somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'আরা': যে সঞ্জীবনী নিয়ে যায় অন্যভুবনে

১৩ ই নভেম্বর, ২০১১ ভোর ৬:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পার্বত্য এলাকার মানুষের মাঝে যে পানীয়টি খুব বেশি জনপ্রিয়, তার নাম ’'আরা’'। আমরা শহুরে মানুষরা অনেকেই এটিকে 'দো-চোয়ানী' বা 'দেশী মদ' হিসেবেই চিনি। আদিবাসী মারমা, মুরং, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য গোত্রভুক্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই '’আরা’' পান করে থাকে। তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও স্থানীয়ভাবে তৈরি এই পানীয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, '’আরা'’ - শব্দটি উচ্চারণের সময় '’র'’ অক্ষরটিতে ব্রেক কষতে হবে। অর্থাৎ, '’র'’ অক্ষরটি সম্পূর্ণ উচ্চারণ করা যাবেনা। তবেই আদীবাসীদের মতো উচ্চারণে বিশুদ্ধতা আসবে। সম্প্রতি বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকা ঘোরার সময় কৌতুহল জাগলো এই পানীয়টি তৈরির ব্যাপারে। আজ আপনাদের জানাবো এর তৈরি পদ্ধতি।

বোতল এবং গ্লাসে রয়েছে 'আরা'

উপকরণসমূহ:
১. তিনটি ডেকচি/পাতিল: প্রথমটি বড়, দ্বিতীয়টি মাঝারী এবং তৃতীয়টি ছোট।
২. একটি বারী (ছোট গামলা)
৩. একটি রাবারের চিকন এবং লম্বা পাইপ
৪. লাকড়ীর চুলা
৫. ’'আরা’' সংগ্রহের জন্য বড় বোতল এবং গ্যালন
৬. ভাত রান্না করার চাউল
৭. চিংড়ে: একটি রাসায়নিক পদার্থ যা ’আরা’ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত মহেশখালী থেকে এই মেডিসিনটি সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে এটির একটি ছোট দলার দাম মাত্র ২ টাকা।
৮. ঠাণ্ডা পানি

চিংড়ে

চিংড়ে

কিভাবে ’'আরা’' তৈরি করা হয়:
প্রথমে বড় ডেকচি/পাতিলে চাউল দিয়ে ভাত রান্না করা হয়। আনুমানিক এক কেজি চাল দিয়ে ৫০০ মিলি 'আরা’' উৎপন্ন হয়। এই ভাতের মধ্যে পরিমাণ মতো পানি মিশানো হয়। সাধারণত এক কেজি চালের ভাতে অর্ধেক লিটার পানি মিশানো হয়। এরপর এই ভাতের সাথে পরিমাণ মতো 'চিংড়ে' মিশিয়ে বড় পাতিলটির উপরে মাঝারী পাতিলটি বসানো হয়। পরবর্তীতে মাঝারী পাতিলের মধ্যে একটি ছোট বারী (গামলা) বসানো হয়। মাঝারী পাতিলের তলাতে ছিদ্র করে দেওয়া থাকে। এতে করে বড় পাতিলের সাথে মাঝারী পাতিলের সংযোগ স্থাপিত হয়। এরপর গামলাসহ মাঝারী পাতিলটির উপরে পূর্ণ ঠাণ্ডা পানি সহ ছোট পাতিলটি বসানো হয়। ছোট পাতিল এবং মাঝারী পাতিলের পাশ দিয়ে এমনভাবে একটি রাবারের পাইপ ঢোকানো থাকে যেন, রাবারের পাইপের একটি প্রান্ত সরাসরি গামলার মধ্যে এবং অপর প্রান্ত 'আরা’'’ সংগ্রকারী বড় বোতলের মধ্যে ঢোকানো থাকে।

জনৈক মারমা'র রান্নাঘরে তৈরি হচ্ছে 'আরা'

পাতিলে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে

এখন বড় পাত্রটির ভিতরের পানি এবং চিংড়ে মিশ্রিত সিদ্ধ ভাতকে লাকড়ির চুলায় জ্বাল দেয়া হয়। এই জ্বাল দেওয়ার ফলে যে বাষ্প উৎপন্ন হয়, তা মাঝারী পাতিলে প্রবেশ করে এবং মাঝারী পাতিলের উপরস্থ ঠাণ্ডা পানি ভর্তি ছোট পাতিলের তলায় সেই বাষ্প বাড়ি খেয়ে গামলায় তরল পদার্থ আকারে জমা হয়। এই তরল পদার্থই ’'আরা’'’। পরবর্তীতে সেই 'আরা’' নামক তরল পদার্থ পাইপের মাধ্যমে গামলা প্রান্ত থেকে সংগ্রহকারী বড় বোতলে সংগ্রহ করা হয়। বোতলে সংগৃহীত 'আরা’' পরবর্তীতে গ্যালনে ভরে সংরক্ষণ করা হয়। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেল 'আরা’'। ২৭০ মিলি আরার দাম পড়বে প্রায় ৫০ টাকা।

লাকড়ীর চুলায় তৈরি হচ্ছে 'আরা'

বোতলে সংগ্রহ করা হচ্ছে 'আরা'

এখানে উল্লেখ্য যে, 'চিংড়ে' নামক রাসায়নিক পদার্থটি দ্বারা সিদ্ধকৃত ভাত চার থেকে সাত দিন ভিজিয়ে রাখলে ’'আরা’' এর গুণগত মান ভালো হয়। আবার অনেকেই ভাতের মধ্যে চিনি মিশ্রিত করেন, যেন বেশি বাষ্প তৈরি হয়ে বেশি 'আরা’' সংগ্রহ করা যায়। ভাতের সাথে এই চিনি মেশানো হলে ’'আরা’'’ এর গুণগত মান কমে যায়। আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়, ছোট পাতিলটির ঠাণ্ডা পানি ঘন ঘন বদলাতে হয় যেন সব সময় ছোট পাতিলটির মধ্যে ঠাণ্ডা পানি রক্ষিত থাকে।

এই ছবিটিসহ অন্য ছবিগুলো খুব ভোরে তোলা, কারণ যে মার্মা পরিবারে গিয়ে আমি এই ছবিগুলো তুলেছি, তারা খুব ভোরে 'আরা' সংগ্রহ করে থাকেন।

বোতলে 'আরা' সংগ্রহ করা হচ্ছে

'আরা’'’ বিষয়ক আমার অভিজ্ঞতা:
বহুদিন থেকেই 'আরা’'’ পানের বিষয়ে আমার একটা কৌতুহল ছিল। এবার বান্দরবানের দুর্গম এক এলাকায় গিয়ে সুযোগ হলো সেটি মেটানোর। স্থানীয় মার্মা বন্ধুকে মনের ইচ্ছা অভিব্যাক্ত করলাম। সে কিছুটা সময় চাইলো... এবং অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। আমাদের হাতে চলে এলো সেই বহু আকাঙ্খিত 'আরা’'’। আমরা বলতে আমি এবং ব্লগার হুদাই পেচাল । সেই মার্মা বন্ধুটি অবশ্য সাবধান করে দিয়েছিল যেন আমরা বেশি পান না করি। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সন্ধ্যার পরপরই শুরু হলো আমাদের পান পর্ব। আহ্! অসাধারণ সেই অনুভূতি, যা ভোলার নয়, বলার নয়, রূপকথাতেই যার পরিচয়। অল্প কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম ব্লগার হুদাই পেচাল আমাকে বলছে, তার নাকি নাচতে ইচ্ছে করছে। আমি সানন্দে তৎক্ষণাত তাকে সেই অনুমতি দিয়ে দিলাম। এবং তারপরে শুরু হলো তার উদ্যাম নৃত্য। ওহ্! সেকি নৃত্য, যা দেখার নয়, বলার নয়, রূপকথাতেই যার পরিচয়। তার সেই নৃত্য তাণ্ডব দেখে আমি হাসতে হাসতে একসময় কাঁদতে শুরু করলাম। শুধু এই কথাগুলোই মনে আছে, বাকীটুকু শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনি।

পুনশ্চ: সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে ব্লগার হুদাই পেচালকে তার উদ্যাম নৃত্যের কথা বলতেই সে পুরোপুরি অস্বীকার করলো; বললো যে, গতরাতে সে নাকি ওরকম কোন কাজই করে নাই। বরং উল্টো আমাকে দোষ দিল, আমি নাকি চিৎকার করে হেঁড়ে গলায় গান গাইছিলাম। কি মিথ্যুক!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১১ ভোর ৬:৩৫
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×