সারাদেশে হঠাৎ করেই যেনো বেড়ে গেছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। যুগে যুগে নারীরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহর,গার্হস্থ্য জীবন থেকে কর্মক্ষেত্র সর্বত্রই যৌন নিপিড়নের শিকার হচ্ছে,নানাভাবে,নানা কৌশলে। কিন্তু আগে মানুষ শিক্ষা দীক্ষায়,সচেতনতায় পিছিয়ে ছিলো,এখন শিক্ষা ও সচেতনতার হার বাড়লেও আশ্চর্য্যজনকভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা যেনো কমছেইনা। নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনাই একটি জাতি,একটি সমাজের জন্যই অত্যন্ত লজ্জাকর ও দুঃখজনক ঘটনা। তাইতো বিবেকবান মানুষেরা যুগে যুগে প্রতিবাদ করে আসছে নারী নির্যাতনের ঘটনার। এখনো এই দুঃসময়ে অজ¯্র শুদ্ধ চিন্তার মানুষ একযোগে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। দিল্লি থেকে টাঙ্গাইল তেঁতুলিয়া থেকে পার্বত্য রাঙামাটি সর্বত্রই শুভবোধ সম্পন্ন মানুষ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামছে,মাঠে আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও এই লড়াইয়ে তাদের সবাইকে যূথবদ্ধভাবে মাঠেই থাকতে হবে। জয়ী হতে হবে মানুষরূপী হায়েনাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে।
সারাদেশের আরো ৬১ টি জেলার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাও বাংলাদেশের মানচিত্রের অংশ। এখানকার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি পুরো দেশকেই সমৃদ্ধ করেছে। যেহেতু এই অঞ্চল বাংলাদেশেরই অংশ সেহেতু নারী নির্যাতনের ঘটনা এখানেও ঘটছে। এখানেও সারাদেশের মতো নারী নির্যাতনের ঘটনা স্বাভাবিক কারণেই কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না। এখানেও তাই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাই মাঠে নামে,প্রতিবাদ করে,বিক্ষোভ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো,এখানে প্রতিবাদ হয়,ধর্ষিতা বা লাঞ্চিতার জাতিগত পরিচয় ভেদে,পরিচয় জেনেই নির্ধারিত আন্দোলন বা কর্মসূচীর মাত্রা।
নারীর উপর নির্যাতন বাংলাদেশের অন্যতম একটি সামাজিক সমস্যা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ইস্যুটিকে রাজনীতিকরণ করা হয় বরাবরই। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অপহৃত নারীনেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণ ও নিখোঁজ হওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনাগুলো হয়তো রাজনৈতিক,কিন্তু এর বাইরে অজ¯্র ঘটনা,যা সামাজিক অপরাধের আওতায় পড়ে,তা নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বরাবরই হয়েছে,এখনো হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য,পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতন নিয়ে কিছু কথিত নারী নেত্রী ও সংগঠন এমন প্রচারণা চালায় যে,যে কারো মনে হতেই পারে,এই এলাকায় শুধুমাত্র পাহাড়ী নারীরাই ধর্ষিতা হয় বা নির্যাতিত হয়। অথচ পরিসংখ্যা বলছে ভিন্ন কথা। পাহাড়ের রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ এর সম্প্রতি দেয়া এক গবেষনা প্রতিবেদন বলছে,২০১২ সালে পার্বত্য তিন জেলায় ২৫ জন নারী ধর্ষিতা হয়েছেন এর মধ্যে ১৭ জন পাহাড়ী এবং ৮ জন বাঙালি। গবেষনা প্রতিবেদন বলছে,ধর্ষনের ঘটনাগুলোতে ধর্ষকদের মধ্যে পাহাড়ী ও বাঙালী উভয়ই আছে। প্রশ্ন হলো,যারা পাহাড়ে নারী নির্যাতন নিয়ে গলা ফাটায় তারা শুধু পাহাড়ী নারী নির্যাতনের কথা কেনো বলবে ? নারী তো নারী’ই। তার আবার পাহাড়ী বাঙালী কি ? তাহলে কি প্রতিবাদকারীদের সততাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়না ?
সবচে আশ্বর্য্যরে বিষয়,নারী নির্যাতন ইস্যুতে হঠাৎ করেই এই নারী নেত্রীদের একাংশ তিন পার্বত্য জেলায় অবরোধ ডেকে বসেছেন ! ইস্যু কি ? থুমাচিং মারমা..। কাউখালি উপজেলা বর্বর হায়েনাদের বর্বরতার শিকার নিরীহ এই স্কুল ছাত্রীর হত্যাকান্ড যেকোন বিবেকবান মানুষকে কষ্ট দিবে। শুধু কি থুমাচিং ? এর আগে সুজাতা বা বলিমিলা ধর্ষন ও হত্যাও একই রকম যন্ত্রনাদায়ক। কিন্তু আজ যারা অবরোধ ডেকেছেন,তাদের জন্য করুনা হচ্ছে,কারণ সম্প্রতি জুড়াছড়িতে কঠিন চীবর দানোৎসবে যাওয়ার সময় ধর্ষিতা দুই কিশোরী এবং নানিয়ারচরে বৌদ্ধ বিহারের ভেতরে চারবছরের শিশুকণ্যা ধর্ষণের পর এই নারীবাদীরা চুপ করে ছিলেন,কোন আওয়াজ ছিলোনা। কারণ কি জানেন ? কারণ,ওই ধর্ষকদের একটি জাতিগত পরিচয় আছে! ওদের বিরুদ্ধে কথা বললে তো খবর আছে ! আর রাজনীতিও তেমন জমেনা।
বাংলাদেশের কোথাও এর আগে কোন ধর্ষন ঘটনার জন্য অবরোধ দেয়ার নজির আছে কিনা জানিনা। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ধরণের অবরোধ কতটা ধর্ষনের প্রতিবাদে তা নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যখন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সকল ধর্ষন ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে যূথবদ্ধভাবে,পাহাড়ী-বাঙালী,জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একযোগে প্রতিবাদ প্রয়োজন,তখন রাজনৈতিক কৌশলে এবং ব্যক্তিস্বার্থে অবরোধ কর্মসূচী দিয়ে যারা সরকার নয়,বিদেশী প্রভূদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চায়,যারা ঘন ঘন বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি আগামী কয়েক বছরের জন্য নিশ্চিত করতে চায়,তাদের জন্য করুনা ছাড়া কিইবা করার আছে। তাদের ভুলে গেলে চলবেনা,বিদেশী প্রভুরা,এই দেশে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে পারবেনা,এর জন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে মানবিকতা ও শুভবোধ জাগ্রত করা। আর তা করার জন্য অসৎ মানসিকতা ভেতরে পুষে রাজনৈতিক হরতাল নয়,এনজিওদের ‘ব্যবসাকেন্দ্রিক’ নারী আন্দোলন নয়,চাই সত্যিকারের সামাজিক আন্দোলন। সমতল থেকে পাহাড়ে,সর্বত্রই বন্ধ হোক নারী নির্যাতন,নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা।