somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধুলোপথ আর কৃষ্ণচূড়া - দ্বিতীয় পর্ব

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধুলোপথ আর কৃষ্ণচূড়া - প্রথম পর্ব


শেষ ক্লাসের প্রতিটা মিনিট নিপার কাছে দীর্ঘ মনে হয়, যেন বুড়ো ঘড়ির কাঁটা ধুঁকে ধুঁকে চলে। ক্লাস শেষ হতেই এক ছুট , শিপলুর হাত ধরে হারিয়ে যাওয়া, স্বপ্নে ডুবে যাওয়া ঘণ্টা দুই তিনেক, কোনদিন কার্জন হল,কোনদিন টি এস সি, একেক দিন একেক বই কেনার জন্য নিউমার্কেট ,নীলক্ষেত ,আবার কোনদিন ফুলার রোড । বিকেলগুলো সন্ধ্যা হয় এক নিমেষেই, তড়িঘড়ি এক ছুট হলের পথে ......স্বপ্ন দেখার অবসরে মান অভিমান,ঝগড়াঝাঁটি, খুনসুটি সবই চলে ।এর মাঝে অন্য কোন চিন্তা কেন যেন ঠাই পায়না। পরস্পরকে ঘিরেই চলে ওদের আবর্তন।


দেখতে দেখতে কিভাবে যেন মাস ছয়েক দুম করে শেষ হয়ে যায়। নিপা হঠাৎ করে খেয়াল করে বাইরের দুনিয়ার সাথে তার সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। আর পড়াশুনা ! পড়াশুনার সাথে তার সম্পর্ক এখন সাপে নেউলে টাইপ। একটু পড়তে বসলেই সারাক্ষন স্বপ্নের রেলগাড়ি এসে মনের স্টেশনে হুইসেল বাজায়। কিন্তু এটা চিন্তা করা পর্যন্তই ! নতুন করে বইয়ের সাথে সখ্যতাটা আর গড়ে ওঠেনা । এমন কি এতদিন ভার্সিটিতে ক্লাস করে একটা কাছের বন্ধু পর্যন্ত হয়নি নিপার। আসলে সেই প্রয়োজনীয়তাটাই কখনো অনুভব করেনি সে। দুম করে একটা কুচিন্তা মাথায় আসে নিপার। কোন কারণে শিপলু নিপাকে ছেড়ে গেলে পুরোপুরি একা হয়ে যাবে সে , এই ভয়াবহ চিন্তাটা আর বেশিদুর শিকড় ছড়াতে দেয়না সে। শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে লাভ নাই। তাই অনেক কিছু ভেবে ওরা দুজন ঠিক করে ,এখন থেকে ঘুরাঘুরি কম আর পড়াশুনায় একটু মন দিবে আর অন্যান্য বন্ধুদের সাথে তাল না মিলিয়ে লাইফের বেস্ট সময়টুকু, ভার্সিটি লাইফটা পানসে করার মানে হয়না । প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে একটা রুটিনের মাঝে আসে ওদের লাইফ। রাত জেগে কথা এখন অনেক কম।

বেশিরভাগ দিন নিপা রাতে শিপলুকে ফোন দিয়ে দেখে হয়ত শিপলু ঘুমাতে যাচ্ছে অথবা ঘুমিয়ে পড়েছে। শিপলুর সামনে ফাইনাল পরীক্ষা দেখে নিপা আর এতে মুখ হাঁড়ি করে বসে থাকেনা।ভাবে,হয়ত সারাদিন ল্যাব,ক্লাস,পড়াশুনা,থিসিস ইত্যাদি নিয়ে অনেক ক্লান্ত,তাই রাতে ঘুম পাওয়াটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে যে অভিমান হয়না,তা না কিন্তু নিজের মন কে বোঝায় নিপা। শিপলু টাও কেমন যেন বদলে গেছে! কয়েক সপ্তাহ দেখাই হয়না তাদের। অনেক চাপে আছে ,এইজন্য হয়ত বা । শিপলুর চেহারা দেখলেই বুঝা যায়,কেমন শুকিয়ে গেছে,আর আগের মত নিজের যত্ন ও করেনা। এমনকি,আত্মসম্মানবোধ টনটনে যেই শিপলু জীবনেও রিকশা ভাড়া টা নিপা কে দিতে দেয়নি,সেই শিপলু সেদিন নিপার কাছ থেকে হাজার খানেক টাকা ধার করেছে। অবশ্য সেদিন শিপলুর মন মেজাজ ও অনেক খারাপ ছিল। বিনা কারণে একটা ধমক খেয়েছে নিপা।কি জানি,কি হয়েছে কিছুই বলল না শিপলু।


সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে নিপা শিপলুর ব্যাবহারে আকাশ পাতাল ফারাক খুঁজে পায়। এখন আর এটাকে পরীক্ষার ব্যস্ততা বলে উড়িয়ে দিতে পারেনা , বেশ কদিন ঝগড়াঝাঁটি হয় কিন্তু যেই কি সেই। শিপলু নিজের খেয়াল খুশিতেই চলতে থাকে। বিষাদ ভর করে নিপার মনে। অনেক ভেবে সে ঠিক করে শিপলুর রুমমেট নাহিদ ভাইয়াকে কল দিবে। কাজটা ঠিক হবে কিনা এটা ভেবে দোনামনা করে অবশেষে নাহিদ ভাইয়া কে কল দিয়ে ভুমিকা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে শিপলুর কি হয়েছে। নাহিদ ভাইয়া প্রথমে গাইগুই করলেও পরে যা জানায়,তা শুনে নিপার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কিছুদিন আগে শিপলু তার বড় আপার বাসায় গিয়ে একটা ভয়াবহ কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। শিপলুর দুলাভাই অনেক আগে থেকেই তার আপাকে মারধোর করত। কিন্তু তার আপা কখনো বাড়িতে অথবা শিপলুকে এই কথা জানতে দেয়নি। কিন্তু ওইদিন ঘটনাক্রমে তার দুলাভাই আপাকে মারধোর করার সময় শিপলু গিয়ে হাজির হয়। আপার ওইরকম বীভৎস অবস্থা দেখে সে আর মাথা ঠিক রাখতে পারেনা। দুলাভাইকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে মারতে থাকে। তার আপা আর আশেপাশের লোকজন জোর করা থামায় তাকে। এখনো তার দুলাভাই হাসপাতালে, সরাসরি বলেই দিয়েছে তার আপার সাথে সংসার করা সম্ভব না আর। সেদিনের পর থেকে শিপলুর বাবা,মা ,আপা কেউ তার সাথে একটা বাক্য বিনিময় তো দুরেরে কথা , বাবা বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। অনেকবার ভেবেছে শিপলু দুলাভাই নামক পশুটার কাছে গিয়ে হাতেপায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে কিন্তু ওই পশুটার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর রুচি হয়নি। তারপর থেকে সবসময় বিষণ্ণ থাকে শিপলু। মাঝে শিপলু সবকিছু নিপাকে খুলে বলবে ভেবেছিল কিন্তু নিপার চোখে একটা অযোগ্য ভাই কিংবা অযোগ্য সন্তানের সীল এঁটে যাওয়া শিপলুকে তুলে ধরতে চায়নি। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে হলের কিছু ছাত্র নামধারী কুলাঙ্গার। শিপলু কিছুদিন হল পা বাড়িয়েছে নেশার পথে !!


নাহিদ ভাইয়া আর কি বলে কিছুই কানে ঢোকেনা নিপার। নিপার জগত তখন পুরাই অন্ধকার। কি করবে ভেবে পায়না নিপা। নিজের পরিবারের কথা ভাবে, বাড়িতে জানলে শিপলুকে মেনে নেয়া তো দূরের কথা নিপাকেই ত্যাজ্য করে দেবে এক কথায়।নিপার আরো অভিমান হয় যে,শিপলু কিভাবে এতদিন এই কথাগুলি গোপন রেখেছে।শিপলুর কষ্টগুলো নিপার চেয়ে আর ভাল কে বুঝবে ! প্রচন্ড অভিমান আর রাগে দুঃখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় নিপা শিপলুর সাথে দেখা করে জানতে চায়,এটা কেন করল সে । ছিঁচকাঁদুনে নিপা সেদিন কিভাবে এত মানসিক শক্তি পেয়েছিল কে জানে, একফোঁটা কাঁদেনি শিপলুর সাথে কথা বলার সময়। শিপলুকে সময় দিয়েছিল সে ২ সপ্তাহের জন্য। এর মাঝে শিপলু নেশা ছেড়ে দিতে পারলে ভাল,নয়ত চিরদিনের জন্য হারাতে হবে নিপাকে। নিশ্চুপ শিপলু কোন কথা খুঁজে না পেয়ে মাথা নিচু করে চলে যেতে থাকে আর নিপার কেন যেন মনে হয়, আর কোনদিন এই মানুষটা ফিরে আসবেনা। অদম্য একটা ইচ্ছা হয় দৌড়ে গিয়ে শিপলুর হাতটা ধরে বলার, আমি মিস্টার পারফেক্ট চাইনা, শুধু চাই একটা জীবন হেলায় অথবা ভালবাসায় তোমাকে ভালবেসে কেটে যাক...


সময়টা তখন রাত বলেই কিনা,শিপলু নিপার কথার গুরুত্বটা বুঝতে পারেনা, নেশায় চুর মস্তিস্ক এক রমনীর ভালবাসাকে ছুড়ে ফেলার জন্য হয়তবা পথ খুঁজে পায়। দিন গোনে নিপা,কবে যে হুট করে শিপলু এসে চমকে দিয়ে বলবে ,তোমার জন্য আমি সব ছেড়ে দিয়েছি!! কল্পনার মায়াজালে শুধু আটকে পড়ে বের হবার জন্য,একমুঠো শ্বাস নেবার জন্য ছটফট করে।


শিপলুর সাথে কথা হয়না নিপার ২১ দিন। এই দিনগুলা নিপার জীবনের ভয়াবহতম দিন।বারবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে শিপলুর নাম্বার ডায়াল করতে ইচ্ছে হত।এই ইচ্ছে টা দমন করতে কি যে ভয়াবহ কষ্ট! এই কয়দিনে একা একা রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে, ক্যাম্পাসে গিয়ে নিপার মনে হয়েছে সে পঙ্গু।শিপলু ছাড়া তার অস্তিত্ব অপূর্ণ। এই ঢাকার অলিগলিতে তাদের দুজনের পদচিহ্ন । যেখানেই গিয়েছে নিপা, তার পাশে শিপলু থাকবেনা এটা ভাবতেই একটা হাহাকার গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠেছে। একবার ভাবে নিপা,কি আসে যায় এত ছোট্ট একটা জীবন নিজের মত করে শিপলুর সাথে কাটিয়ে দিলে !সে কিভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারল! যেই মুহূর্তে শিপলুর জীবনে নিপাকে সবচেয়ে বেশি দরকার পাশে,সেই মুহূর্তে নিপা তাকে একা দূরে ঠেলে দিয়েছে! কি অকৃতজ্ঞ সে, ভালবাসার মানে কি এই !


অবশেষে হার মানে নিপা, বিকেলবেলা কল করে শিপলুকে। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলে,এক্ষুনি আমার সাথে দেখা কর। কিছুক্ষন পর কার্জন হলের পাশে পুকুরটার পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা শিপলুকে দেখতে পেয়েই নিপা এক ছুটে বুভুক্ষুর মত জড়িয়ে ধরে। আশপাশে কে আছে এটা আর খেয়াল থাকেনা।এতদিনের জমানো কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে যায়। প্রথম যে কথাটা নিপার মুখ থেকে বের হয়- স্টুপিড, আমি বলেছি বলেই আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিতে হবে !!! মাথায় এতটুকু ঘিলু নাই? গাধা, হাঁদারাম, গরু .........



অজস্র গালাগাল দেয়া শেষ না করেই শিপলুর মুখের দিকে তাকাতে একটা দৃশ্য ফের মনে পড়ে যায় নিপার। বছর খানেক আগে শিপলুকে প্রথম দেখার দিন এইভাবেই শিপলু এসে দাঁড়িয়েছিল কৃষ্ণচূড়ার নিচে, সেদিন ও পথের ধুলো মেখে কৃষ্ণচূড়ার রং হয়েছিল একটু ফিকে ......সেদিন শুরু হয়েছিল ভালবাসার প্রথম অধ্যায় আর আজ বোধ হয় দ্বিতীয় অধ্যায় ......

৩০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×