somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চোর

১৪ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৮:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ভাদ্র মাসের খাঁ খাঁ করা রোদ্দুর । লম্বা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে ডিস্ট্রিক রোডের দিকে । কাঁচা রাস্তা কিন্তু রোঁদের তাপে পা রাখার জো নাই । গরমে পায়ের পাতা ছ্যাত করে ওঠে । পানিতে খাওয়া জোকে খাওয়া পা তাও রোঁদের তাপ সহ্য করতে পারে না । দুই পায়ের পাতায় দুনিয়ার গর্ত । কাঁদা পানির মধ্যে সারাদিন কাজ করলে পা আর পা থাকে না । আসমত দুই পায়ের দিকে তাকিয়ে ভাড়ি একটা নিঃশ্বাস ফেলে । বর্গা চাষির পা এর থেকে ভালো থাকার উপায় নাই । কতো বার যে ইদ্রিস চাচারে কইছে , চাচা একটা পেলাস্টিকের জুতা কিনা দেন । কাদা পেরির মধ্যে পাও জোঁকে খায় কাদায় খায় তার উপর ভাঙ্গা হামুকের খোসায় পাও কাইট্টা যায় , কিন্তু কে শোনে তার কথা । পাছার উপর লাথি মাইরে খেঁদায় দেয় ইদ্রিস আলী । জাউরার ঘরের জাউরা , হেরে পেলেস্টিকের জুতা দেওন লাগবো, নবাবজাদা হইছো ? যা খ্যাঁতে যা । আইজাকর মধ্যে তিন বিঘা জমি চাষ দিয়া উঠন লাগবো । বাবু গিরি না কইরা হেই কামে মন দাও। জমিন চাষ না অইলে আইজ আর খাওনা নাই ।

কোমর অব্দি পানির খ্যাত চাষ দেয়া চাট্টি খানি কথা না । গরু গুলান জোয়াল টানতেই চায় না । খালি জোয়াল থেকে মাথা সরিয়ে নিতে চায় ।গরুর দোষ দিয়া কি লাভ । পেট ছুই ছুই পানি । হাটু তামাক পেরি কাদার মধ্যে ডাইবা যায় । পাও টাইনা যে আগে বারবো তার ও উপায় নাই । পেরি কাদা চুম্বকের লাহান মাডির মধ্যে টাইনা ধরে। লম্বা কাপড় ফালি কইরা কাইটা গরুর নাভী সহ পেট বাইন্দা রাইখাও কাজ হয় না । রক্ত খাইয়া বিগাত সাইজের জোঁক বিচি কলার সাইজ হইয়া টাপর টুপুর করে পানি তে পরে । তার পরেও বাঁশের লাঠি দিয়া গরুর গুলারে পিডাইয়া লাঙল চালায় । হাইজের আগে তিন বিঘা চাষ না দিলে রাইতের খাওন নাই । গুরু গুলার জন্য মায়া লাগলেও করার কিছু নাই। নিজে বাঁচলে বাপের নাম ।এই ঠাডা পরা গরমে আর কাম করতে মন চায় না । তাই ছুটি নিয়া বোনের বাড়ির দিকে রওনা দিছে আসমত । ছুটির কথা বলাটাও ছিলো বিশাল এক হিস্টরি । কাম সাইরা গরু গুলান গোয়াল ঘরে বাইন্দা রাইতের খাওন খাওয়ার সময় কথা টা সে পারে । চাচা আমি তো আমনের ঘরের কামলা মাইনে চাকর , চাকরী করি ঠিক না ?
হ, ওই আর কি , দুই পায়ের মাঝখানে তামাকের কৌটা রেখে ভোতা মাথা ওয়ালা একটা দা দিয়ে তামাক কাটতে কাটতে মাথা নাড়ে ইদ্রিস আলী ।
চাকরি করলে ছুটি টুটি তো পায় , ভাতের থালায় ভাত মাখতে মাখতে জিজ্ঞাসা করে আসমত ।
পায় তো, ভুরু কুঁচকে তাকায় ইদ্রিস আলী , ক্যান তোর ছুটি লাগবে নাকি ?
জ্বে, চাচা জ্বে , খুশি হয়ে ওঠে আসমত । এক দলা ভাত মুখে দিয়ে চাবাতে চাবাতে দুই গাল ফুলিয়ে কোলা ব্যাঙ্গের মতো চোখ কুচকে তাকায় ।
ওই জাউরার পো, দূর থেকে লাথি ছুড়ে মারে ইদ্রিস আলী । তোর এই দুনিয়ায় আছে কেডা যে ছুটি নিয়া হের কাছে যাবি ।
কি কোন চাচা, চাইর বছর আগে বইনডারে বিয়া দিলাম না পঞ্চায়েত পুর । জাউরা বলায় মন খারাপ হলেও ছুটি পাবার আশায় জাউরা ডাকটা গায় মাখে না আসমত । বইনরে দেখতে যামু । পক্কিরে কতো দিন দেহি না ।
উম! বইনরে দ্যাকতে যাবি । যা তয়, কয়দিনের ছুটি লাগবে।
দেন চাইর পাঁচ দিন, ইস্টি বাড়ি যামু দুই তিন তো থাকন লাগে, নইলে গৃহস্তের অমঙ্গল হয় । ভাতের থালা জিব্বা দিয়ে চাটতে চাটতে বলে ।
যা, কিন্তুক ওই চাইর দিনের ট্যাহা পাবি না ।
কোন কি ? ছুডিতে কেউ ট্যাহা কাডে? হতভম্ব হয়ে যায় আসমত।
কাডে , আমি কাডি, অহন দ্যাখ তুই চিন্তা কইরা যাবি নাকি কাইল বেইন্না বেলায় হাল লইয়া মাডে যাবি ।
চাচা ছুডি দেন, তয় এই মাসের ট্যাহা ডা দেন । ইস্টি বাড়ি যামু মিডাই টিডাই কিছু নেওন তো লাগবো ।
ট্যাহা, মুখ বাকিয়ে বলে ইদ্রিস। তোমারে ট্যাহা দেই আর সেই ট্যাহা লইয়া তুমি উড়াল দাও । আমারে বেকুব পাইছো ?
কি কোন? আমার বেতনের ট্যাহা, দেবেন না? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে আসমত ।
না দিমু না, গেলে যা না গেলে কামে লাগ । হাত পা ঝেড়ে দা দিয়ে কোটা তামাক গুলা নিয়ে ভিতর ঘড়ে খক খকিয়ে কাশতে কাশতে চলে যায় ইদ্রিস । আসমত বোকার মতো চেয়ে থাকে । পাতের অল্প কিছু ভাতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দেয় । সারাদিনের অভুক্ত পেটে অপমান সহ্য হয় কিন্তু ভাতের ক্ষুধা সহ্য হয় না ।

খালি পকেটেই বের হয় আসমত। তার ছুটি চাই চাই । ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে কতো দিন পর পক্কির সাথে দেখা হবে ।হাতে করে কিছু নিতে না পারার কষ্ট তাকে বেশ পিড়া দিচ্ছে। হালার বদমাইশ ইদ্রিস বেতনের ট্যাহাটাও দিলো না । কুত্তার বাচ্চা একটা ইবলিশ। পক্কির বিয়া দিতে গিয়া আসমত তার পৈতৃক ভিটা আর কিছু জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছে । পাত্র পক্ষের দাবি ছিলো একটা মটর সাইকেল আর রঙ্গীন টেলিভিশন সেই সাথে বিছনা বাটি তো আছেই । আসমতের মতো লোকের এমন দাবী পুরন করতে গিয়ে সর্বশেষ সম্বল পৈতৃক ভিটা আর অল্প জমি বেঁচে দিতে হয় । তারপর চার বছর পেরিয়ে যায় আসমতের সামর্থ হয় না বোনের বাড়ি গিয়া বোন কে একবার দেখে আসার । এইবার সে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে । বোনের সাথে দেখা তার করতেই হবে । দুই ভাই বোন তারা পিঠাপিঠি। কতো শীত গৃষ্ম একসাথে কাটিয়েছে । বোনটার জন্য মন তার সব সময় কেমন করে কিন্তু টাকার অভাবে যেতে পারে না ।হন হনিয়ে হাটতে থাকে আসমত ।

ভাদ্রে মাসের গনগনা সুর্যের আলোয় চোখ ঝলসে যায় । আশে পাশে ছায়া দেবার মতো কোন গাছ পালা নাই। ছাপড়ার মতো একটা বন্দ ভাঙ্গা দোকানের আড়ালে বসে খানিক জিরিয়ে নেয় আসমত । সরু একটা আধা শুকনা খালে যেনো মরতে মরতে এখনো বেঁচে আছে ছাপড়ার পেছনে । হাটু পানিতে নেমে দুহাত ভরে পানি খেয়ে নেয় । সেই কোন সকালে বেড়িয়েছে পেটে দানা পানি কিছুই পরে নেয় । যতোটা সম্ভব পেট ভড়ে পানি খায় আসমত । পানি ঠিকি খায় কিন্তু কলিজা ঠান্ডা হয় না । মধ্য গগনের সুর্যের তাপে পানি টগবগিয়ে ফুটছে । ফুটন্ত পানি খেয়ে তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায় ।

পঞ্চায়েত পুর আরো আট মাইলের মতো । কেবল আসছে বেলায়েত নগর । নামেই নগর, আসলে শ্মশান । মানুষ জনের দেখা সাক্ষাত নাই ।সম্ভাবত প্রখর গরমের তাপে কেউই ঘর থেকে বাহির হতে চায় না । হাসমত খানিক জুড়িয়ে হাটা শুরু করে । আহা, পক্কি না জানি কতো খুশি হইবে তারে দেখে। বিয়ার আগে তো ভাইজান বলতে অজ্ঞান আছিলো । আসমত যখন মাঠ থেকে কাজ শেরে ফিরতো পক্কি তার আগেই দুপুরের রান্না শেষ করে রাখতো, মাঠ থেকে ফিরলেই খল বলিয়ে ছুটে আসতো নয়া হাঁসের বাচ্চার মতো । কতো কথা কতো অভিযোগই না তার ছিলো ভাই কে উদ্দেশ্য করে।হাঁসি মুখে সব কথা শুনতো সে , মাঠ থেকে ফেরার পথে সে গোসল সেরেই আসতো, দুই ভাই বোন মিলা এক সাথে কলমি শাক ভাজি , বাইলা মাছের ঝোল আর কলাইয়ের ডাউল দিয়া প্রান ভড়ে ভাত খেতো । পক্কির হাতের ডাউলের স্বাদ এখনো তার জিবে লেগে আছে। অমন ডাউল পৃথিবীর কেউই রাঁধতে জানে না । শুকনা মরিচের বাগাড় দিয়ে যেমন একটা ঘ্রান আনতো ডাউলে ওটা মনে করতেই আসমতের হাটার গতি বেড়ে যায় । বোনের বাড়ি গিয়াই সে বলবে মাছ মাংস তার চাই না তাকে যেনো কলাইয়ের ডাউল আর কলমি শাকের তরকারি দিয়া ভাত দেয় । বোন পাশে বসে বাতাস করবে আর সে প্রান ভড়ে খাবে । চোখে পানি এসে যায় আসমতের ।

এই রাস্তায় তেমন একটা রিক্সা ভ্যান দেখা যায় না, যাও বা দুই একটা আশে কিন্তু আসমতের হাল হকিকত দেখে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায় । জানে যে এই লোকের ভাড়া দেবার সামর্থ নাই । এতে আসমতের কিছুই যায় আসে না সে বিভর বোনের হাতের ডাউল ভাতের স্বপ্নে । মোহনপুরের বিল ডাইনে রেখে এক মাইলের মতো আর বাকি পঞ্চায়েত পুর । আইজ মোহনপুরের হাট বার । সে যখন হাঁটে এসে পৌছায় হাটের শেষ দোকানি তার মালামাল গুছিয়ে নেয় । মন টা খারাপ হয়ে যায় আসমতের, বন্ধু কেরামতের কাছ থেকে পঞ্চাশ টা ধার এনেছিলো , ভেবেছিলো মোহনপুরের হাট থেকে কিছু বিস্কুট কিনে নেবে । পক্কির বিস্কুট খুব পছন্দ । যখন ছোট ছিলো আসমত হাঁটে গেলেই তার বায়না ছিলো বিস্কুটের । বল্লল কবিরাজের দোকানের সামনে বিস্কুটের দোকান বসতো।চটির বস্তার উপর পাহাড়ের মতো উচু করে রাখা থাকতো বিসকুট। দু টাকায় এক মুট বিস্কুট পাওয়া যেতো । সেই বিস্কুট টিয়া পাখির লাহান কুট কুট করে খাইতো আর চোখ মুখ উজ্জ্বল করে হাসতো । সেই হাঁসি কতো দিন দেখে না আসমত । হাঁট শেষ তারপরেও সে খোঁজে , যদি কোন বিসকুটের দোকান খোলা পায়। নাহ, কোন দোকান খোলা নাই । সমস্ত দোকানে তালা দেয়া । মন ভেঙ্গে যায় আসমতের ।লুঙ্গীর খোটায় বাধা টাকা ট তার কাছে এখন বোঝা মনে হচ্ছে । ইচ্ছা করছে ছুড়ে ফেলে দেয় ।হাটের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসছিলো হঠাৎ নজর যায় একটা দোকানের ডালা এক পাশ দিয়ে খোলা । খোলা ডালার ফাঁক দিয়ে দোকানের ভেতর থরে থরে সাজানো বিসকুটের প্যাকেট সাজানো । দোকানদার মানুষ টা কেমন, ভাবে আসমত। এমন আকালের দিনে কেউ দোকান খোলা রাইখা যায় । চোর চুরি করতে দুই মিনিট লাগাবে না , হাসতে হাসতে ভাবে । কিছু দূর যাবার পর থেমে যায় আসমত । আশেপাশে তো কেউই নাই । সে যদি দুই প্যাকেট বিসকুট নেয় তার বোনের জন্য কেউ দেখবে না । দূর থেকে কিছুক্ষন খোলা দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকে আসমত। নাহ, চুরি করা যাবে না । চুরি কইরা ধরা পরলে ইজ্জত থাকবে না । কিছু দুরেই পক্কির শশুর বাড়ি । ধরা পরলে ঠিকি খবর চলে যাবে। মান সম্মান সব চলে যাবে । পক্কি কষ্ট পাবে । হাটা দেয় আসমত । মনে ভেতর খচ খচানি থামে না । আচ্ছা এমন হয় না দুই প্যাকেট বিসকুট নিয়া পঞ্চাশ টাকা সে রেখে আসবে দোকানে তাহলে তো আর ওটা চুরি না । হু, এমন টাই করবে সে । ফিরে আসে খোলা দোকানের কাছে । আশে পাশে দেখে নেয় কেউ আছে কি না , থাকলে তাকে বলবে দুই প্যাকেট বিসকুট দিতে না থাকলে টাকা টা রেখে সে নিজেই নিয়ে নেবে । কেউ কে না পেয়ে আসমত দোকানের ভেতর ঢুকে পরে খোলা ডালা দিয়ে । সাজানো দোকান ।মাল পত্রে বোঝাই । এতো সুন্দর দোকান দেখেই তারো স্বাদ জাগে এমন একটা দোকানের মালিক হবার । কাঁপা হাতে সব কিছুতে সে হাত বুলাতে থাকে। দোকানের ভেতর টা একটা মিঠা গন্ধে ভরা । সম্ভাবত বিসকুটের গন্ধ ।এই বিসকুটই সে নেবে । দুই প্যাকেট সে যত্ন করে বিসকুটের সেলফ থেকে নিয়ে নেয় । দুই প্যাকেট নিতে গিয়ে সে দশ প্যাকেট ফেলে দেয় । ভাবে পরেই যখন গেছে পরে যাওয়া বিসকুট গুলা সে নিয়ে নেয় , পরবর্তি হাটবার এসে সে বাকি টাকা পরিশোধ করে দিলেই ল্যাটা চুকে যাবে । বিসকুট নিয়ে চুপি চুপি দোকান থেকে বেড়িয়ে আসে ।মনে মনে সে ঠিক করে পাক্কির সাথে দেখা করেই সে ফিরে এমন একটা দোকান দেবে। ইদ্রিস মিয়া টাকা দেবে না । আইজকাল অনেক সমিতি হইছে বাজারে তাদের কাছ থেকে ধার নিয়ে দোকান দেবে । মোল্লা বাড়ির খবির মোল্লা তো শুনছি এমন করেই দোকান দিয়েছিলো, আইজ তার কতো পয়সা ।

পঞ্চায়েত পুর এসে ঠিক চিনতে পারে না কোন দিকে পক্কির বাড়ি । পক্কির জামাইয়ের নাম , খোকন সর্দার । গ্রামের মুখের কাছে অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে দেখে একজন এগিয়ে আসে। ওই মিয়া ক্যাডা আপনে, যাইবেন কই । আসমত লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে । ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কি বলবে । যাইবেন কই, আইছেন কই থিকা , আবার জিজ্ঞাসা করে লোক টা । খোকন সর্দার কে চিনেন, মাথা চুলকে বলে আসমত ।
খোকন সর্দার মাইনে কান্দি ছিলা খোকন সর্দার এর কতা কন
কান্দি ছিলা কি , ভ্যাবাচ্যাকা খায় আসমত ।
আরে হে তো আগে চোর আছিলো, মাইনসের বাড়ির কান্দি কাইটা চুরি করতো । চুপসে যায় আসমত । তার বোন জামাই চোর এটা ভাবতে পারে না । বিয়ার সময় ঘটক বলছিলো পোলায় বিজনিস করে ।পুরান মালের বিজনেস ।চোর তো বলে নায় ।
আরে না, কি কোন ? সে না, ওই যে ইকিরগঞ্জ আসমত মিয়ার বোন বিয়া করছে সেই খোকন , নিজেকে মিয়া বলতে বেশ ভালোই লাগে আসমতের ।
হো, হেই খোকন চোরা । অখন অবশ্য চোর নাই , পুলিশের বানানি খাইয়া সোজা হইছে, মোহনপুরে শুনছি মুদীর দোকান দিছে । বিশাল ব্যাপার অখন, চুরির পয়সায় ফুটানি আর কি । আপনে হেরে খোঁজেন ক্যান ?
আমার বইনরে হ্যার লগে বিয়া দিছি , ইতস্তত করে আসমত ।
অ, আইচ্ছা । যান , এই রাস্তা ধইরা যান , সোজা গেলে পুব কুলে একটা আমড়া গাছ দেখবেন তারত পাশেই পাক্কা দলান বাড়ি , ওই ডাই খোকন সর্দারের বাড়ি। চুরির পয়সা, বোঝেন তো । মাথা দুলিয়ে চলে যায় লোকটা ।

আসমত দ্বিধায় পরে যায় , ঠিক বুঝে উঠতে পারে না । ছোট ছোট পায়ে এগোতে থাকে । কিছু দূর গেলেই, লোকটার কথা মতো আমড়া গাছ দেখতে পায় তার নতুন টিনের পাকা দালান বাড়ি দেখে । বাড়ি দেখে আসমতের মন ভড়ে যায় । সামস্ত বাড়ি রঙ্গে ঢঙে যেন জানা দিচ্ছে বাড়ির মালিকের অনেক পয়সা । আবার পথে দেখা হওয়া লোকের কথা মনে করে মন খারাপ হয়ে যায় চুরির পয়সা, সে কি তার বোন কে চোরের সাথে বিয়ে দিলো , ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় । কাঁপা পায়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।বাড়ির দিকে ভালো ভাবে তাকায় আবার । গর্বে বুক টা তার ভড়ে ওঠে, বোন তার সুখে আছে । ইদ্রিস মিয়ার বাড়ির থেকেও সন্দর আর আলিশান ভাবে সে । বাড়ির ভেতর ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্তত করছে আসমত । এত্ত বিশাল বাড়ি , কি সুন্দর রঙ দিয়া সাজানো, সে তার নিজের ছেড়া লুঙ্গি আর তালি দেয়া পিরানের দিকে তাকায় । নিজের উপর নিজেই রেগে যায় । তার কি উচিৎ ছিল না ধার করে হলেও একটা ভালো লুঙ্গি আর পিরান পরে আসার । সে কিভাবে পক্কির সামনে দাঁড়াবে তার বোনই বা কি করে তার ভাই কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে । পক্কি নিশয় ইদ্রিস মিয়ার বউয়ের মতো ভাড়ি শাড়ি গা ভর্তি গয়না পরে , নিশ্চই মুখ ভর্তি পান দিয়ে ঠোঁট লাল করে শাড়ির অঞ্চলে চাবি বেঁধে বাড়ির ঝুল বাড়ান্দা দিয়ে হেঁটে যায় । আসমত উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে, যদি এক পলক দেখতে পায় পক্কি কে । নিজের পায়ের দিকে তাকায় এক পা ধুলা আর কাদা । আশে পাশে কোন ডোবা আছে কি না খুজতে থাকে আসমত । ইস, ভুল হয়ে গেছে আসার আগে পথেই কোথাও পা ধুয়ে আসা উচিৎ ছিলো তার উপরে পায়ে স্যান্ডেলও নাই । আসমতের ইচ্ছা করে পা দুট কোঠাও লুকিয়ে ফেলতে ।

ও মিয়া, কেডা আপনি, বাড়ির সামনে ডাড়ায়ে কেন। পেছন থেকে ভাড়ি কন্ঠের ধমক শুনে ঘুড়ে দাঁড়ায় আসমত ।বিশাল দেহী এক লোক কে সামনে দেখে ভড়কে যায় । কি হইলো হা কইরা কি দেখেন, কারে চাই , গেরস্ত বাড়ির সামনে খারাই রইছেন কি মতলবে , ধমকে ওঠে লোক টি । আসমত সব গুলিয়ে যায় । সে ভুলে যায় যে সে তার বোন কে দেখত এসেছে । হাতের বিসকুট গুলো এগিয়ে দেয় লোকটার দিকে । বিসকুটের প্যাকেট গুলো দেখে চমকে ওঠে লোক টি । ওই ব্যডা, এই বিসকুট তুমি কই পাইছো, থাবা দিয়ে হাত থেকে কেড়ে নেয় ।
বাজার থিকা আনছি , তোতলাতে থাকে আসমত ।
বাজার থিকা অনছস না চুরি করছস, খপ করে আসমতের হাত চেপে ধরে লোক টি । তাই তো কই দশ প্যাকেট বিসকুট কম ক্যা, এই তো সেই দশ প্যাকেট । হালার চোর , আবার বাড়ির সামনে আইসা চুরির মতলব করতাছস । বিশাল মোটা হাত দিয়ে বেমাক্কা একটা চড় কসিয়ে দেয় আসমতের গালে ।
না না , আমি চুরি কই নাই , আমি কিনা আনছি , দোকানে ট্যাকা থুইয়া আইছি । চেঁচিয়ে বলে কিন্তু বেমাক্কা থাপ্পরে তার মাথা ঘুরে যায় , চিৎকার করে বললেও তা কেউ শুনতে পায় না । থাপ্পরের চোটে তার গাল লাল হয়ে যায় চোখ দিয়ে দড়দড়িয়ে পানি ঝরে ।চোখে সে ঝাপসা দেখে । কানের মধ্যে ঝিন ঝিনিয়ে ঝি ঝি পোকা বাজে । সে চিৎকার করে বলে আমি চোর না , পক্কির লইগা বিসকুট আমি ট্যহা দিয়াই কিনছি , কিন্তু সামনে দাড়ানো লোকের কানে সেই চিৎকার ঢোকে না । সে দেখতে পায় নোংরা পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে তার দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বিড়বিড়য়ে কি যেনো বলে। লোকটার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে । সে আসমতের ঘাড়ে ধরে বাড়ির সামনে থেকে সরিয়ে আনে । হালার পো সাহস দেখছো, চুরি করবে তার উপরে আবার বিরবিরাইয়া মন্ত্র পইরা চুরির বান মারবে, শক্ত হাতে আসমতের গলা টিপে ধরে । এই লাইনে আমি তোর ওস্তাদ, জাউরার পো, চুরি ছারছি কিন্তুক বিদ্যা আহনো আছে । এই সব বিরবিরানির সব আমি জানি । আসমত তার গলায় শক্ত হাতের চাপ খেয়ে হাশপাশ করতে থেকে, তার চোখ মুখ লালা হয়ে আসে, দুই হাত দিয়ে গলার উপর থেকে লোহার মতো শক্ত হাত সরানোর চেষ্টা করে কিন্তু লাভ হয় না । এরি মধ্যে আশেপাশে লোক জমা হয়ে যায় । ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন উঁকি মেরে আসমত কে দেখে আঁতকে ওঠে, আরে এই ব্যাডাই তো আমার কাছে তোমার বাড়ির ঠিকানা চাইলো খোকন মিয়া, কইলো তুমি নাকি তার বুন জামাই হও , আমি তো তোমার বাড়ির ঠিকানা দিলাম । আরে থোও তো রাঙ্গা দুদু, এই গুলান সব চোরেই কয়, হিশিসিয়ে ওঠে খোকন। হ, এইডা হইতে পারে, তুমি তো আবার এই কামে ওস্তাদ, চোরে চেনে চোরের নাড়ি, ঘাড় ঘুরিয়ে যেতে যেতে বলে । খোকন সর্দার লোকটার কথায় খিপ্ত হয়ে ওঠে , সে আসমতের পাছায় কষে একটা লাথি মারে তার দেখা দেখি সবাই মিলে আসমত কে বেদম মার মারতে মারতে মারতে এলাকার বাহিরে নিয়ে যায় ।

পক্কির আজ মন টা কেমন জানি করে। অনেক দিন হলো ভাইয়ের কোন খবর নাই । সেই যে বিয়ার বছর সে আইলো তারপর থেকে ভাইয়ের কোন খোঁজ খবর সে জানে না । বাড়ির বারান্দায় হালকা বাতাস দেয় । বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুব দিকে তাকিয়ে থাকে , ওই দিকেই যে তার ভাইয়ের বাড়ি । হঠাৎ করে বাড়ির সামনে চিল্লাচিল্লার আওয়াজ শুনে তাকায় । একটা রোগা কৃষ্ণকায় লোক কে সবাই মিলে মারতে মারতে পুর্ব দিকে নিয়ে যাচ্ছে । দির্ঘশ্বাস ফেলে পক্কি । আহারে , কে জানি কি করছে তার জন্য লোক জন তারে এমন করে মারছে । পক্কি এই গুলা একদম সহ্য করতে পারে না। সে দোতলা থেকে নেমে আসে । নিচে তার মেয়ে টুনির সাথে দেখা হয় । কি হইছে রে মা, জিজ্ঞাস আকরে টুনি কে , মা, জানো হাসতে হাসতে বলে টুনি, বাবায় এক চোর ধরছে হে নাকি বাবার দোকানের বিসকুট চুরি কইরা আবার আমাগো বাড়ির সামনে আইসা মন্ত্র পইরা চুরি করতে চাইছিলো । হাসতে হাসতে চলে যায় টুনি ।পক্কির মন ভাড়ি হয় ।সে ভাবে তার স্বামী কে বলবে একটু খোজ নিতে । ইকিরগঞ্জে গিয়ে তার ভাই কে সাথে করে আনতে ।এমন সময় ঘামে নেয়ে খোকন সর্দার ঘরে ঢোকে । পক্কি কে দেখে সামান্য হাঁসি দেয়। আইজ একটা কান্ড হইছে হুনছো নি? পক্কি মন খারাপ করে খাটে বসে থাকে , খোকন সর্দারের কথায় কান দেয় না । হুনো না , কি কই ? জামা খুলতে খুলতে বলে খোকন সর্দার । বৈদ্যুতিক পাখার সুইচ অন করতে করতে জিজ্ঞাস করে পক্কি , না কইলে হুনমু কেমনে ? আর কইও না এক চোর আইছিলো, দিছি আইচ্ছা মতো ধোলাই । রাঙ্গা দুদুরে কইছে হে নাকি তোমাগো ইকিরগঞ্জের লোক হের কি এক বুইন নাকি এইখানে বিয়া দিছে । যত্তসব ভোকাছ কথা, দিছি মাইর , মাইরের চোটে হাগাই দিছি । চমকে ওঠে পক্কি । কি কইলেন ? কে আইছিলো ?
এক লোক, আমার দোকান থেকে বিসকুট চুরি কইরা আমাগো ঘরের সামনে দাড়াইছিলো , পক্কির দিশাহারা মুখ দেখে খোকন সর্দার চমকে যায় ।
হে এহন কই, বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে পক্কির
হেরে লোকজন মাইরা পূব দিকে গ্রামের সিমানায় দিয়া আসছে । পক্কি ছুটে যায় বাড়ির বাইরে, খোকন সর্দার না বুঝে সেও ছুটে যায় , কি হইছে বউ অমন করো ক্যান । হেয় তো একটা চোর ।
হাতে করে কি আনছিলো, কান্না ভেজা চোখে জিজ্ঞাসা করে পক্কি ।
ক্যান বিসকুট, আমার দোকান থেকে চুরি করছে কইলাম তো, হতবাক হয়ে যায় খোকন সর্দার । পক্কি ছুটে যায় ঘরের বাহিরে , দৌড়াতে থাকে দিক বিদিক জ্ঞ্যান হারিয়ে । তার ভাই এসেছিল তাকে দেখতে । বিসকুট নিয়ে এসেছিলো, তার ভাই, যে ভাই তাকে আদর করে মানুষ করেছে সেই ভাই, সে যে ছোট বেলায় বিসকুট খেতে চাইতো তার ভাই তা ভোলে নাই । খোকন সর্দার ও ছোটে তার স্ত্রীর পেছনে ।
বউ আমারে কও কি হইছে ।
ভাই , আমার ভাই আসছিলো , তার আপনি চোর বইলা মারছেন, কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় পুর্ব দিকে গ্রামের সিমানায় ।থমকে দাঁড়ায় খোকন সর্দার। লোক টা এমন কিছুই যেন বলছিলো । সেও ছোটে তার স্ত্রীর পেছনে । গ্রামের শেষ সিমানায় গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় পক্কি । আশে পাশে কেউ নাই কেবল দূরে একটা অস্পষ্ট বিন্দুর মতো দেখা যায়। পক্কি ভাই ভাই বলে চিৎকার করে। পক্কির গলার স্বর সেই বিন্দু পর্যন্ত পৌছায় না । পক্কি মাটিতে গরাগড়ি খেয়ে কেঁদে চলে । খোকন সর্দার হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে থাকে খুঁড়িয়ে চলা বিন্দুর দিকে ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:২৩
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বনাম তরুণশক্তিঃ লিমিট, ব্যালেন্স, সিস্টেম বোঝাটা খুব জরুরী

লিখেছেন শেহজাদ আমান, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৬



লিমিট, ব্যালেন্স ও সিস্টেমটা বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনের শক্তিধর সংগঠনগুলোকে বুঝতে হবে। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম যখন বলে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বতী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে চাচ্ছে, তখন সেটা যৌক্তিক শোনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রিয় কবি হেলাল হাফিজ আর নেই

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩২





'যে জলে আগুন জ্বলে'র কবি হেলাল হাফিজ মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

আজ শুক্রবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লাগবা বাজি?

লিখেছেন জটিল ভাই, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৫০

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নেট হতে)

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছলনার বালুচরে

লিখেছেন আজব লিংকন, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৩



কিছু প্রশ্নের উত্তর তুমি নিরবতায় খুঁজে নিও
ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে ভুলগুলো বুঝে নিও।।
ছলনার বালুচরে মোহ মায়া ছুঁড়ে দিয়ে
বিষাদের প্রবল স্রোতে তুমি নিজেকে খুঁজে নিও।।

বুঝে নিও।।
ছটফটানিতে গিলে খায়
জীবনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হায়রে সিইও, কী করলি জীবনে....

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫

ছবি রয়টার্স

দেশের বিখ্যাত কোম্পানীর সিইও হোটেল থেকে বের হয়েছেন, এমন সময় তাকে একজন ঠান্ডা মাথায় গুলি করে খুন করল। সিসিটিভিতে সেই গুলি করার দৃশ্য স্পষ্ট ধরা পড়ল। এখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×