somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তাহারে তুমি নাও চিনে

১২ ই মার্চ, ২০২২ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভোর না রাত্রী ঠিক বোঝা যায় না এমন একটা সময় লঞ্চটা ভিষন জোরে একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো । লোকজনের হুড়াহুড়ি আর চিৎকারে আরশাদের ঘুম ভেংগে গেলো, অন্ধকারে কেবিনের লাইটের সুইচ হাতাতে লাগলো । লঞ্চ কি ডুবে যাচ্ছে, নাকি ডুবে গেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, তারাহুরা করে নামতে গিয়ে পায়ের বুড় আঙ্গুলের সাথে লোহার টেবিলের শক্ত একটা ধাক্কা খেয়ে নখ উল্টিয়ে ফেললো । ব্যাথায় দম বন্ধ হবার অবস্থা । কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, আরশাদ কিছুতেই লাইটের সুইচ খুজে পাচ্ছে না, ধুর শালা, নিজেকে গালি দিল আরশাদ । দরজায় ধাক্কার মাত্রা বেরে যাচ্ছে । কিছু একটা বলে ডাকছে সম্ভাবত । হঠাত করে কি করে যেন লাইট জ্বলে উঠলো । এখন পুর কেবিনটা ঝকঝক করছে আলোতে, পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে পা কেটে দরদর করে রক্ত পরছে । মেঝের বেশ কিছুটা জায়গায় ছোট্ট একটা পুকুরের মতো হয়েছে রক্ত জমে, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো, ওর গায়ে যে এত্ত রক্ত আছে দেখে নিজেই অবাক, আরশাদের ধারনা ছিলো ওর গায়ে দুই তিন গ্রাম রক্ত আছে । আবার কে যেনো জোরেজোরে দরজাটা ধাক্কাতে লাগলো, লোহার দরজা ঝনঝন করে বাজছে । বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে ঘুম ভর্তি চোখ নিয়ে পিট পিট করে তাকিয়ে দেখলো কেবিন বয় বিরক্ত ও চিন্তিত মেশানো মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে ।

কি কিছু বলবা, পায়ের ব্যাথা লূকানর চেস্টা করলো আরশাদ ।

বেতাগী চলে এসেছে, তারাতারি করেন, একটু পরেই লঞ্চ ছেড়ে যাবে । হাই তুলতে তুলতে বললো ছেলেটি ।

আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি । মাথাটা দরজার ভেতরে কচ্ছপের মতো আবার ঢুকিয়ে নিলো আরশাদ ।

জলদি করেন , পরে আবার চিল্লায়েন না, বলতে বলতে চলে গেলো ছেলেটা, বিরক্ত হয়ে কান পেতে শুনলো, কি যেন এর নাম ঠিক মনে করতে পারছে না, এদের ধইরা দুইটা লাগান উচিৎ, বেয়াদবের বাটখাড়া সবকয়টা । মনে মনে গজগজ করতে করতে খোড়াতে খোড়াতে সব গুছিয়ে নিলো, কেবিন থেকে কোন মতে বের হয়ে দুই হাতে দুইটা লাগেজ নিয়ে টানতে টানতে তিনতলা থেকে লঞ্চের নিচের ডেকে নেমে এলো । আড় চোখে দেখলো দূরে সেই কেবিন বয়টা দাঁড়িয়ে আছে যেন ওকেই দেখতেই পায় নাই এমন একটা ভাব, ঠিক লঞ্চ থেকে নামার সময় এসে হাত পাতলো, স্যার বকশিস দেন, প্রচন্ড রাগ উঠলেও কিছু না বলে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিলো । পেছন ফিরতেই শুনতে পেলো শালার ফকির , আজকাল কেউ পঞ্চাশ টাকা দেয়, দিলে দিবি একশ টাকা, ফকিরের ফকির । পায়ে ব্যাথায় খুড়িয়ে হাটছিল এতেই মেজাজ খাপ্পা তার উপরে গালাগাল শুনে মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না, ঘুরে দাঁড়িয়ে ঠাস করে এক থাপ্পর বসিয়ে দিলো কেবিন বয়ের গালে, হাত থেকে পঞ্চাশ টাকা কেড়ে নিয়ে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো , আশেপাশের লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই লঞ্চ থেকে নেমে গেলো ।

আধো আলো আধো আধারে লঞ্চটা ভুতের মতো টার্মিনাল ছেড়ে চলে গেলো একরাশ গালাগালি আর কিঞ্চিৎ ধোয়া পেছনে ফেলে রেখে । আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে ছাড়া কেউই নাই সব চলে গেছে যারযার ঠিকানায় । অন্ধকারে নিজেকেই এখন নিজেকে ভুতের মতো লাগছে । ট্রলী লাগেজ টা দুইপায়ের মাঝে নিয়ে বসে পরলো ভোরের আকাশ দেখবার জন্য, চড়ুই পাখির সাইজের মশা এসে ফাইটার জেটের মত আক্রমণ করতে লাগলো । হাত পা ডলতে ডলতে ভোর দেখার খায়েশ ফেলে রেখে বাজারে চলে এলো, দুই তিনটা শুকনা নেড়ি কুকুর ছাড়া কেউই নাই । কমছে কম ছয় কিলোমিটার দূরে বাড়ি, হেটে জাওয়া সম্ভব না এই থেতলানো পায়ে । লাগেজ দুইটা ছাল তোলা রাস্তার উপর দিয়ে খড়খড়িয়ে টানতে টানতে বাজারের ভেতরে গেলো কোন দোকান খোলা পায় কি না এই আশায় । কিছু দূর এগতেই একটা রিক্সা দেখা গেলো, রিকশার নিচে হারিকেনটা টিমটিম করে জলছে । রিকশার কাছে গিয়ে দেখে রিক্সার হুডের মধ্যে বুড় মত এক লোক ঘুমিয়ে আছে । রিক্সা ধরে ঝাকি দিতেই চোখ মেলে তাকালো লোকটা ।

চাচা যাবেন, গাজী বাড়ি !! অধোর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো আরশাদ । লোকটা আড়মোর ভেঙ্গে রিক্সা থেকে নেমে মাথা ভর্তি মেয়েদের মতো চুল ঝাকিয়ে বললো জ্বে না, যাবো না, রিক্সা ধইরা লারেন চারেন ক্যান ।

চাচা চলেন, ভাড়া বাড়িয়ে দেব, করুন মুখে বললো আরশাদ ।

রিক্সা নদীতে ফালাই দেলেও যাবো না,যান এখন রিক্সা নদীতে ফালান ।

রিক্সা নদীতে ফেলবো কেন, কুম্ভকর্নের মতো ঘুমাচ্ছেন তাই ঝাকি দিলাম ।

যেমনে ঝাকি দিছেন মনে হইলো মুড়ি ওয়ালা মুড়ি বানাচ্ছে, আপনে এক কাজ করেন আপনি রিক্সা চালিয়ে চলে যান , আমি যাবোই না । বলে রিক্সা ওয়ালা রিকশার পাশে রাস্তায় কাত হয়ে শুয়ে পরলো ।

এ আবার কি যন্ত্রনা, নিচের ঠোঁট কামড়িয়ে ধরে রাগ কমানর চেস্টা করলো আরশাদ । কাত হয়ে শুয়ে থাকা লোকটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ফোশ করে নিশ্বাস ফেললো । চুল ছড়িয়ে যেভাবে শুয়ে আছে দেখে মনে হচ্ছে কোন মেয়ে মানুষ শুয়ে আছে । ইচ্ছা হচ্ছিলো ব্যাটার পাছায় গদাম করে একটা লাথি মারতে, লম্বা চুলের এই লোককে মারার রুচি হলো না । নিশ্চই মাথা ভর্তি উকুন লাথি মারলে উকুন গুলো না আবার তার পা বেয়ে মাথায় উঠে আসে ।

ভাড়ি লাগেজ দুইটা নিয়ে হাটা শুরু করলো, আজ তার বিয়ে, মেয়ে নাকি খুবি সুন্দুরী, বয়স একটু বেশি, সুন্দুরী একটা মেয়ের কেনো বিয়ে আগে হলো না এটা নিয়ে সে বেশ ভেবেছে কিন্তু কোন শক্তপোক্ত কারন খুজে পেলো না । ছবি পাঠানো হয়েছিলো, ছবিতে আন্ধকারের মধ্যে একটা মুখ, কাজল দেয়া চোখে মাথা নিচু করে তোলা । চেহাড়া বোঝা যায় না । বড়মামা নাকি জ্যোতিষ দেখিয়ে ভবিষ্যৎ দেখেছেন সাংসারিক জীবন নাকি টিউব লাইটের মতো ঝলমলে । বড়মামার বাতিক আছে জ্যোতিষ বিদ্যা নিয়া ঘাটাঘাটি করার । হাত ভর্তি বিভিন্ন ধাতুর আংটি পরে থাকে, পেট খারাপ বন্ধকরন আংটি, বাতের ব্যাথা নিরধ আংটি, ভাগ্য খোলার আংটি, এমন সতেরোটা আংটি দিয়ে তার হাত ভরা, ভাত খেতে গেলে প্লেটের সাথে লেগে খটর মটর আওয়াজ হয় , আরশাদের ঘেন্যা লাগে কিন্তু কিছুই বলতে পারে না , লোকটা ভয়ানক মেজাজি আর যখন তখন হাত তোলার অভ্যাস আছে । একবার দেশের বাড়ি বেরাতে এসে খুব গোপনে একটা বিড়িতে টান দিয়ে ফু দিয়ে ধোঁয়া কেবল ছেড়েছে ওমনি কোথা থেকে চটাস করে গালের উপর এসে একটা থাবড়া এসে পরলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য পিথাগোরাসের সকল সুত্র চোখের সামনে উদ্যাম নৃত্য করতে লাগলো । মাঝে মাঝে এখনো সেই ব্যাথা অনুভব হয় ।

খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেশ কিছুটা পথ হেটে আসার পর পেছন থেকে ক্রিং ক্রিং শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে তাকাতে দেখতে পেলো সেই রিক্সা ওয়ালা মেয়েদের মতো করে হাওয়ায় চুল উড়িয়ে পাশে এসে রিক্সা থামালো । ওঠেন, খোড়া পায়ে কতোদুর যাইবেন, বাক্স দুইটা মাথায় নিয়ে উইঠা পরেন । আরশাদ কিছুক্ষন রাগী চোখে তাকিয়ে থেক রিকশায় উঠে পরলো, হেটে আসার ফলে ব্যাথা জায়গায় বেশ ব্যাথা করছে । আমারে রাগ দ্যাখাইয়া লাভ নাই, এর আগে এক পুলিশ রাগ দেখাইছিলো হ্যার মুখে থুথু দিয়ে রিক্সা নিয়া চলে গেছি, অবশ্য এর জন্য এক মাস জেল খাটছি কিন্তু লোকে বলছে মর্দ ব্যাটার কাম করছি । আরশাদ কিছু না বলে শক্ত করে ব্যাগ দুইটা ধরে থাকলো যাতে পরে না যায় । রিক্সা ওয়লা হাওয়ায় চুল উরিয়ে রিক্সা চালাতে লাগলো, পচা কিছুর বিশ্রি গন্ধ এসে লাগছে নাকে । বমি পাচ্ছে মনে হয় নারেকেল তেলের গন্ধ ।

আমনে কি বিয়া করতে দেশে আইছেন ? হঠাত করে জিজ্ঞাস করলো রিক্সাওয়ালা ।

হুম, অনিচ্ছা সত্বেও উত্তর দিলো আরশাদ, কি করে বুঝলেন ?

আন্ধার রাইতে দুইটা নতুন সুটকেস নিয়া লঞ্চ থেকে নামছেন একা মানুষ , বিয়ার কাম না থাকলে এমন কেউ করে না । মাইয়া কি দেখছেন ?

না দেখি নাই, আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বললো ।

মাশাল্লাহ, মাইয়া দেখেন নাই ভালো কাজ করছেন, আইজকাল দেখা হইলেই ফুস !!! সেভেন আপের বোতলের মতন ।

আরশাদ কোন কিছুই বললো না , তার কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না, পায়ের বুড় আঙ্গুল টা ব্যাথায় টনটন করছে । ইচ্ছা করছে আঙ্গুলটাই কেটে ফেলতে । রিক্সা ঝকর ঝকর করে চলছে, কিছুক্ষন পর পর আচমকা লাফিয়ে উঠছে । রিকশার গদিটা মোটেও আড়ামদায়ক না । পেছনটা অসম্ভব ভাবে ব্যাথা করা শুরু হলো । এর থেকে হেটে জাওয়া ভালো ।

বুজছেন ভাতিজা, এলাকার মেম্বরেরা চোরের চোর, রাস্তায় দশ নম্বর ইট দিয়া নিজের বাড়ির পুকুর বান্ধাইছে একনম্বর ইটে ।

মেম্বার চোর, চেয়ারম্যান চোর না, বাঁকা হাসি দিয়ে বললো আরশাদ ।

আরে হে তো চোরের সর্দার । আমারে কয় টিপ দিয়া গম নিতে , আমি টিপ দেই নাই, ছ্যাপ দিয়া চইলা আসছি ।

আপনি কি সবাই কেই এমন ছ্যাপ দেন নাকি , হেসে উঠলো আরশাদ ।

গরীব মানুষ , মুখ ভর্তি ছ্যাপ খরচ করলেও শেষ হয় না ।

অন্ধকার কেটে কিছুটা আলোর মতো ফুটে উঠেছে । অনেকখন ধরে রিকশাওয়ালা কোন কথা বলছে না , কেবল রিকশার খটরমটর শব্দ আর প্যাডেলের ক্যাচক্যাচ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । কিছু দূরে একটা গরুর গাড়ির মতো দেখা গেলো , আরশাদ কিছুটা অবাক এই এলাকায় গরুর গাড়ি , কখনোই দেখে নাই, দেখতে পাবার কথাও না, নদী অঞ্চল, রাস্তার কোন ঠিক নাই , এই রাস্তা তো ওই খাল, এক মেইল রাস্তায় দশটা খাল পরবে । গাড়ির উপরে কিছু একটা লম্বা মতোন পরে আছে , গাড়িটা আস্তে আস্তে সামনের দিকে যাচ্ছে । রিক্সা ওয়ালা চাচা ওটা কি গরুর গাড়ি না? চোখ কুচকে জিজ্ঞাসা করলো আরশাদ ।

আমার নাম কুডি চৌকিদার, দাদা চৌকিদার ছিলো তাই চৌকিদার ।

আচ্ছা কুডি চাচা ওইটা কি গরুর গাড়ি না ?

দেইখা তো তাই মনে হয়

এই এলাকায় গরুর গাড়ি আসলো কই থেকে

কে জানে , আগে তো দেখি নাই । কিন্তু গাড়িতে কেউ নাই ক্যান ?

রিকশাওয়ালা জোরে চালিয়ে গরুর গাড়ির কাছে যেতে চেস্টা করলো কিন্তু কাছে যেতে পারে না , রিক্সা যতো জোরে চলে গাওরুর গাড়িও ততো জোরে চলে, পাশাপাশি হতেই ম্যাজিকের মতো গরুর গাড়ি সামনে এগিয়ে যায় । ভাতিজা ওইডা তো লাস মনে হইতেছে , ভয়ের সাথে বললো ।

হুম, আমারো তাই মনে হয়, গলাটা কেপে উওঠলো আরশাদের ।

আশেপাশে কোন মানুষজন নাই, একটা গরুর গাড়ি একা একটা লাশ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে। তাও গলা না কাপিয়ে বললো চাচা গরুর গাড়িটা আটকান । দেখি কি আছে ওটায় ।

আমি পারতাম না তুমি যাও গিয়া থামাও বলেই রিক্সা থামিয়ে রাস্তার মাঝে ফেলে রেখে ঢাল বেয়ে নেমে মাঠের মাঝখান দিয়ে ভো দৌড় । হতভম্ব হয়ে বসে থাকলো আরশাদ। তাকিয়ে দেখে বেশ কিছুদুরে গরুর গাড়িটা থেমে আছে, গরু দুইটা লেজ নাড়ছে, আর মাথা ঝাকিয়ে জাবড় কাটছে । আরশাদ রিক্সা থেকে নেমে , ধিরে ধিরে গরুর গাড়িটার কাছে গেলো, উচুনিচু রাস্তায় পায়ে ব্যাথার জন্য হেটে গাড়ি বরাবর এগোতে কষ্ট হচ্ছে , তাকিয়ে দেখে একদম সদ্য গসল করানো কাফোনে মোড়া একটা লাস। কাফনটা এখনো ভেজা । শীতের সকালে হালকা ধোয়া উঠছে । আরশাদের গলা শুকিয়ে আসছে । আর একটু কাছে এগিয়ে গেলো । দুইটা গরুর মধ্যে একটা গরু পেছন ফিরে সজাসুজি আরশাদের চোখ বরাবর তাকিয়ে হালকা আওয়াজ ছেড়ে শিং নাড়িয়ে যেন বলো খুলে দেখো । কর্পুরের তিব্র ঝাঝালো গন্ধে নাক জ্বলে যাচ্ছে । কি এক অজানা টানে আরশাদ এগিয়ে যাচ্ছে । আস্তে আস্তে লাশের মাথার কাছে কাফনের বাধন খুলে মুখ বাহির করতেই একজন নতুন বউয়ের মুখ বেরিয়ে এলো যার মাথা ভর্তি চুল, মুখ যেন হাতে আকা কোন প্রতিমার , সদ্য গোসল করানো বলে মুখে বিন্দু বিন্দু পানির কনা জমে আছে, শরীর ভর্তি গয়না , মুখাটা ফোটাফোটা কুমকুম দিয়ে সাজানো, এতোটাই সজিব যেন এখনি উঠে বলবে আমার নথটা খুলে গেছে একটু পরিয়ে দাও । চেয়ে দেখলো সত্যি সত্যি নথটা খুলে পরে আছে, আরশাদ যত্নকরে নথটা পরিয়ে দিলো , মুখে হাত দিতেই মনে হলো চোখের পাপড়ি নড়ে উঠলো আরশাদ চমকে গিয়ে হাত সরিয়ে নিলো, মুখটা এখনো গরম । গাল ঠোঁট লাল হয়ে আছে । নিস্পলক তাকিয়ে থাকলো আরশাদ । বড্ড কাছের মানুষ লাগছে, গলার কাছে কান্না ঠেলে উঠছে । চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পরলো । একমনে তাকিয়ে থাকলো । হঠাত করে গাড়ি চলতে লাগলো, আরশাদ পেছন পেছন হাটতে লাগলো, গাড়িটি আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে দিলো, আরশাদ চেয়ে দেখলো মেয়েটি কাফনের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে দিলো যেন বলছে আমায় ফেলে যেও না। আরাশাদ হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলো হাতটা পেছন থেকে কে যেন টেনে ওকে মাটিতে চেপে ধরলো । আরশাদ চিৎকার করে নিজেকে ছাড়ানর চেস্টা করলো অসম্ভব শক্তিশালী কিছু তাকে মাটীতে চেপে ধরলো । নিরুপায় হয়ে তাকিয়ে দেখলো গরুর গাড়িটা দূরে বহুদুরে চলে যাচ্ছে । রাগে গা ঝারা দিয়ে ঊঠে দাঁড়িয়ে দেখে সেই রিকশাওয়ালা । দাত কিড়মিড়িয়ে বললো কি ব্যাপার আমাকে যেতে দিলেন না কেন সাথে ।

বাজান ওটা ভুত, আমি তো ভয়ে চলেই গেছিলাম পরে মনে হলো আপনারে ফেলে যাই কি করে তাই এলাম এসে দেখি আপনি ভুতটার সাথে কথা কচ্ছেন , আমি না থামালে আজ মরেই যেতেন । আরশাদের সারা শরীর কাপছে, রিকশাওয়ালার গায়ের উপরেই অজ্ঞ্যান হয়ে পরে গেলো ।

তিব্র মাথা ব্যাথা নিয়ে জেগে উঠলো আরশাদ, চারিদিকে লোকজনার হইচই চিল্লাপাল্লায় কানে তালা পরে যাওয়ার মতো অবস্থা । মুখের উপর সেই রিক্সাওয়ালার মুখটা দেখে যাচ্ছে, তারা লম্বা চুল এসে ওর মুখের উপর পরছে, পচা তেলের গন্ধে পেট গুলিয়ে উঠলো । এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে বুঝলো সে বাড়ি পৌছে গেছে । মামা, মামী, মামাতো বোনদের মুখ গুলো তার উপরে টর্চ লাইটের মতো পরে আছে । মামা তার স্বভাব সুলভ ভয়ংকর গলায় চিল্লাতে লাগলেন বুড়া বয়সে ভুতে ভয় পায় এইটা কেমন কথা । রিকশাওয়ালা তাকে বুঝাতে লাগলো সেও ভয় পাইছে ওটা ভয়ের মতো একটা জিনিস । কুডি মিয়া আরশাদের কাছে এসে হাসি মুখে বললো ভাতিজা আগে বলবা না তুমি চেয়ারম্যান সাহেবের ভাইগ্না, তাহলে তো একবারেই নিয়ে আসতাম , কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো চোরের সর্দারের কথাটা বইলেন না আমি গরীব মানুষ ।

আমাকে এখানে কি করে আনলেন, ও উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ।

তুমি কইছো, ভুতো চেয়ারম্যানের বাড়ি যাবা, মাথায় হাত বুলিয়ে বললো রিকশাওয়ালা , ওমনি তোমারে উড়ায়ে নিয়া আসছি, ওই সব ভুত ফুতের কথা ভুইলা যাও ।

আচ্ছা বলে বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লো আরশাদ ।

শুনলাম আজ তোমার বিয়া , দাত দেখিয়ে বললো কুডি চৌকিদার ।

হ্যা আসবেন সন্ধ্যায় , আপনার দাওয়াত ।

শুকুর আলহামদুলিল্লাহ্ , অবশ্যই আসবো মাথা নাড়তে নাড়তে চোলে গেলো ।

বাড়মামা কোথা থেকে বিশাল এক লাঙ্গোল এনে তাতে গরম লবন চাটানোর ব্যাবস্থা করলো, আরশাদ কোন ভাবেই রাজি হলো না ওটা চাটতে, এটা শুনেই তিনি খেপে আগুন, ব্যাটা তুই চাটবি না তোর চৌদ্দগুষ্টি চাটবে।

আচ্ছা তাইলে আপনি চাটেন, বলে নিজের কামড়ায় চলে গেলো আরশাদ ।

ভুতু চেয়ারম্যান মুখ খানা ভোতা করে বসে রইলেন, তিনি মনে মনে তার বড় বোন কে শাপ শপন্ত করতে লাগলেন, পয়সা খরচ করে তিনি তার ভাগ্নে কে ছোট থেকে বড় করেছেন, বংশের একমাত্র ছেলে । তার নিজের পাঁচ মেয়ে, ছেলের জন্য আর দুইটা বিয়ে করছেন লাভ হয় নাই । এই পাঁচ মেয়ে নিয়ে আছেন তিনি মহা সমুদ্রে এর মধ্যে এই অবাধ্য ভাগ্নে । আজ বিয়া অথচো ভুত দেইখা ভয়ে সে হাইগা মুইতা অস্থির । কনে পক্ষের কানে গেলে ইজ্জত থাকবে না । ভুতু চেয়ারম্যানের ভাইগ্না থাকবে বাঘের মতো সাহসী, হুঙ্কার দিলে ভুতে পেত্নীতে এক কলশিতে জল খাবে তার বদলে হইছে মেনী বিড়ালের মতো মিনমিনা । আমারে কি না বলে লাঙ্গল চাটতে, ব্যাটা ভাইগ্না আমার , আমারে তো চেনো না , আমিতো চাটবোই তোমারেও চাটাবো । আগে শাদি টা হইতে দাও ।

সন্ধ্যায় বিয়ের কাজ শেষ হয়ে গেলো । আরশাদ এখন পর্যন্ত মেয়ে দেখে নাই । ভুতু চেয়ারম্যান মেয়ে দেখাদেখি একদম পছন্দ করে না । একবারে বাসর ঘরে মেয়ে দেখবে । আরশাদ একটু মোড়ামুড়ি করেছিলো, বিয়ের আগে যদি একবার দেখা যেতো । ভুতু চেয়ারম্যান চোখ পাকিয়ে বললো থাবরিয়ে দাতের মাড়ি খুলে নেবে ।

তাইলে আপনি করেন বিয়া, চারটা তো করছেন পাঁচ নম্বর করে ফালান ।

ভুতু চেয়ারম্যান ছড়ছড় করে কেদে দিলেন, বুবু রে কি একটা পোলা তুমি দিয়া গেছো , আমারে কয় শাদি করতে, নিজের বোউরে আমারে নিকা করতে বলে, বুবু আমারে তোমার কাছে নিয়া যাও, এই কুলাঙ্গার তুমি আমারে কেন দিলা ।

আমি আপনার কুলের কেউ না , বলে আরশাদ রাগী গলায় উঠে গেলো ।

বুবু বুবুরে , বলে ভুতু চেয়ারম্যান চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন । আরশাদ এসে বড়মামা কে তুলে দাড়া করিয়ে বললেন মামা এইবার থামেন । ছোট মামী আপনার কান্না দেখে হাসতে হাসতে মাটিতে পরে গেছেন।

কি বললি, ওই বেটি আমার কান্দন দেইখা হাসে, তারে আমি তালাক দিয়া বুঝায় দেব, কতো ধানে কতো চাল ।

মামা থামেন, অনেক রাত হইছে এইবার আমাকে রেস্ট নিতে দেন , ক্লান্ত আমি ।

আরে হ্যা রাইত তো অনেক হইছে যা ঘরে যা নতুন বউয়ের মুখ দেখ, তোর বইনেরা কিসব করছে তোর জন্য যা সেইগুলা দেখ , আর আমি তোর ছোট মামীর ব্যাপারটা দেখছি ।

দেখেন মামা আপনি যদি ছোট মামী কে কিছু বলেন আমি এই রাত্রে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো, গাল শক্ত করে বললো আরশাদ ।

হায় হায় বলে মাথা চাপড়ে দাত কিড়মিড় করতে করতে ঘরের ভেতর চলে গেলো ভুতু চেয়ারম্যান ।

সারাদিনে এতক্ষনে একটু শান্তি অনুভব করলো আরশাদ । প্রচন্ড গরম পরছে । দূরে কোথাও মেঘের ডাকাডাকি শোনা যাচ্ছে, রাত্রে বৃষ্টি হবে । দোতালা বাড়ি ঘরের মাঝ বরাবর সিড়ি আছে যা দিয়ে দোতলায় ওঠা যায় , আজ ওখানে সব সাজসাজ ব্যাবস্থা । আরশাদ নিজেকে শান্ত করে ধির পায়ে উপরে ঊঠে এলো । দরজার কাছে মামাতো বোনেরা হাসাহাসি করছে, টাকা না দিলে ঢুকতে দেবে না, ওদের কে দুই হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করে রুমে ঢুকে দেখে লাল শড়ি মোড়ানো একজন বসে আছে দেখেই পেটের মধ্যে হাসি গুড়্ গুড় করে উঠলো , শপিং মলের র‍্যাপিং পেপাড় দিয়ে মোড়ানো গিফট গুলো কথা মনে পরে গেলো, পাশে গিয়ে কাশি দিয়ে বসলো ।

আমি আরশাদ, হালকা গলায় বললো ।

জ্বে জানি, মৃদু ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো । বিশাল সাইজের ঘোমটার আড়াল থেকে বাচ্চা একটা মেয়ের কন্ঠ ভেসে এলো ।

তোমার নাম কি , ইতস্ততো করে জিজ্ঞাসা করলো আরশাদ ।

হি হি , নাম না জেনেই বিয়া করছেন, খিকখিক করে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পরলো

হাসির ধাক্কায় ঘোমটা খুলে গেলো । অপুর্ব সুন্দর মায়া মাখানো একটা মুখ ঘোমটার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো, হাসির দমকে মেয়েটির নাক থেকে তার নথ টা খুলে কানের পাশে ঝুলতে লাগলো । হাসতে হাসতে উঠে বসে ঘোমটা ঠিক করে নিল , আরশাদ ভুত দেখার মতো চমকে গেলো, সেই মেয়ে সেই মুখ সেই তার মুখের গড়ন, সেই কুমকুম দিয়ে সাজানো মুখ, থরথর করে কাপতে লাগলো আরশাদ ।
জ্বি আমার নাম নিলুফা , আপনি আমার নথ টা লাগিয়ে দেবেন, মেয়েটি কাছে এসে বললো ।

আরশাদের মাথা ঘুরছে, পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে বমি পেল, ভকভক করে বমি করে বিছানা চাদর ভাসিয়ে দিলো । নিলুফা আরশাদের মাথা চেপে ধরে আছে, সে হতবাক হয়ে আরশাদের বমি করা দেখছে ।

আকাশে মেঘ গুড়ুম গুড়ুম করে ডাকাডাকি করছে । ঝরের পুর্বাভাস, অনেক বড় ঝড় আসবে, অঝর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে । দুরে কেউ আজান দিচ্ছে, বিপদে পরলে আজান দিতে হয় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:২৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×