বাংলাদেশের প্রতিটি মফস্বল শহরে একটি করে ঐতহ্যিবাহি রসগোল্লার দোকান আছে; স্থানীয়রা সেই দোকানের রসগোল্লাকেই দেশসেরা বলে দাবী করে। যদিওবা চেহারা সুরত দেখে বর্তমানের সুশীল ভদ্রজন সেই দোকানে প্রবেশ করবে বলে মনে হয়না অথচ সেই বিখ্যাত ময়রার গপ্পো মরণোত্তরকালেও কয়েক পুরুষ ধরে কিংবদন্তি হয়ে ঘুরেবেড়ায় স্থানীয় জনপদে। রসগোল্লা এমনই এক কাঙ্খিত মহার্ঘ্য, কোন বাঙালির পক্ষেই প্রথম রসগোল্লার রস আস্বাদনের স্মৃতি থাকার কথা নয়। যদি থাকে তবে তার বাঙালিত্ব নিয়েই সন্দেহ জাগবে; কেননা মনোবিজ্ঞান বলে পাঁচ বছর বয়সের পূর্বের কোন স্মৃতিই মানুষের থাকে না। তবে রসগোল্লার চেয়েও অধিক আকর্ষনীয় একটি বস্তুর প্রথম স্বাদ গ্রহণের স্মৃতি এখনও আমার মনে আছে; এর কারনটা হলো তার নাম। শৈশবে সেই নামটা উচ্চারণে খুবই লজ্জা পেতাম, ভুল উচ্চারণের কারণে বাপের ধোলাই খাবো বলে ভয়ে কোনদিন বায়নাও করিনি।
পিতা-পুত্র সম্পর্কের অতীত ও বর্তমানরূপ অনেকটাই আলাদা। আমাদের যুগে বাপরে ডরাইতো না এমন কলিজা আলা সন্তান বোধহয় একটিও পাওয়া যাবে না; মা-ই ছিল আদর-আব্দারের একমাত্র আধার। আর বর্তমানে পুরাই উল্টা। ভাতঘুমের আগে মন মর্জি বুঝে বাপের ১০ টা পাকাচুল তুলে দিয়েও বিকালে ১টা লজেন্স জুটবে তার নিশ্চয়তা ছিল না। আর এখন মধ্যবিত্ততো পরের কথা রিক্সাওয়ালার শিশু সন্তানের কোন দাবীও অপূর্ণ থাকে না। পাশের বাসার পেয়ারা চুরির অপরাধে একদিন আমি পিতা কর্তৃক উত্তমরূপে ধোলিত হলাম; শরীরে জ্বর আসলো । লঘু অপরাধে গুরুদন্ড দেয়ার কারণে পিতার পাষান হৃদয় একটু নরম হয়, আমার মান ভাঙানোর জন্য বিকালে আমাকে নিয়া যায় হোটেল রুচিতায়। আমাকে রসগোল্লা আর নিমকি খেতে দেয়। খাওয়া শেষে রসের শেষটুকু চাটতে যেই না জিহ্বাটা প্রিচের পেটে ছোয়ালাম তখনই ঢাডা চটকানা। ‘ভদ্রলোকের ছেলেরা এইভাবে মিষ্টি খায়?’ ফ্যাৎ করে কেঁদে দিলাম। বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে মাথায় ¯েœহের হাত রাখলেন, ‘এই কান্দিস না! ওরে আরো দুইডা মিষ্টি দাও।’ মুহূর্তেই খুশী হয়ে গেলাম। প্রতি মিষ্টির জন্য একাধিক চড় খেতেও কোন আপত্তি নেই, সেখানে এক চড়ে জোড়া রসগোল্লা। এই ‘এক প্লেট ছানাও দ্যাও!’ আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম; ‘ন’ এর জায়গায় ‘ম’ শুনি। খেয়ে খুবই মজা পেলাম। শৈশবে কিছুটা তোতলা ছিলাম বলে ‘ছানা’ উচ্চারণের রিস্কটি পরবর্তিতেও পিতার সামনে আর নেইনি। এখানে উল্লেখ্য ছানা যেমন খুবই কাঙ্খিত বস্তু ডাইবেটিস রোগীর জন্য বারণ, কিন্তু ‘ন’ এর জায়গায় ‘ম’ হলে শব্দটি বরিশাইল্লা আঞ্চলিকতায় দুষ্ট হয় সত্য তবে জিনিসটি সকল যুবকেরই মহাকাঙ্খিত হোক সে রোগী কিংবা সবল।