somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুধু ফরমালিনের দোষ দেওয়া কেন?

০৫ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিজ্ঞান পড়ার সুবাদে ফরমালিনের নাম শুনেছি অনেকবার। আর ইদানিং ফরমালিন নিয়ে যে ক্রেজ চলতেছে তাতে পুরাই ত্যক্ত বিরক্ত!

কি এই ফরমালিন? কেমিস্ট্রির জ্ঞান থেকে জানি ফরমালিন হল ৪০% ফরমাল্ডিহাইডের একটা সোলিউশন, মানে ৪০ ভাগ ফরমাল্ডিহাইড, বাকিটা পানি। গবেষণার জন্য বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ার, তাদের কলিজা-গুর্দা ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন। কিন্তু সেই ফরমালিন শাক-সবজি, ফল-মূল বিবিধ পচনশীল খাদ্যে মিশানো হয় পচন রোধ করার জন্য। আর এ নিয়াই হাউকাউ। কত কত ব্যবসায়ীকে জরিমানা ও হয়রানি করা হল। টনকে টন আম নষ্ট করে ফেলা হল, কিছু আম আবার অফিসারেরা ব্যাগে ভরে নিয়ে গেল খাওয়ার জন্য। মাঝখান থেকে ছুটা-মুটা কিছু ব্যবসায়ী গজিয়ে উঠল, নিজের গাছ থেকে আম পেরে ঢাকায় সাপ্লাই দিল। আমার পরিচিত এক বড়ভাইকে দেখেছি এ উদ্দেশ্যে একটা ফেসবুক পেইজও খুলে ফেলেছে।

বলেন তো ক্ষতি হল কার? অবশ্যই খুদে ব্যবসায়ীদের যারা সরল মনে টুকরি ভরে আম বিক্রি করে। আর আমরা, যারা এখন আমের সিজন থাকার পরও আম কিনছি না।

ফরমালিন মেশানোটা আমাদের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে? ফরমালিন নিজেই একটা উদ্বায়ী পদার্থ, ধীরে ধীরে বাতাসেই মিলিয়ে যায়। পানিতে-সিরকায় ভিজিয়ে ফরমালিন দূর করা, রান্নার মাধ্যমে ফরমালিন নষ্ট হওয়ার কথা আমরা আগেই শুনেছি। আমাদের এক প্রোফেসর আজ বললেন তিনি ফরমালিনের কারণে ক্যান্সার হবার কথা কোথাও পাননি। ফরমালিন কি ফলে নিজে নিজে তৈরি হয়? হতে পারে। আমাদের শরীরে কত ধরণের ম্যাকানিজম যে আছে, তার ইয়াত্তা নেই। ট্রাস্ট মি, আমি এই বিষয়ে একজন স্কলার বলে কিছুমিছু জানি। মানব দেহে যে নিজে নিজে অ্যালকোহলও সৃষ্টি হতে পারে, এই তথ্য শুনে কি আপনার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে? অত ভয়ের কিছু নাই, ট্রাস্ট মি, সেগুলো বের করার ব্যবস্থাও আছে। ফরমালিন বের করার উপায়ও আছে। এটা এমনিতেই পানিতে দ্রবনীয়।

কার্বাইট নিয়েও কেউ কেউ হাউকাউ করে। কি সে কার্বাইট? এই কার্বাইট পানিতে মিশে বানায় ইথাইলিন নামক গ্যাস, যেটা প্রাকৃতিকভাবেই ফল বা সবজি পাকায়, যেমন টমেটো। আম বস্তাবন্দি করে রাখলে পাকে কেন বলেন তো? কারণ ফলে এমনিতেই যে ইথাইলিন তৈরি হচ্ছে সেটা আর বাইরে ছড়াতে পারে না।

ভাববেন না ফরমালিন নিয়ে ওকালতি করছি, বা খুশিতে লুঙ্গি ডেন্স মারারও কিছু নাই। ফরমালিন যে আমাদের একেবারে ক্ষতি করবে না তা না, তবে তার একটা লিমিট তো আছেই। আর ফল তো রান্না করে খাবেন না। একটু অপেক্ষা করুন, এই পোস্টের উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন।

মাত্র কিছুদিন আগে আমাদের আরেক প্রোফেসর একটা সেমিনার করলেন তার একে গবেষণা নিয়ে। সেখানে দেখা গেছে মাছ-মাংসে হেভি মেটাল ক্রোমিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি। ক্রোমিয়াম কি বুঝেন তো? সিগারেটের শুধু নিকোটিন না, আরেকটা ক্ষতিকর পদার্থ আছে, -- ক্রোমিয়াম। এবং এটা ধাতু, রান্নার কারণে এর কার্যকারীতা কিন্তু নষ্ট হচ্ছে না। কোথা থেকে আসে এই ক্রোমিয়াম? আমরা যে বাজার থেকে মুরগীটা কিনছি, এটাকে যে হাজারীবাগের টেনারির বর্জ খাওয়ানো হচ্ছে তা কি আমরা জানি? এটা নিয়ে তো কাউকে ফাল পারতে দেখলাম না! এ ক্রোমিয়াম আমাদের দেহের বিভিন্ন ক্ষতি করার পাশাপাশি ক্যান্সারও সৃষ্টি করে। ইন্টারনেটে খোজ নিলেই এ বিষয়ে অনেক লেখা এবং প্রকাশনা পাবেন।

তেলের সাথে মেশানো হচ্ছে পোড়া পেট্রল! অর্থাৎ জীবাস্ম তেল আমাদের খাওয়ানো হচ্ছে যেটা দিয়ে ইঞ্জিন চালানো হয়। অথবা হয়তো কোন এক শীতের সকালে রান্নাঘরের চুলা জ্বালিয়ে হাতে সেক দিতে গিয়ে দেখলেন বোতল-জাত সয়াবিন তেল মধুর মত ঘন হয়ে গেছে! হার্টের সমস্যার জন্য এর বেশি আর কি চান?
শুটকি মাছে নাকি মেশানো হয় ডিডিটি। এটা কি জিনিস জানেন? পোকা-মাকড় দমনের জন্য ব্যবহার হত আগে। কিন্তু মানুষের শরীরে ভয়াবহ রকম বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে বলে এটা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আমাদের দেশের কৃষকেরা যথেচ্ছ কীট-নাশক ব্যবহার করে, এ কীট-নাশকও কিন্তু আমাদের ক্ষতি করতে পারে যদি তা ধোয়ার পরও কিছু থেকে যায় এবং রান্নার তাপেও পুরোপুরি নষ্ট না হয়।

তরমুজ, বাঙ্গি’র মত ফলে শুনেছি বাইরে থেকে রঙ দিয়ে লাল বা হলুদ বানানো হয়েছে। এগুলো হল কাপড়ের রঙ। বিদেশী দুষ্ট বালকেরা আমাদের দেখিয়ে বলে, -ঐ দেখ শালারা কি বলদ! কাপড়ের রঙ খায়! শুধু ফলেই না, নানান কিছুতেই এই রং-এর ব্যবহার চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। গোলা আইসক্রিম এক সময় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, এখন তাতে ভাটা পরেছে বলে মনে হয়। আর বিভিন্ন রকম “তাজা আমের জুস” তো আছেই। ফরমালিনের নাম করে ইফতারিতে খেজুর খাওয়াটাই ছেড়ে দিলেন, এবার কি পিয়াজু, বেগুনী এগুলোও খাওয়া ছাড়বেন? জানেন না এগুলোতে রঙ মেশানো হয় যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে?

বাইরের দেশে কি রঙ দেয়া হয় না খাবারে? হ্যা, দেয়া হয়। কিন্তু সেটা খাবারের রঙ। সময় মত সেগুলো হজম হয়ে মূত্রের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। কাপড়ের রং-ও বের হতে পারে, কিন্তু সেটা সময়-সাপেক্ষ, ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার তা হবে। আর রঙ তো যেই-সেই পরিমাণ খাচ্ছি না, ইট্‌স্‌ হিউজ!

ভাতের চাউলে মোম তো মেশানো হয় অনেক আগে থেকেই ওটা চকচকে করার জন্য। এতে হয়তো তেমন ক্ষতি নেই, কিন্তু কাস্টমারকে তো বোকা বানানো হল। যেমন বোকা বানানো হয় কার্বাইট দিয়ে টমেটো পাকিয়ে। কাচা টক টক সব্জিকে পাকালে ওটা যৌবনের মত লাল টমেটো হয়তো হবে, কিন্তু সেই লালে মজা পাবনে না। কারণ মেকি জিনিসে আসল স্বাদ তো থাকে না।

বুঝলেন তো এবার আমরা কি খাচ্ছি? এভাবে খুজতে থাকলে ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। অথচ এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর ফরমালিনের গুষ্টি উদ্ধার করে বেড়াচ্ছি। এভাবে না জেনে না বুঝে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা, এটা আমার দৃষ্টিতে একটা ক্রাইম। এই ফরমালিনের দোহাই পেরে কত কত ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ীকে পথে বসানোর পায়তারা, এই রকম হুজুগেপনার কোন মানে হয় না।

ফরমালিন-বিরোধী আইন হচ্ছে শুনলাম। বুঝতে পারছি না এটাকে স্বাগত জানাব কিনা। কারণ এখানে শুধু ফরমালিনকে ফোকাস করা হচ্ছে। তাহলে আরো যে কত কত বিষ আমাদের প্রতিনিয়ত শ্লো পয়জনিং ঘটাচ্ছে, যার প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে বলে টের পাওয়া যায়, সেগুলোর ব্যাপারে কি কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে না? আইন যদি হতেই হয়, তবে তা হবে সকল ধরণের “ভেজাল এবং ফুড পয়জন” বিরোধী। বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে কাজ করতে হবে, সবকিছুর একটা টক্সিক লেভেল ঠিক করতে হবে, এর বেশি পরিমাণে “বিষ” পাওয়া গেলে ত্বড়িত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাপড়ের রঙ খাওয়ানো যাবে না। পোল্ট্রি এবং গবাদি পশুকে ক্ষতিকর হেভিমেটাল খাওয়ানো যাবে না, যথাসম্ভব স্বাস্থ্যকর পরিবেশে পালতে হবে। সর্বপরি শাস্তির মাত্রা এমন হতে হবে যেন মেজিস্ট্রেটকে সামান্য কিছু টাকা-টুকা খাইয়ে পার পাওয়া যায়।

সবার জন্য ফরমালিন ও ভেজালমুক্ত ইফতারির কামনায় শেষ করছি। ধন্যবাদ।
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×