somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধুলোপথ আর কৃষ্ণচূড়া - প্রথম পর্ব

২৮ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ৯:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পিছনের বেঞ্চে বসে হঠাৎ লিনার মাথায় শয়তানির ভুত চাপল। যদিও বলাই বাহুল্য, পিছনের বেঞ্চে একটা মাহাত্ম্য আছে।নিপাট ভ্যাবলাকান্ত গুড বয় ওখানে বসলেও মনটা যেন উড়ু উড়ু করে। খুব সুন্দর করে জৈব রসায়নের নীরস চ্যাপ্টার আমাদের খুপড়িতে ঢুকানোর মহৎ উদ্যোগে ব্যস্ত নাহিদ ভাই বোর্ডে কি যেন লিখছেন। লীনা হাই তুলতে গিয়েও বোয়াল মাছের মত হা করা মুখটা বন্ধ করে ফেলে। ওর চোখ অনুসরণ করে নিপা তাকায়ে দেখে , তার ট্রান্সপারেন্ট ফাইলে রাখা মোবাইলের দিকে ওর নজর। কোচিং এর ভাইয়া পিছন ঘুরে লিখছে বোর্ডে, এই সুযোগে লিনা থাবা মেরে মোবাইলটা হাতে নেয়, নিপার মোবাইল আবার সবসময় সাইলেন্ট থাকত। ওই আশিক বানায়া অথবা ধুম মাচালে রিংটোন নাকি ওর অসহ্য লাগত। আর কীপ্যাডের পুকপুক তো নাকি আরও বিশ্রী। এতে লিনার আরও সুবিধাই হয় বরং।এক হাতে মোবাইলটা বেঞ্চের তলায় নিয়ে সামনে দাঁড়ানো ভাইয়ার নাম্বার এ মিসকল দেয়। দেখি, ভাইয়া কিছুক্ষণ ভাইব্রেশন হজম করে, কলটা কেটে যায়। লিনা তো নাছোড়বান্দা। আবার দেয় কল। এবার ভাইয়া মোবাইলটা বের করে। যেই দেখে ভাইয়া রিসিভ করতে যাবে, অমনি লিনা কল টা কেটে দেয়।


এরপর নিপার ফ্রেন্ড গুলার রুটিন হয়ে যায় ক্লাস নিতে আসা ভাইয়াদের মোবাইলে নিপার মোবাইল থেকেই মিসকল দেয়া। কোচিং এর প্রসপেক্টাস থেকে ভাইয়াদের নাম্বার কালেক্ট করত ওরা । বেচারা নিপা যতই গাইগুই করত,ফ্রেন্ডরা আরো বেশি করে করত। সেই সময় বাকি সবার মধ্যে ওই সবেধন নীলমণি যার পারসোনাল মোবাইল ছিল, তার কারণ ও হোস্টেলে থেকে অ্যাডমিশন কোচিং করত, বাসায় যোগাযোগের জন্য মোবাইল না রেখে কোন উপায় ছিল না।


কিছুদিন যেতে না যেতেই নিপা অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা কল ,মিসকল আর মেসেজের জ্বালায় অতিষ্ঠ। এক্কেবারে নিপাট ভাল মানুষ নিপা শয়তানের হাড্ডি ফ্রেন্ড গুলার জ্বালায় গ্যাঁড়াকলে পড়ছে ! মন মেজাজ খারাপ থাকলে কাউরে রামঝাড়ি দিয়ে কল কেটে দেয় আর না হয় মন মেজাজ ভালো থাকলে রং নাম্বার বলে রেখে দেয়। যতক্ষন কোচিং এ থাকে ওর ফ্রেন্ডরা পালাক্রমে ঝাড়ি প্র্যাক্টিস করে নিপার মোবাইলের অপরিচিত কলার দের। এই আজাইরা কলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নিপার মনে মনে গালাগাল দিয়ে দোস্তদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করা ছাড়া আর কিছু করার ছিলনা।


একদিন নিপার এমনিতেই কি জন্য যেন মেজাজ গরম। ঠিক সেইসময় একটা কল আসল । সে কল রিসিভ করেই ওইপাশের কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলতে থাকল , গরু, গাধা, উল্লুক, শিম্পাঞ্জি খাইয়াদাইয়া কাম কাজ নাই? মাইয়ামাইনশের গলা শুনার জন্য জান আতিপাতি করে? দিন নাই,রাত নাই আজাইরা প্যাঁচাল , আর যদি কল দিসেন , খবর আছে কইলাম ! এইরকম রাম ধমক খেয়েই কি জানি ওপাশের ছেলেটা বলল, সরি , আমরা কয়েকজন বন্ধুই আপনাকে পালাক্রমে ডিস্টার্ব করতাম, আর এরকম হবেনা,আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল,তারপরে দুয়েকটা খুচরা যন্ত্রণাদায়ক কল আসলেও আগেকার ওই নাম্বারগুলা থেকে আর কল আসেনি। সপ্তাহখানেক পর সেই মহৎ ছেলেটা আবার একদিন কল করে জিজ্ঞেস করল নিপাকে যে আর কেও বিরক্ত করেছে কিনা। কৃতজ্ঞতার কারণেই কিনা ,নাকি ছেলেটার কথার মাঝে এমন একটা দৃঢ়তা ছিল, নিপা আর কোন খারাপ ব্যবহার করতে পারেনি। কথা বলেছে টুকটাক ,এই পরিচয়পর্ব যেমন হয়। পরের সপ্তাহে ঠিক একইদিন সন্ধ্যাবেলা শিপলুর কল। ও ভুলেই গেছি বলতে, ওই ছেলের নাম শিপলু,নিপার বছর চারেকের সিনিয়র। ঢাকায় থাকে, কোন একটা ভার্সিটিতে পড়ে। এইভাবে আস্তে আস্তে শিপলুর কলের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর কল আসলে নিপার ভয়েস মিষ্টি হতে থাকে। তারপর যা হয় আর কি ! ডিজুস যুগের মোবাইল প্রেম ! সারাদিন মেসেজ ,ক্লাসের ফাঁকে মোবাইল বের করে লাজুক লাজুক হাসি আর গভীর রাত পর্যন্ত ফোন ওয়েটিং !ফ্রেন্ডরা হতাশ হয়ে ভাবত ,নাহ নিপাটা গোল্লায় গেল । পুরোপুরি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে ......


এরপর আসল দেখা করার দিন। নিপার তো চরম নার্ভাস অবস্থা। ফোনে যতই পকপক করুক না কেন সারাদিন, সামনাসামনি কি বলবে এটা কোনভাবেই ভেবে পাচ্ছিল না । আবার চুপ করে থাকলেও যদি অহঙ্কারী ভাবে! ফ্রেন্ডদের কথাবার্তায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে নিপা "যা হয় হবে" ভাব নিয়ে চলে গেল পার্কে। আশপাশে তাকিয়ে পার্কের লোকজন দেখে একবার ভাবল ,পালাই। আবার কি মনে করে কোণার দিকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচের বেঞ্চে টুপ করে বসে পড়ল আর পা নাচাতে থাকল , বেশি টেনশন করলে ও আবার অনবরত পা নাচাতে থাকে আর দাঁত দিয়ে নখ কাটে। হঠাৎ শুনে একটা গলা, "ব্রেকফাস্ট করনি? নখ খাচ্ছ যে !" মুখ তুলে নিপা দেখে,অসম্ভব মায়া মায়া চেহারার একটা ছেলে দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।


চুল,দাঁত ,নখ,হাত ,পা চেহারা কিছুই ভাল করে খেয়াল করেনি নিপা। গাছের নিচে পড়ে থাকা অসংখ্য ধুলোমাখা লাল কৃষ্ণচূড়ার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা শিপলু কে দেখে তার একটা কথাই মনে হয়েছিল, প্রথম দেখা তো কি হয়েছে ! অনেক অনেক কাল আগে থেকেই এই ছেলেটা শুধু তার !মুখ ফুটে কেও কাউকে বলেনি "ভালবাসি তোমায়" কিংবা হাটু গেঁড়ে একগুচ্ছ লাল গোলাপ বাড়িয়ে বলেনি, " তুমি কি আমার হবে?" কিছু কথা হয়ত বলা লাগেনা, এতটাই গভীর যে এই কথা শুধু বুঝে নিতে হয় ।


দুয়েক সপ্তাহ পরপর ই শিপলু ছুটে আসত ঢাকা থেকে। একবার কিসের জানি অবরোধ ছিল। রাস্তায় নেমে কোন গাড়ি না পেয়ে অসম্ভব মন খারাপ হয় শিপলুর। কিন্তু নিপার সাথে দেখা করবে বলে বেরিয়েছে,তাই যেভাবেই হোক পৌঁছাবেই সে নিপার কাছে ,দরকার হলে সারাদিন পায়ে হেঁটে হলেও পৌঁছাবে। অবশেষে রিকশা, ভ্যান,টেম্পু, ইত্যাদি দিয়ে আড়াই ঘন্টার পথ পাঁচ ঘন্টা লাগিয়ে শিপলু পৌঁছায় । শিপলুর মুখে কোন ক্লান্তির ছাপ নয়,বরং যুদ্ধ জয়ের একটা প্রশান্তি দেখেছিল নিপা সেদিন।


যথাসময়ে এডমিশন টেস্টে পার পেয়ে গেল নিপাটা এবং গাট্টি বোঁচকা নিয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে হলে আস্তানা গাড়ল। কিন্তু প্রথম মাসটা হলে উঠতে পারলনা। সিটটা যেই সিনিয়রের,উনি নাকি একমাস পর হলের মায়া ত্যাগ করবেন,তাই বাধ্য হয়ে নিপা ওই এক মাসের জন্য খালার বাসায় উঠেছিল। প্রথম যেদিন ভার্সিটিতে যাবে,কিচ্ছু চেনেনা ঢাকার ।এত্ত বড় মেয়ে একা ভার্সিটি চিনে নিতে পারবেনা এটা খালা বা খালাত ভাই কাউকেই লজ্জায় বলতে পারল না ।রিকশা চেপে ঢাকা ভার্সিটিতে পৌঁছে গেছিল ঠিকঠাক , যদিও প্রথম দিনেই লেট ক্লাসে। কিন্তু ফেরার সময় এ গলি ,ও গলি ঘুরে শেষ পর্যন্ত আর খালার বাড়ির গলি চিনতে পারলনা। কেমন যেন অসহায় লাগতে লাগল নিপার। একে তো সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে,তার উপর নতুন জায়গা এমনিতেই ভয় ভয় লাগে। খালার বাসায় ল্যান্ডফোনে কয়েকবার কল দিল কিন্তু কেও ধরলনা। অবশেষে শিপলু কে কল দিল ।

আধা ঘণ্টা ধরে জবুথবু হয়ে নিপা দাঁড়িয়ে ছিল ফুটপাতের মাঝখানে,অনেকেই কৌতূহলী হয়ে বারবার তাকাচ্ছিল। দিশেহারা হয়ে যখন দরদর করে ঘামছিল,দূর থেকে শিপলুকে আসতে দেখে ওর মনে হয়েছিল, তার আর কোন চিন্তা নেই, পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে চোখ বন্ধ করে হারিয়ে গেলেও এই মানুষটা তাকে খুঁজে বের করে ফেলতে পারে ।


কিছুক্ষন আগেও বাড়ি ফেরার জন্য উতল হওয়া নিপার শিপলুর হাতটা ধরে হঠাৎ মনে হল, কি আসে যায় এক মানবীর প্রেমে পরাজিত হয়ে একদিন সন্ধ্যা টা যদি রাতের পথ ভুলে বিকেলে মুখ লুকায়......


পরের পর্ব

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:৪৭
৩২টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঘরে ফেরার টান

লিখেছেন স্প্যানকড, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৬:৩১

ছবি নেট।

তুমি মানে
সমস্ত দিনের ক্লান্তি শেষে
নতুন করে বেঁচে থাকার নাম।

তুমি মানে
আড্ডা,কবিতা,গান
তুমি মানে দুঃখ মুছে
হেসে ওঠে প্রাণ।

তুমি মানে
বুক ভরা ভালোবাসা
পূর্ণ সমস্ত শূন্যস্থান।

তুমি মানে ভেঙ্গে ফেলা
রাতের নিস্তব্ধতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বজলুল হুদাকে জবাই করে হাসিনা : কর্নেল (অব.) এম এ হক

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৯

মেজর বজলুল হুদাকে শেখ হাসিনা জবাই করেছিলেন।

(ছবি ডিলিট করা হলো)

শেখ মুজিবকে হত্যার অপরাধে ২৮শে জানুয়ারী ২০১০ এ মেজর (অব.) বজলুল হুদা সহ মোট ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মি. চুপ্পুর পক্ষ নিয়েছে বিএনপি-জামাত; কারণ কী?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬


বিএনপি গত ১৬ বছর আম্লিগের এগুচ্ছ কেশও ছিড়তে পারেনি অথচ যখন ছাত্ররা গণহত্যাকারীদের হটিয়েছে তখন কেন বিএনপি চু্প্পুর পক্ষ নিচ্ছে? অনেকেই বলছে সাংবিধানিক শুন্যতা সৃষ্টি হবে তার সংগে বিএনপিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×