somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জর্জরিত আর্তনাদ

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কেউ মনে রাখেনি; অসহায়ত্ব আর অর্থনৈতিক পঙ্গুতায়
জর্জরিত বিয়াল্লিশ বছর!
কখনো আধা পেট খেয়ে কখনো বা না খেয়ে রাত্রিযাপন করে
সমাজের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে
একে একে কেটে দিলাম বিয়াল্লিশ বছর!

যে উন্মুক্ত উজ্জীবিত চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে
দেশমাতৃকার জন্যে অকপটে আত্মসাহসিকতায়
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সম্মুখ সশস্ত্র সংগ্রামে,
একবিন্দু স্বাধীন অস্তিত্বের মাটির জন্যে
তা আজো ঐ শিম্পাঞ্জীরূপী হায়না’র
একচ্ছত্রছায়া’য় বিপন্ন, বিপদসংকুল।

লক্ষ লক্ষ বুকের তাজা রক্তক্ষয়ের পর পেয়েছিলাম এক স্বাধীন ভূখণ্ড,
স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন মানচিত্র, স্বাধীন ভাষা।
তারপর; একবারও কেউ পিছে ফিরে তাকায়নি
সে গৌরাবোজ্জ্বল ইতিহাসের রক্তমাখা পাতা থেকে শিক্ষা
নিয়ে সুদৃঢ় ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনায়।
যে যার আখের গুছিয়েছে মেশিনগানের নল দেখিয়ে
আকাশপানে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে ‘স্বাধীনতা’র নামে আপন ইচ্ছায়।
কেউ মনে রাখল না,
বিয়াল্লিশ বছর অতিক্রম করলাম।

আমাদের কথা দিয়েছিলেন স্বাধীনতার মহানায়ক,
দু’বেলা দু’মুঠো ভাত আর কাপড়ের সংস্থান করে দিয়ে
পুনর্বাসনমূলক কাজের মাধ্যমে স্বদেশভূমিকে
আশু সমস্যাগুলো থেকে বাঁচাতে,
স্বাধীনতার ভিত’কে আরও শক্তিশালী করার আশায়।
কিন্তু হায়! যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নতুন কত-শত পদক্ষেপ নেবার
আগেই পরাশক্তির বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে মাটির কোলে
স্বপরিবারে শায়িত বজ্রকণ্ঠের নিস্তেজ, নিথর বিশাল দেহ।
জানিনা তাঁকে এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের কে, কীভাবে মনে রেখেছে?
বিয়াল্লিশ বছর অতিক্রম করল!
তারপর; এখনো আমি যেমন আছি, একদম
একজন ভিক্ষুকের মতো দিনাতিপাত,
তিনি ও তাঁর মূল সহযোদ্ধাগণ; আমার একান্ত অনুধাবনে তেমনি
তাঁরাও মিশে যেতে শুরু করেছেন
রক্তাক্ত ইতিহাস থেকে কালের অতল গহ্বরে।

আজও রক্তে অর্জিত ঐ লাল-সবুজের পতাকার দিকে
হিংস্র চোখে তাকায় শকুনিরা; কখন যেন লাল সূর্জটা’কে
পৌরানিক কাহিনী’র হনুমানের মতো
আড়াল করে আকাশ থেকে চন্দ্রহীন রাতের তাঁরাগুলো’কে ছিনিয়ে
এনে সবুজ-সাদা আর তাঁরা’র মেলায় ভরে তুলবে লাল-সবুজের অবয়ব।
তাই, এখনো সেই অপেক্ষায় আবুল আলা মওদুদী’র ভাবাদর্শে
গভীরভাবে মগ্ন পরাশক্তির বীর্জে জন্মপ্রাপ্ত নতুন কূড়ি,
যা ফুল হবার আগেই অকালেই ঝরে পরছে মাটির ধূলিকণায়!
কেউ আত্মউপলব্ধিবোধ, স্বকীয়তাবোধ, বিবেকবোধ থেকে
মনে করেনি সেদিনের বেদনাবিধুঁর বাস্তবতার আখ্যান,
দেখতে দেখতে বেয়াল্লিশ বছর কেটে গেল!

বেয়াল্লিশ বছর ধরে অপেক্ষায় আছি,
কবে আমার সুন্দর ফুটফুটে বোনের লুণ্ঠিত সম্ভ্রমের
প্রতিশোধ স্বরূপ ঐ হিংস্র জানোয়ারদের মুখোশ
উন্মোচিত হবে জনসম্মুখে? কবে গলায় ফাঁসির দড়িতে
ঝুলবে ‘মানুষ’ শব্দটিকে কলঙ্কিত করা বন্য শকুনদের মৃতদেহ!

বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই, এখনো বাহুতে শক্তি পাই
ঐ হায়নাদের শেষ দেখার প্রতীক্ষায়,
দু’হাতে একাত্তরের মতো আরেকবার
মেশিনগান কিংবা স্টেনগান তুলে দিলে
পিতৃ-মাতৃ-স্বজন হত্যা, আর বোনের
গণধর্ষনের প্রতিশোধ নিতাম অকপটেই।

এই বিয়াল্লিশ বছর বেদনা-যাতনায়-পাশবিকতায়
বিদগ্ধ হয়ে পাড়ি দিলাম;
কম কিছু করিনি মানবিক চেতনায় ভঙ্গুর-মেরুদণ্ডহীন
এই সমাজ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড প্রতিস্থাপনের জন্যে!

আমার চুলায় চাল নেই, ঘরের উপরে চাল নেই;
তবুও জীবন বাজি রেখে ছুটেছি
মানুষ হিশেবে ‘মানুষ’ –কথাটির যথার্থতা
আরেকবার প্রমাণের নিমিত্তে।
এই তো সেদিন সহায়সম্বলহীন নগেনের
প্রাণ যেতে বসেছিল উচ্চরক্তচাপ-ডায়বেটিসে; অতঃপর হার্ট অ্যাটাকে,
আমার একখানা পৈত্রিক ভিটে বেচে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে
ওর চিকিৎসা করে সুস্থ্য করে তুলেছি।
সেও মনে রাখেনি, জীবনের অস্তিত্ব লড়াইয়ে সেই একনিষ্ঠতার কথা।

বোন’কে হারিয়েছি বেদনাময় একাত্তরে,
আজও একবিংশ শতাব্দী’তে এসেও
কত দরিদ্র মেয়ের পিতা’কে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করলাম
অবিচল বিশ্বাসের আপন প্রচেষ্টায়।
পাশের বাড়ির শাহেদুরের মা মাথা গোঁজার তিল ঠাই জায়গার
জন্যে কত চেয়ারম্যান-কাউন্সিলরের
হাতে-পায়ে পড়েছে বয়স্ক ভাতা’র কার্ডের জন্যে, পায়নি অবশেষে!
একধরনের চরম লাঞ্চনায়
বঞ্চিত হতে হয়েছে তাঁকে।
আমি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামক ঐ নেমপ্লেটের ভাতা এতদিন
সরকারের রাজস্বে জমা দিতাম, এখন দেই
সন্তানত্যাগী ঐ অসহায় বৃদ্ধা মহিলার জীবনের তাগিদে।

প্রতিবেশী বন্ধু হোসেনের ছেলের বউ প্রসব বেদনার আর্তনাদে
সেদিন সন্ধ্যারাত্রে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বারান্দায়,
অন্য কেউ শুনেও হয়তো শুনেনি!
তাঁর গোঙানো আর্তচীৎকারে
এগিয়ে গিয়েছিলাম নব প্রজন্মের শুভাগমনের
আসন্ন বার্তায় সাম্য অধিকার পূরনের স্বপ্নে
বিভোর হয়ে নতুন রবির কিরণের প্রতীক্ষায়।
তার পৃথিবীতে পদার্পনের আকাঙ্ক্ষায়,
আমি বিয়াল্লিশ বছর কাটালাম।

আমার রাজনৈতিক গুরু কমরেড আব্দুল লতিফ
শেষ জীবন কাটিয়েছেন বিনা চিকিৎসায়
ছারপোকা’য় আচ্ছাদিত বিছানায়,
দেখার কেউ-ই ছিল না এই চিরকুমার বীরযোদ্ধার।
সারাজীবন মার্ক্সবাদে মানুষের জন্যে গভীরতরভাবে
নিমগ্ন থেকে আমাদের মতো নিষ্প্রভ প্রদীপ’কে করে
তুলেছিলেন একেকটা আলোর মশাল, একেকটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ;
যা যেকোন অন্যায়-প্রবঞ্চনা-শোষন’কে পুড়ে করতে পারে ছারখার।

লতিফ ভাইয়ের আগুন নেভা চৌকায় বারুদের মতো
জ্বলে উঠেছিলাম অনাহারী মহৎ প্রাণকে
দু’মুঠো অন্ন নিজের হাতে তুলে দেবার চরম বাসনায়।

স্বাধীনতার বেয়াল্লিশ বছর কেটে গেছে,
কাটেনি সেই ঘোর অন্ধকার।
যে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আস্তে আস্তে বিলীন হতে চলেছে
সেদিনের ঐক্যবদ্ধ স্বপ্ন-প্রগতিশীল চেতনা!
সাদা আকাশের বুকে মেঘপুঞ্জ খেলা করছে জমাট বাঁধার আশায়
আর আমার এই বৃদ্ধ ছানি পড়া চোখের
মাঝখান থেকে অবিরলভাবে গল গল করে
ঝরে পড়ছে লবনাক্ত অশ্রু জলরাশি।
পরক্ষনেই মনে পড়ে আমার সেই পথপ্রদর্শকের
আদর্শ-দর্শন আর বঞ্চিত জীবনের ইতিহাস,
যা হয়তো মহাকালের কোন পাতায় একবিন্দু
জায়গা করে নিতে পারবে না,
অজস্র বীরদের শোকগাঁথা অশ্রুসিক্ত মাল্যের পাশে।

কেউ মনে রাখেনি তাঁকে, শুধু আমি আমার হৃদয় গহীনে নিঙড়ানো
ভালোবাসায় আর শ্রদ্ধায় অতি যতনে রাখব তাঁকে আমৃত্যু।
কোন জন্মবার্ষিকী কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে
লোক দেখানো শ্রদ্ধাঞ্জলি’তে ঢপ দেখাতে নয়,
রেখেছি তাঁর সাম্যবাদী চেতনা নতুন প্রজন্মের হাতে সযতনে তুলে দিতে।

আমায় কেউ মনে রাখেনি, যাদের পাশে
এই আমি প্রায় সত্তর বছর বয়সেও
এগিয়ে যাই জীবনের মায়া ত্যাগ করে কিছু করার অভিপ্রায়ে।
যারা আমার নাম ভেঙ্গে
তাদের সুকীর্তি কিংবা কুকীর্তি হাসিল করে গেছে
অর্থের অট্টালিকা গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে;
তাদের মনে রাখার প্রশ্নই আসে না।

কেউ মনে রাখেনি আমি-আমরা, আমাদের
যারা একাত্তর –এর ভিত রচনা করেছিলাম,
আমরাই হয়তো শুধু মনে রেখেছি সে বীভৎস
দিবারাত্রির যন্ত্রণাময় ইতিহাসকে।

আমি এখনো মনে রেখেছি,
এখনো আমি প্রতিশোধ নেবার অপেক্ষায় আছি!
জাতির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দ্বিধাহীনভাবে চীৎকার করে বলতে-
“তোরা দেশদ্রোহী, রাজাকার, ধর্ষক,
ধর্মব্যবসায়ী, ঘাতক, পাকিস্তানের লেলিয়ে দেয়া
বেজন্মা শুয়োরের ছানা, পাকিস্তান প্রভু’র ভক্ত
কুত্তার বাচ্চা, হিংস্র শিম্পাঞ্জী’র দল।”

কেউ মনে রাখে না, না কোন পথ প্রদর্শক’কে,
না কোন উপকারী’কে, না কোন ইতিহাস’কে,
না কোন স্বজন হারানোর জর্জরিত আর্তনাদ’কে
না কোন রক্তক্ষয়ী মানচিত্রের অর্জনকে!
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×