somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মালিকানা

১৫ ই মে, ২০১১ রাত ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীনতা লাভ করেছে ১৯৭১ সালে। এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ৯ মাসে, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে। এই ৯ মাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাস। এই মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪০ বছর পরও আমরা স্বাধীনতার সুফল পাই নাই, এইটা আজকালের বহুল ব্যবহৃত আক্ষেপগুলার অন্যতম। এই আক্ষেপের বাস্তবতা কতটুকু? স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও কেউ কোন সুফল পায় নাই এ নেহায়েত ডাহা মিথ্যা কথা। বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ অশিক্ষা কুশিক্ষায় দিনাতিপাত করে বটে, কিন্তু ঢাকা শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো সুন্দর সুন্দর নামের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের আধিক্য, প্রচণ্ড জান জট আর পাবলিক বাহণের অভাবের মাঝেও সহস্র গাড়ির বাহার, দেশের একটা বড় সংখ্যার মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করলেও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋনএর সাফল্য হেতু নোবেল জয়, গার্মেন্টস শ্রমিকের মাঝে মাঝে একটু আধটু আন্দোলন করা অথবা আগুনে পোড়া সত্ত্বেও টিভির পর্দায় রিয়েলিটি শো তে গান গেয়ে লাখ লাখ টাকা কামানো এইসব অন্তত কারো না কারো সুফল ভোগের কথা বলে। দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল যখন ‘উন্নয়নের জোয়ার’ আর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’এর কথা বলেন তখন একেবারে ফাঁপা বুলি তো দেন না। তাদের সন্তানরা রাজপুত্র রাজকন্যার মতো সারা দেশ যেভাবে দাবিয়ে বেরান, পশ্চিমা রাষ্ট্রে যেভাবে তারা সম্পদ প্রতিপত্তি এবং খায় খাতির গড়ে তোলেন তাতে অন্তত স্বাধীনতার সুফল এই দুই দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যে ভোগ করেন না এইটা বলা বোধহয় ডাহা মিথ্যা কথাই হবে।

এতে আমাদের সমস্যা কি? আমরা কি চেয়েছি স্বাধীনতার সুফল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ না বরং আপামর জনসাধারণ ভোগ করুক? এই চাওয়াটা অবশ্য অনৈতিক না। আমরা বাঙালিরা চাষার জাত। চাষ বাস আমাদের হাজার বছরের পেশা। যেই ফসলের জন্য শুধু ঘাম না রক্ত এবং ইজ্জত দিয়েছি সেই ফসল আমাদের ঘরে না উঠে যদি ওঠে মুষ্টিমেয় জোতদারের ঘরে আপত্তি এবং আক্ষেপ তাতে হওয়ারই কথা। স্বাধীনতার ফসল জনগণের সম্পত্তি, মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে বাঙলার আপামর গণমানুষ, স্বাধীনতার মালিকানাও তাই জনগণের, বিশেষ কোন দল বা শ্রেণীর না।

ব্রিটিশ আমলে এই ভুখন্ডের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও এই ভুখন্ডের মালিকানা আমাদের ছিল না, ছিল ইউরোপীয় ফিরিঙ্গিদের হাতে। উপনিবেশ নামক বর্বোরচিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী আমাদের ভুখন্ডের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রাকৃতিক সম্পদে দরিদ্র ইংল্যান্ড নিজ দেশে শিল্প বিপ্লবের স্বার্থে আমাদের ভুখন্ডের সস্তা কাঁচামাল আর সস্তা শ্রমএর ওপর নির্ভর করতো। আমাদের ভুখণ্ডেই ভূমি দাসএর মতো নীলকরদের মন মর্জি অনুযায়ী আমাদের চাষবাস করতে হয়েছে। আমাদের শ্রমের ফসল ঘরে তুলে ফুলে ফেঁপে উঠে ঘটেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার। এই যে আধুনিক ইউরোপ, আলোকময় ইউরোপ, ঐশ্বর্যশালী ইউরোপ, শিল্প বিপ্লবের ফলে যেই ইউরোপের জন্ম, সেই ইউরোপের প্রাণশক্তি হলো উপনিবেশ। উপনিবেশ থেকে সস্তা কাঁচামাল, সস্তা শ্রম সংগ্রহ করে আবার উদ্ধৃত প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার হিসাবে উপনিবেশকেই ব্যবহার করা, এই করেই শিল্পবিপ্লবের চারা থেকে গাছ আর গাছ থেকে মহিরুহ হয়ে ওঠা। আধুনিক ইউরোপের ঐশ্বর্যময় কাহিনীতে আমরা বাঙালিরা ঘানিটানা দাস, সত্যিকারের প্রলেতারিয়েত, সাব অল্টার্ন, ফ্রাঞ্জ ফানো যারে বলছেন, “জগতের লাঞ্ছিত”। উপনিবেশে মানুষ নিজভূমেই হয় পরবাসী, নিজের জমির মালিকানাই যে শুধু তার থাকে না তা না, থাকে না নিজের শরীরের ওপর মালিকানা, সবশেষে নিজের মনের মালিকানা হারিয়ে সে হয় সত্যিকারের লাঞ্ছিত। ২৩ জুন, ১৭৫৭ সাল থেকে উপনিবেশের লাঞ্ছিত মানুষ হিসাবে নিজ ভূমি আর দেহ মনের মালিকানা হারানো বাঙালীর তারপর থেকে তাবৎ মুক্তিসংগ্রাম এই মালিকানার মুক্তিসংগ্রাম, নিজ ভূমি আর সত্ত্বার মালিকানা ফেরত পাওয়ার সংগ্রাম।

ক্যারিবিয় দ্বীপ মার্টিনিকএর অধিবাসী ফরাসী উপনিবেশের লাঞ্ছিত সন্তান ফানো অবশ্য শুধুমাত্র উপনিবেশের জনগোষ্ঠিকে লাঞ্ছিত বলেই খালাস হন নাই। মনরোগ বিশেষজ্ঞ ফানো উপনিবেশের সাইকোপ্যাথোলজি নির্ণয় করেছেন। সেই সাথে এর বিরুদ্ধে লড়াই এবং নিদানএর কায়দা বর্ণনা করেছেন। ফরাসী উপনিবেশের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামে ফানো নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ফানোর সংগ্রামের এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ইউরোপ একের পর এক উপনিবেশকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হচ্ছে, এশিয়া এবং আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু এইসব উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে, রক্ত এবং ঘামের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতায় কি জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, এই প্রশ্ন নিয়া উদ্বিগ্ন ছিলেন ফানো। এইক্ষেত্রে, তার ধারণা ছিল, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। এর কারন, দীর্ঘ ঔপনিবেশিক পর্বে এইসব রাষ্ট্রে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত যে নেতৃস্থানীয় শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে তারা চেহারা এবং বর্ণে স্বজাতির মতো হলেও চিন্তা চেতনায় ধারণ করে ঔপনিবেশিক প্রভুকে, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে রাজনীতিতে নামলেও তাদের আনুগত্য পুরোদস্তুর পশ্চিমা প্রভুদের প্রতি নিবেদিত। এই শ্রেণী ক্ষমতায় থাকলে উপনিবেশী প্রভুদের সৈন্য সামন্ত সহকারে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার দরকার নাই, নতুন গড়ে ওঠা এই শাসক শ্রেণীর সাথে ব্যাবসায়িক এবং সার্থকত সম্পর্ক বজায়ে রাখলেই উপনিবেশ টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

ফানোর এই উদ্বেগ, এই বিশ্লেষণ মিথ্যা হয় নাই। ফানো যখন তার বিখ্যাত পুস্তক ‘রেচেড অফ দি আর্থ’ প্রকাশ করেন তার এক দশক আগেই ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য খাতা কলমে বিদায় নিয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিয়েছে তারাও বহু জাতির এই ভূখণ্ডকে উপনিবেশী প্রভুর জ্ঞানেই এক রাষ্ট্র ইন্ডিয়া হিসাবে জ্ঞান করেছে। যেই জগৎ শেঠ রায় বল্লভদের মতো বেনিয়া শ্রেণীর বন্ধুত্বে ব্রিটিশ উপনিবেশের যাত্রা শুরু সেই শেঠদের বিংশ শতকের উত্তরসুরীদের গড়া রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতেই ক্ষমতা ছেড়ে বিদায় নেয় ব্রিটিশরা। তবে গোষ্ঠীগত ভাবে পিছিয়ে থাকা উচ্চবিত্ত্ব লাহোরকেন্দ্রীক মুসলমানরা ক্ষমতার ভাগ বাড়াতেই প্রতিষ্ঠা করে দ্বিজাতী তত্ত্বের। উপনিবেশের তৈরি করা এলিট শ্রেণীর নিজেদের ক্ষমতার কামড়া কামড়িতে ভাগ হয় বাঙলা, ভাগ হয় পাঞ্জাব। ঔপনিবেশিক নকশার সুবিধামতই তৈরি হয় ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান নামক দুই রাষ্ট্র। রাষ্ট্র আর নিজ সত্ত্বার মালিকানা তাই বাঙালী ব্রিটিশদের বিদায়ের পরও পায় নাই। তবে এই মালিকানা বঞ্চনা বিষয়ক যন্ত্রনা অবশ্য ভারত বর্ষের উত্তর ঔপনিবেশিক কালে সবার আগে অনুভব করতে পেরেছি বাঙালী জাতি। উপনিবেশ নিজের প্রভাব বিস্তার করে ভাষায়, সাহিত্যে সর্বোপরি সংস্কৃতির সব জায়গায়। উপনিবেশ জেনে বুঝে শিক্ষা ব্যবস্থায় এর প্রয়োগ করে, আর সচেতন অথবা অবচেতন ভাবে করে সাহিত্যে। আর উপনিবেশী শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিজের অজান্তেই নিজের ভাষা আর সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করতে শেখে, অভ্যস্থ হয়ে ওঠে বিদেশী প্রভুর অনুসরণ, অনুকরণে। নিজ সত্ত্বা আর ভুমির ওপর মালিকানা সে এইভাবেই হারায়। ভারতবর্ষের আর সব জাতির আগে নিজ সত্ত্বার মালিকানার প্রশ্নে জেগে ওঠে বাঙালী জাতি, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পলাশির পরাজয়ের পর থেকে সেই ফকির সন্যাসীর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাঙালির যেই মুক্তিসংগ্রামের শুরু সেই সংগ্রামের সবচেয়ে সচেতন এবং উদ্দেশ্যমূলক প্রকাশ পাই আমরা তাই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর নিজ অস্তিত্ব আর ভুমির ওপর নিজ মালিকানা প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র প্রপোঞ্চ আমাদের গর্বিত মুক্তিযুদ্ধ।

৯ মাসের এই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য বিশেষ গর্বের, এই মুক্তিযুদ্ধ ভারত বর্ষের যে কোন জাতির চেয়ে আমাদের আলাদা করেছে। আগেই বলেছি, ফকির সন্যাসীর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মূলত উপনিবেশ বিরোধী মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতা স্বরূপ, যার মাধ্যমে আমরা নিজ ভুমি আর সত্ত্বার ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধ সাম্প্রতিকতা, আন্তর্জাতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হওয়া ইত্যাদি বিচারে বাড়তি গুরুত্বের দাবিদার, এই বিষয়ে একমত প্রতিটা সচেতন বাংলাদেশী। কিন্তু এর বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের অত্যন্ত প্রবল এবং গভীর প্রভাব আছে। আবার ফিরে যাই ফ্রাঞ্জ ফানোর কথায়। ফানোর মতে উপনিবেশের মানুষের সংগ্রাম, বি-উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া বরাবরি একটা সহিংশ বিষয়। উপনিবেশ যেহেতু একটা সহিংস বিষয়, তাই বি উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়াটাও সহিংস হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় মতবাদ মূলত অহিংশ মতবাদ। বিভিন্ন র্যা ডিকাল জাতীয়তাবাদী সহিংস আন্দোলন গড়ে না উঠলে অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপকে নাড়িয়ে না দিলে এই অহিংস আন্দোলন আদৌ ব্রিটিশদের উৎখাত করতে সক্ষম হতো কি না তাতে সন্দেহ আছে। অহিংস এই আন্দোলন জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল না কখনোই। হিংসার জবাবটা হিংসাতেই দিতে হয়, আগ্রাসনের জবাব প্রতিরোধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সহিংসতার জবাব দিয়েছে সহিংসতার মধ্য দিয়ে। বিউপনিবেশিয়ানের প্রক্রিয়া হিসাবে এবং মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন, সবচেয়ে বড় সম্পদ।

কিন্তু এমন একটা সফল মুক্তিযুদ্ধের পরও আমরা কেন নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম না? উপনিবেশের দালাল, বিদেশী প্রভুদের পা চাটা গোলাম, যাদের বাংলাদেশী উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম নাম দিয়েছেন নয়া উপনিবেশের কড়ি বর্গা, এই কড়ি বর্গারাই আমাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রত্যক্ষ শত্রু। ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়ার রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠি এবং সংস্কারএর ধারাবাহিকতা আমরা এখনো বহন করে চলেছি। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা ছিল না, সুদীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রামের ফসল এই মুক্তিযুদ্ধ। বহু সংগ্রাম, বহু আত্মত্যাগ এর তীলে তীলে গড়া এই মুক্তিযুদ্ধের রাজপথের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা থেকে সহিংশ উত্থানের পেছনে অবদান বাঙলার প্রতিটা স্বাধীনতাপ্রেমী ব্যক্তির, নিজ অস্তিত্ব আর ভুমির ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা যারা চেয়েছে। ৬৯ এর অভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানে, পোস্টারে, গানে আছে এই আপামর জনতার অংশগ্রহণের কথা। কিন্তু ৭ কোটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস শেষ হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা দখল করার ষড়যন্ত্র। বি উপনিবিশায়নের ধারাবাহিকতায় যেই মুক্তিযুদ্ধ, সেই মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা কুক্ষিগত করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকার নয়া উপনিবেশের প্রতিনিধি সাম্রাজ্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নোয়াতে খুব বেশী দেরি করে নাই। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারে একেবারে গোড়া থেকেই কার্যকর ছিলেন মার্কিন মদদপুষ্ট কড়ি বর্গারা। আর এই কারণে আমরা দেখি, মার্কিন সহযোগিতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুর সাথে দূরত্ব বাড়ে জাতীয় চার নেতার, ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসে খন্দকার মোস্তাক গং। তারপরও বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দসায় মুক্তিযুদ্ধের ফসল কুক্ষিগত করা পুরোপুরি সম্ভব হয় নাই। বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড এই মুক্তিযুদ্ধের ফসল লুটেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। ৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসনের পুরো সময়টায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা বিন্দুমাত্র জনগণের হাতে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পুরো চেতনা, বি উপনিবেশায়নের পুরো প্রক্রিয়াকে এই সময়টায় জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ, ভারতীয় অভিভাবকত্ব এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয়া, এই সবের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরো চেতনা, বাঙালীর সুদীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে এই সময়। ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষ আবার চেয়েছে স্বাধীন দেশে নতুন করে স্বাধীন হতে, মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু নয়া উপনিবেশের কড়ি বর্গাদের দল আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি নুর হোসেনের রক্তের সাথে বেইমানী করে আবারো মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা দখল করেছে। সমান ভাবে বিদেশী প্রভুদের প্রতি অনুগত এই দুই দল জগৎ শেঠ রায় বল্লভদের মতো নিজেদের বেনিয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা এবং ধন সম্পদ লুটের বাসনায় পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতার কামড়া কামড়িতে লিপ্ত হয়। গত ২০ বছর ধরে এই দুই দল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে অবদান, সর্বোপরি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজ নিজ মালিকানা প্রতিষ্ঠার দ্বন্দে লিপ্ত। জনগণ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এই শব্দগুলোকে এরা এমন ভাবে ব্যাবহার করে যাতে মনে হয় এই দুই দল বাদে বাংলাদেশে প্রকৃত কোন দেশপ্রেমীক নাই, মুক্তিযোদ্ধা নাই, সর্বপোরি মানুষ নাই। জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই দুই দলই প্রতিনিয়ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন প্রতিরূপ কনকো, ফিলিপ্স, শেভরন, এশিয়া এনার্জি ইত্যাদি বহুজাতিক কোম্পানির সাথে আতাতে লিপ্ত।

ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের ভুখণ্ডের ওপর আমাদের অধিকার ছিল না, ছিল না আমাদের স্বাধীন অস্তিত্বের ওপর অধিকার, নাই। উপনিবেশ আমাদের ভূখণ্ড থেকে নিয়েছে সস্তা শ্রম, সস্তা কাঁচামাল, আবার আমাদের ভূখণ্ডকেই বানিয়েছে তাদের বাজার। প্রায় ৬০ বছর আগে খাতা কলমে উপনিবেশ বিদায় নিলেও এই পরিস্থিতি এক বিন্দু বদলায় নাই, বরং নতুন করে আরো প্রকট হচ্ছে। আর এই পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখছে নয়া উপনিবেশের কড়ি বর্গা শ্রেণী। বাঙালির আপামর জনসাধারণের মুক্তি সংগ্রামের নানান সাফল্যের মালিকানা দাবি করে ভোগ দখল করছে এই কড়ি বর্গারা।

তারপরও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম অব্যাহত আছে, বহু বাধা বিপত্তি ষড়যন্ত্র পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। হাজার চেষ্টা করলেও নতুন প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের সুবিশাল ইতিহাস “সাড়া জাগানো ৩০ মিনিট” এর নাটকে ভোলানো যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্রেফ ৯ মাসের ঘটনায় আবদ্ধ রেখে, স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক আর বাঙালী বনাম বাংলাদেশী বিতর্কে ব্যস্ত রেখে ভোলানো যাবেনা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য। বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম চলছে এবং চলবে। নিজ ভূখণ্ড, প্রাকৃতিক সম্পদ, নিজ মনন, অস্তিত্বের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে, উপনিবেশের ছাপচিত্র ঝেড়ে পুছে বাঙলার প্রতিটা ইঞ্চি থেকে দূর না করা পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে, বাঙলার বুক থেকে উপনিবেশের কড়ি বর্গাদের উৎখাত না করা পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে, পৃথিবীর বুক থেকে উপনিবেশ নামক বর্বরতার মৃত্যু নিশ্চিত না করা পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে বাঙলার নতুন প্রজন্মের সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা।
১৫টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×