somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এবার দার্জিলিং, সিকিমের গল্প (শেষ পর্ব)

১৪ ই জুলাই, ২০১০ রাত ২:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্বগুলোর লিংক এখানেঃ
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

আগের পর্বে বলেছিলাম আমাদের সাঙ্গু লেইক আর নাথুলা পাস ভ্রমনের কথা। পথে আরও দেখেছিলাম “বাবা মন্দির”, নামটা ভুলে গিয়েছিলাম, আমাদের এক ভারতীয় ব্লগার ভাই মনে করিয়ে দিলেন। যাইহোক, সেদিন ফেরার পর সন্ধ্যায় গ্যাংটকে মার্কেটগুলো একটু ঘুরেফিরে দেখলাম। মার্কেটগুলো যেখানে সেই মূল রাস্তাটায় বিকেলের পর থেকে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয় যাতে পর্যটকরা নিরাপদে ঘুরেফিরে দেখতে পারে। একটা জিনিস আমার খুব ভাল লাগে, ভারতের সব জায়গায়ই ভারতীয় বাংগালীদের দেখা মেলে। তারা ঘুরতে খুব পছন্দ করেন। বরাবরের মত গ্যাংটকেও প্রচুর বাংগালী পর্যটকদের দেখা মিলল এবং তারা আসেন সপরিবারে, পরিবারের সব বয়সের সদস্যদের নিয়েই। ভারতে বেড়াতে গেলে আমি আরেকটা জিনিস করি, সেটা হল এক গাদা চকলেট কিনি, সব সময় আমার পকেটে চকলেট থাকে, কারণ, আমাদের দেশেতো ক্যাডবেরি বা পার্ক পুরো দ্বিগুন দামে বিক্রি করে! সুতরাং, ভারতে যেহেতু এসেছি, চকলেট আর লেইস চিপসটা একটু প্রাণ ভরে খেয়ে না যাই কেন !!! :D

নাথুলা পাসে আমরা তিনজন গিয়েছিলাম। কিন্তু পরদিন একজন কমে গেল, আমরা দুজন হয়ে গেলাম। আমার বাল্যবন্ধু হালিম ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। ও উত্তরাতে একটা ইংলিশ মিডিয়ামের কোচিং সেন্টারে পড়াত। আমরা সবাই ঈদের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওর কোচিং সেন্টার যেহেতু খুলে যাচ্ছে তাই ওকে ফিরে যেতেই হবে, সে আবার কাজে খুব মনোযোগী, তাই কোন ভাবেই রাখতে পারলাম না।/:) পরে যখন ও ছবিগুলো দেখেছিল, বুঝতে পেরেছিল, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটা ভ্রমন সে হাতছাড়া করেছে। আফসোসটা আরো বেড়ে গিয়েছিল, যখন দেশে গিয়ে দেখে হরতাল না যে কি কারণে ওর কোচিং আরো দু’একদিন বন্ধ ছিল! :((:((

পরদিন আমরা সকালে হোটেল ছেড়ে বেরুলাম। আমাদের গন্তব্য উত্তর সিকিমের ইয়ুমথাং ভেলি, ২ দিন এক রাতের প্যাকেজ। বিভিন্ন জায়গা থেকে যাত্রী সংগ্রহ করার কারণে রওনা দিতে প্রায় ১০/১১ টা বেজে গেল। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, চারিদিক ঝকঝকে, চমৎকার আবহাওয়া !! এখানে আমাদের গাড়ীর চালকই আমাদের সুপারভাইজর কাম গাইড। আমরা ৮৬১০ ফিট উচ্চতায় লাচুং নামে একটা জায়গায় রাতে থাকব। তো আমাদের থাকাকালীন যেসব খাবার প্রয়োজন হবে সেই বাজার সদাই সব গ্যাংটক থেকেই জীপের উপরে বোঝাই করা হল। ওখানে হোটেলে আমাদের এইসব বাজার ওরা রান্না করে দিবে। গাড়ী চলতে শুরু করল। আবারও সেই অপূর্ব প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে পথ চলা। পথে পথে পাহাড়ী ঝর্ণা। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সিকিম হল পাহাড়ী ঝর্ণার কারখানা !! দু’একটা বড় ঝর্ণায় আমাদের গাড়ী যাত্রা বিরতি করেছে্ আমরা সেখানে ছবি তুলেছি।



রাস্তার অবস্থা মোটামুটি, আসলে পাহাড়ে বিভিন্ন সময় ধ্বস নামে, এইসব কারণে রাস্তা ভাল রাখাটাও একটু কষ্টসাধ্য। তারপরেও বলব, যেই জীপগুলোতে ওরা নিয়ে যায় সেগুলোর কারণে ঝাকি কিছুটা কম লাগে। কিন্তু, মোটের উপর আপনাকে ভালই ঝাকাঝাকি করা হবে রাস্তায়।:P কিন্তু, এডভেঞ্চারাস একটা মন নিয়ে চললে এইসব ঝাকি খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। :):)

যাইহোক, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম গন্তব্যের দিকে। আসলে এই সৌন্দর্য ভাষায় পুরোপুরি বর্ণনা করা সম্ভব না, নিজেকে গিয়েই দেখে আসতে হবে। সারাদিন ভ্রমন করার পর বিকেলের দিকে আমরা চুংথাং পৌছালাম। সেখানে তিস্তা নদীর উপর একটা ব্রিজ আছে, তার উপর হাটাহাটি করলাম, ছবি তুললাম।


চুংথাং এ তিস্তা নদী, ব্রিজের উপর থেকে...

লোকজন চা নাস্তা খেল। আমি মূলত লেইস চিপস আর বিস্কুটের উপরেই থাকতাম।এর পর আরও ২১ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আমরা সন্ধ্যা নাগাদ লাচুং পৌছে গেলাম। মোটামুটি সাধারণ মানের একটা হোটেলে জায়গা হল। আধার নেমে যাওয়াতে আশপাশ নজরে এল না। তবে অনবরত পানির কলকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। আসলে জায়গাটা ছিল নদীর ধার ঘেষেই। ঈষৎ চাদের আলোতে দূরে সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া নজরে এল। আমরা যে আছি একেবারে পাহাড়ের কোলেই !! পেছনে পাহাড় আর সামনে নদী, সাথে জম্পেশ ঠান্ডা ! সেইরকম একটা পরিবেশ। গরম গরম খাবার পরিবেশন করা হল, খাওয়া গেল মোটামুটি কারণ, আমাদের কথা মাথায় রেখেই রান্নার চেষ্টা হয়েছিল। খাবার পরিবশনকারী যেই মেয়েটি ছিল, সে আবার বেশ মজার। কথা একটু বেশী বলছিল, কিন্তু লাভ কি? সে বাংলা বা হিন্দি কোনটাই পারে না ! :P:P সম্ভবত ওর ভাষা ছিল “ভুটিয়া” বা এই জাতীয় কিছু। সুতরাং ওর কাছ থেকে ইশারা এবং বিভিন্ন মিশ্র ভাষায় খাবার চেয়ে নিতে বেশ হাস্যরসই হচ্ছিল। পরে ওর কাছ থেকে কিছু ভুটিয়া ভাষা সেখার চেষ্টা করলাম। যদ্দুর মনে পড়ে, ভাতকে বলে "“ত”", রুটিকে “"খ"” আর পানিকে "“চোছো”"। :):) যাইহোক, সেইরকম মজা পেলাম!! রাতে ঘুমাতে গেলাম দুটো লেপ গায়ে দিয়ে, কিন্তু যতই রাত বাড়ে, মনে হল ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। উহ,কি কঠিন শীত রে বাবা !! ঘরের ভেতর মনে হল আরো বেশী শীত। এভাবেই রাত পার করলাম, কিন্তু ঘুমটা হয়েছিল জম্পেশ, বোঝেনইতো সারাদিন ছেচা খাওয়ার পর ভাল ঘুম না হয়ে কি উপায় আছে ??? :):)

সকালে উঠে নাস্তা করে বেরিয়ে পরলাম। আমাদের গন্তব্য স্বপ্নের ইউমথাং ভ্যালি! লাচুং থেকে ২৪ কি.মি. দূরত্বে ১১৮০০ ফিট উচ্চতায় এই উপত্যকা।এক দেড় ঘন্টায় আমরা পৌছে গেলাম। জায়গাটা অদ্ভুত সুন্দর। আর কনকনে ঠান্ডা বাতাস। ডিসেম্বরে যখন তুষারপাত শুরু হয় তখন এই এলাকাটি অচেনা এক রূপ ধারণ করে যে ছবি আমরা ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে দেখেছি। যাইহোক, এই জায়গার সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না। কয়েকটা ছবি দিলাম। আপনারাই দেখুন।







তো আমাদের ট্যুরের কন্ট্রাক্ট কিন্তু এই পর্যন্তই। কিন্তু জানা গেল, এখান থেকে ৩২ কি.মি. দূরে ১৫৩০০ ফিট উচ্চতায় ইউমিসমডং নামে একটা জায়গা আছে যাকে “জিরো পয়েন্ট” বলে, সেটা নাকি আরেকটি খুব সুন্দর জায়গা। সবাই একমত হলাম, যেহেতু ছেচা খেয়ে এতদূর এসেছি ওইটাও দেখেই যাব। :P এইজন্য ড্রাইভারকে জনপ্রতি ২০০ রুপি করে দিতে হবে। তাই সই। সেখানে গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! যদিও নাথুলা পাসেই জীবনে প্রথম বরফ ছুয়েছিলাম, কিন্তু ইউমিসমডং এ তো পুরা এলাহি কান্ড!! আমি কোথায়? ভারতে না সুইজারল্যান্ডে ??!! ভেতরে ভেতরে আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে গেলেও সেটা এই উপত্যকা ছেড়ে আর কোথাও যেতে পারছিল না। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ, সাদা আর সাদা। আমরা বরফে লুটোপুটি খাচ্ছি, বরফ মুখে দিচ্ছি, একে অপরকে ছুড়ে মারছি! মুম্বাই থেকে আসা কিশোর বয়সী দুভাই আমাদের সংগী হল। আমরা হাটতে হাটতে অনেক দূরে পানির ধারে চলে গেলাম। দেখলাম পাথরের ফাকে ফাকে কিভাবে বরফের বিশাল খন্ড জমে আছে! এই জায়গায় এসে মনে হল আমাদের ট্যুরটা পরিপূর্ণ হল। আর বেশী না বলে আপনাদের কিছু ছবি দেখাই, তাহলেই বুঝবেন।:D

























আমরা সেই পাহাড়ী স্রোতধারার কাছ থেকে ফিরে দেখি সবাই চলে গেছে শুধু আমাদের গাড়ী অপেক্ষা করছে। আর আমাদের ভ্রমনসংগীদের মধ্যে কলকাতার এর পরিবারও ছিল, তাদের সাথে খুব ছোট এক বাচ্চা। সেই বাচ্চাটি আবার ঠান্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছিল। সুতরাং মায়ের বকুনিটা বেশ ভালই শুনতে হল। আচ্ছা, আপনারাই বলুন, এই প্রচন্ড শীতে আর সমুদ্র পিষ্ঠ হতে এত উচু জায়গাতে ওনারাইবা এত ছোট বাচ্চা নিয়ে কেন আসতে গেলেন?? :P

যাইহোক, এভাবেই শেষ হল আমাদের অসাধারণ এবং চির স্মরণীয় একটা ভ্রমন। পরের কাহিনী হল শুধুই গ্যাংটকে ফিরে চলা। সারাদিন ভ্রমন করে সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরা। পরের দিন সকালে উঠে ঢাকার পথে যাত্রা। আবার সেই ব্যস্ত জীবন আর ছকে বাধা অফিসের হাতছানি।/:) আমার মন কিন্তু পড়ে রইল ওই পাহাড়ের মাঝেই, ইয়ুমথাং ভ্যালি আর ইউমিসমডং এই…... :|:|
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১১ দুপুর ১২:০৫
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×