somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আধাঁরের অনুভব

২৫ শে এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৫:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





এক.

-তোমার তো যোগ্যতা, মেধা আছে এ অজপাড়া গাঁয়ে পড়ে থেকো না, শহরে কোথাও গিয়ে হাইস্কুলে গিয়ে চাকুরী-বাকুরী কর?
হেড স্যার রজতবাবু অরুপের হাত ধরে বললেন দেখ, অরুপ গ্রামের এ ছোট্ট প্রাইমারী স্কুল যে কোনদিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতদিন বড়কর্তারা সাহায্য করেছিলো চলেছে, মুখ গুটিয়ে নিয়েছেন তারা।
-হয়তো স্কুল আর চলবে না। আমাদের না হয় জমির বুকে ফসল তুলে কেটে যাবে, কিন্তু তুমি তো তরুন মানুষ, তোমার ম্যালাদিন পড়ে আছে সামনে। তাছাড়া এ গাঁয়ে তোমার আত্নীয়স্বজন কেউ নেই যে, তাদের সাথে থেকে যাবে!

অরুপ প্রথমে রাজী হয়ে চায়নি কিন্তু ভেবে দেখলো ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে এভাবে থেমে না থেকে একটু উপভোগ করা যাক, নয়তো শেষ বয়সে আফসোস জ্বিবের ডগায় আওয়াজ তুলবে। তাই শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেল। ঘরে ফিরে তাকে কিছু ভাবতে হলোনা।
পরদিন রজতবাবু পোষ্ট অফিস থেকে একটা চিঠি নিয়ে হাজির।
শোন,অরুপ উনি আমার বন্ধু রঞ্জিত মালাকার তুমি নিশ্চই চেন? তোমাদের কলেজের বাংলার ক্লাস নিতেন। অরুপ চিনতে পেরেছি বলতেই’ খামটা ধরিয়ে দিলেন ওর হাতে এটা তোমার চাকরীর জয়েনিং লেটার।
এবার তৈরি হয়ে নাও।
ও যে বাড়িতে ভাড়া থাকতো তাদের মনটা অবশ্য একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিলো মাসান্তের দশদিন সবেমাত্র গেছে, পুরো ভাড়াটা তাই তারা পাচ্ছেনা। অরুপের গোছানোর মতো কিছুই নেই । বাক্সপেটরা দুটো। শেষ বারের মতো ওর ছাত্ররা মনখারাপ করে রইলো কিন্তু কি আর করা সময় তো পরিবর্তন হয়; তাই এসব মেনে নিয়েই চলতে হবে।

পড়াগ্রাম ছেড়ে ওর যাত্রা এখন ‘নিদভাঙ্গার’ ছোট্ট শহরে বাসে চাপার আগ অবদি ওর চোখ একটু ঝাপসা হয়ে আসছিল কেউ ছিলনা এ গাঁয়ে । মা-বাবা তো সেই কবেই আকাশ পাড়ি দিয়েছে। তবুও আজ খারাপ লাগছে। কেন যে খারাপ লাগছে.....

দু’পাশে পাহাড় আর নদী একপাশে দুরন্ত ঘন বনজঙ্গল আর একপাশে ছোট্ট মফস্বল শহর। এ শহরে পা ফেলবার আগেই অরুপ শহরটাকে ভালোবেসে ফেললো। পথের ধারে না জানা জঙ্গলী ফুলকে হাতে তুলে নিল। ঠিক ছবির মতো শহরটা।
রজত বাবুই ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন স্যার রঞ্জিত বাবু এখানেই থাকেন। বাসে চাপার পর থেকে যদিও তার বুকটা ব্যাথায় চিনচিন করছিলো কিন্তু এই শহরের হাওয়া গায়ে লাগতেই খারাপ লাগাটা পাল্টে গেল।
তাই আপন মনেই বলে উঠলো ভাগ্যটা আমার উড়ন্ত ঘুড়ি হয়ে গেছে, হাওয়া লেগে কখনো নদীর ধারে কখনো ইটের ভাটায় কখনো ফুলওলা জমিনে আছরে পড়ে।

অটো থেকে নেমেই চোখ বুলিয়ে নিল অরুপ। হেটে আসতে হলো কিছুটা বাক্স-পেটরা নিয়ে ত্রিনাথ মন্দির অবদি। কার্ড ফোন থেকে ফোন দিতে হলো রঞ্জিত বাবু কে।
স্যার আমি তো এসে গেছি; ফোনের ওপারে হাসির আমেজ শোনা গেল।
-ওখানেই দাড়াও তুমি; আমি দয়মন্তিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ও তোমাকে জায়গা মতো পৌছে দেবে

রাস্তার একপাশে দাড়াতে চায়রি অরুপ কেমন দেখায়! ত্রিনাথের সিড়ি গোড়ায় দাড়িয়ে ছিল। পুব আকাশের দিবাকর ব্যাটা পশ্চিমের একপাশে হেলে পড়েছে তখন। পিনপতন নিরবতা হয়তো এখানে থাকার কথা কিন্তু তা নেই কদমের ফুলে ভরে গেছে গাছটা। সেটার চারপাশে ক’জুটি হাত পা ছড়িয়ে গুনগুন করছে; এ যেন আরেক দৃশ্যপট। যে ছবিগুলো না জানা কোন চিত্রকরের আঁকা তার সেই আঁকাটা ক্যালেন্ডারের পাতায় শোভা পেত। ন্যুড ক্যালেন্ডার দেখার মাঝে যেমন একটা অন্যরকম অনুভব আছে ঠিক তেমনি আছে যুগলবন্দী কদমগাছ ও কদম,ফুল দেখাতে।
মনটা তন্ময় হয়ে গিয়েছিল।
- হয়েছে কদম যুগল অনেক দেখেছেন, এবার আসুন ট্যাক্সি রাস্তায় দাড়িয়ে রয়েছে।
বালুচরি একটা শাড়ী পড়ে ফর্সা মতোন একটা মেয়েটা দাড়িয়ে। ওই বোধহয় দয়মন্তি !!
ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলো এর আগে একবার এই যানটিতে উঠার সুভাগ্য হয়েছিলো অরুপের এই নিয়ে দু’বার।
-কটায় বেড়িয়েছেন
- সাতটায়
- কিছু খেয়েছেন
- অত সকালে কিছু খেতে পারিনা।
- এসব ন্যাকামো এখানে টিকবে না, সব উঠে যাবে। বাবু কাবু হতে মাত্তর সাতদিন লাগবে। ভজহরি লাগাবে কড়াকড়ি।
- এই ভজহরিটা কে?
- আপনার পাশে পাশে থাকবে পিয়ন ও কেয়ারটেকার।
অরুপ এবার একটু সহজ হয়ে বসে বললো স্যার কি আপনাকেই পাঠালো আর কোন লোক ছিলোনা? দয়মন্তি একটু হেসে নিয়ে বললো কেন আমি কি দেখতে ব্যাঙ্গাচির মতো!! নাকি বোবা
- বোবা যদি আপনি হতেন তাহলে ঈশ্বরের পস্তাতে হতো যা মুখ আপনার!! তাছাড়া দেখতে খারাপ না হলেও তবে কাচালঙ্কার মতোই মনে হচ্ছে; এই সন্ধ্যেয় মেয়েছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তো তাই ভেবে কষ্ট লাগছে।
- অত ভেবে কাজ নেই এটা গ্রাম না এটা শহর। কষ্ট ‘কেষ্টর খাতায় তুলে রাখতে হয়’ আদিখ্যেতার কোন দাম নেই।
চুপ মেরে গেল অরুপ; দু’পা ফেলে জগৎ দেখা হয়নি তার। তাই ভাবনাটা আপাতত কম থাকলেই ভালো।


দুই.


ত্রিনাথ মন্দির থেকে দুই কিলো দুরে নিদডাঙ্গা। পাহাড়ী টিলার কাছে ওর স্কুল। একপাশে জলাভুমি পিছনে উচু পাহাড় আর দুপাশে সারি সারি বাড়ি; জোর বর্ষন হলে নিচের রাস্তায় পানি জমে যায়, চলাচল বন্ধ। স্কুলটা একটা টিলার উপর নেমে যাবার রাস্তাটা পুরোনে হলেও সুন্দর ফুলের চাদরে মোড়ানো। এখানকার ছাত্র-ছাত্রী মূলত খ্রীষ্ট বংশীয় কো এডুকেশন স্কুল।

তিন ক্লাসের স্কুল সিক্স টু এইট শ’তিনেক ছাত্রছাত্রী। স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষকই এই নগরীর তাই পাঁচটার আগেই বাড়ি ফেরে ওরা। অরুপ হেড পদেই যোগ দিয়েছে। স্কুলের পেছনেই দু’রুমের ছোট অর্ধপাকা দোচালা ঘর । থাকা খাওয়া ওখানেই সার্বক্ষনিক পিয়ন ও কেয়ারটেকার ভজহরি বাবু।
স্কুলের একমাত্র ড্রয়িং টিচার দয়মন্তি, রঞ্জিত বাবুর দুর সম্পর্কের ভাতিজি। কারো প্রতি ইন্টারেষ্টেড ভাবটা অরুপের নেই, সে ড্রিংক করেনা নস্যিও নেয়না কাজের বাইরে সবকিছুতেই তার উদাসীনতা। উদাসীনতার একটা কারণ দেখানো দরকার ভেবেই কেউ প্রশ্ন করলেই বলে দেয় আমি এমনটি হতে পারিনা। ভজহরি বলে ঠিক হয়ে যাবে লক্ষীর গুতো খেলেই।
বর্ষাবরনের অনুষ্ঠানে কজন টিপ্পনী কেটে বললো বিয়ে করছেন না কেন? বয়স তো গেল চলে;
-যাকনা এসব আমাকে দিয়ে হবেনা।
-অন্য কোন সমস্যা আছে কি?
দয়মন্তি পেছনেই ছিলো সশব্দে বলে উঠলো কদম তলায় অন্যের প্রেম করা দেখতো খারাপ লাগেনা বিয়ে করতেই আপত্তি !! ঢং!!
কত বয়স হলো? দিন কি শেষ হয়ে আসছে? এই জাতীয় প্রশ্ন অরুপের মাথায় আসে না; দিন কাটছে কাটুক না; অরুপের সাথে রঞ্জিত বাবুর প্রায়ই দেখা হয়। তা এবার তো বয়েস হলো; বিয়ে টিয়ে কিছু একটা করো অরুপ? মেয়ে দেখবো? আমি ছাড়া তো এখানে তোমার গার্জেয়ান কেই নেই।

দিন তো যাচ্ছেই কাটুক না ; অরুপের উদাসীনতা রঞ্জিতবাবুকে খানিকটা ভাবায় কিন্তু কি করবেন। প্রেম-ট্রেম কিছু করলে না হয় একটা কিছু হতো ! স্কুলের বাদ-বাকীরা কদ্দিন বলে ক্ষান্ত দিয়েছে।
পড়াগ্রামে না হয় ঝামেলা ছিলনা; পাথর হয়ে থাকা কোন সমস্যাই ছিলোনা। কিন্তু এইখানে একা থাকা বিস্তর সমস্যা। কারো বাড়ি বেড়াতে না গেলেও পার্টি জাতীয় কিছুতে একা যাওয়া বড়ই বেমানান।
কিন্তু কারো সাথে ওর এডজাষ্ট হওয়া অসম্ভব বলেই জানে, তাছাড়া বেশি ভাবতে জানেনা অরুপ ভালোবাসে প্রকৃতিকে; তাই নীরবতা যেন ওর নিরব সঙ্গী।
দয়মন্তির সাথে মাঝে-সাঝে গা-ছেড়া কথাবার্তা হয়; এ পর্যন্তই।
মাঝে মাঝে যদিবা কখনও একটু মায়া হয় কিন্তু দার্শনিক মার্কা কথাবার্তা আর আদিখ্যেতা সব ভন্ডুল করে দেয়। অরুপের কাছে এসে ওর আগোছালো জীবনটাকে গোছাতে ইচ্ছে করলেও তা আর করা হয়ে উঠেনা। এমন মানুষ গুলোকে কেউ একজন গাইড না করলে যতœ ছাড়া এমনি করে তালগাছের মতো বেড়ে উঠে তবে সেটা নিরসহীন। দয়মন্তি আড়চোখে ঠিক খেয়াল করে চলে অরুপে পথচলাকে এভাবে নিরব যন্ত্রনায় পুড়তে দেয়া যায়না।

এক মেঘলা আকাশের দিন স্কুল ছুটির পর বার্ষিক রেজাল্ট জমা দিতে এসে অনেকক্ষণ বসে থেকে শেষে অরুপের সাথে দেখা হলো। ততক্ষনে বৃষ্টি নেমে গেছে।
- ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠলো কোথায় গিয়েছিলেন?
- কোথায় আর যাব বলুন? তেমন তো জায়গা নেই?
- করে নিলেই তো হয়?
- আমাকে দিয়ে হবেনা
দয়মন্তি কিছু বলতে গিয়ে চেপে যায় তারপর রেজাল্টশীট গুলো জমা দিয়ে বললো তাহলে এ বেলা যাই। পরশু তো রেজাল্ট!!
- আচ্ছা যান
দয়মন্তি চলে যাচ্ছিল আবার ফিরে এলো
শুনুন !!
-বলুন
- এভাবে জীবন চলেনা। এভাবে জীবন কাটানো যায়না! কথা গুলো বলতে বলতে দয়মন্তি উঠে দাড়ালো বৃষ্টিধারা একটু থেমেছে কিন্তু আকাশের মুখ কালো হয়েই আছে। মনে হয়না আজ আর থামবে। ছাতা মেলে দরজায় পা বাড়ালো।
অরুপ বাবু তাহলে এবার যাই। সন্ধ্যে হয়ে এলো বলে।
ঠিক আছে তাহলে যান!
নাহ্ অরুপ বলবেনা বসে যান একটু কিংবা চা খান এককাপ,এসব ওর ধাচে নেই আছে খালি জ্ঞানগর্ভ কথা।
সিড়ি পেড়িয়ে চোখ কপালে উঠার মতো অবস্থা, নিচে তাকিয়ে আক্কেল গুড়–ম হয়ে গেল দয়মন্তির!! রাস্তায় থই থই পানি; স্রোত বইছে, নিচের পানাঢাকা পুকুরটা ডুবে গেছে। ফিরে এলো দরজার সামনে।

-এবেলা বাড়ি না গেলে পরে তো আর যেতে পারবেন না, অরুপ এই কথা বলতে বলতে সামনের জানালায় তাকালো, আরে রাস্তাতো ভরতি হয়ে যাচ্ছে পানিতে।
সর্বনাশ!! পানি বাড়ছে যে, ডুবতে হবে নাকি; মরন-টরনের ভয় নেই অরুপের। বিধিলিপি কি বদলানো যায়? চিন্তা এখন একটাই দয়মন্তি এখনো বাড়ি যেতে পারেনি!!
- অরুপ বাবু বাড়ি যাবো কি করে? এখন গেলে সাঁতরে যেতে হবে, আমি আবার সাঁতার জানিনা।
- হয়তো বোট নামবে; একটু পড়েই যেতে পারবেন
- এটা ম্যারিকা না যে দ্রুত সাহায্যের জন্য বোট নামবে; এটা মফস্বল এলাকা।
- হয়তো আপনাকে নিতে বাড়ি থেকে লোক আসবে।
- কি করে আসবে, সাঁতরে!! কাকাবাবু বড্ড বিশ্বাস নির্ভর লোক, সে জানে অরুপ বাবু তার খুব ভালো মানুষী বোকারাম ছাত্র। আর যাই হোক দ্রুপদীর বস্ত্র হরণ করার সাহস তার হবেনা।
দয়মন্তি কিছুক্ষণ বসে রইলো ; পানিতে গ্যাসের লাইন ডুবে গেছে, বাতিটাও হঠাৎ তাই নিভে গেল। মোম জ্বাললো অরুপ।
ভজহরি নেই এক সপ্তাহ বাড়ি গেছে। আজকাল তাই হাত পুড়িয়ে তাকেই রাঁধতে হচ্ছে। উপায় নেই, লক্ষী ছাড়া ঘর এলোমেলো হয়ে আছে,বিচ্ছিরি কান্ড!! দয়মন্তি ভেতরে এসো বসলো।
‘রান্নার আয়োজন করছেন নাকি’
- হ্যা, রাতের,কেরোসিন নেই। মোম ও শেষ হয়ে আসছে। আজ বোধহয় বাতি জ্বলবে না তাই রাত হবার আগেই রান্নাটা করতে হবে। তাছাড়া বৃষ্টি কমে এসেছে আপনাকের তো যেতে হবে!!
-তারাতে চাইছেন নাকি? বসে ছিল দয়মন্তি ছট করে উঠে দাড়ালো, ছাতা মেলে সোজা রাস্তায় তখনি আবার ঝুপ বৃষ্টি নামলো।
রান্নাঘরে চুলো জ্বালাতে গিয়ে চোখ জ্বলে উঠলো, অরুপের মনটা দু’ডানার চিল হয়ে গেল, নিচে যা পানি জমেছে। দয়মন্তি যেতে পারবে বলে তো মনে হয়না। অথচ কি করবে ও, এখানে রাখাও তো বিপদ !!

ছাতা হাতে নিয়ে নিচে নামলো। অন্ধাকার হয়ে গেছে চোখ তাই বেশি চলে না, চোখের জমিনে কিছুতেই চোখ পড়লো না দয়মন্তিকে, পানিতে ভেসে গেল কি ? রঞ্জিত বাবু কে কি বলবো?
কিছুটা সময় ভেবে-টেবে এসে ঘরে ঢুকতে যাবে ; দূরের বারান্দায় কে দাড়িয়ে? দয়মন্তি’ ভিজে শাড়ীতে হাতে ছাতা নেই, হাওয়ায় উড়ে গেছে।
- আসুন ঘরে আসুন?
- আপনি যান বৃষ্টি থামলে চলে যাবো।
- পানিতে পড়লে আপনাকে তো আর পাওয়া যাবেনা।
- সেও ভালো পাথরের গায়ে ফুল হতে হবে না।
- আসুন তো !
ঘরের ভেতর ঢুকে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে দয়মন্তি বললো , ভিজে কাপরে গায়ে জ্বর আনব নাকি একটা শুকনো কাপর দেয়া যাবে?
মেয়েদের কাপড় এখানে আসবে কোত্থোকে? আমি তো প্যান্ট-লুঙ্গি ছাড়া কিছু পড়ি না, -এবার তাহলে নিচে নামতে হয়!
- কেন?
- ও পাশের কারো বাড়ি থেকে শাড়ি নিয়ে আসি!
- কি বুদ্ধি বোকার!! বে-কার তালপাতা আর কি? লোক না জানালে হচ্ছেনা বুঝি? নিজের শুকনো কাপর দিন?
- আপনি এক মিনিট দাড়ান?
- দাড়িয়েই তো আছি এবার কি পটের মুর্তি হতে বলছেন?
অরুপ ছুটে গেল ভজহরির ঘরে ওর প্যাটরা খুলে কালোরঙ্গা একটা শাড়ি পেল; তাই নিয়ে এল।
ব্যাপার কি ঘরের ভেতর মেয়েছেলের শাড়ি; বলি কিছু-টিছু কেস্ আছে নাকি?
অরুপ মাথা চুলকে বলে আরে নাহ্, ভজহরির বউ কদ্দিন আগে যে এসছিলো, ফেলে গেছে আর কি?
শাড়ি চেঞ্জ করতে গেলাম, ভাষ্কর্য হয়েই এখানটায় থাকবেন যেন।
সিগারেট জ্বালালো অরুপ, ধোয়া ছাড়লো মুখ টিপে টিপে। দয়মন্তির গলায় যা ঝাজ। যাই হোক ‘এই সময় সিগারেট খাওয়া তার নেশা’।

খুব ভারি বর্ষণ হচ্ছে। দোচালা ঘরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেবে।
‘আমার দিকে চোখ তুলে একদম তাকাবেন না? শাড়ি না হয় পাল্টেছি কিন্তু ভেজা জামা, কি করবো? তাই আপাতত শাড়ি দিয়েই।
দয়মন্তি চুল ছেড়ে বিছানায় বসলো।
অরুপ রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললো, জ্বর না বাধাঁতে চাইলে তোয়ালে জড়িয়ে নিতে পারেন? আবার ন্যাকামো থাকলে দরকার নেই; ওটা আমি ব্যাবহার করি কি-না।
- হয়েছে থাক লাগবেনা,এমনি চুল শুকাবে।
চুলা জ্বেলে রান্নার আয়োজন করলো অরুপ। বৃষ্টি আজ থামবে না,,ভেতর ঘরের আলো যে কখন নিভে গেছে বুঝতেই পারেনি ও উঠে দাড়াতেই ভয় লেগে গেল! ঘর আধার! দয়মন্তি কোথায়? -এই যে শুনছেন?
- হুম ! ভয় নেই! পেছনেই আছি। রান্না করুন।
- দেয়ালের ভুত হওয়া হচ্ছিল নাকি? দেয়াল সেটে দাড়িয়ে আছে দয়মন্তি।


তিন.

ওদের খাওয়ার পরপরই ঘরের সব আলো ফুরিয়ে এলো। একটা তেলের প্রদীপও নেই যে আজ জ্বালাবে। টর্চ নেই, ভরসা হলো দেশলাই, কাঠি আছে মাত্র পাঁচটা।
এখানে পানি খুব উতলা, এই টিলা ডুবে যেতে পারে পেছনের যে বর্ষণ হচ্ছে পাহাড়ে, পানির স্রোতে স্কুল সহ ভেসে যেতে কোন বাধাঁই লাগবে না।
দয়মন্তির মুখে এসব শুনে কিছুটা ঠান্ডা হয়ে গেছে অরুপ।
বিছানা একটা মেঝেতেই শুতে হবে তাকে।
নিন শুয়ে পড়–ন বলে মেঝেতে শুয়ে পড়লো ও। চুল বেঁধে দয়মন্তি খাটে শুয়ে পড়লো । প্রচন্ড রকমের বাজ পড়ছে ঘর কেপে উঠছে। বুকে দিদ্রিড়িম করে লাগছে দয়মন্তির। কেটে যাচ্ছে একটু একটু করে ভয়ানক প্রহর ভয় তাড়াতেই হয়তো দয়মন্তি বললো Ñ - কেন?
- কামড় দেব!
- কি বলেন?
- হুম!
অরুপ চুপ করে গেল।
‘ কি হলো হাত দেন? আমার ভয় করছে ! আপনার হাতটা ধরবো?
অরুপ হাতটা বাড়িয়ে দিল। শীতল হাত, উত্তাপ নেই; কেমন যেন সাপের মতো।
- মেঝেতে পানি জমে যাচ্ছে, দাড়িয়ে থাকতে হবে মনে হচ্ছে?
- তাই থাকুন, এখানে শোয়ার ধান্দা করা যাবেনা। শরীরে শরীর লাগলে ঘুম হয়না আমার।
এভাবেই কাটলো বেশ কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত দয়মন্তির পাশেই শুতে হলো অরুপকে। শর্ত একটাই গায়ে গা-লাগানো যাবেনা।
দয়মন্তি নীরবতা ভেঙ্গে বললো, আপনার হাত এতো ঠান্ডা কেন? হঠাৎ কোথাও বাজ পড়লো হাতটা শক্ত করে ধরলো পুনরায়। অরুপ ঠান্ডা হয়েই ছিল একটা ছোট্ট দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো, যার জীবনটাই ঠান্ডা হয়ে আছে, যার কোন উত্তাপ নেই, তার হাত তো ঠান্ডা হবেই।
- তো উত্তাপহীন ভাবে এখানে পড়ে আছেন কেন? আজ যা স্রোতের তান্ডব মরেও যেতে পারেন!
- না হয় গেলাম, কিন্তু এখানে থাকা ছাড়া যে আমার কোন উপায় নেই
- সত্যিই

ঘরের একপাশে পানি জমে গেছে। প্রচন্ড বর্ষন হচ্ছে। ঘর কাপানো বজ্র দানবের শব্দ।
- শুনছেন ওপাশটায় ফিরুন? ভয় করছে আমার ! দয়মন্তি তরল কন্ঠে বলে গেল। অরুপ উল্টো দিকে মুখ ফেরালো, পেছন থেকে দয়মন্তি ওকে ধরলো । আবারও প্রচন্ড কাপুনি দিয়ে কাছে কোথাও বজ্রপাত হলো। মনো হলো পুরো ঘরটা যেন দুলে উঠলো।
মিনিট দশেক এভাবেই থেকে আস্তে আস্তে করে নিজেকে সড়িয়ে নিল দয়মন্তি, তারপর বললো আসলেই তুমি অন্যরকম একটা ভালো মানুষ এই উত্তাপেও এভাবে উপেক্ষা করলে..........।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো অরুপ
-এমন ঠান্ডা হয়ে থাকলে কিভাবে একটুও উত্তাপ জাগলো না? নাকি সকাল হবার আগেই মারা পড়তে পারে এই ভয়ে!

দীর্ঘ রাতটা যে কখন দীর্ঘ থেকে স্বল্পতায় নেমে এলো ঘুম ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত অরুপ বুঝতেই পারলো না, চোখ ফেলা যায়না, দয়মন্তির বুকের কাপর সরে গেছে; শরীরে শিরশির উঠে আসবার আগেই ঘর ছেড়ে বাইরে চলে এল।
চারপাশটাকে যেন কোন দানব এসে তছনছ করে দিয়ে গেছে। পানি নেমে আসছে আস্তে আস্তে। এ যাত্রায় বেচেঁ গেল। সত্যিই পাশে একজন কেউ থাকা প্রয়োজন নয়তো বেচেঁ থাকাটা কষ্টের হয়ে দাড়ায় !! একা এ ঝড়ের রাত পাড়ি দেয়া হয়তো হতোইনা , হয়তো স্রোতে ভেসে যেতে হতো।

দৌড়ে ঘরে ছুটে এলো অরুপ। বিছানায় দয়মন্তি তখনও ঘুমুচ্ছে।
ওর মুখের উপর ঝুকে বললো, এই মেয়ে আমার ঘরের ঘরনী হবে?
হঠাৎ কানের কাছে কথা শুনে হকচকিয়ে তাকালো দয়মন্তি। অরুপ বললো আমার মেয়ে তুমি বধূ হবে?
‘ঠোট টিপে হাসলো ঘুমচোখ নিয়ে’ তারপর বললো কার ঘরনী হব? তোমার?
- তোমার মতো পাথরকে করবো বিয়ে?
- পাথরের জীবনটা তুমিই সাজাতে পারবে?
- পারবো না!!
- পারতে তোমাকে হবেই

সূর্যের উত্তাপ গগন ছড়াবার আগেই অরুপের চোখ জোড়া ঝাপিয়ে পড়লো ওর চোখে।




সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:১৯
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন পারাবার: শঠতা ও প্রতারণার উর্বর ভূমি

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪০


অনার্সের শেষ আর মাস্টার্সের শুরু। ভালুকা ডিগ্রি কলেজের উত্তর পার্শ্বে বাচ্চাদের যে স্কুলটা আছে (রোজ বাড কিন্ডারগার্টেন), সেখানে মাত্র যোগদান করেছি। ইংরেজি-ধর্ম ক্লাশ করাই। কয়েকদিনে বেশ পরিচিতি এসে গেল আমার।

স্কুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×