বার্ষিক পরিক্ষা শেষ । নানু খবর পাঠিয়েছে বাড়ি জাওয়ার জন্য । আমরা অনেক কাজিন প্রায় পঞ্চাশ জনের একটা লম্বা লিস্ট। কিন্তু নানু আমাকে খুব পছন্দ করতেন । নানু তার বাবার বাড়ি বেড়াতে গেলে সাথে আমাকেই নিয়ে যেতেন । সারাবছর নানু অপেক্ষায় থাকতেন কখন ডিসেম্বর মাস আসবে আর আমার বার্ষিক পরিক্ষা শেষ হবে । পরিক্ষা শেষ তো হয় ছোট মামা নতুবা বড় মামা কে পাঠিয়ে দিতেন আমাকে নেবার জন্য । আমিও তক্কে তক্কে থাকতাম । কারন আমি জানতাম বার্ষিক পরিক্ষা শেষে আমাকে বাড়ি যাবার অনুমুতি দেয়া হবে । সাধারনতো আমাকে কোথাও একা যাবার অনুমুতি দেয়া হয় না । স্কুলের স্কাউটের জাম্বুরিতেও আমাকে একা যাবার অনুমতি নাই । তাই স্কাউট করলেও দুরে কোন অনুষ্ঠানে আমি যেতে পারতাম না । বন্ধুরা চান্স পেলেই ক্ষ্যাপাতো ।
চট্রগ্রামে নৌ স্কাউট জাম্বুরি হবে । সব ঠিকঠাক । যাবার আগের দিন আম্মা না করে দিলো । হাতে পায়ে ধরার পরেও কাজ হয় নাই । চিল্লাচিল্লি কান্নাকাটি করেও কোন সুবিধা আদায় করতে পারি নাই । চোখের সামনে দিয়ে বন্ধুরা দাঁত দেখিয়ে চলে গেলো । আর আমি বিদায় কমিটির একমাত্র মেম্বার হয়ে স্কুলের বারান্দায় একা মুখ কালো করে বসে রইলাম । আসল কথায় আসি । বড়মামা পরিক্ষা শেষ হবার পরেই চলে এলেন । আমাকে দেশের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য । আমি খুশিতে আটখানা । কারন তখন রাস্তাঘাট এমন ছিলো না । খুলনা থেকে বরিশাল যেতে অনেক যন্ত্রনা সহ্য করতে হতো । কিন্তু সেইসব যন্ত্রনা আমার কাছে মোটেও যন্ত্রনা মনে হতো না । প্রথমে বাস তারপরে মাইল খানেক রিক্সা তারপরে হাঁটা তাও সম্ভাবত দুই তিন মাইল হবে তারপরে নৌকা করে বাড়িতে পৌছানো । ভোর বেলা রওনা দিয়ে গভীর রাতে বাড়ি পৌছাতাম । নানু অপেক্ষায় থাকতো । যেই পৌছে যেতাম সাথে সাথে আমার যত্ন আত্তি শুরু । গরম পানি দিয়ে হাত পা ধুইয়ে, নতুন কাপড় পরে (এক সেট নতুন কাপড় আমার জন্য নানু বাড়িতে সবসময় থাকতো যতো দিন নানু সুস্থ্য ছিলেন ) প্রীয় নারেকেলের দুধের পোলাও, চিংড়ি মাছের মালাই কারি আর মুরগীর মাংস গলঃধকরন করে দোতলার একটা কামড়ায় আমাকে রেখে আসা হতো ঘুমানোর জন্য সঙ্গে কুন্তি মাসি (বাড়ির কাজের মহিলা) যাতে আমি ভয় না পাই । ধোয়া চাদরের নরম আবেশে ঘুম আপনা আপনি চলে এসতো । ভয় টয় পাবার সময় আর পেতাম না ।
সকালে কুডি মামু ( বাড়ির কাজের লোক) এক কলশি খেজুরের রস নিয়ে আসতো । কুডি মামু জানতেন আমি কাঁচা খেজুরের রস খেতে পছন্দ করি । রস এনেই ডাকাডাকি শুরু । আমি চোখ ডলতে ডলতে নেমে বাসি মুখেই জামবাটিতে করে এক বাটি কাঁচা রস চুকচুক করে খেয়ে ফেলতাম । গলা দিয়ে খেজুরের রস ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে খোলতে সুরুত করে নেমে বুকের ভেতরটা ঠান্ডা একরাশ পরশ দিয়ে যখন পেটের মধ্যে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিতে তখন মনে হতো যেন পৃথীবির শ্রেষ্ঠ পানিয় খেলাম । কিসের কোকাকোল আর পেপসি । আহ ! সে যে কি এক স্বাদ । কোকাকোলা বা পেপসির কি ঝাঁজ তার থেকে বেশি ঝাঁজ ছিল কাঁচা খেজুর রসে আর স্বাদ সে তো অপ্রতিম । সেই রস খেয়ে শরীরে যেন বল ফিরে পেতাম । গায়ের মধ্যে একটা চনমনে ভাব জেগে ঊঠতো । তারপর সকাল দশটায় হতো সকালের নাস্তা । অবশ্য তার আগে চা মুড়ি আর একপ্রকার ছোট ছোট গোল গোল বিস্কুট পাওয়া যেতো সেই সময় । ওই গুলা দিয়ে রাক্ষুসে ক্ষুধাটা কে দমিয়ে রাখতাম ।
ঘরের কোনায় কানায় হেটে চলে বেড়ালেও কান থাকতো নানুর নাস্তার ডাকের । যেই না নানু নাম ধরে ডাকতো। ব্যাস এক দৌড়ে টেবিলে পৌছে যেতাম । বিশাল বড় বড় চিতই পিঠা দুধে ভেজানো খান দুয়েক গলায় চালান করে দিয়ে পাটি সাপটায় এট্যাক করতাম । এর ফাঁকে নানু বাড়ির গরুর দুধের ঘিয়ে ভাজা পরটা আর আলু হালকা মুচমুচে করে ভাজা আর ডিম ভাজা পাঠিয়ে দিতেন টেবিলে । পাটি সাপটা শেষ করে নিজেকে কোন দিক তাকানোর অবসর না দিয়ে মাথা নিচু করে ঘিয়ে ভাজা পরটায় মন দিতাম । এখনকার ঘি এর মতো এমন তেল চিটচিটে একটা ব্যাপার তখন ছিলো না । ঘিয়ে ভাজা ঠিকি হতো কিন্তু হাতে ঘি লাগতো না । আর সে কি সুবাস । ঘিয়ের সুবাসেই ক্ষিদে বেড়ে দ্বিগুন হয়ে যেতো । আর আলুভাজা । উফ ! কি দুর্দান্ত তার স্বাদ । একটু করে পরটা ছিড়ে আলুভাজা টা পরটার টুকরায় জড়িয়ে মুখের ভেতর চালান করে দেয়ার পর কষ্ট করে চাবানো লাগতো না । মুখের ভেতর যেয়েই তা নতুন বউয়ের মতো নরম সরম হয়ে টুকুস করে পাড়ার উমা বৌদির মতো জিবের সাথে ছেলেখেলা করে গলা দিয়ে পিছলে নেমে যেয়ে পাকস্থলীতে রেস্ট নিতো। আর আমি চোখ বুজে থাকতাম । এই চোখ বুজেই বাকি নাস্তা সেরে নিতে না নিতেই বড় এক গ্লাশ গরম দুধ এসে যেতো । আর এখানেই আমার আপত্তি । উহা আমার পছন্দের লিস্টের বাহিরে । আর নানু এটা জানতেন । তিনিও সেই দুধের গ্লাশের সাথে এসে যেতেন । এতো যতো আবেশ টাবেশ ছিলো তা নিমিশেই দুর হয়ে যেয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে গটগট করে খেয়ে নিতাম দুধ । নানু মিস্টি করে হেসে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে বলতেন খেলতে যেতে । ততক্ষনে আমার গ্যাং বাড়ির উঠানে জড়ো হয়ে গেছে । তারা রাতেই খবর পেয়েছে আমি উপস্থিত ।
বাড়িতে আমার সঙ্গি সাথির কখনোই অভাব হয় নাই । আমার জন্ম আমার নানু বাড়িতেই হয়েছে । সেই সুত্রে আমার সঙ্গীসাথির কমতি ছিলো না । সিমা (ছেলে, কি করে বা কেনো তার নাম সিমা তা আজো জানি না) নুরুল আমিন, মিজানুর, হুমায়ুন আর আমি । আর একজন ছিলেন শেফালি আপা। আমাদের থেকে বেশ বড় । আমার আবার তার প্রতি কিঞ্চিৎ মন উচাটান ছিলো । উহা কেউ বুঝতো না আবার সবাই বুঝতো । আর শেফালি আপাও আমাকে আদর করতেন । অন্তত ওদের থেকে বেশি । শেফালি আপার শরীরে এক অদ্ভুত সুবাস ছিলো । গ্রামের মেয়ে কোন সুগন্ধি ব্যাবহার করতেন না অবশ্য সেই সময় সুগন্ধি অনেক শহরের মেয়েরাও ব্যাবহার করতো না । তারপরেও তার সারা শরীরে অদ্ভুত একটা সুবাস থাকতো । যখন তিনি আমাকে আদর করে জড়িয়ে ধরতেন সুবাসটা আমি টের পেতাম । বুক ভরে সেই সুবাস টেনে নিতাম । তার আঙ্গুল গুলো আমার চুলের ভেতর খেলা করতো । আমি আমার মধ্যে রোমাঞ্চকর এক অনুভুতি অনুভব করতাম । শেফালি আপা বলতো তোর চুল গুলি অনেক সুন্দর । মনে হয় রেশম দিয়ে বানানো (আমি অবশ্য অনেকবার আয়নায় দেখে বোঝার চেষ্টা করেছি সুন্দরের কিছু পাই নাই । একবার রেশমি সুতা জোগাড় করে এনে মিলিয়ে দেখার চেষ্টাও করেছি । মেলাতে পারি নাই ) ।
শেফালি আপার একটা সমস্যা ছিলো তিন মাঝে মধ্যে উধাও হয়ে যেতেন । এই যেমন রাত্রে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেছেন পরের দিন সকালে তাকে আর বিছানায় পাওয়া যেতো না । দুই তিন দিন পরে দুরে কোন এক পুকুর পারে সন্ধ্যার দিকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে গাড়া অবস্থায় পাওয়া যেতো তাও অজ্ঞ্যান । শেফালি আপার মাথা ভর্তি লম্বা চুল ছিলো । অসম্ভব সুন্দর। আপাকে আমি কখনো চুলের যত্ন নিতে দেখি নাই । তারপরেও আপার চুল গুলো ছিলো ঝলমলে । যেন সারাক্ষন তার চুলে রোদ এসে খেলা করে । তিনি যখন হাটতেন চুল গুলো পেছন দিকে কোমর জড়িয়ে দুলতে থাকতো । যেনো একদল নৃত্য শিল্পী নেচেনেচে আপার সাথে ঘুরে বেড়ায় । মাটির মধ্যে গাড়া থাকার ফলে চুল গুলো কাঁদায় লেপ্টে যেতো । কিন্তু তারপরেও আপার সুন্দর্যের একফোটা কমতি হতো না । মনে হতো মাটির প্রতিমা । আপাকে দেখতাম প্রায় বিরক্ত হয়ে বলতো ধুর ছাতার চুল সব কাইট্টা ফেলবো । আপার চুল নিয়েও আর এক কাহিনী আছে । আপা মাঝেমধ্যেই তার চুল কেটে ফেলতে চাইতেন কিন্তু কোন নাপিত তার চুল কাটতে চাইতো না । সবাই ভয় পেতো । অনেক আগে এক নাপিত নাকি চুল কাটতে এসেছিলো । আপাকে জল চোকিতে বসিয়ে কেবল কাঁচি চুলে ছুয়েছে ওমনি নাকি কে যেন নাপিতের কান বরাবর এমন এক থাপ্পর দিয়েছে যে নাপিতের কান ফেটে সারা জীবনের জন্য এক কান বয়রা হয়ে গেছিলো । আপা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতো আর বলতো মিলন তুই কি সুন্দর করে চুল কাটিস অথচো দ্যাখ কোন নাপিত আমার চুল কাটতে চায় না । আমি হেসে বলতাম আসলে হইছে কি আমার ভয়ে ওরা তোমার চুল কাটতে চায় না । আপা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো । ওই যে থাপ্পরটা তো আমি মেরেছিলাম । আপা আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাকিয়ে বললো হ্যা তুই খুলনা থেকে থাপ্পর মারছিস । আমি পরম আনন্দে মাথাটা আপার কোলে ঠেসে ধরে বলতাম হুম ওটা আমি ছিলাম ।
সিমা ছিলো শেফালি আপার ভাই । ও একদম চাইতো না আপা আমাকে আদর করুক । সারাক্ষন চেষ্টা করতো আমি যেনো কনো ভাবেই আপার কাছাকাছি না যেতে পারি । কিন্তু কি হবে আমি এসেছি শুনলেই আপা নিজেই চলে আসতো । নানুর সাথে গল্প করার তালে আমাকে কব্জা করে তার কাছে নিয়ে যেত । আর আমি বাধ্য ছাত্রের মতো মুগ্ধ হয়ে থাকতাম । সিমা একদিন একটা বড় লাঠি নিয়ে এসে বললো চল আমরা আজ শিয়াল মারবো । আপার মুরগী খেয়ে ফেলছে গতোরাত্রে । আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি । ওমনি কোথা থেকে আপা উড়ে এসে খপ করে আমার হাত টেনে ধরে বললো না খবরদার ও যাবে না ও অনেক ছোট। সিমা চোখ সরু করে ঠোঁট উল্টে বললো ও কি করে ছোট , মিলন আর আমি একি সমান । আমার পাশে এসে হাত দিয়ে মাথার সাইজ মেপে বললো তার উপর ওর গোঁফে দেখা যাচ্ছে আমারো গোঁফ হচ্ছে । আপা আমাকে টান দিয়ে তার পেছনে নিয়ে বললো তারপরেও ও ছোট ।
- মিলন তুই যদি না যাস রাত্রে সিন্নির ভাগ তো পাবি না সেই সাথে হা ডু ডু খেলায়ও তোরে নেব না । আমাকে শাসাতে লাগলো সিমা ।
আমি কোন মতে হাত ছাড়িয়ে বললাম আপা আমি যাই । আপা আমাকে ফের ধরতে পারা আগে দুই লাফ দিয়ে দে ছুট সেই সাথে সিমাও দৌড় দিলো ।
আমি সিমা নুরুল আমিন হুমায়ুন সবাই চার দিক দিয়ে ঢুকে গেলাম জংগলের মধ্যে । হাতে বিশাল বল্লম । আমি অবশ্য জীবনে বল্লম চালাই নাই । কিন্তু বাকিরা বল্লম চালাতে ওস্তাদ । আমার প্রধান দায়িত্ব বল্লম দিয়ে শিকার কে চেপে ধরার বাকিরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারবে। তো বল্লম হাতে চুপি চুপি মাথা নিচু করে ঝোঁপের মধ্য দিয়ে পা টিপে চলছি । কিছুদুর থেকে হুমায়ূন কুক কুক করে ডাক ছাড়লো অর্থাৎ সামনেই শিকার । আমি সটান হয়ে গেলাম । বল্লম ধরে চোখ নাক মুখে যতোটা পারা যায় কুঁচকে হিংশ্রতা আনার চেষ্টা করে ঝোপের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । ভাবখানা এমন আমার ওমন কুঁচকানো মুখ দেখে শেয়াল বাবাজি অক্কা পেয়েই যাবে। ওইদিকে অন্যরা বিভিন্ন কায়দায় শিয়াল কে তার ড্যারা থেকে বের করার চেষ্টা করছে । কিছুটা দুরে হুটপাটের শব্দ পেলাম সেই সাথে খ্যাক খ্যাক করে ডাক শুনতে পেলাম । নুরুল আমিন চেঁচিয়ে বললো মিলন রেডি থাক শিয়াল তোর দিকেই যাচ্ছে । পা থেকে মাথা পর্যন্ত কি এক কারনে থরহরি কম্প শুরু হয়ে গেলো । হাত দিয়ে কনভাবেই বল্লম চেপে ধরতে পারছিলাম না । ওদিকে খ্যাক খ্যাকের মাত্রা বাড়তেই লাগলো আর ঝোপের ভেতর হুটপাটও বেড়ে গেলো । মনে হলো কিছু একটা ছুটে আসছে । আমি নিজের বীরত্বের প্রতি সম্পুর্ন আস্থা রেখে থরথরিয়ে কাঁপা হাতে বল্লোম চেপে ধরে অপেক্ষা করছি । শিয়াল এলেই মেরে দেব । হঠাত কোথা থেকে কি হলো এক বীভৎস মুখ ঝোপ থেকে বেড়িয়ে আমাকে দেখেই তার লম্বা লম্বা দাত গুলো দেখিয়ে হা করে কামড়ে দিতে ছূটে এলো । আমিও বীর পুরুষের মতো বল্লম ফেলে ঝোপের ভেতর চিতপটাং হয়ে পরে গিয়ে খেয়ে ফেললো গো বলে চিৎকার করতে লাগলাম আর চার হাত পা বিভিন্ন দিকে ছুড়ে লাফাতে লাগলাম । আমার ওমন অজানা নৃত্য কৌশল দেখে শিয়াল বেচারাও ভড়কে গিয়ে ভয়ে পালিয়ে গেলো । পাছায় হুমায়ুনের জোড়া লাথি খেয়ে সজ্ঞ্যানে ফিরে এলাম । ভালো করে চেয়ে দেখি চার চারটা ঘামে ভেজা খুদ্ধ মুখ আমার দিকে দাঁত মুখ কিড়মিড় করে তাকিয়ে আছে । এই শালারে কে আনছে তারে আগে দুইটা লাগা , নুরুল আমিন রেগে গিয়ে বললো । আমি সিমার দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিলাম । ততক্ষনে সিমা দৌড়ে এলাকা ছাড়া ।