবনে কার্য্যকর করা, তার নিয়ম মোতাবেক চলা; শুধু মাথা মাটিতে ঠেকানোই সাজদা নয়। আকাশ, মাটি, পাহাড়, পর্বত, নদী, সমুদ্র, গাছপালা, এক কথায় সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহকে সাজদা করে (কোরান- সুরা রা’দ, আয়াত ১৫; সুরা আর রহমান, আয়াত ৬) অর্থাৎ এরা আল্লাহর বেঁধে দেয়া সমস্ত আইন-কানুন মেনে চলে। এরা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আল্লাহকে সাজদা করে না।
দাজ্জাল (Dajjal) নিজেকে রব অর্থাৎ প্রভু, পালনকর্ত্তা বোলে ঘোষণা কোরবে ও মানবজাতিকে তা স্বীকার কোরতে আদেশ কোরবে। মোসলেম বোলে পরিচিত এ জাতিটিসহ সমস্ত মানবজাতি দাজ্জাল (Dajjal)কে স্বীকার কোরে নিয়েছে ও তার পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে অর্থাৎ দাজ্জালের সৃষ্ট বিভিন্ন ‘তন্ত্র’ বা ‘বাদ’গুলিকে গ্রহণ কোরে তাদের জাতীয় জীবনে তা প্রয়োগ কোরে সেই মোতাবেক তাদের সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা কোরছে- এক কথায় আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে ত্যাগ কোরে দাজ্জালের সার্বভৌমত্বকে গ্রহণ কোরেছে, আল্লাহর দেয়া মূল্যবোধকে ত্যাগ কোরে দাজ্জালের দেয়া মূল্যবোধকে গ্রহণ কোরে তাকে রব বোলে স্বীকার কোরে নিয়েছে।