অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখক তাসলিমা নাসরিন এক সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন নিয়ে কিছু মন্তব্য করায় বাংলাদেশের হুমায়ূন ভক্তরা খুব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের নাকি তাসলিমা অশিক্ষিত বলে হেয় করেছেন ইত্যাদি। তাতে হুমায়ূনের শিক্ষিত পাঠকরা খুব মাইন্ড করেছে। মাইন্ড তারা করতেই পারে। “বেদের মেয়ে জোসনা” কেন এই দেশে হিট হলো তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকতেই পারে, কিন্তু “বেদের মেয়ে জোসনা” যে হিট করেছিল তাতে তো কোন সন্দেহ নেই। হুমায়ূনেরও অতখানি পাঠক না থাকলে তাসলিমা আগ বাড়িয়ে তার পাঠক নিয়ে কথা বলতে যাবেন কেন। হুমায়ূন পাঠক নন্দিত। তার জনপ্রিয়তা প্রবাদপ্রতিম। কিন্তু হুমায়ূন আসলে কাদের জন্য লিখেছেন?
সাহিত্য পড়ার জন্য একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন নেই। তাসলিমা খুব সম্ভবত একাডেমিক শিক্ষার কথা এখানে বুঝাননি। শিক্ষার কথা বললেই আমার সবাই ধরে নেই কে কতটা পাশ দিয়েছে তার তালিকা। এটাও একজন অশিক্ষিত মানুষের লক্ষণ। প্রতি বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরকম প্রচুর অশিক্ষিত ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসে যারা সার্টিফিকেটধারী অশিক্ষিত। তারাই আসলে তাসলিমার কথায় বেশি ক্ষেপেছেন।
হুমায়ূন তার পাঠকের কাছেও কি পরিমাণ ধরা ছিলেন এর কয়েকটা উদাহরণ দেই। তিনি জানতেন খুব বেশি পৃষ্ঠার বই তার পাঠকরা দেখলে আঁতকে উঠবে। তাই তিনি ৭০-৮০ বড়জোর ৯০-১০০ পৃষ্ঠার মধ্যে একটা লেখা শেষ করতেন। এগুলো না হতো উপন্যাস, না গল্প। এটা যে তিনি একা করতেন তা না। বাংলাদেশের হুমায়ূনের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম জনপ্রিয় ইমদাদুল হক মিল, আনিসুল হক, জাফর ইকবালরা করে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে সুনীল, সমেরেশ, শীর্ষেন্দুদের দুই-আড়াশো পৃষ্ঠার বই আকছার বেরুচ্ছে। হুমায়ূন প্রবাদতুল্য জনপ্রিয়তম লেখক কিন্তু বই বের করতে হয় পাঠকের মুখ চেয়ে, ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না। তার “জোসনা ও জননীর গল্প”র বিক্রি “আজ জরিনার বিয়ে” টাইপের বই থেকে অনেক কম। এর কারণ কিন্তু অর্থ নয়। একজন বিপুল জনপ্রিয় লেখকের বেলায় যদি পাঠকের ক্রয় ক্ষমতার কথা বলা হয় তাহলে তাকে প্রবাদতুল্য বলা চলে কিভাবে। সুনীল-সমরেশের ঢাউস বই বেরুবার সাত-আট ঘন্টার মধ্যে ফুঁরিয়ে গেছে এমন ঘটনা প্রচুর ঘটেছে। বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের এমন রেকর্ড নেই। এটা বলে হুমায়ূন উল্লেখিত লেখকদের চেয়ে কম জনপ্রিয় বলছি এটা যেন কেউ না ভাবে। হুমায়ূনও যে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়েও বাংলাদেশী বইয়ের বাজারের শিকার ছিলেন সেটাই এখানে বুঝানো হয়েছে।
হুমায়ূনের দীর্ঘ লেখক জীবনে দীর্ঘ কোন উপন্যাস আমরা পাইনি। বড় ক্যানভাসের কোন রচনা আমরা পাইনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও তার লেখা অতান্ত পীড়াদায়ক। কয়েকটা রোমান্টিক মুক্তিযুদ্ধের লেখা লিখা ছাড়া এক্ষেত্রে তার অবদান তেমন কিছুই নেই। তার ভক্তরা এসব ক্ষেত্রে “জোসনা ও জননীর গল্প” উপন্যাসের কথা বলেন। কিন্তু এটা এই কিংবদন্তিসম লেখকের নিজের জন্য সেরা লেখা হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের উপর সেরা কিছু কি?
হুমায়ূন স্বাধীনতা বিরোধী কাগজে লিখতেন। তিনি ইনকিলাবের মালিকানায় সাপ্তাহিক পূর্ণিমায় উপন্যাস দিয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এই নিয়ে হুমায়ূনকে তাঁর ক্ষোভ জানিয়েছিলেন। হুমায়ূন নিজেই সেকথা তার লেখায় স্বীকার করেছেন। এ ব্যাপারে নাকি হুমায়ূনের নিজের কি ব্যাখ্যা আছে। তিনি অবশ্য সে ব্যাখ্যা প্রকাশ করেননি। কাজেই আমরা সেই মহান ব্যাখ্যা আজ আর জানতে পারবো না। তার ছোট ভাই লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে লক্ষ কোটি টাকা দিলেও বোধহয় স্বাধীনতা বিরোধীদের কাগজে লেখাতে পারবে না।
হুমায়ূন একটা প্রজন্মকে সঙ্গে পেয়েছিলেন যাদের তিনি যা গেলাতেন তারা তাই গিলতো। তিনি সেই প্রজন্মকে যতটা বাংলাদেশকে চেনাতে পারতেন তা করেননি। তিনি রাজনীতি থেকে শত হাত দূরে থেকেছেন। তার লেখায় সেটা স্পষ্ট। একটা প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, উদাসিন হয়ে যাচ্ছে, উদ্ভট সব তথ্য বিশ্বাস করছে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে হুমায়ূন তখন বৃষ্টি বিলাস, সমুদ্র বিলাস, নীল জোসনা, গোলাপী পায়জামা লিখে তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। হুমাযূন আজাদ “পাক সাদ জমিন সাদ বাদ” লিখে সাঈদের রোষানলে পড়ে রাস্তায় তার ছেলেপুলের হাতে চাপাতির কোপ খান। আজাদের হুমাযূনের মত এত বিশাল ভক্তকূল ছিল না। বই মেলায় আজাদ একা একাই বসে থাকতেন। তার জন্য পুলিশি প্রহরার প্রয়োজন হয়নি কখনো। কিন্তু হুমায়ূন ফ্লিমি স্টারদের মত জনপ্রিয় ছিলেন এইদেশে। কেন তিনি আজাদের মত উপন্যাস লিখে তার ভক্তকে, একটা চৌকস, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রজন্মকে তাদের শক্রুদের চেনাতে সাহায্য করলেন না? শেষ বয়েসে এসে “দেয়াল”-এর মত উপন্যাস লেখা আসলে কোন আজেই আসেনি। কারণ ততদিনে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সবাই যোগ্য শাস্তি পেয়ে গেছে। হুমায়ূনের পাঠকরাও ততদিনে বুড়ো শালিক হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধুকে তারা আ্ওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি দৃষ্টিতেই দেখতে শিখেছে। জামাতীদের মধ্যেও বিপুল পরিমাণে হুমাযূন ভক্ত আছে। কারণ হুমায়ূনে খুব একটা এ্যালার্জি তাদের হয় না। যেটা জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে কখনোই সম্ভব নয়। জামাত-শিবির তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে রেখেছে অনেক আগেই।
শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের আরেক জনপ্রিয়তম লেখক। তাঁর জনপ্রিয়তার গল্পও কিংবতির মত প্রচলিত আছে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, শরতের ভক্তকূল যারা শরতের নায়কের মত নিজেকে মনে করতো তারা জাতপাতকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে চাইতো কারণ শরতের লেখায় সেই নির্যাসটা ছিল। হুমাযূনের লেখা পড়েও তার পাঠককূল এভাবে নিজের মধ্যে মুক্তচিস্তা, যুক্তিবোধ ধারন করতে পারতো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে হুমায়ূনের মিসির আলী শেষ পর্যন্ত অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে মিমাংসা করতে পারতো না। কারণ জগৎ রহস্যময় বলে! তিনি নাইকো ক্যামেরার মধ্যে ঈশ্বর অস্তিত্বের থিউরি পেতেন। তার পাঠকরা তাহলে আর কোত্থেকে মুক্তচিন্তা আর যুক্তিবাদী হবে? হয়ওনি।