কথাগুলো আরশাদকে বললো রূপরেখা৷ আরশাদ গ্রামের ছেলে ৷ সে জানে চরের বালুকাবেলায় কি করে পানি আনতে হয়, জানে নৌকার পাল কখন উড়াতে হয়, আর গুণ বাইতে হয় কখন৷ কিন্তু এখন সে এ সবের অনেক কিছুই ভুলে বসে আছে৷ ভুলে বসে থাকার চেয়েছে ভালো হবে বোধ হয় যদি বলা যায়, ধূলোর আস্তর জমেছে, বেশ মোটা করে, সেটা বলা হলে৷
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সব কিছু ভুলা যায় না৷ যেমন ভুলা যায় না আকাশের মেঘ, কালো রং৷ ভুলা যায় না নীলচে পাহাড়, কারও কারও মুখ৷
এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সে আরশাদ ভুলে গেছে অনেক কিছুই৷ বিদেশে থাকতে থাকতে তাকে ভুলে যেতে হয়েছে রূপ, গন্ধ, রং৷ ফরাসিদের দেশেই সে আছে অনেক দিন৷ প্যারিসের পার্শ্বে ছোট্ট একটি শহরে তাদের বড় অফিস৷ কৃষিকাজে সহায়তার জন্য কম্পিউটার ভিত্তিক সফটওয়্যার বানায় তাদের কোম্পানি৷ সেই কোমলসম্ভার কিনে নেয় ইউরোপ অ্যামেরিকার কৃষকরা৷ কখন বৃষ্টি হলে কী করতে হবে, না হলে কী , পোকার আক্রমণ, মাটির আদ্রতা, জলের কণা- সব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল দিয়ে চালিয়ে রাখো কিছুক্ষণ, কিছুক্ষণ পর বলে দেবে কত হতে পারে এই মৌসুমের সম্ভাব্য উৎপাদন! ডিজিটাল কৃষি! এই ধরণের কাণ্ড-কারখানা করে বেশ কামাচ্ছে তারা৷
বছর বিশেক আগে যখন তার বয়স ত্রিশের খুব কাছে, তখন সে এসেছিল প্যারিসে৷ তারপর দিন গেছে অনেক৷ অনেক রাত দেখেছে সে একা একা ঘুরে৷ কিন্তু খুঁজে পায়নি ঢাকাকে, দিনের ঢাকা রাতের ঢাকা৷
বাড়িতে কেউ ছিল না৷ ছিল না বাবা মা, ভাই কিংবা বোন৷ সেই ছেলেবেলা বাবা-মা মারা যাবার পর বড় হয়েছে সে এক মামার কাছে৷ সেই মামাও আজ নেই৷ তাহলে কার কাছে যাবে সে৷ দিনে রাতে ভাবে আরশাদ৷ ভাবতে ভাবতে সময় গেছে কিন্তু দেশে যাওয়া হয়নি৷ ফেসবুক নামক সামাজিক নেটওয়ার্ক তাকে টানে না কখনো৷ অফিসের দ্বিতীয় প্রধান বলে তাকে কিছু কিছু অপ্রিয় কাজ করতে হয়৷ এর মধ্যে ফেসবুক একটি৷ এ জন্য একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছে৷ সেই ফেসবুক দিয়ে তারা জানায় তাদের নিজেদের পণ্যের কথা৷ আলোচনা সমালোচনার জবাবও দেয়৷ স্রেফ অফিসিয়াল৷ তারপরও প্রতিদিন সেই ফেসবুকের পাতায় জমা হয় বন্ধুত্বের আহ্বান, লিঙ্ক, আর হাই- হ্যালো৷
অফিসে সেদিন একটু আগেই এসেছে আরশাদ৷ স্বভাবমত একটি বড় মগে কালো মিশমিশে কফি নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে খুলে দেয় বদনগ্রন্থ, মানে ফেসবুক৷ ইনবক্সে একটি চিঠি...
‘‘আরশাদ, কেমন আছো? আমাকে চিনতে পারছো? কোথায় হারিয়ে গেলে?’’
শেষ নাম দেয়া নেই৷ প্রয়োজনও নেই৷ প্রেরকের নাম তো আগেই দেয়া আছে৷ একবার দুইবার তিনবার আরও কয়েকবার সে পড়ে চিঠিটি৷ কফি নিয়েছিল আগে, সেটি টেবিলেই পড়ে রইলো৷ হতে থাকলো ঠান্ডা৷ ঠান্ডা কফি আর বিষ- দুটোই সমান আরশাদের কাছে৷
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সেই রূপরেখাকে নিয়েই পদ্মার চরে হাটছিল আরশাদ৷ হালকা শীতের রোদ৷ সেই শীতের রোদে পিঠটাকে পেতে দিয়ে চরের বালিতে পানি উঠাবার কথা আরশাদকে বলেছিল রূপরেখা৷ এদিকটার বাতাস বেশ হালকা, মোলায়েম৷ আরিচার এই চরটি আসলেও সুন্দর৷ আলুক্ষেত সবুজ হয়ে আছে৷ মৌমাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ আকাশে পাখি, মনে হয় পানকৌড়ি৷ নদীতে হঠাৎ লাফ দিয়ে ডিগবাজী খাচ্ছে শুষক৷ ছেলেবেলায় এরা এই গঙ্গা ডলফিনকে বলতো শিশু!
: তুমি কি জানতে আমি কোথায় আছি? ফেসবুকে কীভাবে খুঁজে পেলে আমাকে? নিরবতা ভেঙ্গে আরশাদ প্রশ্ন করলো রূপরেখা কে৷ রূপরেখা চৌধুরী৷ বছর খানিকের ছোট হবে আরশাদের চেয়ে৷ কিংবা সমান৷ কিন্তু আশ্চার্য, রূপরেখাকে দেখাচ্ছে তার চেয়েও অনেক বড়৷ মেয়েরা নাকি এমনি! জীবন আর সংসার দেখতে দেখতে বুদ্ধি যখন খুব বেড়ে যায়, তখন তারা যায় বুড়িয়ে৷
: সুলেখার জন্য খুলেছি৷ আমার মেয়ে৷ দারুন দারুন সব ছবি আপলোড করে৷ সেগুলি দেখতে পেতাম না৷ অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ায় থাকে সে৷ খুললাম ফেসবুক৷ তারপর একদিন কীভেবে খুঁজতে থাকলাম তোমাকে, যদি পেয়ে যাই৷
: এই বয়সে পেয়ে কী হবে?
: বয়স হলেই কি সব ফুরিয়ে যায়?
: বয়স থাকতেও তো অনেক কিছু ফুরিয়ে যেতে পারে!
: সেটাই তো হয়েছে৷ না হলে সেই রাতে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে কেন?
: আমি তো ছেড়ে যাইনি৷ তুমি বাধ্য করেছো৷
কথাটি বলেই একটু আনমনা হয়ে যায় আরশাদ৷
ঝড় বাদলের রাত নয়৷ নয় গরম গুমটের রাত৷ তারপরেও সেই রাতটি ছিল অন্যরকম৷ আলো-আঁধারির রাত৷ হালকা বাতাস বইছিল৷ গ্রুপ স্টাডিতে তারা এসেছে চট্টগ্রামের একটি গ্রামে৷ আরশাদ আর রূপরেখা, দুই জনই সেই দলে৷ উদ্ভিদ বিদ্যা নিয়ে তারা পড়ছে৷ গাছ-গাছড়া খুঁজতে খুঁজতেই তারা চলে এসেছে এখানে৷ ছোট্ট টিলা ঘেরা গ্রাম৷ দিনে কাজ শেষ করে সকলে একটু ক্লান্ত৷ গ্রামের একটি স্কুলে থাকবার ব্যবস্থা৷ তখনই ছেলেরা নেমে পড়লো স্কুলের শান বাঁধানো পুরানো পুকুরে৷ সাঁতার প্রতিযোগিতা৷ না আরশাদ তাতে প্রথম হয়নি৷ শেষের একটু আগে ছিল৷ মেয়েরা হেসেছিল ওদের কাজ কারবার দেখে৷ রাতের খাবার পর আড্ডা৷ হাটাহাটি৷
আরশাদের বরাবরই ভালো লাগতো রূপরেখাকে৷ বলতে পারেনি৷ সময় ছিল না বলার৷ নিজের পড়ালেখা আর খরচাপাতি যোগাড় করতেই যার যায় যায় দিন, তার আবার প্রেম৷
সে রাতে গ্রামের পথে রূপরেখার সঙ্গে হাটছিল আরশাদ৷ গ্রামের পথগুলোতে অন্ধকারের মধ্যেও বেশ আলোর দেখা মেলে৷ আলো তারা পেয়েছিল৷ এই কথা ঐ কথা, নানা কথার মাঝে রূপরেখা জিজ্ঞাস করেছিল, কেন আরশাদ তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে৷ আরশাদ এই প্রশ্নে লজ্জা পেয়েছিল৷ বলছিল, ‘তাকিয়েই তো থাকি৷ কিন্তু অন্য কিছু তো করি না, বলি না কিছুই৷ তুমি কি আমার চোখের ভাষায় কোন বাজে ইঙ্গিত পেয়েছিলে?’
এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না রূপ৷ তারপর তারা হাটতে থাকে৷ বাতাসে বুনো গন্ধ৷ সেই গন্ধে মাতাল রূপরেখা আলতো করে নিজের হাতটি ছুঁইয়ে দিয়েছিল আরশাদের হাতে৷ আরশাদ সেটিকে অস্বাভাবিক ভাবেনি৷ তারপর এই কথা, সেই কথা৷ ক্লাশের অন্যরা অনেকটাই এগিয়ে ছিল তাদের কাছ থেকে৷ এই আলো-আঁধারের রাতে কি যেন থাকে বাতাসে, গাছে, অন্ধকারে৷ দুরে কোথাও কিছু দেখতে পেলো রূপ, ধোঁয়া ধোঁয়া, ঠিক সময়ই ডেকে উঠলো একটি খেকশেয়াল৷ ভয় পেয়ে রূপরেখা জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে৷ আরশাদের বুকে গন্ধ আছে, আশ্চার্য গন্ধ৷ কিছুক্ষণ সেই গন্ধে মিশে যেতে চাইলো সে৷ তারপর খুব কাছ থেকে নিজের ঠোটটি ছুঁইয়ে দিল আরশাদের ঠোটে....৷
না , লেপ্টে ধরে থাকলো না আরশাদ রূপরেখাকে৷ এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিলো৷ যুবক আরশাদ৷ প্রেম যার বুকে, মনে ভয়, বললো, ‘না, এটা ঠিক নয়৷’ তারপর হাটতে থাকলো সে৷ যতটা দ্রুত সম্ভব৷
আস্তানায় পৌঁছে কোন কথা নয়৷ সকালে উঠেই এক অযুহাতে চলে গেলো সে দ্রুত, ঢাকায়৷ রূপরেখাও জানতো না এই চলে যাবার কথা৷
: কেন তুমি এমন করেছিলে সেদিন? সেই রাতের কথা মনে করে জিজ্ঞাসা করলো সে আরশাদ কে৷
: এই মধ্য বয়সে, কিংবা বয়সের শেষার্ধে এসে বলি, আমি জানি না৷ কেবল এইটুকু জানি, আমি তোমাকে সেভাবে নয়, চেয়েছিলাম অন্যরকম করে৷ চাওয়া এবং তখনকার পাবার মধ্যে হয়তো তফাৎ ছিল৷
: বিয়ে করোনি কেন?
: তোমাকে পাইনি বলে৷
: আমাকে তুমি চাওনি৷ পদ্মার ঘোলা পানির দিকে তাকিয়ে রূপরেখা৷ তারপর বলে, আমাকে চাও না এখন?
অকস্মাৎ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না আরশাদ৷ ভাবে, রূপের জন্য সে বসে আছে এতদিন৷ কিছু ভালো লাগা স্মৃতি নিয়ে সে আছে এখনো৷ এই স্মৃতিটুকু রূপরেখাকে কেন্দ্র করে৷ মেয়েটি তার সঙ্গে দেখা করতে চায়, তাই সরাসরি প্যারিস থেকে ঢাকা৷ একটি মাত্র ইমেলের আহ্বানে সে উড়েছে হাজার হাজার মাইল৷ এই বয়সেও কী সে তাকে আগের মতোই, না বলা প্রেমের মতোই ভালোবাসে সে? রূপরেখার স্বামী গত হয়েছেন অনেকদিন৷ তার সংসার আছে৷ সন্তান আছে৷ কীভাবে পাবে তাকে? এটাও কী সম্ভব! তারপর সাহস করে বলে
: সেই আলো আঁধারের রাতে তুমি আমাকে যেটা দিয়েছিলে, সেটা দেবে....?
ভাবে রূপরেখা৷ পদ্মা আর যমুনা এক সঙ্গ বইছে এখানেই একটু দূরে৷ এক নদীর পানি নীল, আরেকটার ঘোলা৷ মিলছে, আবার মিলছে না৷ সেদিকেই তাকিয়ে সে বলে
: যদি দেই, নেবে?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১০ রাত ১০:১৬