somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ ২০ জুন। কবি ও সমাজ সংগঠক সুফিয়া কামালের জন্মদিন। তার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধায় আমার এই নিবেদন।

২০ শে জুন, ২০১৪ সকাল ৯:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পদে পদে প্রগতিবিমুখ সামাজিকতার কঠিন শৃংখল, জীবনের বাঁকে বাঁকে রক্ষণশীলতার কঠোর ঘোরটোপ ঠিক এমনি সময়ে শায়েস্তাবাদ নবাব পরিবার ৫ আষাঢ় ১৩১৮বাংলা, ২০ জুন ১৯১১ ইংরেজী সনে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দরবেশ বাবা তার ডাক নাম রেখেছিল হাসনা বানু। তাঁর পিতার নাম ছিল সৈয়দ আব্দুল বারী, মাতার নাম সৈয়দা সাবেরা খাতুন।

বহু ভাষাবিদ সৈয়দ বারী (কুমিল্লার বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারের সন্তান) পেশায় ছিলেন একজন উকিল। সুফিয়ার বয়স যখন মাত্র সাত বৎসর তখন তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হয়ে নিখোঁজ হন। সুফিয়ার মা অপরিসীম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে সব প্রতিকূলতা জয় করেন। পরবর্তীতে তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট সুফিয়ার মধ্যে পরিস্ফুটিত হতে থাকে।

বাল্যশিক্ষা

শায়েস্তাবাদ নবাব পরিবারের প্রচলিত ভাষা ছিল উর্দু। সুফিয়া মায়ের কাছ থেকে প্রথমে বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেন। তার মামার বিশাল লাইব্রেরী থেকে চুপি চুপি বাংলা বই এনে পড়তেন। অথচ তাঁর মামা ছিলেন নারী শিক্ষার ঘোর বিরোধী।
মামাবাড়ির পারিবারিক মসজিদে সুফিয়া আমপারা পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কুরআন শরীফে সবক নেয়ার আগেই পর্দার বেড়িতে অন্দরমহলে আটকা পরেন তিনি। নবাব পরিবারের মেয়েদের তখন স্কুলে যাবার নিয়ম ছিলনা। কিন্তু সুফিয়া বায়না ধরেন তিনি স্কুলে যাবেন। অভিভাবকরা অবশেষে তাঁকে ছেলে সাজিয়ে মাথায় টুপি পরিয়ে স্কুলে পাঠান। কিন্তু বাস্তবে স্কুলে যাওয়া হয়ে উঠেনি তাঁর। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে এর বেশী কিছুই অর্জন করতে পারেননি তিনি। তাঁর মামা, ভাইএরা বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে বাংলা বই এনে দিত আর সুফিয়া সেগুলো পড়ে পড়ে তার জ্ঞানের পিপাসা মিটাতেন।
পড়াশুনার প্রতি বোনের আগ্রহ দেখে সুফিয়ার বড় ভাই তার নিজের বৃত্তির টাকা দিয়ে সুফিয়ার জন্য ‘সন্দেশ’ পত্রিকা রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেকাজেও ছিল প্রতিবন্ধকতার বেড়ি। নবাব বাড়ির মেয়ের নামে ডাকে বই আসছে জানাজানি হয়ে গেলে নিন্দার ঝড় উঠবে চারদিকে। শেষমেষ অন্য ব্যবস্থা হলো। স্থানীয় জুবিলী স্কুলের পন্ডিত পোস্টমাস্টারীও করতেন। সুফিয়ার নামে পত্রিকা আসার সাথে সাথে তিনি সেটা নিজের কাছে রেখে দিতেন। পরে সুযোগ বুঝে সুফিয়ার হাতে পৌঁছে দিতেন।
মাত্র সাত বৎসর বয়সে কোলকাতায় বেগম রোকেয়ার সাথে সাক্ষাত হয় সুফিয়ার। আজকের আলোকিত নারী হওয়ার প্রবল সম্ভাবনাটি বোধ হয় তখনই তার মধ্যে আঁচ করতে পেরেছিলেন বেগম রোকেয়া। তাই সুফিয়ার মাকে বলেছিলেন, ওকে পড়াবেন। তখন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রথম শুরু হচ্ছে। প্রচন্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার ভাগ্য সুফিয়ার হয়নি।

লেখালেখির শুরু

রক্ষণশীল হলেও সুফিয়ার মামারা ছিলেন উদার মানসিকতাসম্পন্ন। তাই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর জ্ঞানী-গুণী-পন্ডিত ও লেখকদের পদচারণায় মুখর থাকত নবাব বাড়ির আঙিনা। আসত বিভিন্ন ধরনের পত্রিকাও। সেগুলোতে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের লেখা পড়ে পড়ে উৎসাহিত হতেন সুফিয়া। লেখা লেখা খেলায় মেতে উঠতেন ঘরের ভিতর। কিছুটা শংকা, কিছুটা ভয় নিয়ে নিজের লেখা নিজেই পড়তেন, আবার লুকিয়ে ফেলতেন কোথাও।

পত্রিকায় প্রথম লেখা

১৯২৩ ইং সনে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুফিয়া। চলে আসেন স্বামীর কর্মস্থল বরিশালে। সুফিয়ার জন্য একটা বিরাট সুবিধা ছিল যে নেহাল হোসেন সাপ্তাহিক ‘তরুণ’ পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন। এই পত্রিকার জন্যে লেখা চাওয়া হলে তিনি তার স্ত্রীর কয়েকটা লেখা সম্পাদকের কাছে নিয়ে যান। মনোনীত হয় একটি গল্প ও একটি কবিতা। পত্রিকার প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম সুফিয়া এন হোসেনের একটি গল্প ছাপা হয়। তবে লেখকের নাম হিসেবে ছাপা হয় মিসেস এন হোসেন। সুফিয়ার বড় মামা ও চাচা শ্বশুড় পত্রিকায় তাঁর লেখা দেখে বেজায় নাখোশ হন নবাব পরিবারের ইজ্জতের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হয়ে। তিনি তার ভ্রাতৃষ্পুত্র নেহাল হোসেনকে ডেকে রাগের কথা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননা। নেহাল হোসেন স্ত্রীর সাহিত্য অনুরাগের কথা ভেবে সবকিছু নীরবে হজম করেন।
সুফিয়া কামালের জীবনের সবচেয়ে অনিশ্চিত ও হতাশার সময় ছিল ত্রিশের দশক। সেই সংকটময় সময়ে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ ও প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশিত হয় যা তাঁর ব্যক্তি ও সাহিত্যজীবনে সোনালী আলোর দ্বার উন্মোচন করে দেয়।

সমাজসেবামূলক কাজে হাতেখড়ি

সমাজসেবামূলক কাজে সুফিয়ার হাতেখড়ি কোলকাতার ‘শিশুসদন’ ও ‘মাতৃমঙ্গল সমিতি’ দিয়ে। তারপর এগিয়ে চললেন সুফিয়া। ১৯২৫ ইং সনের কথা। রীতিমতো একটা দুঃসাহসিক কাজ করলেন সুফিয়া। হিন্দু মহিলাদের সাজে সজ্জিত হয়ে নিজের হাতে চড়কায় সূতো কেটে নিয়ে গান্ধীজির হাতে তুলে দেন তিনি। কিশোরী বধূর এই অসাধ্য সাধনে সেদিন যারপর নেই অবাক ও বিস্মিত হয়েছিলেন তার স্বামী নেহাল হোসেন।
ছোটকাল থেকে সমাজের রক্তচক্ষুর প্রতি সুফিয়া ছিলেন অকুতোভয়। বিয়ের সময় স্বামীর সমর্থন ও সহযোগীতায় তার সেই মনোভাব প্রাণ ফিরে পেলো যেন। ১৯২৯ইং সনে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রথম বিমানে চড়েন। এটা শুধু তাঁর সাহসিকতারই পরিচয় ছিলনা। সকল প্রকার সামাজিক কূপমন্ডকতা ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ছিল চরম প্রতিবাদ। এর আগে ১৩৩৬ বাংলা সনে তিনি আর একটি প্রতিবাদী কাজ করেন ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর ছবি ছাপিয়ে।
জীবনের যে কোন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তিনি অনায়াসে। তাঁর সংগ্রামী ব্যক্তিজীবনের পরিচয় মিলে এখান থেকেই। ১৯৩২ইং সনের ১৯ ডিসেম্বর স্বামীর অকাল মৃত্যু, শায়েস্তাবাদের নবাবী সম্পত্তি বাড়িঘরসহ নদী ভাঙনে বিলীন হওয়া এসব কিছু তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি মোটেও। ততদিনে তাঁর বড় মামাও ইন্তেকাল করেছেন। এমতাবস্থায় কঠিন আত্মপ্রত্যয় ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সকল প্রকার সামাজিক গঞ্জনা ও অপমানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান সুফিয়া। পরিবারে উপর্জক্ষম কেউ ছিলনা তখন। অথচ বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সুফিয়া নিজেই উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেন। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট ছাড়া এমন একটা জীবনমুখী সংগ্রামী সিদ্ধান্ত নেয়া সে যুগে সুফিয়ার পক্ষেই সম্ভব ছিল। কালকাতা কর্পোরেশন স্কুলে তিনি চাকরী নেন শিক্ষকতার। কিন্তু অশিক্ষা আর কুসংস্কারে ডুবে থাকা সমাজ সুফিয়ার এহেন আচরণ মেনে নিতে পারেনি। ফলে শিশু কন্যা ও বৃদ্ধ মাতার হাত ধরে প্রায় সহায় সম্বলহীন অবস্থায় তাঁকে পথে নেমে আসতে হয়। কিন্তু ভেঙে পড়েননি তিনি একটিবারের জন্যও। এগিয়ে চললেন নতুন প্রাণউদ্যমে ও সংগ্রামী চেতনায়। তারই ফলশ্রুতিতে আজকের আলোকিত সুফিয়া কামাল।
সুফিয়ার সেই চরম দুর্দিনে সেই সময়ের দুই লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কথাশিল্পী জনাব মাহবুব-উল আলম ও আবুল ফজল আভির্ভূত হয়েছিলেন তপ্ত মরুতে শীতল জলাধারের মতো। নানাভাবে তারা সুফিয়াকে স্বান্তনা দিতেন ও সাহস যোগাতেন। আর সুফিয়ার জ্ঞাতি বোন বেগম মরিয়ম মনসুর সেই সময় সুফিয়ার প্রতি সাহায্যের হাত না বাড়ালে আজকের বেগম সুফিয়াকে আমরা পেতাম কিনা সন্দেহ।
একদিকে দারিদ্র আর একদিকে বিধবা বলে সমাজের চোখে অপয়া হিসেবে চিহ্নিত - এই দ্বিমুখী সাড়াশি আক্রমণের মুখেও নিজের সিদ্ধান্তে সুফিয়া ছিলেন অবিচল। তবে সেই সময়ে সওগাত সম্পাদকের আচরণে সুফিয়া যারপর নাই মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন। আবুল ফজলের কাছে লেখা সেই সময়ের একটি চিঠিতে সুফিয়ার মানসিক সংঘাতের চিত্র ফুটে উঠে। মাহবুব-উল সাহেবকে লেখা একটি চিঠিতেও অনুরূপ চিত্র ফুঠে উঠেছে। আবুল ফজল সাহেবকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন
“চারিদিকের নিস্পেষণে আমি ক্রমশ: সংকুচিত হয়ে আসছি। আমাদের সমাজে বিধবার অবস্থান আপনাকে কি বলতে হবে নতুন করে? বিধির বিধানের উপর মানুষের বিধান বড় ভয়ানক। আমি কিছুই করতে পারছিনা।”
আর এক চিঠিতে তিনি লিখেন,“...সমাজে বাস করি, অপ্রিয় কানাকানিও হবে, সাহিত্য আলোচনা ও নি:সঙ্গতাও দূর হবেনা আপনি সব জানেন, অভিজ্ঞতা বেশী। আমিও জানি এসব। তাই আমার মন হাহাকারে ভরে উঠে, যদি কখনও আসেন কথা কইব কিন্তু পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে, আমার মন এরই বিরুদ্ধে রুখে উঠে। কারও বাড়ি গেলে আমার যাওয়াটার গভীর উদ্দেশ্য কি তাই সন্ধান করতে পরিচিতরা ব্যস্ত হয়ে উঠেন, এতে আমি দু:খ বোধ করি।”

দ্বিতীয় বিয়ে

অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত সংসার, কন্যা ও মায়ের দায়িত্ব, স্কুল শিক্ষকতা সর্বোপরি নানা মানুষের নানা বিরূপ সমালোচনা এসবের চর্তুমুখী আক্রমণের মুখে চরম আকার ধারণ করে সুফিয়ার জীবন-যন্ত্রণা। তার উপর রয়েছে সাহিত্য সেবার মতো সুকুমার বৃত্তির চর্চা। এক সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সুফিয়া। তার প্রভাব পড়ে শরীরের উপর। অসুস্থ হয়ে শয্যা নেন তিনি। ঠিক এই সময়ে এগিয়ে আসেন জনাব মিজানুর রহমান। তার চেষ্টায় ৮ই এপ্রিল ১৯৩৯ইং সনে শয্যাশায়ী সুফিয়াকে বিয়ে করেন উচ্চশিক্ষিত, প্রগতিবাদী সাহিত্যিক চট্রগ্রামের বিখ্যাত খান বংশের যুবক কামাল উদ্দীন খান। সুফিয়া পরিচিত হন সুফিয়া কামাল হিসেবে। শরীর সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে লেখনী সচল হয়ে উঠে তাঁর।

আন্দোলন ও সংগ্রামে সুফিয়া

নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের আর্তনাদ ব্যথিত করত সুফিয়াকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানব সভ্যতার চরম বিপর্যয়ে বিচলিত হয়ে উঠেন সুফিয়া। তিনি সৃস্টি কর্তার কাছে এ অবস্থার অবসান কামনা করে লিখলেন ‘প্রতিকার’ কবিতা। কলম হাতে তিনি এগিয়ে এলেন নির্যাতিত মানবাত্মার প্রতি। তিনি লিখলেন,
“রক্তিম আলোকে হেরি পৃথিবীর রক্তশক্ত হৃদয়
কৃষ্ণাব বেদনা-ঘাতে শত ক্ষতময়!
তোমার দিগন্তের আজ বেলাশেষে গোধূলীর আলো
ফোটে নাকো, দেখা যায লেখা সেথা কালো কালো
কুন্ডলিত ধুম্ররাশি! অকস্মাৎ তীব্র বিস্ফোরণ
নয়ন ধাঁধিয়া তোলে! মানুষের মৃত্যু আয়েজন
নিত্য সমারোহ চলে নির্ঘোষিয়া শয়তানের জয়।
সহিয়া রহিবে তুমি এত, দয়াময়?
আদিগন্ত ব্যাপি আজ নাচি চলে যার,
তান্ডব বিভৎস লীলা; করিবে না কি এর প্রতিকার?”

সংগঠক সুফিয়া কামাল

তখন ১৯৪৬ইং সাল। কোলকাতায় সা¤প্রদায়িক দাংগা চরম আকার ধারণ করে। সুফিয়া তাঁর মেয়ে ও বেগম মরিয়ম মনসুরের মেয়ে জাকিয়াকে নিয়ে কোলকাতায় ব্রেবোণ কলেজে দাংগা আক্রান্ত লোকদের জন্যে একটি আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলেন এবং দীর্ঘদিন সেটা পরিচালনা করেন।
সমাজের নিগৃহীত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের হয়ে কথা বলার বীজ প্রোথিত হয়েছিল সুফিয়ার ভিতর সেই কৈশোর থেকেই। দেশ বিভাগের পর সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন সুফিয়া। তখন থেকেই তার সামনে খুলে যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বিশাল প্রেক্ষাপট। সেই সময়ের নারী নেত্রী লীলা রায়ের অনুরোধে সুফিয়া যোগ দেন ‘শান্তি কমিটিতে।’ এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা। সুফিয়া অচিরেই তার সাহসিকতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার জন্যে এই কমিটির সভানেত্রী মনোনীত হন।
১৯৪৭ইং সনে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রগতিশীল মহিলাদের নিয়ে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’। এই সমিতিরও সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল। একই সময়ে স্থানীয় বিশিষ্ট মহিলাদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ওয়ারী মহিলা সমিতি’। সুফিয়া কামাল এই সমিতিরও সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৫১ইং সনে গঠিত হয় ‘ঢাকা শহর শিশু রক্ষা সমিতি’। সুফিয়া কামাল এই সমিতিরও সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬০ইং সনে সুফিয়া কামাল প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মৃতি কমিটি’। এর উদ্দেশ্য ছিল বেগম রোকেয়াকে জনসমক্ষে পরিচিত করে তোলা।
স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে সুফিয়া কামালের বাসায় বসেই প্রথম সিদ্ধান্ত হয় ‘৭১এ ঘাতক-দালার নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠনের। মূলত তাঁর ও শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপেই দু’ধারায় বিভক্ত ঘাতক বিরোধী আন্দোলন এক ধারায় মিলিত হয় এবং জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক ও অধ্যাপক আব্দুল মান্নানকে সদস্য সচিব করে ৪৫ সদদ্যের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ‘৭১ এর ঘাতক দালাল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। তিনি গণআদালতের একজন বিচারকও বিনর্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে শেষ মুহূর্তে তাঁর নাম বাদ দেয়া হয়। এই কমিটি কর্তৃক গঠিত ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের’ তিনি ছিলেন চেয়ারপারসন। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর তিনি এই কমিশনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলন

সুফিয়া কামাল ছিলেন একজন অকুতোভয় যোদ্ধা। যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীর প্রয়োজনে, সংকট সময়ে তিনি সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন সোচ্চার কন্ঠে। ১৯৫২ইং সালের ভাষা আন্দোলন তথা বাঙালী জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর বিদেশী আগ্রাসন নাড়িয়ে দেয় সুফিয়া কামালের সাহিত্য জীবনকে। রাজনৈতিক এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে তাঁর লেখনী। তাঁর জীবনকালের সাহিত্য সাধনার যত ফসল আমরা পেয়েছি তার একটা বিরাট অংশই এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
১৯৫৪ইং সনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন বাতিল করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ২১ ফেব্রুয়ারীর শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে এদেশের ছাত্রসমাজ। এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সুফিয়া কামালও এর প্রতিবাদ জানান। এর আগে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে তেল ও নুনের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাজের সকল স্তরের মহিলারা সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে মন্ত্রি আতাউর রহমানকে প্রকাশ্য রাস্তায় ঘেরাও করে যা এর আগে কখনও ঘটেনি। এরপর আসে উনসত্তুরের গণ অভ্যুত্থান। পশ্চিমা ভয়-ভীতি আর প্রলোভনে যখন অনেকে দিশেহারা তখন সুফিয়া এগিয়ে আসেন সাহস ও অনুপ্রেরণা নিয়ে।
প্রতিবাদী সংগ্রামী সুফিয়া কামালের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের সাথে সরাসরি আলোচনা। ঐতিহাসিক তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদনের পর পরই ঢাকায় আসেন আয়ুব খান। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অস্ত্রবাজদের রাজত্ব। প্রতিকারের আশায় মহানগরীর শান্তিপ্রিয় মানুষ একটি কমিটি গঠন করে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে তার সাথে দেখা করতে যায়। সেদিন সুফিয়া কামালের সাহসী প্রতিবাদে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ফিল্ড মার্শাল। সুফিয়া বলেছিলেন, “আপনি তাসখন্দ চুক্তি করে অতবড় পাক-ভারত যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারলেন। সে তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডগোল তো সামান্য। এ পারবেন না একি হয়?
স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের শেষে এবং আশির দশকের সামরিক সরকার, স্বৈরাচার, মৌলবাদ ও সা¤প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন। যে কোন প্রকার দুঃশাসন ও সা¤প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিে আস্ফালন বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠ উচ্চারিত হতো সবার আগে।
১৯৭৫ইং সনে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেন সুফিয়া কামাল। তাঁর সংগ্রামী চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। তারপর আসে ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থান। সামিল হন সুফিয়া কামালও। কার্ফ্যু অমান্য করে তিনি মৌন মিছির বের করেন। ফলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন উজ্জীবিত হয় আর এক দফা। পতন হয় স্বৈরাচারের।
এক কথায় সুফিয়া কামাল ছিলেন সব্যসাচী প্রতিবাদী কন্ঠ। যেখানেই অত্যাচার-অবিচার, রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ন সেখানেই সোচ্চার ছিল তাঁর কন্ঠ। ভাষা আন্দোলন, বাংলা হরফ রক্ষার আন্দোলন, রবীন্দ্র সংগীত রক্ষার আন্দোলন, বিশ্ব শান্তি রক্ষার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, কালা-কানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ‘৭১ এর ঘাতক ও দালালদের বিরুদ্ধে জোট গঠন, ফতোয়াবাজী ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সব জায়গায় জড়িয়ে আছে সুফিয়া কামলের নাম।

দেশপ্রেমিক সুফিয়া

একদিকে কবি-সাহিত্যিক অন্যদিকে সমাজসেবী সাংগঠনিক এসব পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে সুফিয়া কামালের দেশপ্রেমিক পরিচয়। যারা সুফিয়া কামাল সম্পর্কে জানেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন একথা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৩ মার্চ এক বৈঠকে ইয়াহিয়া খানের সামনে সুফিয়া কামাল যে বক্তব্য তুলে ধরেন তাতে তাঁর সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় পেয়ে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বিস্মিত না হয়ে পারেননি। তখন থেকেই পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শেন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সুফিয়া কামালের উপর। তাই সোভিয়েট সরকার বিশেষ বিমানে করে তাঁকে সোভিয়েট ইউনিয়নে নিয়ে যাবার ইচ্ছে ব্যক্ত করে। কিন্তু তিনি তাতে রাজী হননি। দেশের চরম দুর্যোগ মুহূর্তে নিজকে সমস্ত ঝুট-ঝামেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় সুফিয়া কামাল নিজ বাড়িতে অবস্থান করে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। তাঁর প্রতিবেশীরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাবার সময় তাদের রেশন কার্ড তাঁর কাছে রেখে যায়। এগুলো দিয়ে রেশনের চাল-ডাল উঠিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন সুফিয়া কামাল। এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়েও তাঁর লেখনী থেমে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনা তিনি ডায়রীতে লিখে রাখতেন। এগুলোর সংকলিত প্রকাশই হচ্ছে সুফিয়া কামালের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল ‘একাত্তরের ডায়েরী’।
যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দ্বারা লাঞ্চিত আশ্রয়হীনা মেয়েদের তিনি যথাসাধ্য সাহায্যের চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এদের পূর্ণবাসনের জন্যে তিনি গড়ে তুলেন ‘নারী পূর্ণবাসন সংস্থা’। তিনি নিজে ছিলেন এর সভানেত্রী। তাছাড়া নারী মুক্তি আন্দোলনে তাঁর মুল সংগঠন হলো ‘মহিলা পরিষদ’-- যার দৃপ্ত পদচারণায় আজও উদ্বেলিত হচ্ছে এদেশের নারীসমাজ। ১৯৯৮ইং সনে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যে ঢাকার সচেতন নাগরিক সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘ত্রাণ কমিটি’। সুফিয়া কামাল ছিলেন এর আহবায়ক।

নারী মুক্তি আন্দোলনে সুফিয়া কামাল

এদেশের নারী জাগরণ, নারী আন্দোলনের পিছনে সুফিয়া কামালের অবদান অপরিমেয়। নারী জাগরণ আর নারীমুক্তি ছিল তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য। ১৯৬১ইং সনে মুসলিম পারিবারিক আইন প্রণয়ন ছিল নারী মুক্তি আন্দোলনের জন্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিজয়। পরবর্তীতে মৌলবাদী চক্র এই আইনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারী সমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে।
এতকিছুর পরও এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যায়। সুফিয়া কামাল উপলব্ধি করেন যে, নারী সমাজের পূর্ণ মুক্তি না আসা পর্যন্ত গণতন্ত্র পূর্ণতা পায়না। এ নিয়ে তাঁর ক্ষোভের অন্ত ছিলনা এবং তিনি তা প্রকাশও করেছিলেন অত্যন্ত জোড়ালোভাবে। ‘বেগম’ এর প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে---
“... মুসলিম সমাজ আজ এক কঠোর দায়িত্ব গ্রহণের সম্মুখীন। অর্জিত স্বাধীনতা, সম্মান ও গৌরব অক্ষুণœ রাখতে হলে কেবল পুরুষই নয়, মুসলিম নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে। তার সংগে সংগে ভবিষ্যৎ নারী সমাজকে এমনবাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে তারা সেই স্বাধীন সার্বভৌম আদর্শ রাষ্ট্রের দাবীদার হতে পারে সগৌরবে। এর জন্যে চাই আমাদের মানসিক প্রসার, আশা-আকাংখার ব্যপ্তি আর জীবন সম্বন্ধে স্থির ধারণা।”
এ সম্পর্কে তার আরও একটি উদ্বৃত্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন,
“... গণতন্ত্র যদি হয়, তাহলে সেখানে কথা বলার স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। তা হচ্ছে কই? দু:খ হচ্ছে সরকার মহিলাদের কথা জানার, বুঝার চেষ্টাও করছেন না। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী মহিলা হলেই নারীর অধিকার আদায় হয়না। নারীর অধিকার আদায় করতে হলে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ন করতে হবে।


মানুষে মানুষে বৈষম্যের প্রতিবাদে সুফিয়া কামাল

আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিবাদ, সমাজ সংগঠন এসব কিছু জীবন্ত রূপ পেতো তাঁর কবিতায়। সাহিত্যকে তিনি শুধু সুকুমার বৃত্তির আবর্তে সীমাবদ্ধ রাখেননি। এর মাধ্যেমে তিনি কথা বলেছেন নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের পক্ষে। তাঁর সাহিত্যের প্রতিবাদী কন্ঠ উচ্চারিত হয়েছে সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে। একটা ছোট্র ঘটনায় তার প্রমাণ মিলে।
১৯৯২ ইং সনে সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকা শহরকে সাজানো হয় তিলোত্তমা স্বপ্নের নগরী হিসেবে। কিন্তু এর আড়ালে বহুমুখী সমস্যায় জর্জড়িত হচ্ছে মানুষ। প্রাণপাত করছে একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে। একজন সচেতন সমাজ সংস্কারক হিসেবে সুফিয়া কামালের মনে দারুণভাবে নাড়া দিয়ে যায় এটা। কবিতার মাধ্যমে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। তিনি লিখেন,
“নির্লজ্জ নগরী নটি, নিত্য নব নব রূপায়ণে
সজ্জিত করিয়া দেহ, বসি বাতায়নে
লুব্ধ কর ভ্রান্ত পথিকেরে
------------------------------
সাজায়ে প্রত্যঙ্গ, অঙ্গ স্বচ্ছ আবরণে
ঝলমল করি ওঠো দীপ্ত দিবালোকে
----------------------------
মানবেতর মানুষেরা
বেঁচে আছে যারা
শোণিতাক্ত পথে ও প্রান্তরে
সুসজ্জিত তোমার বাসরে
পশিতে যাইয়া শোন আজি
দিকে দিকে উঠিতেছে বাজি
সকরুণ বাঁশীর সুর
খসে যাবে পায়ের নূপুর
স্খলিত হবে বহির্বাস
ব্যর্থ হইবে পুষ্পশয্যা ঘনাইবে সর্বনাশ”।
সুফিয়া কামাল একদিকে যেমন ছিলেন আপোষহীন ব্যক্তিত্ব তেমনি অন্যদিকে তীক্ষè বিবেকবান একজন মানুষ। সমাজের যে কোন প্রকার বৈষম্য তাঁকে নাড়া দিত সবার আগে। ১৯৯৭ ইং সনে ঈদ উপলক্ষে এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা দামের পাকিস্তানী লেহেঙ্গা ঢাকার বাজারে আসে। পত্রিকায় এর ছবিও প্রকাশিত হয়। এর বিপক্ষে সুফিয়া কামালের বিবৃতি পুরো অসুস্থ পরিবেশকে পাল্টিয়ে দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোন মহিলা যদি এই টাকায় লেহেঙ্গা কিনেন তবে তিনি যেন বিদেশে গিয়ে তা পরিধান করেন। আর শৈত্য প্রবাহে যত মানুষ মৃত্যুবরণ করছে তাদের কথা স্মরণ করে তিনি যেন কিছু শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।
যে কোন আন্তর্জাতিক ঘটনা তাঁকে নাড়া দিত ভীষণভাবে। ১৯৯২ ইং সনে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে তিনি বাংলাদেশের ১৬ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবির সাথে পত্রিকায় বিবৃতি দেন। এবিষয়ে তিনি দৈনিক ‘ভোরের কাগজে’ তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ‘অতিথি প্রতিবেদন : আজকের ভাবনা ’ শিরোনামে।
“ভারত ভাগ্যবিধাতা এবার যে কলংক-কালিমা বিভুতিতে আচ্ছন্ন হলো, তাতে সা¤প্রদায়িকতার এক বিরাট কলংকিত অধ্যায় বিশ্ব ইতিহাসে অঙ্কিত হলো। বিপুল জনগোষ্ঠী, বিরাট সামরিক বাহিনী, প্রবল শান্তি, সাম্য ও ধর্ম নিরপেক্ষতার রূপে যে ভারত সোচ্চার কন্ঠে আদর্শ স্থান অধিকার করার দাবী করে আসছিলো, আজ বাবরী মসজিদ ধ্বংসের কারণে সে গর্ব, সে অহংকার ওই মসজিদ ধ্বংস¯তূপের তলে চিরতরে বিলুপ্ত হলো”।

মৃত্যু
সুফিয়া কামালের জীবনে কোথাও অন্ধকার ছিল না। পুরোটাই আলো। এক কথায় তিনি স্বয়ং ছিলেন আলোর উৎস। পথ দেখাতেন সবাইকে। কিন্তু সেই আলো আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ১৯৯৯ ইং সনের ২২ নবেম্বর পি জি হাসপাতোলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমৃত্যু তিনি যে আদর্শের পথে হেঁটেছেন সেই আদর্শ আজ যে পঙ্কিল আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে তা দেখার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এটা বোধ হয় এক দিক থেকে ভালই হলো। মৃত্যুর আগেই বুকে মৃত্যুশেল বিধাঁর যন্ত্রণা থেকে তিনি বেঁচে গেছেন।

শেষকথা
সুফিয়া কামালের কবিতা ও রাজনীতি ছিল একই সূত্রে গাঁথা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, একাত্তরের মুক্তযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহু কবিতা লিখেছেন। তাঁর মতে রাজনীতি হলো মানবতাবোধের প্রতিষ্ঠা, সমঅধিকার ও মানুষের ভাল থাকা। তিনি তাঁর কবিতার বাঁকে বাঁকে সংগ্রাম করে গেছেন একজন নারী হিসেবে, একজন মা হিসেবে, একজন স্ত্রী হিসেবে সর্বোপরি নির্যাতিত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের কন্ঠ হিসেবে। তাঁর কবিতার বাণী ছিল যে কোন উৎপীড়ন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন ধর্মীয় গোঁড়ামী, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে। এদেশের নারী জাগরণে, নারী মুক্তি আন্দোলনে তিনি ছিলেন আপোষহীন ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ধর্মান্ধ অপশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠ ছিল সোচ্চার। তিনি ছিলেন বাংলার বিবেক। তাঁর কবিতার শব্দ বিন্যাস ছিল সুচারু ফলা। ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন সকল প্রকার বঞ্চনার বিরুদ্ধে।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×