somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তেঁতুল গাছে ভূতের বাড়ি

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা রাতের বেলা সেই তেঁতুল গাছটির তলা দিয়ে ভুলেও যেতাম না। ভয়ংকর সেই তেঁতুল গাছ! লোমহর্ষক সেই তেঁতুল গাছের কাহিনী। এক একর জায়গা জুড়ে তেঁতুল গাছটির ডালপালা বেষ্টিত করে থাকত। গাছতো নয় যেন ইয়া বড় এক দৈত্য। দেখলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। বুক ধড়পড় করে। গলার পানি শুকিয়ে যায়। শুনেছি ওই গাছেই নাকি ভূতটি বাস করে। যার এক চোখ লাল- আরেক চোখ সাদা। শরীর জুড়ে বড় বড় নখ। একদিন এক মহিলাকে গাছের উপর তুলে নিয়েছে। সারারাত খোঁজাখুজির পর মহিলাকে এলাকার মানুষ পায়নি। পরদিন মহিলাটিকে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় মানুষ তেঁতুল গাছ থেকে উদ্ধার করে। মহিলাটি রাতে তার বাপের বাড়ি থেকে ফিরছিল। মহিলার সাথে থাকা একমাত্র শিশুপুত্রটি প্রাণে রা পেয়েছিল সেদিন। তবে ছেলেটি সেই দিন থেকে আর কথা বলতে পারে না। এখনো সে বোবা। ইশারা ইঙ্গিতে মানুষের সাথে কথা বলে। ডাক্তার কবিরাজ দেখানোর পরও ছেলেটির মুখে এখনো কথা ফুটেনি।
নানার বাড়ি গেলে আমরা তেঁতুল গাছ নিয়ে এ রকম কথা শুনতাম। এক বছর আমরা এক এক রকম কাহিনী শুনতাম। আরেকবার শুনেছিলাম এক কিশোর ছেলের কাহিনী। ছেলেটি নাকি রাতে বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। তেঁতুল গাছের নিচে আসার পর সে নাকি দিক হারিয়ে পশ্চিমের বনে চলে গিয়েছিল। ছেলেটি যাবার কথা ছিল উত্তর দিকে। চলে গেছে পশ্চিমের গর্জন বাগানের দিকে। গর্জন বাগানে যেতে হলে একটা (ছরা) খাল পার হতে হয়। ছেলেটি নাকি দুইদিন সে বনে ছিল। তৃতীয় দিন উশকো খুশকো চুল সমেত সে বাড়ি ফিরে আসে। ফিরে এসে আবোল তাবোল বকতে শুরু করে। সেই থেকে ছেলেটি পাগল হয়ে রাস্তাায় রাস্তায় ঘুরতে লাগল। এভাবে এক একবার আমরা সেই তেঁতুল গাছটি নিয়ে অনেক ভয়ংকর কাহিনী শুনতাম। কাহিনী বলতেন আমার মামাতো বোন শিল্পী আপা। অথবা মামাতো ভাই সোহেল। সে সব অনেক দিন আগের কথা। এখন শিল্পী আপার বিয়ে হয়েছে। সোহেল পাচঁ বছর দুবাই থেকে ফিরে বাজারে একটা কাপড়ের দোকান দিয়ে থিতু হয়েছে।
বৈশাখ ও জৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল। এ দুই মাসকে মধুমাস বলা হয়। এ সময়ে আমরা নানার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। এ মাসে আম, কাঁঠাল, আনারসসহ আরো নানান রকমের রসালো ফলে ভরে যায় পুরো দেশ। আমার নানার ছিল বড় এক ফলের বাগান। সে বাগানে- আম, জাম, লিচু, বরই, আনারস, জামরুল, জলপাই সহ নানান জাতের ফলের গাছ ছিল। আমি সেই বাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। পাখিদের গান শুনতাম। কাঠবিড়ালির নাচানাচি দেখতাম। বন মোরগের দৌড়াদৌড়ি দেখতাম।
রাস্তার দৃশ্য ছিল অনেক সুন্দর। কাঁঠালের ভার নিয়ে হাঁটুরেরা বাজারে যেত।
বাবা আমাকে আর মাকে নানার বাড়ি রেখে পরদিন চলে আসতেন। আমার বাবা ছিলেন সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। আমার মামা-মামীরা বাবার সাথে মশকরা করতেন। বাবা কখনো তাদের সাথে পাল্টা মশকারা করতেন না। বাবা তাদের কথা শুনতেন আর হাসতেন। প্রায় প্রতি বছরই আমরা নানার বাড়িতে যেতাম। থাকতাম পনের দিন থেকে একমাস পর্যন্ত। যেবার মা যেতেন না সেবার আমি যেতাম। আমি গেলে নানি আমার সাথে গল্প করতেন। নানার বাড়ি আমার নিকট অনেক ভালো লাগত। আমার বড় মামি ছিল বড্ড ভালো মামি। বাবা ফেনী গিয়ে আমাকে বাসে তুলে দিতেন। নানার বাড়ির লাল মাটি দেখতে আমার বেশ ভালো লাগত। এছাড়া চা বাগান আর ছোট ছোট টিলা দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যেত। আমি আমার খালাতো ভাই, মামাতো ভাই সহ দলবেঁধে চা বাগান, ওই টিলাগুলোতে ঘুরে বেড়াতাম। গর্জন বাগানের ছোট ছোট চারাগাছ তুলে বাজারে বিক্রি করতাম। তিন টাকা দিয়ে বাজারের মাটির গুদাম ঘরে সিনেমা দেখতাম। চা, নাস্তা, ঘোরাঘুরির পর বিকালের দিকে বাড়ি ফিরতাম। আমার মেজো খালা যদি জানতে পারতেন আমরা গর্জন গাছের চারা বিক্রি করে ছবি দেখেছি Ñ তখন তিনি অনেক বকাবকি করতেন। নানার বাড়িতে গিয়ে আমরা বড় মামার ঘরে উঠতাম। আমার ছিল দুই মামাÑ বড় মামা ও ছোট মামা। বড় মামা পাখি শিকার করতেন আর ছোট মামার ছিল এক গুরুর গাড়ি। সে গরুর গাড়ি করে মামা এ বাজার থেকে ও বাজারে ঘুরে বেড়াতেন। মামার ধান, কাঁঠাল, আনারসের ব্যবসা করতেন।
নানার বাড়ি গেলে আমি ছোট খালার বাড়িতে থাকতাম। নানার বাড়ির পাশেই ছিল ছোট খালার বাড়ি। ছোট খালা প্রাইমারি স্কুলের শিকিতা করতেন। তিনি একটু গরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার খালাতো ভাইটিকে তিনি অনেক নির্দয়ভাবে মারতেন। আমি সারাদিন নানার বাড়িতে থেকে সন্ধ্যা হলেই ছোট খালার বাসার চলে যেতাম। মিজানের সাথে পড়তে বসতাম। মিজান হলো খালার একমাত্র ছেলে। সে ছিল আমার সমবয়সী। আমার সাথে ওর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমি যখন ওদের বাড়িতে যেতাম তখন ও আমার সাথে অনেক গল্প করত। আমরা তিন খালাতো ভাই প্রায় একসাথে থাকতাম। আমি, মিজান আর মনু। মাঝে মাঝে আমরা সারাদিন পাহাড়ী এলাকায় ঘোরাঘুরি করতাম। মনে পড়ে একদিন মিজানের গিয়ারওয়ালা সাইকেল নিয়ে চা বাগানের উঁচু পাহাড়ী পড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি সে কথা।
আমার বড় মামার ঘরের সামনে ছিল এক পেয়ারা গাছ। গাছটি পেয়ারার ভারে নুয়ে পড়ত। আমি সাধারণ গাছে উঠি না। ওই গাছটি অপোকৃত ছোট হওয়াতে উঠতে পারতাম। গাছে উঠে আমি পেয়ারা খেতাম আর কাঠ বিড়ালি কবিতাটি পড়তাম। আমার কবিতা শুনে শিল্পী আপু হাসতেন। মামি বলতেন, এ পেয়ারাতো এখনো বড় হয়নিÑ বড় হলে খাইছ। বড় হলে আমি কি আর থাকব- আমি বলতাম। আমার কথা শুনে মামি হাসতেন। আমার বড় মামি হলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মামি। তিনি আমাদেরকে অনেক আদর করতেন। মামি আমাদের জন্য নানান রকম পিঠা বানাতেন। মামির হাতের রান্না যেন অমৃত! মামির রান্নার স্বাদ এখনো আমার জিবে লেগে আছে।
রাত তখন দশটা। আমরা চারজন বাজার থেকে নানার বাড়ি যাচ্ছিলাম। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। ঘুমোট অন্ধকারে চেয়ে আছে পথঘাট। নানার বাড়ির যাওয়ার পথ ছিল দুইটি: একটি চা বাগানের মধ্য দিয়ে- অন্যটি তেঁতুল গাছের তলা দিয়ে। রাত দশটার পর চা বাগানের পথটি বন্ধ হয়ে যায়। এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমরা তেঁতুল গাছের পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সেই ভূত নাকি আগুনকে ভয় পায়। আমাদের নিকট কোনো আগুন ছিল না। আমরা ছিলাম চারজন। সকলের বয়স পনের বছরের নিচে। আমাদের ভেতর সোহেল ছিল একটু সাহসী। আমি ছিলাম একটু সাহসী বাকী দুইজন ছিল তীতুর ডিম। ওরা দুইজন মানে মিজান আর মনু আমার দুইহাত ধরে আছে। আমরা ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম তেঁতুল গাছের দিকে। ভীরু ভীরু পায়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম তেঁতুল গাছের দিকে। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। দূরে একটা পেঁছা ডাকছে। আমাদের বুক ধড়পড় ধড়পড় করছে। কপাল দিয়ে চিকন ঘাম বের হতে লাগল। তবু আমরা হাঁটছিলাম। যত হাঁটি পথ যেন আর শেষ হয় না। যখন তেঁতুল গাছটির নিকট আসলাম তখন তেুঁতুল গাছটির ঠিক বিপরীত দিক থেকে একটা বিড়াল ডাক দিয়ে উঠল। বিড়ালের ডাক শুনে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা চারজন কাঁপতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম ভূত বুঝি পেয়েই গেল আমাদের। এ রকম জানলে খালার বাড়িতে থেকে যেতাম। সকালে আসলে কি এমন তি হতো। সোহেল শুধু শুধু আমাদেরকে জোরাজুরি করে নিয়ে এলো। এখন দেখি সোহেলও ভয়ে কাঁপছে। ভয় পেলেও আমরা হাঁটতে লাগলাম আর একটু পথ পেরুলেই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ওখানে যেতে পারলেই আর কোনো ভয় নেই। কোথায় তেঁতুল গাছের ভূতের ভয়। আমরা উল্টো ভূতকে ভয় দেখাব। এমনটা ভাবতেই তেঁতুল গাছের একটা ডাল মটমট করে ভেঙে পড়ল। ঝড় বৃষ্টি কিছুই নেই শুধু শুধু ডাল ভেঙে পড়ার তো কোনো কারণ দেখছি না। নিশ্চয়ই সেই ভূতের কান্ড। আসলে ডাল ভেঙে পড়েনি সে ভূতটি গাছ থেকে লাফিয়ে পড়েছে। আমরা পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি ভূতটি বড় বড় চোখে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একটি চোখের রং সাদা অন্যটির লাল। ভূতকে আসতে দেখে আমি সাথে সাথে বললাম চলো দৌড়াই। আমরা তিনজন সামনের দিকে দৌড়াতে লাগলাম। ওরে মাগো ওরে বাবাগো বলে আমরা চিৎকার করছিলাম। আমাদের ডাক শুনে সামনের বাড়ি থেকে এক মহিলা বের হয়ে এলেন। মহিলাটির হাতে ছিল এক হারিকেন। মহিলাটিকে সবাই সুরমার মা বলে ডাকে। সেইদিনের স্মৃতি আজো আমি ভুলতে পারিনি। আমরা চার বন্ধু আজো সেই ‘তেঁতুল গাছে ভূতের বাড়ি’র কথা বলাবলি করি।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:০৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রান্ত নিথর দেহে প্রশান্তির আখ্যান..... (উৎসর্গঃ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগারদের)

লিখেছেন স্বপ্নবাজ সৌরভ, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৪২



কদিন আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে
কুকুরের মত জিহবা বের করে বসবো
শুকনো পুকুর ধারের পাতাঝরা জামগাছের নিচে
সুশীতলতা আর পানির আশায়।

একদিন অদ্ভুত নিয়মের ফাঁদে নেতিয়ে পড়বে
আমার শ্রান্ত শরীর , ধীরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×