নায়ক জসিমের অধিকাংশ সিনেমায় ছোট বেলায় দেখতাম তার মা, বোন বা স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার সাহেব তাকে মোটা কন্ঠে বলতেন,
- রোগির অবস্থা খুব খারাপ, অপরেশন করতে হবে। আপনি টাকার জোগাড় করুন। আমরা অপরেশনের ব্যবস্থা করছি।
বাস্তবে আমাদের বেসরকারী মেডিকেলের পাশাপাশি সরকারি মেডিকেলগুলোর চিত্রও ভিন্ন নয়। শুধু পার্থক্য এটুকুই যে, নায়ক জসিমের মত আমরা ঠেলাগাড়ি, রিক্সা বা ট্যাক্সি চালিয়ে এত কম সময়ে এত টাকার যোগান দিতে পারি না। আমাদের সাধারনের পরিনতি এরুপই হয়ে থাকে।
দিনে দিনে দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, চিকিৎসা ব্যাবস্থার উন্নতি হচ্ছে, সজ্জা সংখ্যা বাড়ছে। তবে তা কি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমানুপাতিক? বা যৎসামান্য যা আছে তার-ই কি সঠিক ব্যবহার হচ্ছে?
সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে জনগনের সেবার জন্য একেক জন ডাক্তার গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ এরাই যখন ডাক্তারি পড়া শেষ করে তখন টাকার জন্য চাতক পাখির মত হা করে থাকে। প্রাইভেট হসপিটাল আর চেম্বারগুলো তাদের প্রান হয়ে ওঠে। সামান্য সময়ের যেটুকু সরকারি হাসপাতালে দেয় তার ভেতরও তাকে কার্পন্যতা বা টাকার খেলা।
এই ডাক্তারই একদিন ইংলিশে 'এইম ইন লাইফ' প্রবন্ধ লেখার সময় ডাক্তারি পেশাকে কতই না সেবামুলকভাবে তুলে ধরেছিলেন। নিজেকে সেচ্ছাসেবী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। হয়তো তা শুধু পরীক্ষার খাতায় ভাল নম্বর অর্জনের নিমিত্তে। কারন আমি অনেক বানিজ্য বিভাগের ছাত্রকেও এই একই কাজ করতে দেখেছি।
আমি বলছি না যে সরকারি হাসপাতাল গুলোতে মোটেই সেবা পাওয়া যায় না। তবে তা ঢালিত টাকার সমানুপাতিক। টাকা যত যত ঢালবেন সেবার পরিমান তত তত বাড়তে থাকবে।
হ্যা, সমাজের উচুতলার বাসিন্দাদের এগুলোর কোনটাই না ভাবলেও চলে। কারন তাদের বাচ্চার একবেলা হাগু না হলে পরের বেলা তাদেরকে সিংগাপুরে দেখা যায়। দিনে দিনে সিংগাপুরকে আমার কাছে চিকিৎসাক্ষেত্রে এদেশেরই অংশ মনে হয়।
শুধু টলমলে চোখে বসে থাকতে হয় আমাদের মত সাধারনদের। অচিকিৎসার অবহেলায় পড়ে থাকতে হয় হাসপাতালের বারান্দাগুলোতে। কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে একটা বিছানা মিললেও পরক্ষনেই ধরিয়ে দেওয়া হয় বিশাল পরীক্ষা তালিকা। যা বড় অংকের পয়সা খরচ করে পাশের কোন ল্যাব থেকে করিয়ে আনতে বলা হয়। তখন মৃত ইলিশ মাছের মত কাগজ পানে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। ডাক্তার সাব তার লভ্যাংশ প্রাপ্তির আশায় মুচকি হাসেন।
"প্যারাসিটামল দুই বেলা" – এ যেন আমাদের মত জন সাধারনের জন্য সেই সকল পিয়াষু ডাক্তারদের সাধারন বুলি। অথচ তিনিই যখন প্রাইভেট চেম্বারে রোগি দেখেন তখন কতই না দরোদি হয়ে ওঠেন।
আমি এমনও ডাক্তার দেখেছি যে অফিস টাইমে তারা ব্যক্তিগত রোগিদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আর এদের জন্যই শিরোনাম হয় "ডাক্তারের চেম্বার টেবিলে প্রশান্তিতে ঘুমন্ত বিড়াল"। অবশ্য তখন এদেরকে বেশ পশুপ্রেমীই মনে হয়।
পেটের অপরেশন করে দু'সপ্তাহ পর ব্যাথা নিয়ে যখন রোগি পুনরায় ডাক্তারের সম্মুখিন হন তখন দ্বিতীয় অপরেশনে রোগির পেটে অপরেশনের কেঁচি পাওয়া যায়। এশুধু ভুলের জন্য নয়, অবহেলার জন্যও বটে।
অথবা, ডান পায়ে কান্সার নিয়ে অপরেশন শেষে রোগি বুঝতে পারেন তার বাম পা টি আর তার দেহের অংশ নয়। তখন ডাক্তার সাহেব জ্বিহবা কামড়ে ধরে এমন একটা ভাব নেন যেন খেলার মাঠে কোন ভুল করে বসেছেন।
এই ভুলগুলো সবার জন্য যে হয় তা না। ভুলগুলো নির্ভর করে আপনি গাছের গোড়ায় কতটুকু পানি দিয়েছেন তার উপর। কারন, ডাক্তার গাছটি তো আর মরুভুমির ক্যাকটার্স নয়!!
"এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে নাকো তুমি" – ডি এল রায়ের কথাটি কতই না আবেগ ঢালা ছিল। হয়তো তিনি এ প্রকৃতির মানুষের মনে অকৃত্রিম শান্তি দেখে এমন বুলি আওড়িয়েছিলেন। আজকের অবস্থাও কি ঠিক তেমনই আছে?
আজ যেমন রাস্তার কোলে অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠা কোন গাছের সন্ধান মেলে না। তেমনি এখানে সাধারনের জন্য এতটুকু সেবা মেলে না। যা পায় তা-ই যেন বিলাসিতা।
এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে হয়তো সত্যিই সেই 'এমন দেশটি' ফিরে পাওয়া যাবে। হয়তো প্যারাসিটমল বা এন্টাসিড দিয়েই আপনাকে কান্সার উপশমের ব্যার্থ চেষ্টা করতে হবে।
(০৫/১১/২০১৫)