ডেইলি প্যাসেঞ্জার -পর্ব ১
ডেইলি প্যাসেঞ্জার -পর্ব ২
বি আর টিসির লাল রঙের এসি বাসগুলো একেকটা সাক্ষাৎ মশার আস্তানা। বিশেষ করে সকালবেলার প্রথম ট্রিপটাতে মশার দলবলের পিনপিনানি অটো মিউজিক সিস্টেমের কাজ করে।তার সাথে পাবলিকের মশা মারার চটাস চটাস শব্দ তো আছেই। একদিন মশার পরিমাণ একটু না,অনেক বেশিই ছিল। শেষমেশ পাবলিক বিরক্ত হয়ে ড্রাইভার কে মশা নিধনের উপর টিপস দিতে শুরু করল। এক যাত্রী আবার এক কাঠি সরেস। ড্রাইভার কে বলল, ওই মিয়া এরোসল নাই? ড্রাইভার নির্বিকার মুখে বলে,আছে তো! এই কথা শুইনা সবাই নড়েচড়ে বসে।একেকজন বলে ,ধুর মিয়া ,এতক্ষন পর এই কথা! তা কই এরোসল? ড্রাইভার নিরীহ মুখ করে বলে- "দোকানে" .
বাচ্চাদের কর্মকাণ্ড আসলেই ভয়ংকর। এমনিতেই কিছু বিচ্ছু পোলাপাইন থাকে, যাদের প্রশ্নবাণে বাবা মার মনে হয়,ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি । সেইটা যদি হয় আবার বাসের মত পাবলিক প্লেস,তাইলে তো কথাই নেই !
স্কুলড্রেস পরা দুই পিচ্চি মায়ের সাথে বাসে উঠল খিলখেত থেকে। পিচ্চি দুইটা বড়জোর ক্লাস ওয়ান টু তে পড়ে। মেয়েটাকে মা কোলে নিয়ে বসল, আর ছেলেটাকে পাশে বসাল।কিছুদুর যেতেই আরেক মহিলা যাত্রী উঠল,ছেলে পিচ্চিটাকে বলল, "বাবু তুমি আমার কোলে বস" . পিচ্চি প্রবলভাবে মাথা ঝাকিয়ে বলে, "না না কোলে বসব না।" পিচ্চির মা বলে, "ও মা ,কেন?আন্টি তো।কোলে বস।" পিচ্চি বলে , "আই হেট গার্লস" ! পিচ্চির মা এই কথা শুনে টাশকি খাইল কিনা কে জানে,তবে আমার মনে হল এই পিচ্চি বড় হইলে নির্ঘাত একটা "জিনিস" হবে !
ভয়ংকর বিচ্ছু টাইপ এক পিচ্চি লেগুনার হেল্পার। আমি কয়েকদিন ধরে এইটা খেয়াল করে আবিষ্কার করলাম লেগুনার হেল্পার কারো বয়স ই সাত আটের বেশি হবেনা। এরা জীবনে স্কুলে কয়দিন গেসে জানিনা,কিন্তু অংকে যে তারা মারাত্মক দক্ষ,তাতে কোনই সন্দেহ নাই। প্রথম প্রথম আমি তাব্দা খাইয়া গেসি এদের ভাড়া কাটা দেখে,এক্কেবারে পাক্কা হিসাব। লেগুনার ভিতরে লেখা ১০০,৫০০ টাকা ভাংতি নাই। একজন ১০ টাকার ভাড়া দেয়ার জন্য ১০০ টাকা দিতেই পিচ্চি হেল্পার দিল ঝাড়ি। বলল লেখা আছে দেখেন,১০০ টাকার ভাংতি নাই। কোণার দিকে বসা একটা লোক ফাজলামি করে ১০০০টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নে ,কোথাও তো লিখা নাই,১০০০ টাকার ভাংতি নাই,আমাকে তাইলে ভাংতি করে দে। পিচ্চি দাঁত কেলিয়ে চুপ করে গেল।
কিছুক্ষন পর ওই ভদ্রলোক আবার কয় , আমাকে শ্যামলী নামিয়ে দিবি ব্যাটা। পিচ্চি পাইসে সুযোগ, সে পুনরায় দাঁতের দোকান দেখায়ে কেলাইতে কেলাইতে কয়, " আমি আফনারে কেমতে নামামু? আমি তো আফনারে কোলেই উডাইনাই" !!!
এক বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যায় প্রচন্ড ভিড় বাসে। তাও জায়গায় জায়গায় বাস থামিয়ে লোক উঠাচ্ছে হেল্পার। পাবলিক গালাগাল দিলেও এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে। এক লোক বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে বলে,এহ, হারামি বান্দরের দল, সিটিং বাস তো না,ফিটিং বাস,কত বেশি লোক ফিটিং করা যায় বাসের ভিতরে,নাকি? এই কথা শুনে পিচ্চি হেল্পার বলে, এহ, নিজে ঝুইলা আছে বান্দরের লাহান,আর আমারে কয় বান্দর !
মোহাম্মদপুরের এক বাসে, এক লোক ছেলেকে নিয়ে হন্তদন্ত করে উঠল, বাস ছেড়ে দিচ্ছিল দেখে তাড়াহুড়ায় গেটের মুখের সিটে বসা দশাসই এক মহিলার পায়ে ব্যথা দিয়ে ফেলসে। সাথে সাথেই মহিলার চিল চিৎকার, চোখের মাথা খাইসেন? আমার পা দেখতে পারেন নাই? ( যদিও উবু না হইলে উনার পা দেখা মোটামুটি অসাধ্য ব্যাপার) ।লোক টা মিনমিন করে বলে,সরি,আসলে তাড়াহুড়া করে উঠতে গিয়ে এইরকম হইসে,সরি। মহিলা কিসের কি! সমানে ঝাড়তে লাগল। ঝাড়ির সারমর্ম হইল,উনার পা দেখতে না পাওয়ার মানে লোকটা আন্ধা আর না হয় পা মাড়াইছে ইচ্ছা করে ! লোকটা আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ মহিলার পিছের সিটে বসে পড়ল ( বাধ্য হয়ে, আর সিট খালি ছিলনা )
একটু পর বাসে হকার উঠল। "দাজ্জাল চিহ্নিত হয়েছে" এই নামের একটা বই হাতে নিয়ে হকার প্রাণপণ চেষ্টা করতেই থাকল পাবলিক কে বিশ্বাস করানোর জন্য যে, এই বই এর প্রতিটা অক্ষর সত্যি। লোকটার ছেলে হঠাৎ বাপ কে জিজ্ঞেস করল,বাবা "দজ্জাল" কি? লোকটা মনে হয় ছিল খুব রসিক, কি ভেবে আঙ্গুল দিয়ে সামনের সিটে বসা মহিলা কে দেখায়ে দিল ! পিচ্চি টা আর অতশত বুঝে নাই, জোরে জিজ্ঞেস করল, বাবা বাবা, এই আন্টিটা দাজ্জাল? এই কথা শুনে বাসে যেন বোমা ফাটল।পাবলিক মিছেমিছি কিছুক্ষন হাসি চাপার চেষ্টা করে একসময় সংক্রামক ব্যাধির মত হাসি ছড়িয়ে পড়ল । হাসি ছাপিয়ে শোনা গেল ওই মহিলার চিল চিৎকার, " কি!! এত বড় কথা, নির্লজ্জ বেহায়া লোক.................."
"দাজ্জাল" আসলেই আবির্ভূত হয়েছে কিনা জানিনা, তবে "দজ্জাল" যে বহু আগে থেকেই কতগুলো নিরীহ মানুষের জীবন তেজপাতা বানায়ে রাখসে তা বুঝতে বাসের আর কারো বাকি থাকল না ......