somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : "খুনি"

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সময়টা ছিল বর্ষাকাল ।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল টিনের চালে । বর্ষার গোমড়া আকাশের মতই মুখ গোমড়া করে বসে আছে আমির । মনটা ভালো নেই ওর ।
জানালার পাশে বসে আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে সে । কখন যে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল সেদিকে যেন তার কোন খেয়ালই নেই । ভাবনার জগতের অনন্ত এক দিগন্তে হারিয়ে গিয়েছে সে ।
হঠাৎ পিছন থেকে ডাক দিল শুভ ।
: কি রে বের হবি না ?
: (চমকে উঠে) ও তুই ? বস ।
: কি রে দোস্ত মন খারাপ নাকি তোর? (শুভ’র জিজ্ঞাসা)
: কই না তো । (মুচকি হেসে জবাব দিল আমির)
: চল, বের হই ।
: চল ।
বাড়ি থেকে বের হয়ে নদীর দিকে হাঁটা শুরু করলো দু’জন ।
গ্রামের নাম মির্জাপুর । ওদের গ্রামটা ফেলে উত্তরে গেলেই পড়বে বাজার, আর বাজার ফেলে পশ্চিমের পথ ধরে গেলেই সামনে মেঘনা নদী । শৈশবের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই নদীটাকে ঘিরে ।
শুভ একাই কথা বলছে । আমির চুপচাপ । কোন কথা নেই তার মুখে ।
: কিরে আমির, আমি একাই তো বকবক করছি । কথা বলছিস না কেন তুই ?
: আমার শুনতেই ভালো লাগছে (মৃদুস্বরে বললো আমির)
হঠাৎ আমিরের সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায় শুভ ।
: সত্যি করে বলতো, কি হয়েছে ?
আমির কোন কথা বলে না । শুভকে সরিয়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করলো সে । শুভও সঙ্গী হলো তার । হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে গিয়া দাঁড়ালো দুজন । দু’জনই নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে । হঠাৎ মুখ খুললো আমির ।

: আচ্ছা শুভ, আজ কত তারিখরে ?
: আজ ১৮ জুলাই । কেন ?
: তোর সাব্বিরের কথা মনে আছে ?
: কেন থাকবে না ? (শুভ’র উত্তর)
: আজ সাব্বিরের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী ।
: ও হ্যাঁ, তাইতো । আমার তো মনেই নেই । তুই তো দেখি এখনো ভুলতে পারিস
নি ওকে ।
: কি ভাবে ভুলবো, বল ?
এই বলেই, শুভকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো আমির ।

সাব্বির, আমির ও শুভ’র সাথে একই ক্লাসে পড়তো । সাব্বিরের পরিবারে ওরা চারজন সদস্য ছিল । বাবা,মা,ছোট ভাই আর ও । সাব্বিররা ছিল অনেক গরীব । ওর বাবাই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি । মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজের চুক্তি নিয়ে কাজ চালাতো সে । তার বাবার প্যারালাইসিস হওয়ায় পরিবারে নেমে আসে এক অন্ধকার অধ্যায় । গত্যান্তর না দেখে, সাব্বিরকেই পড়ালেখার পাশাপাশি নেমে পড়তে হয় পরিবারের হাল ধরার জন্য । শুরু হয় জীবনের সাথে যুদ্ধ ।

সকালে প্রায়ই না খেয়ে থাকতে হতো ওদের । ভাত জুটতো সপ্তাহে ৪-৫ বেলা, বাকি সময় আটার রুটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে খেতে হতো ।
সাব্বিরদের একটি গরু ছিল । সেই গরুর দুধ বিক্রির টাকা দিয়েই চালাতে হতো চার সদস্যের সংসার । প্রতিদিন ভোরে উঠে গরুর জন্য ঘাস কেটে আনতে হতো, এরপর ঘাস কেটে গরুকে খাইয়ে স্কুলে যেত সাব্বির । ওর বই ছিল না । স্কুলে গিয়ে অন্যদের বই দেখে পড়া শিখতো । এভাবেই পড়ে ক্লাস ফাইভ ও এইটে বৃত্তিও পেয়েছিল সে । যাই হোক, স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে গরুর দুধ নিয়ে বাজারে যেত বিক্রির উদ্দেশ্যে । দুধ বিক্রির পর গ্রামের লোকজনের বাজার রিকশা বা ভ্যান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে অল্প কিছু টাকা নিতো । আর এই টাকাগুলো দিয়েই বাড়ির জন্য খাবার কিনতো ।

সাব্বিরের সাথে আমিরের পরিচয় হয় ক্লাস সিক্সে । প্রথমে গরীব হবার কারণে সাব্বিরকে সহ্যই করতে পারতো না আমির । কিন্তু আস্তে আস্তে ওরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠে । আমির প্রায়ই যেত সাব্বিরের বাড়িতে । সাব্বিরের মা তার জমিয়ে রাখা টাকা দিয়ে সেমাই কিনে এনে রেঁধে খাওয়াতো আমিরকে । মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রায়ই বলতো, “তুমি আমার আরেকটা ছেলে” । সাব্বিরও আমিরদের বাসায় যাতায়াত করতো । কিন্তু খুব কম । কারণ, আমিরের বাবা সাব্বিরকে পছন্দ করতো না । সাব্বিরদের নারিকেল গাছ ছিল । ও মা খুব ভালো নারিকেলের নাড়ু বানাতো । আর বানালেই সে আমিরের জন্য নিয়ে আসতো । দু’জন দু’জনকে পড়ালেখার ব্যাপারে খুব সাহায্য করতো ।

আমিরদের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন হাসান চৌধুরী । তার মেয়ে বিন্দু আমিরদের সাথে একই ক্লাসে পড়তো । মেয়েটি যেমন সুন্দরী ছিল, তেমনি ছিল মেধাবী । আমির খুব পছন্দ করতো বিন্দুকে । বিন্দুর পরিবার খুব রক্ষণশীল হওয়ায় স্কুলের সময় ছাড়া তাকে বাইরে বের হতে দিত না । তাই, বিন্দুকে এক নজর দেখার জন্য কখনো স্কুল ফাঁকি দিতো না আমির ।

হঠাৎ, ক্লাস নাইনে উঠার পর থেকে আমিরের চোখে একটা বিষয় ধরা পড়লো । সাব্বির প্রায়ই বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকে, কথা বলার চেষ্টা করে । তাই ওর সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে আমিরের । ইতিমধ্যে, আমির কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছে সাব্বিরের সাথে ।

একদিন স্কুল ছুটির সময় । আমির যেই ক্লাস থেকে বের হবে, তৎক্ষণাৎ তার চোখে পড়লো ঘটনাটি । সাব্বির, বিন্দুকে একটি চিরকুট গুঁজে দিল ওর হাতে । আমির আর সহ্য করতে পারলো না । সে রাগে-ক্ষোভে জ্বলতে লাগলো আর শপথ নিল এর শোধ সে তুলবেই । আর এর জন্য নানা ফন্দি-ফিকির আঁটা শুরু করলো ।

বর্ষাকাল চলে এসেছে তখন । গ্রামে তখন ফুটবল খেলার ধুম পড়ে গিয়েছে ।

জুলাইয়ের ১৮ তারিখে আমিরদের সাথে পাশের গ্রামের খেলা । ওদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম নবীনগর । সেই গ্রামের এক বেয়াদব ও লম্পট ছেলের নাম ছিল আনিস । সে ছিল ল্যাং মারায় খুবই পারদর্শী, তাই বিপক্ষ দল সব সময় ওর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতো । আমির, সাব্বিরের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এই আনিসকেই ঠিক করে টাকা পয়সা দিয়ে । আনিসের সাথে একটু সমস্যা ছিল সাব্বিরের । আসলে, আমিরের মূল উদ্দেশ্য ছিল আনিস সাব্বিরকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে ওর হাড় ভেঙে দেয়ার জন্য । এতে সাপও মরলো কিন্তু কেউ জানতেও পারলো না কেন এমন হলো ???

খেলা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে । আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের ভিতর দিয়ে খেলা চলছিল । প্রথম থেকেই সাব্বিরকে লক্ষ্য করে খেলছিল আনিস । প্রথমার্ধ গোলশূণ্য ছিল । দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই দু’দলই খুব আক্রমণাত্মক খেলা খেলছিল । হঠাৎ ৬৮ মিনিটের মাথায় আক্রমণে যায় মির্জাপুর । বল ছিল সাব্বিরের পায়ে । মাঠের ডান প্রান্ত দিয়ে দৌড়ে এগিয়ে যাবার সময় কোথ্থেকে আনিস এসে ট্যাকেলর ভান করে ল্যাং মারে সাব্বিরকে । উপুড় হয়ে পড়ে যায় সাব্বির । কিন্তু, কে জানতো এই পড়ে যাওয়াই শেষ ? আর কখনো উঠবে না সে । মাঠের কোণায় ভাঙা ইটের অংশ পড়ে ছিল । ইটের চোখা অংশটুকু উপরে থাকায় ইটটা বুকের ভিতর ঢুকে যায় ওর । স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা খেলার মাঠ । হাসপাতালের এম্বুলেন্সে খবর দেয়ার পরেও তা দেরি করায় ভ্যানে করেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় সাব্বিরকে ।

হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ডাক্তার সাব্বিরের নার্ভ পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করে । মির্জাপুর গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া । সাব্বিরের বাবার বোবা কান্না আর মায়ের আহাজারিতে ভারি হয়ে যায় মির্জাপুরের আকাশ বাতাস । স্তব্ধ হয়ে যায় আমিরও ।

এর কিছুদিন পরের ঘটনা । বিন্দু আমিরকে স্কুল ছুটির পর নদীর পাড়ে আসার অনুরোধ করে । আমির যখন নদীর পাড়ে আসে, তখন বিন্দু আমিরকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয় । চিরকুট খুলে আমির অবাক । আরে, এ যে সাব্বিরের হাতের লেখা । চিঠিটা পড়ার সময় আমিরের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল চিঠিটা । পড়া শেষ হলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে আমির ।

কি ছিল সেই চিঠিতে ???

“প্রিয় বান্ধবী,
আমরা খুব গরীব । দিন এনে দিন খেতে হয় আমাদের । বাবা অসুস্থ হবার কারণে আমাকেই উপার্জন করতে হয় পরিবারের জন্য । আমরা ২ বেলা ভাতও খেতে পারি না । এ অবস্থায় লেখাপড়া করে এ সমাজে টিকে থাকা দায় । আমার ছোট ভাইটা এবার ক্লাস ফাইভে বৃত্তি দিবে । ওর বেতন বাকি পড়ে আছে, বইও কিনতে পারি নি । তোমার বাবাকে বলে যদি ওর বেতনটা মাফ করে দিতে তাহলে আমার ও আমার পরিবারের জন্য খুব উপকার হতো । আর যদি পারো আমাকে ক্লাস ফাইভের বই কেনার টাকা ধার হিসেবে দিয়ো । আমি তোমার টাকা পরিশোধ করে দিবো ।
ভালো থেকো ।
ইতি,
সাব্বির”


শুভকে জড়িয়ে ধরে এসব ঘটনার কথা ভাবছিল আর চিৎকার করে কাঁদছিল আমির । এসময়, টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো । যেন প্রকৃতিও আমিরের শোকের মূহ্যমান হয়ে কান্না আরম্ভ করেছে ।

সাব্বির মারা যাবার পর ওর মা গরুটা বিক্রি করে দেয় । এরপর থেকে ভিক্ষা করে সংসার চালায় । সাব্বিরের ছোট ভাই, এখন ক্লাস এইটে পড়ে । সামনে বৃত্তি দিবে । ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল সে । আমির এখনো সাব্বিরের বাড়িতে যায় প্রায়ই । ওকে দেখলে সাব্বিরের মা খুব খুশি হয় । বুকে টেনে কপালে চুমো দেয় । আর সাব্বিরের ছোট ভাইটা ওকে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকে । গল্প শুরু করে দেয় ওর সাথে ।

কিন্তু, সাব্বিরের মা হয়তো কখনো জানতেই পারবে না, যাকে সে এত আদর যত্ন করছে সেই আমিরই তার কলিজার টুকরা সাব্বিরের খুনি
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×