somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খল পরিকল্পনা করে শক্তি খাটিয়ে শৃঙ্খলা আনা যায় না'-অধ্যাপক ড. সামছুল হক

৩০ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি করেছেন। বিশিষ্ট পরিবহন বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতনামা তিনি। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বন্ধ, চালু ইত্যাদি সংকট উত্তরণে পিছু হটেছে সরকার। গণপরিবহনের নৈরাজ্যে সরকারের এমন আত্মসমর্পণের ঘটনা নতুন নয়। নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও জনবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখনও যেন কল্পনার বিষয়।
গণপরিবহনের চলমান সংকট, যানজট, নগর উন্নয়ন এবং পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি সাপ্তাহিক-এর মুখোমুখি হন এই বিশেষজ্ঞ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু



সাপ্তাহিক : রাজধানীর গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিস নিয়ে নানা ঘটনাই ঘটল। কীভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন বিষয়টি?
অধ্যাপক ড. সামছুল হক : সিটিং সার্ভিস নিয়ে সম্প্রতি যা হলো, তা পাগলামির একটি অংশ বলে মনে করি। এই ঘটনা সরকারের জন্য বিব্রতকর।
সাপ্তাহিক : এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। সরকারই উদ্যোগ নেয়, আবার সরকারই পিছু হটে। এর জন্য মূলত দায়ী কে?
ড. সামছুল হক : পেশাদারি লোক না থাকার কারণেই এমনটি হয়ে আসছে। সরকারের মধ্যে কোনো প্রস্তুতি ছিল না। ব্যবস্থাপনা হচ্ছে একটি বিজ্ঞান। ব্যবস্থাপনায় সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণেই বারবার ননসেন্সের (কাণ্ডজ্ঞানহীন) পরিচয় দিচ্ছে।
২০ বছর আগে সিএনজি নিয়ে নানা অভিযানে যে ব্যবস্থা দেখেছি, এখনও তাই দেখছি। ফলাফল কি হবে তা সরকারের লোকেরাও জানেন। এরপরেও লোকদেখানোর জন্য এমন ঘটা করে আয়োজন করা হয়। ‘কিছু একটা করতে পারলাম’ এমন একটি ভাব দেখানোর জন্যই এই ব্যর্থ অভিযান।
সাপ্তাহিক : এখানে পেশাদারি বলতে আসলে কী বোঝাতে চাইছেন? প্রস্তুতিটা কী?
ড. সামছুল হক : গোটা দুনিয়াতেই পরিবহন সেক্টরের জন্য বিশেষ জনবল থাকে। এই জনবলের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, ডক্টরেট করা। তারা পেশাদারিত্বের প্রশ্নেই বিশেষজ্ঞ জনবল নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে এমন পেশাদার জনবল আপনি পাবেন না। পরিবহন সেক্টর নিয়ে কথা বলছেন, অথচ তিনি এই সেক্টরের কেউ নন। বিআরটিএ এবং ডিটিসিএ-তে যারা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছেন, তার গণপরিবহনের জনবল নন।
অর্থাৎ যারা এই সেক্টরের পরিকল্পনা করেছেন, তদারকি করছেন এবং কথিত অভিযান পরিচালনা করছেন, তারা সবাই অপেশাদার বলেই আমি মনে করি। গণপরিবহন বিষয়টা কী, এর চরিত্র কী, এটি কার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং এর সিস্টেম বোঝার জন্য সামগ্রিক জ্ঞানওয়ালা জনবল থাকা দরকার সেটাই সরকার অনুধাবন করতে পারে না।
সাপ্তাহিক : এটি কি কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন?
ড. সামছুল হক : গোটা দুনিয়ায় গণপরিবহন নিয়ে আলাদা ইউনিট রয়েছে। এর নাম-ই হচ্ছে ‘পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ইউনিট’। এই ইউনিটে শুধু একটি প্রোডাক্ট থাকে না। বাসভিত্তিক গণপরিবহন, রেলভিত্তিক গণপরিবহন এবং নৌভিত্তিক গণপরিবহন থাকে। রেলে আবার এমআরটিভিত্তিক গণপরিবহন, লাইটেন ট্রানজিট ভিত্তিক গণপরিবহন, মনো রেলভিত্তিক গণপরিবহনও থাকে।
এদের কোনোটিই আবার পূর্ণাঙ্গ না। এর কারণ হচ্ছে কোনো গণপরিবহনই ডোর টু ডোর সেবা দিতে পারে না। কিন্তু জনগণ চায় ডোর টু ডোর সেবা।
এই চাওয়াটাই বুঝতে পারার ব্যাপার। কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে চাইবে। আর এটি করলেই নিয়ন্ত্রণ আর থাকে না। কারণ রাস্তা বাড়ানো সম্ভব না।
রাস্তার কাঠামো পরিবর্তন না করে অধিক সংখ্যক মানুষকে সেবা দিতে পারাই হচ্ছে সরকারের সার্থকতা। আর তখনই পেশাদার জনবল অস্থির হয়ে ওঠে।
এটি বিআরটিএ-এর বুঝতে পারার কথা ছিল। রাস্তায় ছোট গাড়ি চলছে ৮৪ শতাংশ। বিআরটি-এ পেশাদার লোক থাকলে বলতেন সর্বনাশ হয়ে গেছে, কিছুদিন পর তো রাস্তায় আর কোনো বাস চলতেই পারবে না।
এই হলে অনেকেই ব্যক্তিগত কার কিনে ফেলবে। মানুষ সিএনজিতে উঠবে। অনেকেই মোটরসাইকেল কিনবেন। এ কারণেই বলছি, যখন যা ঘটছে, তা সামাল দেয়ার জন্য অপেশাদার লোক দিয়ে সমাধানের জোড়াতালির চেষ্টা চলছে।
গণপরিবহন নামের আলাদা যদি কোনো বিভাগ থাকত তাহলে পাঁচ বছর পর রাস্তায় কি হবে, তার পরিকল্পনা তারা সাজিয়ে রাখতেন। কোনো আন্দোলনেরও দরকার পড়ত না, আবার অভিযানেরও দরকার পড়ত না। কোথায় কোনো ওষুধ দিতে হবে, তা তারাই ভালো জানতেন।
সাপ্তাহিক : গণপরিবহনের অনেকগুলো ধাপের কথা বললেন। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী কোনটিকে বলবেন?
ড. সামছুল হক : একটি মেগা সিটিতে বাস-ই একমাত্র কার্যকরী গণপরিবহন বলে মনে করা হয়। কারণ এমআরটি বলেন আর বিআরটি বলেন, এটি মেইন করিডরে চলে। কিন্তু বাস অনেকটাই কাছাকাছি জায়গায় আসতে পারে।
এক সমীক্ষায় বলছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ সরকার রিভাইসড এসটিপিতে যে ৭টি আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রচলন করবে, তাতে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ লাগবে। এত বড় বিনিয়োগ করার পরেও সেখানে ১৭ ভাগ সেবা থাকবে এবং বাসে থাকবে ৪০ শতাংশ। এখান থেকেই প্রতীয়মান হয় যে কোনটির গুরুত্বটা বেশি।
যারা এসটিপি নিয়ে আসলেন, তারাও বললেন বাসভিত্তিক যে গণপরিবহন রয়েছে সেখানে জট পাকানো রয়েছে। বাসকে আরও স্বাস্থ্যবান করার তাগিদও রয়েছে।
সাপ্তাহিক : শুধু অপেশাদার জনবলের কারণেই কি এই জট?
ড. সামছুল হক : আমি আপাতত তাই বলব। অপেশাদার জনবলের কারণেই এই জট। বিভিন্ন সেক্টর থেকে ২০ কি ২২ জন লোক ধার করে এনে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি করা হয়। সেখানে মালিক, শ্রমিক, পুলিশ, সাংবাদিকও থাকছেন। এদের কেউই গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ নন। আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। চাইলেই কমিটি রাস্তায় দশটি বাস নামানোর জন্য সুপারিশ করে থাকে।
সাপ্তাহিক : প্রয়োজন, সমস্যা তো যে কোনো নাগরিকের চোখেই ধরা পড়ে। সুপারিশ করতেই পারেন?
ড. সামছুল হক : গণপরিবহন বৈজ্ঞানিক সিস্টেমের ফল। কোন রাস্তায় কোন পরিবহন থাকবে, তার মান কি হবে এগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা থাকতে হবে।
গবেষণা পেপার সরকারের হাতে থাকলে বলতে পারত, কালশীতে একটি নতুন রাস্তা হয়েছে। এর জন্য দৈনিক ৫০টি বাস লাগবে। বাসের মান এমন হতে হবে, বাস অমুক জায়গায় রাখতে হবে, চালক নিয়োগে এই এই যোগ্যতা থাকতে হবে। তখন বড় বড় কোম্পানি এসে টেন্ডার ড্রপ করত। সকল যোগ্যতার মাপকাঠিতে নির্ধারণ করে বাছাইকৃত কোম্পানিকে তখন বলবে, পিকআওয়ারে এই চাহিদা, অফ পিকআওয়ারে এই চাহিদা এবং কিছু জায়গা ধরে বিরতিহীন বাস নামান।
সাপ্তাহিক : তার মানে সিটিং?
ড. সামছুল হক : সকল দেশেই এটি আছে। একটি মোড় থেকে যদি সকল যাত্রী মিলে যায় তাহলে খামাখা রাস্তায় বিরতি দেয়ার দরকার কি? এতে জ্বালানি বাঁচল, যাত্রীদের সময় বাঁচল।
সাপ্তাহিক : বাড়তি বাণিজ্যের সুযোগ তো থেকেই যায়?
ড. সামছুল হক : না। সরকার তো শর্ত দিয়েই তাদের বিরতিহীন সার্ভিসের সুযোগ দিয়েছে। মিরপুর থেকে মতিঝিল বিরতিহীন কয়টি গাড়ি চলবে এবং ভাড়া কত হবে তা সরকারই ঠিক করে দিয়েছে। একইভাবে মহিলা এবং বৃদ্ধদের জন্য স্পেশাল সার্ভিস থাকবে। কতক্ষণ পর পর বাস থাকবে তারও নীতিমালা থাকবে। রাতে কয়টি বাস চলবে সে ব্যবস্থাও থাকবে।
সাপ্তাহিক : রাতে তো যাত্রী মেলে না। শর্তের বিপরীতে বাণিজ্যকে বড় করেই দেখবে কোম্পানি?
ড. সামছুল হক : সব জেনেই তো বিনিয়োগে আসবে। কতটুকু বিনিয়োগ করলে কতটুকু লাভ হবে, তার পূর্ব হিসাব কোম্পানির কাছেও থাকছে। সরকার আর কোনো কোম্পানিকে ওই রাস্তায় বাস নামতে দেবে না। সকল যাত্রী একই কোম্পানির জন্য বরাদ্দ করে দেবে সরকার।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাতের বেলায় যাত্রী পাবে কই? সবসময় সমান লাভ করবে না এমন শর্ত মেনে নিয়েই রুট পারমিট পেয়েছে। সকাল বা বিকেলে অর্থাৎ পিকআওয়ারে যে মুনাফা অর্জন করবে কোম্পানি তা রাতের বেলাতে পুষিয়ে নেবে।
এটি করতে পারলে মালিকও লাভবান হতে পারে এবং যাত্রীরাও সেবা পায়। ঈদের সময় এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসায়ীরা যে লাভ করেন, সারা বছর কিন্তু তা করতে পারেন না। একটি সময়ের জন্যই বসে থাকা।
সকল শর্ত মেনে কোম্পানি যখন রাস্তায় নামবে তখন তারাও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতে কাজ করতে চাইবে। পরামর্শ মতে হয়ত ৫০টির জায়গায় ৪০টি বাস কিনবে। এর মধ্যেই পিকআওয়ারের জন্য দ্বিতল বাস, অফ পিকআওয়ারের জন্য একতলা বাস এবং রাতে চালাবে মিনিবাস।
ব্যবসার স্থিরতা থাকলে কোম্পানি তখন ধ্যান-জ্ঞান দিয়ে আরও বুঝতে চেষ্টা করবে। সকল শর্ত মেনে যাত্রীর সেবাও নিশ্চিত করতে পারবে আবার নিজের লাভও করতে পারবে।
শর্ত মানলে ফের রুট পারমিট পাবে। নইলে ফের টেন্ডার হবে।
সাপ্তাহিক : একাধিক কোম্পানি থাকলেও এখনও তো নানান শর্ত থাকে।
ড. সামছুল হক : কালশী রাস্তায় একটি কোম্পানির পরিবর্তে এখন হয়তো দশটি কোম্পানি বাস নামিয়েছে।
রাজধানীর প্রধান সমস্যা হচ্ছে যানজট। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস দাঁড়িয়ে থাকে। এতে জ্বালানি বেশি পোড়ে। লাভ কম হয়। কারণ যে পরিমাণ ট্রিপ দেওয়ার কথা, তা পারছে না।
অন্যদিকে একাধিক কোম্পানি থাকার কারণে রাস্তার মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। যাত্রী নিয়ে কাড়াকাড়ি চলে।
এই প্রতিযোগিতায় কয়েকটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। মালিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি নামায়। ব্যাংক বলে রাস্তায় তুমি যা ইচ্ছা কর, কিন্তু আমাকে শতকরা ১৫ ভাগ সুদ দিতেই হবে। এরপর মালিক ড্রাইভারের কাছে লিজ দিয়ে বলে লাভ-লোকসান সব তোর, দিন শেষে আমাকে এই পরিমাণ টাকা দিতেই হবে। এই দুটি পক্ষ একেবারে ফিক্সড হয়ে যায়।
এরপর চালক দেখে লাভ করতে হলে গাড়ি দ্রুত চালাতে হবে এবং ইচ্ছা মতো যাত্রী তুলতে হবে। চালক তখন যাত্রী ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। তার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো তাই করতাম।
মালিক ঝুঁকি এবং সুবিধার সমস্ত দায়ভার চালকের হাতে দিয়ে দিয়েছে। দিন শেষে দশ জন চালকের দশ ধরনের আয়। মালিক নয়, যাত্রী সেবা মেলে চালক দ্বারা।
অনেকে বলেন, ঢাকায় দেড়শ মতো বাস অপারেটর আছে। এটি ভুল। আমি মনে করি, সাড়ে ৬ হাজার চালকের প্রত্যেকেই অপারেটর।
চালক যখন দেখল মালিকের এ পরিমাণ দিতেই হবে। তখন সে মিরপুর ১০ নম্বরে ঘণ্টাখানিক দাঁড়িয়ে একবারে বাস বোঝাই করা শুরু করল। মাঝখানে আর কোনো বিরতি না দিয়া মতিঝিলে এনে নামিয়ে দিল।
১০ কি ১২ বছর আগে যখন একজন এইভাবে বিরতিহীন সিস্টেম চালু করল, আরেকজন দেখল যে আমি সারাদিন চালিয়ে তিন ট্রিপ দিতে পারছি না। আর সে জ্বালানি কম ফুরিয়ে ট্রিপও বেশি দিচ্ছে, আয়ও বেশি করছে। এরপর শুরু হয়ে গেল গেটলক, আল্লাহর কসম বিরতিহীন, কম বিরতিহীন ইত্যাদি ইত্যাদি নামে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।
সাপ্তাহিক : তার মানে এই সিস্টেমের শুরুতে কর্তৃপক্ষের নজর ছিল না?
ড. সামছুল হক : সবই তো চলে বিশেষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। বিআরটিএ-ও এই সিন্ডিকেটের পার্ট। শুরুতে যদি এই রোগ সারানোর ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়।
গেটলক সিস্টেম চালু করার পর রাস্তায় আরও যে দশ জায়গায় যাত্রী অপেক্ষা করছে, তারা আর গাড়ি পাচ্ছে না। অথচ গেটলকের নামে গাড়ি ফাঁকা যাচ্ছে। যাত্রী তখন ক্ষুব্ধ হতে থাকল। এরপরেই কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙল।
সাপ্তাহিক : মানুষের তো চাহিদা আছে সিটিং সার্ভিস নিয়ে?
ড. সামছুল হক : অবশ্যই মানুষের এই সিস্টেমে চাহিদা আছে। কিন্তু মাঝ পথের যাত্রীদের উপায় কী? সবাই তো সিটিং সার্ভিসেই যাচ্ছে। মাঝপথের যাত্রীদের জন্য কোনো সেবা থাকবে না?
এখানেই পেশাদারিত্বের প্রশ্ন। যদি একটি করিডরে একটি মাত্র কোম্পানি থাকত এবং ওই করিডরে প্রতিদিন ৫০ হাজার যাত্রী বহনের জন্য দেড়শ পরিবহন থাকত, তাহলে কিন্তু এই সমস্যা থাকত না। তখন শর্ত থাকত বাসে বৈচিত্র্য আনার, যা আগে বললাম।
এক মালিকের নিয়ন্ত্রণে থাকলে তখন বিআরটি বা মন্ত্রীকে রাস্তায় নেমে অভিযান পরিচালনা করতে হতো না। এক মালিককে ডেকে আনলেই হিসাব মিটে যেত। কারণ তার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ থাকত। নিজের সর্বনাশ নিজে কখনই করত না।
পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খল পরিকল্পনা করে শক্তি খাটিয়ে শৃঙ্খলা আনা যায় না।
সাপ্তাহিক : এবার সিটিং সার্ভিস নিয়ে সরকারের যে পিছুটান দেখলাম, তা নিয়ে কি বলবেন?
ড. সামছুল হক : এমন আত্মসমর্পণ আগেও হয়েছে। সিএনজি নিয়ে বারবার অভিযান চালিয়েও কোনো ব্যবস্থায় ফেরাতে পারেনি। এখনও চালকরা মিটারে চালায় না। চালক মনে করে, মিটারে চালালে তার মালিককে দেয়া জমার টাকাই উঠবে না। তার মানে সেবা চলে যাচ্ছে চালকের হাতে।
সম্প্রতি সিটিং বন্ধ করার দিন সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিল চালকরা। চালকরা মনে করল, তার পেটে লাথি মারা হলো। চালক সাড়ে ৬ হাজার। তাদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। আছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তারা আবার রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধও নয়।
এত সংখ্যক চালককে তো ম্যানেজ করার উপায় থাকে না। সরকার গেছে অব্যবস্থাপনাকে ব্যবস্থপনায় ফিরিয়ে আনতে। এটি চিন্তা করাই তো বোকামি।
যে সিস্টেমের জন্মই পঙ্গুত্বের মধ্য দিয়ে, তাকে আপনি সুস্থ করবেন কি করে?
সাপ্তাহিক : এই পঙ্গু সিস্টেম নিয়ে আমরা আসলে যাচ্ছি কোথায়?
ড. সামছুল হক : ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে হলে আপনাকে পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করতে হবে। আজ থেকে ২০ বছর আগে রাজধানীতে ঘণ্টায় গতি ছিল ২৫ কিলোমিটার। ৫ বছর পর হল ঘণ্টায় ১৮ কিলোমিটার। ১৯৯৪ সালে ডিআইটিএস প্রথম এই গতি নিয়ে রিপোর্ট করে। ১৯৯৮ সালে রিপোর্ট করে ডিইউটিপি। এখন রিভাইসড এসটিপি রিপোর্ট বলছে, রাজধানীতে ঘণ্টায় গড় গতি হচ্ছে ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার।
তার মানে নগরবাসীর গতি এক প্রকার স্থবির প্রায়। হাজার হাজার বাস নামিয়ে তো এই সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। সমস্যা হচ্ছে যানজটে। আপনি যদি বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করেন এবং এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে দশ বছর পর এই শহর পুরোই স্থবির হয়ে পড়বে।
একটি নগরী স্থবির হয়ে পড়লে, তার কোনো স্পন্দন থাকে না। স্পন্দন না থাকলে তাকে মৃত নগরী বলা হয়। মুখের কথা নয়। এটি বিজ্ঞানের কথা। ডাক্তার যেমন, রিপোর্ট দেখে রোগীর ব্যাপারে তথ্য দেয়, তেমনি নগরীর ব্যাপারেও আপনাকে এমন রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে কথা বলতে হয়। এখানে অনুমানের কোনো জায়গা নেই।
সাপ্তাহিক : এই গতিহীনতায় সবচেয়ে প্রভাব পড়ে কিসে?
ড. সামছুল হক : গণপরিবহন। স্ট্যাডিতেও তাই এসেছে। পুরানো কোনো মালিক নতুন বাস নামাতে চাইছে না। সে বরং বেড়িয়ে যেতে চাইছে। নতুন কেউ কেউ না বুঝেই বিনিয়োগ করতে চাইছে, এদের কেউ আবার কালো টাকার মালিক। কিছুদিন পরেই আবার বুঝতে পারে, এটি আসলে বাণিজ্যের জায়গা নয়।
গতি স্তিমিত হয়ে পড়লে ব্যাপক হারে কেবল প্রাইভেট বা সিএনজি গাড়িই বাড়তে থাকবে। মোটরসাইকেল বাড়বে।
উন্নত বিশ্ব জানে বাসকে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার চালাতে হবে। অনেক শহরে তাই চলে। সবাই যানজটে পড়ে থাকলেও বাসের লেন পরিষ্কার থাকে। সে তার নিজস্ব গতি নিয়ে নির্বিঘেœ যেতে পারছে। অনেকটাই ব্রডব্যান্ডের ইন্টারনেট সংযোগের মতো করে। তখন অনেকেই ছোট গাড়ি ছেড়ে বড় গাড়িতে চড়তে চায়। কারণ রাস্তায় কেউই বসে থাকতে চায় না।
আর আমাদের এখানে পুরোই উল্টো। যানজটের কারণে মানুষ বড় গাড়ি ছেড়ে ছোট গাড়ি চড়ছে। টোটালি পরিকল্পনার অভাব।
সাপ্তাহিক : সরকার তে যানজট নিরসনে নানা উন্নয়নও করছে। রাস্তা, ফ্লাইওভার করছে।
ড. সামছুল হক : সোজা, সস্তা এবং ভোটের রাজনীতির জন্যই এখন উন্নয়ন হয়। এই উন্নয়নে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। গণপরিবহনকে নির্দেশিত করে, চাপিয়ে দেয়া আদেশ দিয়ে একটি শহরের উন্নয়ন হতে পারে না। সরকারের মধ্যে পরিকল্পনা থাকলে পেশাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উজ্জ্বল করে রাখত। তারাই সব দেখত। না পারলে পরে মন্ত্রণালয়ের কাছে যেত।
পরিকল্পনা থাকলে এই অপরিকল্পিত উন্নয়ন হতো না। এসটিপিতে প্রথমেই বলা ছিল বাসকে সুশৃঙ্খল কর। ফুটপাত পরিষ্কার কর। এর জন্য খরচ লাগে না। ইচ্ছা থাকলে আজই করা যায়। কিন্তু হবে না। কারণ এখানে রাজনীতি আছে।
যে অপেশাদার লোকগুলো এসি রুমে বসে ফ্লাইওভারের নকশা করছেন, তিনি তো আর ফুটপাতের দায় নিতে চাইবেন না। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হলে প্রতিদিন মাঠে থাকতে হবে। মাঠে থাকার লোক কই? সবাই তো ঠাণ্ডা ঘরে বসে ফ্লাইওভার, আরও আরও নতুন বাস কেনার পরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত। এতে রাজনীতি থাকে, বিশেষ হিসাব থাকে, গাড়ি কেনারা নামে মন্ত্রণালয়ের পিয়ন থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত দেশের বাইরে রাষ্ট্রীয় খরচে ঘুরে আসার সুযোগ থাকে।
সরকারও তো হোয়াইট কালার জবে বিশ্বাসী। ফ্লাইওভার উদ্বোধন করতে ফিতা কাটা যায়। ফুটপাত দখলমুক্ত করে বা গণপরিবহনের সেবা বাড়িয়ে ফিতা কাটা যায় না। এখানে ঘাম ঝরে। সবই সিন্ডিকেটের অংশ। আগে ডিপার্টমেন্টগুলো মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহি করত। এখন আর তা নেই। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে গিয়ে দেখুন, কি সর্বনাশ করা হয়েছে। কোনোই জবাবদিহিতা নেই।
সাপ্তাহিক : তাহলে এই উন্নয়নের মানে কি দাঁড়ায়?
ড. সামছুল হক : আমি এই উন্নয়নকে ডিক্টেটেড উন্নয়ন বলি। যার অর্থ নির্দেশিত বা স্বেচ্ছাচারী উন্নয়ন।
তথ্য নেই, পরিকল্পনা নেই। ফ্লাইওভার একটিতে কাজ হচ্ছে না, তাহলে আরেকটি কর। প্রয়োজনে ফ্লাইওভার দিয়ে গোটা নগর ঢেকে দাও।
পরিবহন এমন একটি জটিল বিষয়, যার পরিকল্পনা ২৫ বছর আগে নিয়ে রাখতে হয়।
সাপ্তাহিক : এরপরেও নগরে থাকতে হচ্ছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার কোনো উপায় আছে কিনা?
ড. সামছুল হক : ২০০৫ সালে রেল, নৌ এবং সড়কপথ নিয়ে সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হলো।
বাসগুলোকে একত্রিত করার কথা বলা হলো। বলা হলো, বাসকে গুরুত্বপূর্ণ লেনে ছেড়ে দাও। এরপর মেট্রোতে যাও। উপরে দুটি এমআরটি, নিচে একটি বিআরটি কর।
সাপ্তাহিক : সরকার তো এমআরটি এবং বিআরটিতে যাচ্ছে।
ড. সামছুল হক : বিআরটি হবে না। ফ্লাইওভার হয়ে গেছে। অমিত সম্ভাবনাগুলো কবর দেয়া হয়েছে। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাওভার ছিল না। সেখানে চারটি এমআরটি এবং দুটি বিআরটি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন আর একটিও হবে না। সরকার বিআরটি-৩-এর কথা বলছে। মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের কারণে সেটাও আর হবে না।
সবক্ষেত্র নষ্ট করে এখন পেছাতে পেছাতে উত্তরার দিকে যাচ্ছে সরকার। অযৌক্তিক উন্নয়নই এখন সর্বনাশের মূল। কথিত উন্নয়ন কী ক্ষতি করছে, তা দুটি প্রকল্প আমলে নিলেই পরিষ্কার হয়। তিনটি এমআরটি এবং দুটি বিআরটি সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ৩১টি জেলা থেকে মানুষ এসে কেউ বাসে, কেউ মেট্রোতে, কেউ বিআরটিতে আবার কেউ সিএনজি অথবা রিকশায় করে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে পারত। এক মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারই সব শেষ করে দিয়েছে।
এই সর্বনাশ বিশ্লেষণ না করে আবার মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারে গেল। ন্যাড়া নাকি একবার বেল তলায় যায়। আর আমাদের সরকার গেল দুইবার। বিআরটি-৩ বনানী আসার কথা ছিল। তাও আর হচ্ছে না।
সাপ্তাহিক : এখন কোথায় ঠেকবে?
ড. সামছুল হক : এখন আর এটি হচ্ছে না। এর বর্ধিত অংশ হচ্ছে অর্থাৎ মূল অংশ হচ্ছে না। গাজীপুর থেকে এসে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ঠেকবে।
সাপ্তাহিক : এয়ারপোর্ট থেকে মানুষ যাবে কীভাবে?
ড. সামছুল হক : একই প্রশ্ন আমিও সরকারকে করেছিলাম। জবাব নেই। ২০১০ সালে নেয়া হয়েছিল এয়ারপোর্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত একটি করিডর। তা আর হলো না। এখন সরকার বিআরটি-৩ মহাখালী পর্যন্ত আনার জোড়াতালির পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানতে পারলাম।
কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে অযৌক্তিক ফ্লাইওভারের কারণে, তা আর কোনো দিনই পূরণ হবার নয়।
অযৌক্তিক উন্নয়নের ভাগিদার অনেক। ডিসিসি না করলে বিবিএ করছে। নতুবা সেনাবাহিনী করছে। সেনাবাহিনী না করলে এলজিআরডি বা সড়ক বিভাগ করে ফেলছে। সবাই তো ব্যবসা, কমিশন নিয়েই ব্যস্ত।
মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের দুটি সিগন্যালের কথা আমি তিন বছর আগে বলেছিলাম। কেউ কানে তোলেনি। এখন সিগন্যাল উপরে উঠছে। অন্ধ লোকের উন্নয়ন মানুষের কাজে আসে না।
সাপ্তাহিক : সিগন্যাল ফ্লাইওভারে!
ড. সামছুল হক : হ্যাঁ। মগবাজার এবং মৌচাকের দুটি জায়গায় ফ্লাইওভারের উপরে সিগন্যাল বসাতে হবে। এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে, রাস্তা ধ্বংস করে, ফুটপাত নষ্ট করেÑ তাহলে কী লাভ হলো?
যে দুটি সিগন্যালের কারণে মৌচাক-মগবাজারে যানজট হতো, সেই দুটি সিগন্যাল রয়েই গেল। অন্ধ জনবলের কারণেই জনগণের এই সর্বনাশ হচ্ছে।
ফ্লাইওভারের কারণে শত শত নতুন গাড়ি আসবে। পুলিশ ফ্লাইওভারে বসে সিগন্যাল দেবে। বিশ্ববাসীর কাছে হাসির কারণ হবে। পুলিশের বসার বা হাঁটারও কোনো জায়গা নেই।
এসব না করে যদি ফুটপাতটি দখলমুক্ত করে, আরো প্রসারিত করে দিত, মানুষ দুই-তিন কিলোমিটার হেঁটেই যেত। মানুষ হাঁটার জায়গা পায়না বলেই গাড়িতে বসে থাকতে বাধ্য হন। অথচ এর জন্য অর্থ ব্যয় করতে হতো না।
ফ্লাইওভারের কারণে ফুটপাত সংকীর্ণ হয়ে গেল। মূল সড়কে খুঁটি বসল। চাইলেও আর মেট্রো বা বিআরটি করা সম্ভব হবে না। অপেশাদার জনবলই আত্মঘাতী উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। খাম্বা বা দৃশ্যমান খুঁটিই এদের কাছে উন্নয়নের দর্শন।
সাপ্তাহিক : তাহলে কি এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই?
ড. সামছুল হক : দুটি সিগন্যাল আছে, এটি বুঝতেই সময় লাগল তিন বছর। তাহলে ফাঁদ থেকে বের হবেন কি করে!
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে যান। কোনো ড্রেনেজ সিস্টেম পাবেন না। যারা এটি তৈরি করেছেন, তারা জানেন এটি উজবুকের জাতি। যা দিবেন তাই খাবে। কোনো হৈচৈ হবে না। ফ্লাইওভারের বৃষ্টির পানি সরাসরি পড়ে নিচের রাস্তা নষ্ট করছে। নিচের রাস্তা ভালো থাকলে তো কেউ আর ফ্লাইওভারে উঠতে চাইবে না। নদীর উপরে ব্রিজ করলেও পিভিসি পাইপ দিয়ে বৃষ্টির পানি নিচে নামানো হয়। অথচ তদারকি প্রতিষ্ঠান ডিসিসি কোনোদিন এ নিয়ে জবাবদিহি করেনি।
সরকারে কোনো সজ্ঞানের লোক আদৌ আছে কিনা আমার জানা নেই। থাকলে ফ্লাইওভারের নিচে লাখ লাখ মানুষকে এভাবে জিম্মি করে রাখার কথা নয়। অথচ এই আম জনতাকে দেখিয়েই প্রজেক্ট নিয়েছে, বিনিয়োগ করেছে।
সাপ্তাহিক : দাতা গোষ্ঠীও এমন প্রজেক্টে আসছে। তারা কি এর ফলাফল দেখছে না?
ড. সামছুল হক : দাতারাও বুঝে গেছে, এ দেশে যা দেবে তাই খাবে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার কানাডার লিয়া নামের একটি কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান পেয়েছিল। কলসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান হচ্ছে একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি। তারা পাঠিয়ে দিল কলকাতার অখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে, যারা আমার সামনে বসলে হাঁটু কাঁপত। কাজের প্রেজেন্টেশন দিত সাদারা আর কাজ করত কলকাতার লোকজন।
ভুল করলেও এখানে কেউ ধরতে পারে না, তাহলে ভালো প্রতিষ্ঠান বা পেশাদার জনবল পাঠানোর দরকার কি?
সাপ্তাহিক : একই চিত্র গোটা দেশেই?
ড. সামছুল হক : ঢাকার চাইতে চট্টগ্রামের অবস্থা আরও করুণ। চট্টগ্রামে আপনি ফ্লাইওভার ছাড়া কিছুই দেখতে পাবেন না। গণপরিবহনের নাম গন্ধ নেই সেখানে। মাথায় পচন ধরলে তো অন্য অঙ্গও অকেজো হয়ে যায়। ঢাকায় তাও দুই একটি গণপরিবহন মিলছে। অন্য শহরে তাও নেই। ইজিবাইকের ছড়াছড়ি। সিএনজির দখলে রাস্তা।
রাস্তাও আর বাড়ানোর সুযোগ নেই। রাস্তার পাশে বড় বড় ভবন হচ্ছে। এমন একটি ভঙ্গুর মেরুদণ্ডের ওপর শহর কতদিন বাঁচবে তা সহজেই অনুমেয়।
পুরো দেশটা যদি একটি শরীরের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে প্রত্যেকটা শহর হচ্ছে একেকটি ক্যান্সার সেল। ক্যান্সারের সেল অনিয়ন্ত্রিত বেড়েই শরীরে মৃত্যু ঘটায়। শহরগুলোর উন্নয়নও অনিয়ন্ত্রিতভাবে হচ্ছে। ফ্রি স্টাইলে যা ইচ্ছা তাই হচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রামগুলোও কথিত শহরের রূপ নেবে। তখন ক্যান্সার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না।
এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আর কোনো সরকারই ম্যানেজ করতে পারবে না।
সাপ্তাহিক : এই ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনে উপায় নেই?
ড. সামছুল হক : ঢাকা এখনও ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে। এরশাদ সরকারের নানা সমালোচনা আছে। কিন্তু তার আমলে কয়েকটি কাজ হয়েছিল, যা ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়ত করেছিল। প্রগতি সরণি, বিজয় সরণি, রোকেয়া সরণির মতো প্রাইমারি সড়কগুলো এরশাদের আমলেই করা। বেড়িবাঁধ, পান্থপথও তার আমলে করা। এরশাদ যাওয়ার পর আর কোনো সরকার কিন্তু প্রাইমারি সড়ক করেনি।
ঢাকা ছিল তেজগাঁও পর্যন্ত। এরশাদ এসেই রামপুরা সড়ক করে ঢাকাকে প্রসারিত করল। আশির দশকের কথা। এরপর আর কী হলো? এক বা আধা কিলিমিটার দূরে আরেকটি সড়ক হওয়ার কথা ছিল না? কই হলো?
সাপ্তাহিক : এই ‘না’ করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?
ড. সামছুল হক : রাজনীতি। কথিত গণতন্ত্র আগে ভোটের হিসাবটাই করে। যেখানে উন্নয়ন করলে ভোট বাড়বে, চোখে দেখা যাবে, তা নিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও নানা সমালোচনা আছে। আমরা কেউই এমন সরকার চাই না। এরপরেও কথা থেকে যায়। তারা মাত্র দুই বছর ক্ষমতায় থাকল। হাতিরঝিল তারাই পেরেছে। কুড়িল, বনানী তারাই করেছে। সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল বিমানবন্দরের মধ্য দিয়ে একটি সড়ক করা। সেটিও সম্ভব হয়েছে তাদের আমলে। অথচ শক্তিশালী গণতন্ত্রের কথা বলেও মেট্রোরেল সেদিকে নিতে পারেনি।
জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসে এত বছর পরেও কেন একটি প্রাইমারি সড়ক করতে পারল না?
সাপ্তাহিক : ঢাকার রূপ ফিরিয়েছে হাতিরঝিল। আপনি এই প্রজেক্টের সঙ্গে ছিলেন। কেমন দেখছেন?
ড. সামছুল হক : প্রায় দখল হয়ে গিয়েছিল। সাত হাজার বস্তিবাসীর কবলে পড়ে হাতিরঝিল প্রায় বন্ধ তখন। ঝিল ভরা ময়লা-আবর্জনা। রাজনীতি হতো এখানে।
আমি হাতিরঝিলের রাস্তার পরিকল্পনাকারী ছিলাম। আমাকে প্রথমে বলা হলো, আপনি মাঝখান দিয়ে শুধু ৮০ ফুটের একটি সড়ক বানিয়ে দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেই পরিকল্পনা বদলে দিল। তারা বলল, একটি রাস্তা কেন? ঝিল উদ্ধার করে চতুর্দিকে রাস্তা করার পরিকল্পনা করতে বলল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সাড়ে আট কিলিমিটার সড়কের পুরো নকশা আমি করে দিলাম। মানুষ ঘুরছে কিন্তু কোথায় থামতে হচ্ছে না। রাস্তা ঘুরেও বিরক্ত নন মানুষ।
তখন পারলে এখন পারছে না কেন? এখন সেনাবাহিনীর বাধা, নৌবাহিনীর বাধা, রাজনৈতিক দলের বাধা, অমুক গোষ্ঠীর বাধা।
সাপ্তাহিক : তার মানে কথিত গণতন্ত্রই এখন জনস্বার্থবিরোধী?
ড. সামছুল হক : আমি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছি না। শুধু বলব, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয়। আরও দেশ আছে, সেখানে নগর আছে, উন্নয়ন হচ্ছে। তার তুলনায় আমরা কি করছি, সেটাই ভাবনার বিষয়। লোকদেখানো উন্নয়ন ঘটিয়ে অপার সম্ভাবনা নষ্ট করার কোনো অধিকার সরকারের নেই। একইভাবে ডিকটেটেড উন্নয়নও করতে পারে না সরকার। করতেই হবে এমন মনোভাব জনস্বার্থে যায় না। বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন ঘটলেই জনস্বার্থ রক্ষা হয়।
সাপ্তাহিক : এই অবস্থায় রাজধানী ঢাকার ভবিষ্যৎ কী?
ড. সামছুল হক : রাজধানী স্থানান্তরের আর কোনো বিকল্প নেই। এমন এলোমেলো শহরে রাজধানী থাকতে পারে না। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এমনকি মিয়ানমারও রাজধানী পরিবর্তন করল। কারণ তারা দেখল একবিংশ শতাব্দীর রাজধানী আগের শহরে হতে পারেনি। তারা আর সময় নেয়নি।
সাপ্তাহিক : আপনার মতে কোথায় যেতে পারে রাজধানী?
ড. সামছুল হক : একমাত্র ভালো একটি জায়গা ছিল পূর্বাচল। সেটিও আর নেই। পূর্বাচল, সাভার, ন্যাশনাল পার্কের পুরো এলাকা লাল মাটি দিয়ে তৈরি। অবকাঠামোর জন্য সহায়ক। এখানকার মাটি শক্ত।
প্রতিষ্ঠান থাকলে, পেশাদার লোক থাকলে এতদিন রাজধানী স্থানান্তরের জন্য অস্থির হয়ে উঠত। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিজেই এখন ব্যবসার দোকান খুলে বসেছে। পূর্বাচল দখলে নিয়ে প্লট বিক্রি করে টাকা আয় করছে।
সাপ্তাহিক : তাহলে রাজধানীর উপায় কী?
ড. সামছুল হক : রাজধানী স্থানান্তর করতেই হবে। শুধু আমরাই বলছি না। দাতা সংস্থাগুলোও এখন নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রাজধানী স্থানান্তরের কথা বলছে।
অনেক দূরে হয়তো যেতে হবে। অধিক জনবসতির দেশ। তাতে আবার আশি শতাংশ জায়গা পলি মাটির। হয়তো কোনো চর এলাকা বেছে নিতে হবে। কিšুÍ সেটা প্রাকৃতিকভাবে অর্থনৈতিক শহর হবে না। অনেক অর্থ ব্যয় করে সাজাতে হবে।
রাজধানী হতে হবে একটি স্টেডিয়ামের মতো। চতুর্দিকে সমান দূরত্বে খেলোয়াড় থাকবে। এখন কি সেটা হয়? উত্তরার লোক মতিঝিলে এসে কাজ করে যাচ্ছে। রাস্তায় থাকছেন ছয় ঘণ্টা। তার কারণে আরেকজন রাস্তায় নামতে পারছেন না। এটি বুঝতে পারলে প্রতিষ্ঠানের পেশাদার লোকজন ছটফট করত। পেশাদার লোক থাকলে কেরানিগঞ্জে উন্নয়ন ঘটাতো। চলে গেল পূর্বাচলে। অর্থাৎ উন্নয়নের আয়োজনই হচ্ছে রাজধানীকে স্থবির করে দেয়ার জন্য।
টেকসই উন্নয়নের জন্য অন্য দেশগুলো চৌকস পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে। সবাই সমান অধিকার ভোগ করতে পারবে, তার জন্যই নানা পরিকল্পনা নিয়ে থাকে তারা।
যোগাযোগ ভালো থাকলে অর্থাৎ মানুষ যদি রেলের উপর ভরসা পেত তাহলে ঢাকা ছেড়ে দিত। বাড়ি থেকে এসে অফিস করত। বাইরের দেশে তাই হয়। ১৫ মিনিটে আসতে পারলে নারায়ণগঞ্জের লোক ঢাকায় বসবাস করবে কেন?
ঢাকা বাংলাদেশের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান। অনেক দেশেই এমন শহর থাকে না। অথচ সরকার তার সুবিধার জন্য যেটুকু দরকার সেটুকুই করছে।
ফলে উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে, তা হলো ঢাকাকে স্তিমিত করে দেয়া। একটি শহরের দুটি স্পন্দন (বিট) সময় থাকে। সকাল এবং বিকেলে। ঢাকায় সকালে বিট উঠলে আর নামে না। রাতেও তাই থাকে। ঢাকা এখন স্পন্দনহীন মৃত নগরী।
পছন্দমাফিক উন্নয়নে নিজের স্বার্থ হাসিল হয়, জনগণের স্বার্থ এখানে মার খায়। সম্ভাবনা ছিল, সরকার নষ্ট করছে। ব্যক্তি উদ্যোগে দেশ এগিয়ে গেলেও রাজনীতি, সরকার সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দুবাইয়ের বালুতে মানুষ পুড়ে কালো হয়ে যায়। সেই মরুদেশ দুবাইয়ে গোটা পৃথিবী থেকে ট্যুরিস্ট যাচ্ছেন। সম্ভাবনা ছিল না, সম্ভাবনা তৈরি করেছে শুধুই পরিকল্পনা দিয়ে। পরিকল্পনার কী সৌন্দর্য, দুবাই তার উদাহরণ।
আমাদের খাল ছিল, চারটি নদী ছিল। সেগুলো গলা টিপে হত্যা করা হলো। মশা হয় বলে খাল বন্ধ করারও নজির আছে। একটি খালকে একেবারে বন্ধ করে দেয়া হলো, এত বড় অপরাধের জন্য কোনোই জবাবদিহিতা নেই। নেই কোনো অনুশোচনাও।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×