জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং কিছু কথা...
গত শনিবার, ১৩ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। প্রথম দিনের পরিসংখ্যান মতে প্রতি আসনের জন্যে ১০৯ জন করে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। প্রতিবারের মতো এবারও এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে যেন মেলা বসেছে ক্যাম্পাসে! ৭০০ একর এর বেশি জায়গা নিয়ে যে ক্যাম্পাস, পরীক্ষা চলাকালীন সেই ক্যাম্পাস এ যেন তিল ধারণের জায়গা নেই। পরীক্ষা কেন্দ্র-গুলির সামনে অভিভাবকদের জনসভা, আর অন্যান্য জায়গায় পরিবারের সকলের পিকনিক পিকনিক আমেজ! প্রতি পরীক্ষার্থীর সাথে গড়ে তিনজন মানুষ, ছেলেটি অথবা মেয়েটি এসেছে মাত্র এক ঘণ্টার এই পরীক্ষা দিতে, আর বাকি সবাই এসেছে পিকনিক করতে। এমনিতেই এ ক্যাম্পাস প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত, সবাই তাই এক ঢিলে দুই পাখী মারার ধান্দায় ব্যস্ত! আর বিভিন্ন সংগঠন এর ইনফরমেশন স্টল গুলির কারণে ডেইরী গেট থেকে শুরু করে শহীদ মিনার পর্যন্ত পুরো এলাকায় এখন গ্রাম্য মেলার আমেজ! শুধু ইনফরমেশন নিলেই হবে?? খাওয়া-দাওয়া লাগবে না? অবশ্যই লাগবে, আর তাইতো ইনফরমেশন স্টল গুলির ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন খাবারের দোকান। কি নেই সেখানে? সাধারণ চা-বিস্কুট,ফুচকা থেকে শুরু করে পোলাও-বিরিয়ানি এমনকি হালের ফাস্ট ফুড , সবই মিলছে!
শুনে খুব লোভ হচ্ছে, তাইনা? ভাবছেন, পাইসি, এইটাই ত চান্স, ঘুইরা আসি জা. বি. থেইকা! ঘুরাঘুরিও হইব, খাওয়া দাওয়াও হইব, আর লাক ভাল হইলে কিছু হুর-পরীরও দেখা পাওয়া যাইতে পারে!
ভাই/আফা, থামেন। এতক্ষণ যা যা কইছি তা একটুও মিথ্যা না! বাট দ্য নাইট ইজ স্টিল ইয়াং! এতক্ষণ যে ব্যাপারগুলোকে খুবই লোভনীয় মনে হচ্ছিল, তার সবগুলাই অনেক বড় বড় সমস্যার জন্ম দিয়েছে আমাদের ক্যাম্পাস লাইফ এ। এবং এটা যে শুধু এবারই ঘটছে ব্যাপারটা, তা কিন্তু না, প্রতি বছরই ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন এ ধরনের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের......
প্রথমত, জনসংখ্যা সমস্যা! ভাই, বিশ্বাস করেন, ভয় লাগে! এত মানুষ একসাথে দেখলেই ভয় লাগে! আমরা এখানে যারা পড়ি, অসামাজিক হিসেবে আমাদের বদনাম আছে, আমরা সাধারণত এত মানুষ একসাথে দেখি গ্যাঞ্জাম লাগলে, সেটা আলাদা ব্যাপার!
ভাবছেন এভাবে তাদেরকে ছোট করে দেখলাম? গার্মেন্টস কর্মীদের সাথে তুলনা করে? তাহলে বলি, এছাড়া আর কিই বা বলা যেত? মিছিল? হাহ! ভাইরে, সে জিনিসও কি দেখতে বাকি আছে? ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটির ক্যাম্পাসে অবস্থানরত বিভিন্ন হল এর কর্মীদের উপুর্যুপুরি লাল গোলাপ শুভেচ্ছায় ক্যাম্পাস আজ সিক্ত! মানুষজন ঠিকমত হাটতেই পারছে না, তার মধ্যে কিছুক্ষণ পর পর একেক হল থেকে তারা আসেন কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির চামড়া তুলে নেয়ার উদ্দেশ্যে, মুখে এই বুলি থাকলেও সামনের ব্যানারে কিন্তু বড় বড় করে লেখা, নবীন ভাই-বোনদের লাল গোলাপ শুভেচ্ছা, ক্যাম্পাসের পরিভাষায় যার নাম শোডাউন! আর কবি বলেছেন, আমরা শক্তি আমরা বল... কোন বাধাই তাদের শুভেচ্ছা জানানর পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না! এই যে একটু আগে বললাম মানুষে মানুষে সয়লাব, এ পরিস্থিতিতেও তারা পেছপা হন না, ঝোপ-জঙ্গল সব ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে জেতে থাকেন তারা! এরকমই এক দৃশ্য দেখলাম শনিবারে, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে। শহীদ মিনার হয়ে একটি শোডাউন আসছিল সমাজবিজ্ঞানের দিকে, কিন্তু সামনে এগুনোর উপায় নেই মানুষের জন্যে। তখন নেতা কি করলেন? রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, নেতা মিছিল নামিয়ে দিলেন রাস্তার পাশে! সে দৃশ্য ভোলার নয়, প্রচুর অভিভাবক সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাদের অপ্রস্তুত করে দিয়ে বীর-দর্পে এগিয়ে গেল শুভেচ্ছা বাহিনী! সেখানে যারা দাঁড়িয়েছিলেন তারা তাদের সন্তানকে এরপর এখানে ভর্তি করবেন কিনা, সন্দেহ হয় আমার!
পিকনিক পিকনিক!!! পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোর আশেপাশে প্রায় প্রতিটা গাছের নিচে, খবরের কাগজ বিছিয়ে চলছে মিনি পিকনিক। একজন পরীক্ষা দিতে এসেছে, তার পরিবারের বাকি সদস্যরা সবাই তাকে উৎসাহ দিতে হাজির। বাবা-মা, মামা, চাচা, কোলের গ্যাদা বাচ্চাটা পর্যন্ত! খাওয়াদাওয়া, আড্ডা চলছে, সেই সাথে চলছে ক্যাম্পাস নোংরা-করণ প্রকল্প। ক্যাম্পাসে কিছুদূর পরপর ময়লা ফেলার ডাস্টবিন থাকলেও, সেগুলো সম্ভবত মানুষজনের ভিড়ে কার চোখে পড়ছে না! যত্রতত্র খাবারের উচ্ছিষ্ট, আবর্জনা কাগজপত্র পড়ে আছে। মাছি উড়ছে ভনভনিয়ে, ক্যাম্পাস এর নেড়ি কুত্তাগুলি ঘুরছে এদিক সেদিক, উচ্ছিষ্টের খোঁজে। সব মিলিয়ে এক নারকীয় পরিবেশ।
এবার ইনফরমেশন স্টল-গুলোর কথায় আসি। আমার ক্যাম্পাসে যে এতগুলি সংগঠন আছে, প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষা না হলে আমার জানাই থাকত না! বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ত আছেই, সারা বছরে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে তারা জানান দেয় যে তারা আছে, সেই সাথে এখানে আছে বিভিন্ন জেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতি। ঈশ্বর আমাদের উপর খুবই সদয়, কেননা ক্যাম্পাসে পঁয়ষট্টি জেলার সবগুলোর সমিতি নেই! থাকলে তথ্যকেন্দ্রের বিস্তার বাড়তে বাড়তে হল পর্যন্ত চলে আসতে পারত! সারা বছর যাদের কোন প্রকার খোঁজ খবর নেই, সেই সমিতিগুলোই ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়! এবং এটা দিন দিন বাড়ছে। আমি যখন ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসি, তখন সবগুলো স্টল মিলিয়ে মেহের চত্বরও পার হয় নি। এবার কিছু কিছু স্টল শহীদ মিনার ছুঁয়েছে। এমনিতেই মানুষের কারণে হাটা যাচ্ছে না, তার উপর এই স্টল গুলো যাতায়াতের পথকে করেছে সঙ্কুচিত। যেখানে সবগুলো সংগঠন মিলে একটা বড় আকারের তথ্য কেন্দ্র বানালে কাজ হয়ে যায়, সেখানে কর্তৃপক্ষ যে কি মনে করে এত-গুলো স্টল বসানোর অনুমতি দেন, আমার তা বোধগম্য নয়।
খাবারের দোকান প্রসঙ্গে বলি। সাধারণ রুটি, চা- সিগারেট এর দোকান হলে কথা ছিলো। তেহারি, বিরিয়ানি, ফুচকা, ফাস্ট ফুড সব কিছুর দোকানই আছে। ছায়ার নিচে আগে যেখানে অভিভাবকেরা দাড়িয়ে থাকতেন, সেখানে সারি সারি চেয়ার টেবিল বিছিয়ে তারা পসরা সাজিয়ে বসেছেন। সবাইকে বাধ্য হয়ে তাই দাঁড়াতে হচ্ছে রাস্তায়, যাতায়াতের ঘটছে বিঘ্ন। খাবারের দামও বেশ গলাকাটা, সুযোগ পেয়ে যে যার মত পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। আর পিকনিক পার্টির মতোই, এই দোকানদারেরা আবর্জনা এবং উচ্ছিষ্ট ফেলছেন দোকান এর আশেপাশেই অথবা নিকটস্থ পুকুরে! ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলে এই জায়গা দিয়ে হাঁটা চলা করাই দায় হয়ে পড়বে। আমাদের গত ভিসি তো পরীক্ষা শেষ হবার পর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের মাঠে নামিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচীতে লাগিয়ে দিয়ে ব্যাপক আলোচিত(কারো কারো কাছে সমালোচিত!!) হয়েছিলেন। অনেকেই তখন তার এই উদ্যোগ কে স্বাগত জানিয়েছিল। গালভরা কিছু শ্লোগান সহকারে মানুষকে শুভেচ্ছা জানানর চাইতে এই ক্যাম্পাস-বান্ধব উদ্যোগ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য এবং সময়োপযোগী ছিল। দেখা যাক এবারের ভিসি কি পদক্ষেপ নেন।
এবার সবচেয়ে বড় সমস্যায় আসি, যাতায়াত সমস্যা। আমাদের ক্যাম্পাস এ যাতায়াত এর সবচেয়ে বড় ঝামেলা হল, আমাদের রাস্তা একটাই, ঢাকা আরিচা মহাসড়ক। বিকল্প কিছু যাতায়াত এর ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় প্রচুর। বিভিন্ন জায়গা থেকে পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা আসার সময় শুরুতেই যাতায়াতের এই দুর্ভোগের সম্মুখীন হন। ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি পাবলিক পরিবহন ক্যাম্পাস অভিমুখে আসে, বর্তমানে হানিফ যার মধ্যে জনপ্রিয়। এই পরীক্ষার মৌসুমে হটাৎ করেই হানিফ তাদের ভাড়া বাড়িয়ে ৫০ টাকা করেছে, কোন প্রকার আগাম কারণ ছাড়াই। বাকি পরিবহনগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। সরকারী পরিবহন বিআরটিসি এর নবীনগর থেকে মতিঝিল রুটের বাসগুলো হটাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ পর পর দু’একটা বাস আসলেও তাতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। আর লোকাল বাসগুলোর কথা কিছু নাই বললাম।
এই যখন অবস্থা, তখন কিছু পরীক্ষার্থী ভার্সিটির স্টুডেন্ট বাসে করে ক্যাম্পাসে আসার দুঃসাহস দেখায়! গত শুক্রবার বঙ্গ-বাজারে এই নিয়ে ঘটে বিপত্তি। সন্ধ্যা ৬টায় সেখানে দু’টি বাস ক্যাম্পাসে আসার জন্যে দাড়িয়ে ছিল। এদের একটি কমিউনিটি বাস, যেখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের লোকদের জন্যে। যাই হোক, ৬টা বাজার আগেই দু’টি বাসই পুরোপুরি ভরতি, দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। বেশ কয়েক দফায় পরীক্ষার্থীদের নামিয়ে দেয়া হল বাস থেকে, তবুও ক্যাম্পাসের ছাত্রদের সবাই বাসে জায়গা পাচ্ছে না। হটাত কোথা থেকে এর শিক্ষক উদয় হলেন, কমিউনিটি বাসে জায়গা পান নি। তিনি এসেই বাসের সকল ছাত্রছাত্রীদের নামিয়ে দিলেন, এবং বাসটিকে টিচার বাস হিসেবে ঘোষণা দিলেন! ছাত্রছাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ তার মনে কোন রেখাপাত করলো না। সবাইকে ৭টার বাসে আসতে বলে তিনি একাই সে বাসে পায়ের উপর পা তুলে ক্যাম্পাস অভিমুখে রওয়ানা দিলেন!! হ্যাটস অফ স্যার! ৭টার বাস আসার আগ পর্যন্ত, এবং পরেও বহুবার আপনার কথা মনে পড়েছে আমাদের। প্রচুর সুনাম গেয়েছি আপনার, আমরা সবাই মিলে, সামনে থাকলে শুনতে আপনার কাছে ভালো লাগত না হয়ত, অবশ্য কোন কথা গায়ে লাগার মতো অবস্থায় আপনারা আছেন বলে আমার জানা নেই। ক্যাম্পাসে আপনারা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় বলেই বিবেচিত আমাদের কাছে, যাদেরকে ছুঁয়ে দিলেই জাতপাতের চিন্তা ভিড় করে মনে।
কথায় কথায় অনেক দূরে চলে এসেছি। বলছিলাম পরীক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কথা। যাইহোক, সবাই কোন না কোনভাবে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়, পরীক্ষা দেয়ার জন্যে। মুল সমস্যাটা হয় পরীক্ষা শেষে। সবাই একসাথে ছুটছে বাসস্টপে, সেখানে বাসের জন্যে হাহাকার। কিন্তু সবাইকেই তো বাড়ি ফিরতে হবে তাইনা। তাই কেউ কেউ বাসের ছাদে, কেউ ট্রাকে চড়ে যাচ্ছে বাসায়। গতকাল সন্ধ্যায় দেখলাম এক ট্রাক ভর্তি ছেলে যাচ্ছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। মনে পড়ে গেল, ছয় বছর আগে আমিও এভাবে ট্রাকে চেপেই বাসায় ফিরেছিলাম, অন্য উপায় না পেয়ে। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে যাচ্ছে এই সম্ভাবনাময় মুখগুলো, কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নেবে? দুর্ঘটনায় পড়লে কি হয় সবারই জানা, অনেক গুলো বাস ভাংচুর হবে, রাস্তা অবরোধ হবে, পরের দিনের পেপারে ছোট করে একটা নিউজ আসবে, “মেধাবী ছাত্রের অকাল মৃত্যু”। তারপরে সব শেষ। কিন্তু এই চক্র কি এভাবেই চলতে থাকবে?? ক্যাম্পাসে যারা পরীক্ষা দিতে আসছে, তাদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব কিছুটা হলেও কিন্তু ক্যাম্পাসের প্রশাসনের উপর বর্তায়। শুধু প্রসপেক্টাস এ ‘পরীক্ষার্থীদের জন্যে ক্যাম্পাস থেকে কোন বাস দেয়া হবে না, সবাইকে নিজ উদ্যোগে আসতে হবে’ এই কথাটা লিখে দিয়েই দায়িত্ব এড়িয়ে যায় ক্যাম্পাস। অথচ চাইলেই ক্যাম্পাস প্রশাসন এবং বিআরটিসি এর যৌথ উদ্যোগে পরীক্ষা চলাকালীন ন্যায্য ভাড়ায় কিছু বাস চালু করা যেতে পারে। তাতে পরীক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগত সকল পরীক্ষার্থীকে আমার তরফ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



