প্রিয়তমা,
এই মেঘ কালো, আঁধার কালো, জল টলোমলো নয়ন, ছিমছাম ষোড়শী তন্বী ছেড়ে আমার ফিরে আসতেই হচ্ছে। বহুগামী মন আমার একে রয় না, তবু আমার হৃদয়ে তুমি সদা বিরাজমান, তুমি আমার আত্মায় গাঁথা, সে আমি বেশ জানি।
তোমার ছেড়ে যাওয়াটা এবার নির্ঝঞ্ঝাট হলো না, বিগত বিশ বছরের মতোন। ট্রেনের ইঞ্জিনটা যখন দাউদাউ করে জ্বলছিলো, যাত্রীরা যখন হুলুস্থুল করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো তাপানুকূল কামরাটি এবং সমগ্র ট্রেনটি ছেড়ে, তখন ছুটে বেরোনোর বদলে আমার ক্লান্ত লাগছিলো আর আমার মাথায় ঘুরছিলো কীই না হতো তিনটে কামরার বদলে সবগুলো কামরাই যদি উল্টে যেতো, আমার কী এদেশ বেড়ানো আর হবে না! এদেশের জলে আরও ভাসবার আগেই, পদ্মের বিল আমার দ্যাখা পাবার আগেই, সহস্রধারা-নাফাকুম-হিমছড়ি-খৈয়াছড়া-শুভলঙেরা আমার পরশ পাবার আগেই, গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথের ধূলো আমার পায়ে চুমু খাবার আগেই যদি আমার চলে যেতে হয়, যদি চলে যেতে হয় তোমায় এবং ওই অপরূপা কৃষ্ণকলিকে ছেড়ে, নানান হিজিবিজি। আর এই ফেরবার কালে অর্ণব কানে কানে গাইছে ‘...শ্রান্ত ভালে, যুঁথীরও মালে, পরশে মৃদু বায়…’ ঠাকুরদার এই গানটি অর্ণব ভালো গায় নি বা গেয়েছে তা জানিনা তবে এই বেলা তোমার কথা যখনই মনে পড়ছে ঠিক তখন গানটি বেশ লাগছে। সিস্টার বলেছিলেন গানটির প্রেক্ষাপট চলমান। সত্যিই তাই। তুমি ঠিক যেভাবে যেখানেই থাকো, নিত্য আমায় পরশ করো, যেভাবে কোনো প্রতিদানের আশা ছেড়েই তুমি আমায় ভালোবাসো এবং ভালোবাসতে দাও, তোমার শরীরে অলিতেগলিতে য্যামন মিশে আছে আমার ভাবনা, আমার ভালোলাগা, আমার প্রথম প্রেম আর আমার প্রথম চুমুর স্মৃতি, আমার কৈশোর, তোমার সান্নিধ্যে আমার যে সুখ, তোমায় একান্তে পাবার যে ব্যাকুল ইচ্ছে, যা তুমি জানো, যা আর কেউ জানবে না, যা তুমি কাউকে বলে দেবে না সেসব কথা যেন বলে গ্যালো গানটা। যেভাবে তোমার ঘ্রাণ ঘিরে থাকে আমায়, গানটা য্যানো সেসব কথাই বলে গ্যালো। কী বিজন বেদনা হবে, সুহাসিনী, তোমায় ছেড়ে যাই যদি কখনও, জানো! তোমায় আমি কী করে ছাড়ি, ও প্রিয়ভাষিণী! কিন্তু তুমি জানো, ও সত্যিই সুন্দরী, মায়াকাড়া, ওর আকাশবাতাস আমায় প্রেম দ্যায়, আমায় মোহন করে, মোহিনী ও। ওর জন্যও প্রাণ কাঁদে আমার। ওর কাছেও আমি হয়তো থাকতেই চাইবো। তোমার প্রেম আমাকে প্রাণ দ্যায়, ওর প্রেম সেই প্রাণ তরতাজা রাখে। এই পর্যায়ে এসে বুঝতে পারছি, আমি হয়তো ওরেও ভালোবাসি। হয়তো না, ভালোইবাসি। কিন্তু তোমার মতোন সার্বক্ষণিক প্রয়োজন ওকে নেই আমার। ওর কাছে এসেই আমি তোমায় অনুভব করি, যদিও তোমার সাথে রইলে ওরে আমার মনে পড়ে না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে এক আধবার। তখন আমি ভেবে রাখি ওর কাছে আসবো, ওরে ছাড়া শুধু তোমায় নিয়ে আমি বাঁচবো না। বাঁচবো, ভালো রবো না। ভালো না রয়ে বেঁচে থাকাকে কি বেঁচে থাকা বলে?
বর্তমানে ওই আকাশ, ওই ধুলোবালি, ওই বুকচেরা ব্যস্ত রাস্তার স্থবির যন্ত্রদানব, ওই বাজারঘাট, ওই ডাস্টবিন আর আকাশছোঁয়া বাড়িঘর, মোড়ের ফ্লেক্সিলোডের দোকান, কৃষ্ণচূড়া গাছ আর শহরময় ঘামের গন্ধ আর একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে দ্যাখা হয়ে যাওয়া মাঝ রাস্তায় আমার ভীষণ মনে পড়ছে, কী করে বোঝাই তোমায়? কী করে বলি, ওসবকিছুই তুমি লাগো আমার? এই তাপানুকূল কামরার নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় বসেও ওই কাঠফাটা রোদ আর আশ্বিনে গরমের জন্য আমার ভেতরটা আকুলিবিকুলি করছে, যে কাঠফাটা রোদ আর আশ্বিনে গরমে আমার তুমি থাকো। দেবী আমার, তুমি জানো, ওখানকার ওই শান্ত নীরব পরিবেশে, যাত্রীবাহী গাড়িগুলো যেখানে স্থবির হয়ে থাকে না, অযথা ভোঁ কাটে না, যেখানে দুঘন্টা বেড়িয়ে এলেও গায়ে ধূলোর পরত জমে না, যেখানে আনায়াসে দুটোচারটে পুকুর আর মৃত্যুপথযাত্রী প্রাণদায়ী নদীটির দ্যাখা মেলে, যেখানককার বাতাসটা ফরাসী শিফনের মতোন ফুরফুরে, সেখানে বসেও আমি ওই শাঁখারীবাজার-নিউমার্কেট-টিএসসি-তাঁতীবাজার-বেচারামদেউরী-ফার্মগেট-মানিকমিয়া অ্যাভিনিউ-ক্রিসেন্ট লেক-বাংলাবাজার-সদরঘাট-বনানী-মোহাম্মদপুর-হাতিরঝিল-গাবতলী-খিঁলগাও-মহাখালী আর এসব জায়গায় মানুষের, এসব নামে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা তোমার আর ট্রাফিক জ্যামের, সীসাভর্তি ভারী বাতাসের, অযথা আওয়াজের আর ধূলোর কী ভীষণ অভাববোধ করছিলাম!
যাত্রীবাহী ট্রেনটি তুরাগ সেতু পার হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরটা ক্যামন চনমনে হয়ে উঠবে, টঙ্গীর কারখানাগুলো দেখতে দেখতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে আসণ্ণ মিলনের আনন্দে, আর এয়ারপোর্টে যখন ট্রেনটা দাঁড়াবে, কিছু মানুষ নামবে এবং উঠবে, সেই ব্যস্ততা আমায় কী অপার্থিব সুখ এনে দেবে, সে লিখে প্রকাশের স্পর্ধা আমি করি না। ট্রেনটা যখন এয়ারপোর্ট পার হয়ে বনানী-মহাখালি হয়ে ছুটে যাবে, নগরীর ব্যস্ততার মাঝেও আমার মনে হবে ক্রসিঙে দাঁড়ানো গাড়ি গুলো আমায় দেখে হাত নাড়ছে, আর নগরীর মানুষজন-দোকানপাট-বাড়িঘর-অফিসআদালত দেখে দেখে আমার আর আশ মিটবে না। আর আমার তখন মনে পরে যাবে এইতো আমার তুমি, এইতো তুমিময় সবকিছু। নাজিরাবাজারের কাবাবের দোকানটা কিংবা শাঁখারীবাজার তাঁতীবাজারের ঘিঞ্জি গলি-দালানকোঠা-সুরসামগ্রীর দোকান-পুজোমন্ডপ-হোলিখেলা কিংবা বুড়িগঙ্গার বাতাস ও উৎকট গন্ধ, গাবতলী ও নানান জায়গার ছোটবড় কোরবানীর হাট কিংবা মিরপুর রোড কিংবা দিনরাত কখনও বিশ্রাম না পাওয়া ফার্মগেটের ভিআইপি রোড কিংবা গুলশান বনানীর প্ল্যানমাফিক ফ্ল্যাটবাড়ি কিংবা ধানমন্ডি খিলগাঁওয়ে গজিয়ে ওঠা রেস্তোরাঁ কিংবা হাজারো মানুষের প্রাণের মিরপুর স্টেডিয়াম কিংবা ফুলার রোডের বৃষ্টি আর পলাশীর মোড়ের ব্যস্ত চা নাস্তার দোকান আর নীলক্ষেতে বইয়ের বাজার আর টিএসসির সোসাইটিকেন্দ্রিক আড্ডার দল কিংবা কার্জন-মৎস্য ভবন-হাইকোর্ট-শিল্পকলা-ছায়াসুশীতল মিন্টো রোড-বেইলি রোডের অভিজাত শাড়ির দোকান, আজিজ সুপার মার্কেট কিংবা সাকুরা, কাঁটাবনের পোষা প্রাণী বিকিকিনির দোকানপাট, কাওরানবাজারের এক দোকানীর পড়ে যাওয়া ধনিয়াপাতার আঁটি কুড়িয়ে দৌঁড়ে পালানো শিশু, এসবই কি তুমি নও, এ সবকিছুতেই কি আমারও অস্তিত্ব মিশে নেই?
এসব ভাবনা ও পথ অতিক্রম করে ট্রেনটা যখন আর্মি স্টেডিয়াম পার হবে, তক্ষুনি আমার ইচ্ছে হবে বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টে যেয়ে হাজির হতে, সেসব সুরেলা রাত ভাবতেই তীব্র সুখে ভরে যাবে আমার প্রাণমন, আমার আবার মনে পরে যাবে এসব তোমার কৃপা, তোমার দান, তোমার অনুগ্রহেই আমার স্মৃতির ঝোলাটা ভরে উঠছে একটু একটু করে। আর এরপর যখন ট্রেনটা স্টেশন রোডের বাজার পেরিয়ে তেঁজগাও ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে গিয়ে তেঁজগাও স্টেশনে থামবে কিংবা থামবে না, আমি তখন বাড়ির ঘ্রাণ পাবো। ততক্ষণে আমার মনে হবে আমি নিজের ভুবনে ফিরেছি, তোমার বাতাসে, তোমার আবেশে আমার গা ডুবে গ্যাছে। তুমি তখন থেকেই আমায় জড়িয়ে ধরছো, আমি হাত বাড়িয়েই ছুঁয়ে দেবো তোমায়। আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ, আমি ততক্ষণে একটু একটু তোমার মাঝে মিশছি, তুমি মিশে যাচ্ছো আমার মাঝে। তোমায় পাশে বসিয়ে আমি শোনাবো আমার ওই গোপন অভিসারের সব কথা। ট্রেন এরপর আস্তে আস্তে এগোবে, আর কোনো তাড়া নেই। আমি আমার স্মৃতির শহরে ফিরেছি, এই আমার অস্তিত্ব। এরপর ট্রেনটা যখন ঢিমতেতালে ‘ট্রেনের চাকা-ভাতের থালা-মনের কথা’ বলতে বলতে খুশিমনে এগিয়ে চলবে, তখন আমার আনন্দ আমি আর বাঁধ দিয়ে রাখতে পারবো না, ওটা ফুটতে শুরু করবে টগবগিয়ে আর দূর থেকে কমলাপুরের উঁচু লোহার টাওয়ারটা যখনই চোখে পড়বে, আমার মনে হবে ছুটে গিয়ে ওটা জড়িয়ে ধরি, ধরেই থাকি, ওকে বলি, ‘তুমি আমার, এই স্টেশন আমার, এই মাটি আমার, এই শহর আমার, এই মানুষ আমার।’
প্রাণেশ্বরী তিলোত্তমা, আমি তোমায় ভালোবাসি। আমায় তুমি যে প্রশান্তি দাও, সে আর কেউ তো দ্যায় না! দোজখের এই ওম আমায় হয়তো শত স্বর্গের সতত বসন্তের অধিক সুখ দেবে। আমি চাইতেই পারতাম, আমার য্যানো মৃত্যু হয় পাহাড়ে কিংবা ঝর্ণায়, কিন্তু তা আমি চাইবো না। আমি বারবার, বারবার চাইবো, আমার য্যানো মৃত্যু হয় তোমার বুকে, তোমার বুকে, তোমার বুকে। আজ আমি কথা দিলাম, আমি যেখানেই যাই, আমি ফিরে ফিরে আসবো। কাক শালিখের বেশে নয়, আমি মানুষ হয়েই ফিরে আসবো তোমার কোলে, সেদিন আমার যা কিছু কাজ আমি পরে সাঙ্গ করবো, তুমি শুধু চরণ ধরতে দিও আমায়, একটু বসতে দিও পাশে, দেবে তো?
ইতি,
তোমার আমি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:৩২