ঘর নিস্তব্ধ..সবাই চুপচাপ। মেজো চাচা বিছানায় শুয়ে আছেন। কয়েকদিন ধরে শরীরটা খুব বেশি খারাপ। তাই দেখতে আসছে আত্নীয়-স্বজন। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আসতে হলো। শত হলেও গুরুজন। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, মানুষ বয়স হয়ে গেলে কতটা অসহায় হয়ে পড়ে। কেউ কেউ তাঁর কাছে ক্ষমা চাচ্ছে, আবার তিনিও কারো কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন, কেউ সান্তনা দিচ্ছে সুস্থ হয়ে যাবার। আমি খেয়াল করলাম চাচা আঁড়চোখে আমাকে দেখছেন। হঠাৎ করেই সবাইকে ঘর থেকে চলে যেতে বললেন শুধু আমি ছাড়া। প্রত্যেকেই অবাক হলো, কারণ আমি চাচার এমন আদরের কেউ না যে তিনি আলাদাভাবে কথা বলবেন। মেজো চাচার ছেলে ব্যাপারটা ভালোভাবে নিলো না। তাঁর সাথে চাচার সম্পত্তি নিয়ে কি যেন ঝামেলা চলছে। কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। হয়ত ভাবছে আমার সাথে সম্পত্তি নিয়ে কথা বলবে। হাস্যকর মনমানসিকতা।
চাচা ঘরের দরজা লাগিয়ে দিতে বললেন। বিছানাটায় হাত দিয়ে দেখিয়ে বসতে বললেন। তখনো বুঝতে পারছি না হচ্ছে কি। তারপরও বসলাম।
"তোমার মনে আছে কি না জানিনা..." বলতে বলতেই আমার একটা হাত নিয়ে তাঁর দুই হাত দিয়ে ধরলেন। একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। কখনও তো চাচার সাথে এতোটা সখ্যতা ছিলো না।
"তুমি অনেক ছোট ছিলে, আমার আর্থিক, পারিবারিক কিছু ঝামেলার কারণে তোমাদের বাসায় কিছুদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছিলাম। একদিন আমি..." একঝটকায় আমার হাত সরিয়ে নিলাম।
"আমার স্পষ্ট মনে আছে, কিছু ভুলিনি, আমার তো অবাক লাগছে এতোগুলো পাপের মধ্যেও এই কথাগুলো আপনার এখনো মনে আছে। কিন্তু এতো বছর পর হঠাৎ এইসব কথা বলার কি মানে চাচা?"
"আমি তোমার কাছে মাফ চাই মা, আমি অনেক বড় পাপ করে ফেলেছি, মাফ করে দাও আমাকে।"
"ওহ, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বলে ক্ষমা চাচ্ছেন, নাহলে তো ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন ছিলো না তাই না?"
"আমি জানি ওইটুক বয়সে আমি তোমার সাথে যে আচরণ করেছি..."
মাথার ভেতরটা না দপদপ করে উঠলো, "না আপনি জানেন না। আর এভাবে দরজা আটকে এখন ক্ষমা চাচ্ছেন কেন? সাহস থাকলে সবার সামনে ক্ষমা চান।"
"আমি তো আর বেশিদিন নেই কিন্তু সবার সামনে বললে যে পরের দিন গুলো তোমার জন্যেই খারাপ হবে"
"আর এখন আমি বের হয়ে সবাইকে কি বলবো, কেন আপনি দরজা লাগাতে বললেন, কি এমন কথা, এটা করেও তো আপনি আমাকেই বিপদে ফেলে গেলেন"।
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলতে গেলাম।
"তাহলে কি আমি ক্ষমা পাবো না?"
"এতো বছর পরেও আমি বুঝে উঠতে পারিনি আপনাকে ক্ষমা করলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো তো?"
চাচা তাঁর ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন। দরজার ওপারে সবাই হয়ত অপেক্ষা করছিলো। আমি কারো উত্তর দেওয়ার অপেক্ষা না করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:১৮