somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভৌতিক গল্প: ছায়াশিশু (প্রথম পর্ব)

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক
তখন আমার বয়স কম, ২৪ হতে পারে বড়জোর।হাসবেন্ড পুলিশ ক্যাডারে জয়েন করেই আমাকে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন নতুন শহরে।এর আগে তিনি বেসরকারি একটা কলেজে পড়াতেন।ভদ্র নম্র মানুষটিকে শিক্ষক হিসাবেই বেশি মানাতো কিন্ত কপালদোষে তাকেই হতে হলো পুলিশ।নতুন ইউনিফর্ম পড়ে বের হওয়ার আগে প্রতিদিন তিনি নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়নাতে দেখতেন।আমার চোখে চোখ পড়লে লাজুক হাসি হাসতেন।

আমাদের সরকারি কোয়ার্টার টা বেশ চমৎকার এক জায়গায়।ইঁটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিমছাম এক তলা বাসা।সামনে দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তা চলে গেছে একেবেঁকে একদম নদীর ধার পর্যন্ত।আমাদের বাসাটাই কলোনীর শেষ বাসা।তারপর দুএকটি পুরোনো পরিত্যাক্ত কোয়ার্টারের পর জঙ্গল।

আমি প্রথম কয়েকদিন বাসা গোছানোর উন্মাদনার পর আবিষ্কার করলাম করার মত তেমন কোনো কাজ আমার হাতে নেই।সময় কাটানোই যেন একটা সমস্যা হয়ে গেল।একটু বিকেল হলেই আমি তাই একা একা এদিকে সেদিকে ঘুরে বেড়াতাম।পাশের পুরাতন কোয়ার্টারে গিয়ে কুল বড়ই আর আমলকি পেড়ে খেতাম।বাঁধানো বকুল গাছের নিচে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম আবার মাঝে মাঝে জঙ্গলেও চলে যেতাম পায়ে পায়ে।প্রথম দিকে অবশ্য একটু ভয় ভয় লাগত কিন্ত পরে আবিষ্কার করলাম বাইরে থেকে দেখতে যত ঘন আর ভয়ানক মনে হয় ভেতরটা তার চেয়ে অনেক ফাঁকা।বেশ রোদ হাওয়া আসে।ভেতরে কিছু মাটির পায়ে চলা রাস্তা আছে।আমি মাঝে মাঝেই সেই রাস্তা ধরে হেঁটে বেড়াতাম।

আমার হাজবেন্ড আমার এই ছেলে মানুষী শখের কথা জানতেন।আমি মাঝেমাঝে তার জন্যেও ফলমূল নিয়ে আসতাম তিনি সেগুলো বেশ শখ করে খেতেন।পুলিশের বউকে কোনো বাজে লোকে জ্বালাতন করবে এমন ভয় ছিল না তাই তিনি মানা করতেন না।তার শুধু একটাই ভয় ছিল কোনো সাপখোপ যেন আবার না কামড়ায়।তাই সাবধানে থাকতে বলতেন।


একদিন দুপুরবেলা খাওয়া সেরে কেন যেন ভাল লাগছিল না।উনি যে খেতে আসবেন না তা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন।তাই পায়ে পায়ে বেরিয়ে পড়লাম।বাইরে কটকটে রোদ কিন্ত জঙ্গলের ভেতর সেই রোদের তাপ গিয়ে পৌঁছায় না কিন্ত কেমন যেন আলো ছায়া খেলা করে।সেদিন মাটির পথ ধরে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গেলাম।খেয়াল হলে বুঝতে পারলাম এদিকে এর আগে আসিনি।গাছপালাও বেশ ঘন এখানে।যখন ফিরতে যাব তখন দেখলাম একটা পায়েচলা পথ চলে গেছে ডানদিক ধরে যদিও তা গাছপালায় প্রায় ঢেকে গেছে তবুও বেশ বোঝা যায়।আমার কৌতুহল বরাবরই বেশি তাই আমি শাড়ির আঁচল বেশ করে কোমরে পেঁচিয়ে আগাছা মাড়িয়ে জঙ্গল সরিয়ে হাঁটা দিলাম।কিছুদূর গিয়েই পথ শেষ হয়ে গেল।দেখলাম সামনেই ঘাসে ছাওয়া খানিকটা ফাঁকা জায়গা আর সেখানে একটা পুকুর।ছোট পুকুরটাতে টলটলে সবুজ পানি।সবচেয়ে যে জিনিসটা দেখে অবাক হলাম সেটা হচ্ছে পুকুরের জরাজীর্ণ শান বাঁধানো ঘাটে বসে একটা ছোট্ট মেয়ে খেলছে।পুকুরের অপরপাড়ে একটা বাড়ির ধ্বংসস্তুপ গাছগাছালি আগাছাতে ছেয়ে গেছে।এমন নির্জন জায়গাতে কার বাচ্চা একাএকা খেলছে বুঝতে পারলাম না।পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম।ডাকলাম,এই বাবু তোমার বাসা কোথায়?তোমার নাম কি।মেয়েটি মুখ তুলে একবার তাকিয়ে আবার খেলায় মন দিল।শ্যামলা বরনের বেশ ফোলাফোলা গালের বাচ্চা।বয়স হয়ত বছর তিন চার হতে পারে।গায়ে একটা লাল জামা তাতে বড় বড় হলুদ ফুল।একদম ছোট করে ছাঁটা চুলে মেয়েটির মুখটি বড় মিষ্টি লাগছে।

শুনেছি জঙ্গলের অপর দিকে নদীর পাড়ে জেলেদের গ্রাম।এই মেয়েটি হয়ত জেলেদেরই মেয়ে।খেলতে খেলতে এখানে চলে এসেছে।জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে অনেক কেই মাথায় মাছের ঝাঁকা নিয়ে শহরের দিকে যেতে দেখি কারন নদীর ধার থেকে পাকা রাস্তা দিয়ে যেতে অনে ঘুরপথ হয়।মেয়েটি হয়ত বাবা-মার সাথে এসেই জঙ্গলের রাস্তা চিনেছে।যাই হোক সেটা নিয়ে আর বেশি ভাবলাম না।পুকুরের ধারে কৃষ্ণচূড়া, কড়ই, বকুল এমন অনেক ফুলের গাছ।ঘাটের উপরে যে বসার জায়গা তারপাশে বড় দুইটি শিউলি গাছ।সাদা ফুলে পাথরের বেঞ্চ ছেয়ে আছে।উষ্ণ দুপুর,চনমনে হাওয়া ফুলের গন্ধ সব মিলিয়ে আমার কেমন ঝিমঝিম লাগতে লাগল।আমি আঁচল দিয়ে ফুল পাতা ঝেড়ে পাথরের বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম।এরপর কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি তা বুঝিনি।ঘুম ভাঙলে দেখলাম রোদ পরে গেছে।ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি মেয়েটি তখনও চলে যায়নি বরং পানিতে পা ডুবিয়ে দুপায়ে পানি নেড়ে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ করে খেলছে।আমি উঠে বসে ভাবলাম বাসায় যেতে হবে কিন্ত তার আগে বাচ্চাটিকে বাড়ি পৌঁছে দেয়া উচিত।আমি একটু সামনে গিয়ে ডাকতেই মেয়েটি আমার পিছুপিছু আসতে লাগল।

আগে যদিও জেলে গ্রামে যাইনি তবুও আন্দাজের উপর সামনে হাঁটতে লাগলাম।একসময় জঙ্গল শেষ হয়ে আসল।দেখলাম ছন বাঁশ আর টিনে ছাওয়া গায়ে গায়ে লাগা অনেক ঘর।বাচ্চা মেয়েটি লাফাতে লাফাতে এমনি কিছু ঘরের আড়ালে চলে গেল।আমিও কৌতুহল নিয়ে জেলে পাড়া ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।এখানে সেখানে জাল শুকাতে দেয়া।এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে হুল্লোড় করে খেলে বেড়াচ্ছে।কিছু দূরেই নদী,কেউ কেউ গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।এদের দেখেই বুঝলাম কিভাবে বাচ্চা মেয়েটি জঙ্গলে পানির ধারে নির্ভয়ে একাএকা খেলছিল।গরিব বাবা মা জীবিকার সন্ধানে এত ব্যস্ত থাকে যে বুকের দুধ ছাড়ার পর বাচ্চাদের একা ছেড়ে দেয়।বাচ্চারাও ঠিকই বিপদআপদ কাটিয়ে একা চলতে শিখে যায়।কিন্ত আমরা বাচ্চাদের এত বেশি ধরেবেঁধে রাখি যে বড় হয়ে গেলে যখন সময় আসে তখনও তারা একা চলতে ভয় পায়।

আনমনে হাঁটছি এমন সময় একটা কুটির থেকে এক মহিলা হা হা করে ছুটে এল।দেখলাম সে মহিলা আর কেউ না আমাকে যে প্রায়ই তাজা মাছ বিক্রি করে যায় সেই কান্তি।ছিপছিপে শরীর হলে কি হবে শরীরে তার বেজায় জোর।মাথায় ঝাঁকা চাপিয়ে জোর চিতকারে দুপুরের বাতাস কাঁপিয়ে সে মাছ ফেরী করে।আমরা দুজনেই তাজা মাছ পছন্দ করি বলে প্রায়ই তার থেকে মাছ নিই।দাম নিয়ে ক্যাচক্যাচ করিনা বলেই হয়ত সে আমায় একটু বিশেষ রকম খাতির করে।সে হাত ধরে নিয়ে মাটির দাওয়ায় পিড়ি পেতে আমায় বসাল।দেখলাম ছোট হলেও বেশ ছিমছাম পরিষ্কার ঘরদুয়ার।চারটি ছেলে মেয়ে তে ঘর ভরা।সে আমায় কি খাতির করবে তা বুঝে পাচ্ছিল না।শেষ পর্যন্ত তার হাতের মুড়ি আর নারকেলের নাড়ু আমার খাইয়ে তবেই আমাকে ছাড়ল।এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল কান্তি আমাকে বড় রাস্তায় রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে ফিরে গেল।

বাড়ি ফেরার পথে অন্যমনস্ক হয়ে শুধু ভাবছিলাম প্রাচুর্য নেই কিন্ত কান্তির জীবন কি ভীষণ রকম পরিপূর্ন।ঘর আলো করে রেখেছে চার চারটি সন্তান।তার উঠোনে,তার লাউ মাচায়,তার ছনের চালে,তার মাটির দাওয়ায় কেমন যেন এক শান্তি ছেয়ে আছে।মনটা ভরে যেতে চায়।বাড়ি ফিরেও অন্যমনস্কতা কাটলো না।হাসবেণ্ড ব্যাপারটা খেয়াল করে বারবার প্রশ্ন করতে লাগলেন।রাতে যখন আমার অভিযানের কথা জানালাম উনি নিমেষেই বুঝে গেলেন মন খারাপের কারন।

পাঁচ বছর হয়ে গেছে কিন্ত আমার কোলে কোনো ফুল ফোটেনি।কম বয়েসে বিয়ে হয়েছে আমাদের উনি বা আমি কেওই চাইনি পরিবার বাড়াতে।কলেজ থেকে অনার্স শেষ করতে বিয়ের তিন বছর হয়ে গেছে।তারপর দুবছর ধরে আশায় আছি কিন্ত আশা পূর্ন হয়নি।উনি শক্ত আলিঙ্গনে আমায় ধরে রেখে কোমল গলায় আমার সাথে কথা বলেন।যেন এভাবেই সব দু:খ মুছে দেয়া যাবে।কিন্ত আসলেও হয়ও তাই,একসময় আর মনে থাকেনা আমার কোনো অপূর্ণতা আছে,গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতেযেতে নিজেকে খুব সুখি মনে হয় আমার।

পরদিন উনি বলেন যতদিন চাকরি না পাই আমি যদি বাচ্চাদের স্কুলে বা কোচিং এ পড়াই বা এমন কিছু করি তাহলে সময় ভাল কাটবে।আমিও তাই ঠিক করি।কান্তি বলেছিল তার বড় দুটি ছেলে স্কুলে পড়ে কিন্ত ভীষণ বেয়াড়া।স্কুলে যেতে চায় না,পড়া নাকি বুঝে না।প্রাইভেট বা কোচিং এ দেয়া তার পক্ষে সম্ভব না।আমি কান্তিকে বলে দিই ও যেন দুপুরে খাওয়ার পর বাচ্চা দুটিকে আমার কাছে পড়তে পাঠায়।পরদিন থেকে ওর ছেলে দুটি আসে।আস্তে আস্তে অন্যদের ছেলে মেয়েরাও আসতে থাকে।নানা বয়েসি দশ বারোজন বাচ্চায় আমার ঘর ভরে যায়।আমার বেশ ভালই লাগে তাদের পড়াতে।

পড়াতে পড়াতে বিকেল হয়ে যায় তাই ওদের জন্য কিছু নাস্তা দিই।আমার রান্নার শখটা আবার জেগে ওঠে।পাউরুটি, কেক,শিঙাড়া,পিঠা একেকদিন একেক জিনিস পেয়ে বাচ্চারা খুব খুশি হয়।তাদের খুশি দেখে আমিও খুশি হই।জেলের বাচ্চাদের বিনামূল্যে পড়াচ্ছি বলে অন্যবাসার ভাবিরা নাক কুঁচকায় কিন্ত আমি তেমন পাত্তা দিই না।হাসবেন্ডের যখন আপত্তি নেই তখন আর অন্যের কথা শুনে কি হবে।

ব্যাস্ত থাকি বলে বেড়ানো হয়না আর।তবুও মাঝেমাঝে পড়ন্ত বিকেলে বাচ্চাদের সাথে জংগল এর রাস্তায় কিছুদূর হেঁটে আসি।অনেক সময় ওদের সাথে ওদের ছোট ভাই বোন আসে।ওরা বারান্দায় বা বাগানে খেলে।মাঝেমাঝে পুকুরে দেখা বাচ্চাটিকেও দেখি।পড়নে সেই লাল জামা।বাচ্চাটি মনেহয় কথা বলতে পারেনা।একদিন ওর হাতে একটা ডালপুরি দিয়েছিলাম।সে হাত পেতে নিল কিন্ত কিছু বলল না শুধু মায়াবী চোখে তাকিয়ে থাকল।

এর মাঝে একদিন বিকেলে বাচ্চাদের সাথেই হাঁটতে বেড়িয়েছি।ওরা তো একদৌড় দিয়ে হারিয়ে যায়।লাল জামা পড়া বাচ্চাটাই ছিল আমার সাথে সেও কোথায় আড়াল হয়ে গেল কে জানে। তখন দেখলাম কান্তি জোর কদমে হেঁটে আসছে।আমায় দেখে সে থমকে দাঁড়ালো। আমাকে প্রায় জোর করে জঙ্গলের বাইরে এনে বাসার বারান্দায় বসে বলতে লাগল।কোনোদিন যেন আমি একাএকা ওই জঙ্গলে সন্ধ্যার সময় না যাই।কারন জিগাসা করতেই বলল জায়গাটা খারাপ।অনেকেই ভয় পেয়েছে বা খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে।আমি হেসে ফেলে বললাম,কিন্ত তুমি তো ওদিক দিয়েই আস নাকি?সে গম্ভির মুখে বলল তার কাছে শক্তিশালী ওঝার মাদুলি আছে।তাছাড়া সে বা ওদের গ্রামের কেউও নাকি রাতে অই জঙ্গলে যায় না,তখন অনেক ঘুরে পাকা রাস্তা দিয়ে চলাচল করে।পান চিবাতে চিবাতে বারবার বলল খাড়া দুপুর আর সন্ধ্যার পর আমি যেন ওখানে না যাই।আরো ভাল হয় একেবারেই না গেলে।আমি ওকে আর পাত্তা দিলাম না নইলে হাবিজাবি বর্ননা শুরু করতে পারে।রাতে হাসবেন্ডকে কথায় কথায় বিষয়টা জানালে উনিও বলল এমন কথা স্থানীয়দের কাছে শুনেছেন।

দুই

বাচ্চাদের নিয়ে ভালই কাটছিল সময়টা।হঠাত করে জ্বরে পড়লাম।ডাক্তার জানালো টাইফয়েড।বুয়াকে দিয়ে রান্নার কাজ চললেও আমার যে সেবাযত্ন দরকার তা হয় না।তখন এত দূর্বল হয়ে গিয়েছি যে বসে থাকতেও পারিনা বেশিক্ষন।শ্বশুর বাড়ি থেকে কাওকে পাঠানো হবে এমন সিদ্ধান্ত হলো।যখন বিধবা ফুপু শাশুড়িকে কাজের মেয়ে সহ পাঠানো হবে শুনলাম তখন আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম।

সন্তান না হওয়ার ব্যাপারে আমার শাশুড়ি আমায় ভাল মন্দ কিছুই বলতেন না।ভায়ের আশ্রয়ে থাকা হাসবেন্ডের বিধবা ফুপুই বছর না ঘুরতেই গুনগুন শুরু করেছিলেন।তার সাথে যোগ দিয়েছিল বাড়ির নতুন ছুকড়ি চাকরানী।আমার পড়াশোনা নিয়েও অনেক গঞ্জনা শুনতে হয়েছে।শেষদিকে অবস্থা এমন হয়েছিল যে আমাকে চারটা ভাত খেতে দিতেও তাদের আপত্তি।সরাসরি না বললেও শাশুড়িকেও বেশ অসন্তুষ্ট মনে হত এতদিন বাচ্চা না হওয়ায়।আমি অবশ্য হাসবেন্ডের কাছে এসব নিয়ে কিছু বলিনি,মুখ বুজে নিজের কাজ করে গেছি।কার বিরুদ্ধে নালিশ করব?সবাই তো তার আপনজন।বড়ভাবি একবাড়িতেই থাকতেন কিন্ত আলাদা সংসার।উনিই ছিলেন আমার একমাত্র সমব্যাথী।তিনিই হয়ত আমার কষ্টের কথা হাসবেন্ডকে জানিয়েছেন।হাসবেন্ড তাই সরকারি চাকরী পাওয়ামাত্রই আমাকে এখানে নতুন বাসায় এনেছেন।

দেখলাম ফুপু বাসায় এসে সমস্ত সংসার নিজের হাতে নিয়ে নিলেন।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললামআমার সাথেও বেশ মিষ্টি ব্যবহার করছেন।অবশ্য আমার নিজের বাসায় তো আমার সাথে খারাপ আচরন করা যায় না তাছাড়া আমি প্রায় সারাদিনই ঘুমিয়ে কাটাই।।আমি অসুস্থ হওয়ার পর বাচ্চারা প্রায়ই আমাকে দেখতে আসত।তারা অনেকেই বিচিত্র সব জিনিস নিয়ে আসত,যেমন বুনোফুল,মুড়ির মোয়া এমনকি একজন তো কবিরাজের মাদুলি নিয়েও হাজির হয়েছিল।

ফুপু শাশুড়ি এসেই তাদেরকে দূর দূর করে তাড়াতে লাগলেন।তার দাপটে কেউ আর বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেষতে পারেনা তারপরও অনেকে পা টিপেটিপে চুপিচুপি উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করে কিন্ত কাজের মেয়ে ময়নাও তক্কেতক্কে থাকে।এভাবেই চলছিল কিন্ত একদিন অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল।খাড়া দুপুর বেলা ময়না বাথরুমে ভেজানো কাপড়গুলো আছড়ে ধুচ্ছিল হঠাত সে চিলের মত চিৎকার করে বাইরে ছুটে আসল।ফুপু ছুটে এলেন আমিও বিছানা থেকে নেমে গেলাম।হাফাতে হাফাতে সে বলল সে কাপড় নেয়ার জন্য যেইনা বালতিতে হাত দিয়েছে দেখে একটা ছোট্ট বাচ্চা সেখানে হাবুডুবু খাচ্ছে।আমার গিয়ে দেখলাম বালতিতে কিছুই নেই অবশিষ্ট কিছু ভেজানো কাপড় ছাড়।ময়নাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হল যে সে ভুল দেখেছে।ভেজানো কাপড় দেখে বাচ্চা ভেবেছে।কিন্ত সে মানতে নারাজ।সে বারবার বলতে লাগল হাতের তালুর সমান ছোট্ট বাচ্চা বালতির পানির মাঝে হাবুডুবু খেতে খেতে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিল।মানুষের বাচ্চা তো এত্ত ছোট হয়না।অত ছোট বাচ্চা তো শুধু মায়ের পেটেই থাকে জন্মের আগে।তাছাড়া বাচ্চা আসবেই বা কোথা থেকে?আমি মোটেও ওর কথা বিশ্বাস করলাম না।বয়স কম হলে কি হয়ে এই মেয়েটা একদম বদের হাড্ডি।মিথ্যা কথা বলায় ওর জুড়ি নেই ওকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি।

ফুপুও দেখলাম ওর উপর চরম বিরক্ত হলে গালি দিতে দিতে বললেন এইসব হিচ্ছে রাতদিন টিভিতে আজগুবি হিন্দী সিরিয়াল দেখার ফল।আবার যদি সে এমন ষাঁড়ের মত চিৎকার করে তার পিলে চমকে দেয় তবে তিনি কি কি করবেন তার ভয়ংকর বর্ননা দিলেন।রাতে হাসবেন্ডকে একথা জানালে তিনি হাসতে হাসতে বললেন দেখ গিয়ে ওর কোনো ছোট বাচ্চা ছিল কিনা।হুমায়ুন আহমেদের রহস্য গল্পের নায়িকারা তাদের বাচ্চার মৃত্যু বা ইচ্ছাকৃত এবরশনের পর এধরনের জিনিস দেখতে থাকে মানসিক সমস্যার কারনে।তার কথা শুনে আমিও হেসে ফেললাম।

দুইদিন পর আমি ফুপুর সাথে ডাক্তার দেখানোর জন্য গিয়েছি ফিরে এসে দেখি বাইরের বারান্দায় বসে ময়না বাঁশপাতার মত কাঁপছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে।আমাদের দেখেই সে হাউমাউ করে বলে উঠল সে আর এই বাসায় থাকবে না।বাসায় নাকি ভুত আছে।আমরা চলে গেলে সে টিভি ছেড়ে দিয়ে কিছু সবজি নিয়ে বসে ড্রইংরুম এ।সবজি কাটতে কাটতে একটা আলু গড়িয়ে সোফার নিচে চলে যায়।সে সেটা বের করার জন্য সেখানে হাত ঢুকাতেই কি যেন একটা তার হাত কামড়ে ধরে।সে হাত টেনে বের করতেই হাত কামড়ে ধরা অবস্থাতে বেড়িয়ে আসে বছর খানেকের একটা বাচ্চা।কেমন যেন ফ্যাকাশে মরামরা গায়ের রঙ।সে কোনোমতে হাত ছুটিয়ে পালিয়ে এসেছে।দেখলাম হাতে সত্যিই দাঁতের দাগ কেটে বসে গেছে।আমার ভেতরে ভেতরে ভীষণ রাগ হতে লাগল।মতলব কি এই ছুঁড়ির?এক বছরের বাচ্চার তো দুই পাটির সবগুলো দাঁত থাকেনা।নিশ্চয় বাইরের কোনো বাচ্চার সাথে ঝামেলা পাকিয়েছে,সেই হয়ত তখন কামড়ে দিয়েছে।এখন আমাকে ভয় দেখানোর জন্য আজগুবি কথা বলছে।ময়না অবশ্য আর থাকতে চাইল না।সেদিন বিকেলেই অগত্যা তাকে বাসে তুলে দিতে হলো।

ময়না চলে গেলে ফুপু শাশুড়ি কেমন যেন চুপসে গেলেন।মনে হল তিনি ভয় পেয়েছেন।আমার অবশ্য সন্দেহ ছিলনা যে এসব ময়নার বানানো কথা তবে একটা ঘটনায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম।সেদিন শুক্রবার তাই হাসবেন্ডের ছুটি।সন্ধ্যার পর দুজনে বসে সিনেমা দেখছি আর ফুপু রান্নাঘরে রাতের রান্নার আয়োজন করছেন।হঠাত একটা চিৎকার আর ভারি কিছু পতনের শব্দে আমরা দুজনেই রান্নাঘরে ছুটে গেলাম।দেখি ফুপু মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন মাথার কাছে খানিকটা কেটে রক্ত বের হচ্ছে।তাকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নেয়া হলো।মাথায় সামান্য ছড়ে যাওয়া ছাড়া কোনো আঘাত পাননি তিনি।জ্ঞান ফিরলে উনি বললেন।রান্নার জন্য তিনি যে মুরগীর মাংস বড় গামলায় ভিজিয়ে রেখেছিলেন তার ঢাকনা খুলতেই দেখেন পানিতে একটা মানুষের বাচ্চা ভাসছে।সেটাকে বাচ্চা না বলে ভ্রুন বলায় ভাল কারন নাভিতে তখনও নাড়ি ঝুলছে।এই দৃশ্য দেখে তিনি আঁতকে উঠে পিছিয়ে যান।তার সাহস যে অনেক তা বলতেই হবে কারন নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি আবার গামলায় উঁকি দেন এবং দেখেন সেখানে মুরগীর মাংস ছাড়া কিছুই নেয়।ময়নার কথার প্রভাবে ভুল দেখছেন ভেবে তিনি রান্না শুরু করেন।মশলা নেয়ার জন্য দেয়ালের কাবার্ডের দরজা খুলতেই দেখেন একটা ছোট ছেলে গুটিসুটি মেরে সেখানে বসে আছে।কেমন যেন ভয়ানক তার চেহারা।ফুপু তাকাতেই সে জিভ বের করে তাকে ভেংচি কেটে দেয়।জিভের রঙ কুচকুচে কাল!এই দৃশ্য দেখে তিনি সহ্য করতে পারেন নি অজ্ঞান হয়ে গেছেন।ফুপু জোর দিয়ে বলতে লাগলেন এই বাড়ির কোনো দোষ আছে।রাতে হাসবেন্ড আঁতিপাঁতি করে সারা বাড়ি খুঁজে দেখলেন কিন্ত কিছুই পাওয়া গেল না।পরদিন সকালেই ফুপু বাড়ি ফিরে গেলেন।

গল্পের শেষ পর্ব দ্রুতই আসছে---
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৩৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×