সামহোয়্যারনামা লিখতে গেলে ত্রিভূজ বনাম এ-টিম এর দ্বৈরথ এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নাই। এটা এই ব্লগের সবচে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, নানান ছন্দে, নানান কৌশলে, নানান ইস্যুতে এখনো চলমান। সামহোয়্যারইনে সম্ভবত সবচে আলোচিত, সর্বাধিক বিতর্কিত, সর্বাধিক অ্যাবিউজড এবং প্রায়-প্রাতঃস্মরণীয় নিকটির নাম ত্রিভুজ। পক্ষান্তরে, এ-টিম হল সামহোয়ারের প্রথম এলিট গ্রুপ যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ অবস্থানকে ফোরফ্রন্টে রেখে ত্রিভুজ এবং তার সহগামী শক্তির বিরূদ্ধে লড়াইয়ে সামিল। এটা একটা ইডিওলজি ওয়ারফেয়ার, যেখানে "মুক্তিযুদ্ধ/জামাত" পজিশনিং এই যুদ্ধের ইডিওলজি নির্ধারণ করেছে। ইডিওলজির সাথে যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজির আবার বিস্তর ফারাক। শত্রুকে পরাজিত এবং হীনবল করার যাবতীয় কৌশল এই যুদ্ধে দুপক্ষই নির্বিচারে প্রয়োগ করেছে।
ত্রিভুজ নেটওয়ার্ক বনাম এটিম যুদ্ধে মূলত তিনটি পন্থা অনুসৃত হয়। এক, ডিমোরালাইজেশন : নির্বিচার গালিগালাজ একে অন্যের বিরূদ্ধে প্রাণিবাচক এবং অন্যান্য অবমাননাকর শব্দব্যবহারের মাধ্যমে; দুই, ইমেজ ডাউনসাইজ করা: মূলত একে অপরের বিরূদ্ধে ভন্ডামির অভিযোগ রেজিস্টার করা এবং সেজন্য প্রয়োজনে ব্লগীয় বাস্তবতার বাইরের দৃষ্টান্ত ব্যবহার করার মাধ্যমে; তিন, গেরিলা ক্যামোফ্লেজ নিয়ে: রিভার্স সাইকোলজি এপ্লাই করার মাধ্যমে। যুদ্ধ যে পন্থাতেই হোক না কেন, তাতে পদাতিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে শহীদ হয় অসংখ্য নিক। উভয়পক্ষেরই রয়েছে দুর্ধর্ষ এবং আত্মঘাতী নিকস্কোয়াড।
ইডিওলজির জায়গা থেকে এ-টিম প্রো-প্রগ্রেসিভ, প্রো-লিবারেশন, সেক্যুলার এবং বিজ্ঞানমনস্ক। কিন্তু ব্লগীয় অ্যাকটিভিটির দিক থেকে তাদের রিঅ্যাকটিভ মনে হয়। আবার ত্রিভুজ যদিও হালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার অবস্থানকে ব্যক্ত করছেন, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে তিনি এন্টি-লিবারেশন, প্রো-জামাত এবং প্রো-ইসলামী নেটওয়ার্কেই সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু এই গোষ্ঠী তাদের ব্লগীয় অ্যাকটিভিটির চরিত্র বিচারে প্রো-অ্যাকটিভ।
ডিমোরালাইজেশন বা নির্বিচার গালাগালিপন্থার কথা বলা যাক। জগতসংসারের হেন কোনো অবমাননা শব্দ নাই যা ব্লগীয় যুদ্ধে দেখা যায় না। এক্ষেত্রে এ-টিম একটা ক্ল্যাসিক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে, সেটি ত্রিভুজকে একটা প্রাণিবাচক অভিধায় ক্রমাগত অভিহিত করার মধ্য দিয়ে। এই অভিধার প্রয়োগ এত সর্বব্যাপী যে, প্রথম আলো ব্লগ তার নীতিমালায় "কাউকে প্রাণিবাচক শব্দে ডাকা যাবেনা" শীর্ষক আইন প্রণয়ন পর্যন্ত করে! "ছাগু" শব্দটি ছড়িয়ে পড়ে ব্লগ থেকে ব্লগান্তরে, এমন কি ফ্লিকার, ইউটিউব এবং ই-স্নিপস এর আর্কাইভে। গান হয়েছে "ছাগু" নিয়ে, নানান টেম্পারড ফটোগ্রাফ এসেছে তার, কবিতা হয়েছে ব্লগে ব্লগে। এমনটা মনে হয়েছে যে, "ছাগু" ডিসকোর্সটি বহু ব্লগারের সৃজনশীলতার বিকাশে সহায়ক ছিল। তাদের কল্পনাপ্রতিভার সর্বোত্তম প্রকাশ দেখা গেছে রিলেটেড পোস্টগুলোতে। প্রসঙ্গত, প্রথম আলো ব্লগের শক্ত নীতিমালায় যেহেতু কাউকে প্রাণিবাচক শব্দে অভিহিত না-করার আইন আছে, তাই সেখানে "রামানুজান" নামে এক নিকের আবির্ভাব হল। রামানুজান কিছুই করেন না সেখানে, শুধু পশুপালনবিদ্যার বই ঘেঁটে ঘেঁটে ছাগল পালনবিদ্যা নিয়ে একটা একটা করে "সিরিয়াস" পোস্ট দিতে থাকেন। কোনো গালি নেই, কারো নাম নেয়া নেই, কিন্তু এই নিকটি ব্যান হয়েছে সেখানে। এতে বোঝা যায় "ছাগু" ব্রান্ডিং কোন্ উচ্চতায় উঠেছে বাংলা ব্লগে। একইভাবে, "গেলমান" নিয়েও একইরকমের আরেকটা ব্রান্ডিং এর প্রবণতা এ-টিম ব্লগারদের দেখা গেছে।
ত্রিভুজ নেটওয়ার্কেও গালির বিচ্ছুরণ কিছু দেখা গেছে। তবে সেগুলো অনেক কম সপ্রতিভ, নিরীহ গোছের গালিই, যতটুকু দেখেছি। দালাল টালাল জাতীয়। এর বাইরে কিছু থাকলে আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। গালি দেয়ার চেয়ে এ-টিমকে গালির উপলক্ষ তৈরি করে দেয়াতেই তাদের তৎপর দেখা যায়। এ-টিমের তীব্র গালিগুলোকে ভোঁতাভাবে কনজিউম করা, বা অবজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজের ব্লগীয় ছন্দে অবিচল থাকা... মোটামুটি এরকমই ছিল ত্রিভুজ নেটওয়ার্কের ডিমোরালাইজেশন কৌশল। এটা সচেতন কি অনিচ্ছাকৃত জানি না। তবে এরকম ভোঁতা রিসেপশন এ-টিমকে আরো উত্তেজিত করত, সন্দেহ নেই। ফলে প্রথম দিকের "ক্রিয়েটিভ" গালিগালাজময় আক্রমণের স্তর থেকে তাদের নিচে নেমে আসতে হয়েছে অনেক।
ইমেজ ডাউনসাইজ করার ক্ষেত্রে ত্রিভুজ নেটওয়ার্ক রিলিজিয়াসলি সময় দিয়েছে। এটা মূলত এ-টিমের ব্লগারদের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের সত্যমিথ্যা ব্লগে প্রকাশ করে দেয়ার মাধ্যমে। এ-টিমও এই কাজ করেছে, তবে অতটা রিলিজিয়াসলি নয়। এর ফলে আমরা জানতে পারি কোন্ ব্লগার যৌবনযাত্রায় ব্লগান, কে মগবাজারের টাকা খান, কারা ভারতের এজেন্ট, কার ১০০০ নিক আছে, কোন নিকের মালিকানা কার, কে উইকিপিডিয়ায় কনট্রিবিউট করতে গিয়ে "ধরা" খেয়েছে, ইত্যাদি। ইমেজ ডাউনসাইজ করার কৌশল ত্রিভুজ-এটিম যুদ্ধ ছাড়িয়ে অন্যান্য ব্লগীয় ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
তবে এই দুই ফ্রন্টের যুদ্ধে এ-টিমের সম্মিলিত আক্রমণ ত্রিভুজকে কাহিল করেছে এমন মনে হয় নি। ত্রিভুজ আক্রান্ত হয়েছে সামহোয়ারে এবং অপরাপর কম্যুনিটি ব্লগগুলোতে, ব্যক্তিগত ব্লগস্পটগুলোতে আরো তীব্রভাবে। কিন্তু সেসব জায়গায় কাহিল না হলেও ত্রিভুজ কাহিল হয়েছে তৃতীয় ফ্রন্টে। এই পর্বে "অশ্রু" নামক এক নিকের আবির্ভাব হল যার প্রোফাইলে এক কামুক পুরুষের ছবি। এই "অশ্রু"র কাজ হল ত্রিভুজকে প্রশংসা করা, এবং তাকে নিয়ে প্রেমের কবিতা রচনা করা। অশ্রুর সেই কবিতাগুলো, তার নন-হেটেরোসেক্সুয়াল ভালবাসার পয়গাম ত্রিভুজকে কিছুমাত্রায় বেকায়দায় ফেলে দিত সন্দেহ নেই। অমি রহমান পিয়াল আমার আগের এক পোস্টের মন্তব্যে স্বীকার করেছেন যে রিভার্স সাইকলজি এপ্লাই করার এক সফল দৃষ্টান্ত "অশ্রু" নিকটি।
এছাড়াও রিভার্স সাইকলজি বা ক্যামোফ্ল্যাজ এটাকের আরো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ত্রিভুজ-এটিম যুদ্ধে। নারী নিক ব্যবহার করে বিপক্ষের পুরুষ ব্লগারের "চরিত্র হনন" করা এবং সেই "দুশ্চরিত্রতার" প্রমাণ দাখিল করে ঐ পুরুষ ব্লগারকে সামহোয়ারে ব্যান করার মত ঘটনাও ঘটেছে।
আমরা যারা দর্শক তাদের এটিম-ত্রিভুজ যুদ্ধ প্রভুত বিনোদন যেমন দিয়েছে, আবার বেদনাও কম দেয় নাই। বেদনা এজন্য যে, এই যুদ্ধে আমরা প্রচুর সম্ভাবনাময় এবং প্রতিভাবান নিককে হারিয়েছি। এই যুদ্ধ শুরুর আগে এ-টিমের ব্লগারদের নানারকমের প্রতিভার স্ফূরণ দেখেছি সামহোয়ারে, কিন্তু কালে কালে এর সামান্যই অবশিষ্ট আছে। একইভাবে ত্রিভুজকেও দেখা গেছে দীর্ঘদিন সামহোয়ারে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে। এখন এ-টিমের অনেকেই, আগেই বলেছি, একটা রিঅ্যাকটিভ পজিশন নেয়, একটা ওয়াচডগের মত কাজ করে। কোথাও কোনো রাজাকার মাথাচাড়া দিল কি না, কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কটুকাটব্য করল কিনা এসবই তাদের অনেকের ব্লগীয় কর্মকান্ড। এটা করতে গিয়ে তাদের নতুন করে বলবার কথাগুলো আর বলা হয় না, অন্তত এই ফোরামে। দৃষ্টান্ত হিসেবে হাসিব-এর নাম বলা যায়। সচলায়তনে হাসিবের লেখার স্বাদ পেয়েছিলাম যা ভুলবার নয়। কিন্তু সামহোয়ারে এসে দেখলাম হাসিব তার লেখকপ্রতিভার ওপর সুবিচার করছেন না। আর এখন তো তাকে ব্যান করাই হয়েছে সামহোয়ারে। কিন্তু এটা বোধ হয় এটিম-এর সব ব্লগার সম্পর্কে সমভাবে প্রযোজ্য নয়। কাউকে কাউকে প্রায়ই তাদের স্বমহিমায় দেখা যায়।
নিক ম্যানেজমেন্টে এ-টিম অনেক ইন্টারেস্টিং ঘটনার জন্ম দিয়েছে। তাদের টিমওয়ার্ক খুব প্রফেশনাল, দেখা যায় কোনো একটি নিক উদ্ভাবনের পর এ টিমের একাধিক ব্লগার সেই নিকটিকে অপারেট করছে। একেকটা নিকের একেক ধরনের চেহারা, আচার আচরণ, বাংলা লেখার ধরন, রেগে যাওয়ার ধরন, সতীর্থদের সাথে খাতিরএর নেটওয়ার্কিং, মুদ্রাদোষের ধরণ। সেইমত বুঝে শুনে একটা নিককে একাধিক লোকের পক্ষে ভ্রান্তিহীনভাবে অপারেট করতে পারা নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের।
(চলিবেক)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ১২:৩৪