#১২১,
বাসা থেকে বের হয়েই প্রচন্ড রোদ দেখে মেজাজ টা কিটকিট করে উঠলো হালিম সাহেবের । যতক্ষন পর্যন্ত অফিসের এসি রুম টার ভিতরে ঢুকতে না পারবেন ততক্ষন পর্যন্ত শান্তি নাই ।
"শরীফের গাড়িটা কই " বলে নিজেই চারিদিকে একনজর চোখ বুলিয়ে নেয় , না দেখা যাচ্ছে না আজ । মূল রাস্তায় এবার অন্য ট্যাক্সি খুজতে থাকেন তিনি ।
" কিসের কি,, একটা সিএনজি ও খালি নাই , যত্তসব ।" নিজেই রাগে গড়্গড় করতে থাকেন ।
শরীফ একটা প্রাইভেট ট্যাক্সি ক্যাব চালায়, সবসময় গলির মাথায় অপেক্ষা করে, গত ৩ মাস ধরেই এমন হচ্ছে , তবে মাঝে মাঝে যাত্রী পেলে সে চলে যায় , আজও বোধহয় এমন কিছুই হয়েছে ।
"স্যার যাইবেন ?/" -
হালিম সাহেবের সামনে এসে থামে একটা রিক্সা , মাথা ঘুরিয়ে রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে থেকে মেজাজটা আরো এক ডিগ্রি খারাপ হয়ে যায় হালিম সাহেবের । জসীম উদদীন রোডের এই জায়গাটাতে প্রতিদিন দেখা যায় এই রিক্সাওয়ালাকে, আর প্রতিদিনই হালিম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করবে, যাবে কি না ?/
-না, দাঁত কটমট করে জবাব দেন হালিম সাহেব ।
তবুও দাঁড়িয়ে থাকে রিক্সাওয়ালা, অফিসের টাইম হয়ে যাচ্ছে, গাড়িও পাওয়া যাচ্ছে না, কি করবেন ?/ হাই প্রেশারের পেশেন্ট তিনি, চাইলেও বেশি চিন্তা করতে পারেন না।
- চলেন স্যার, আজকে আমি লইয়া যাই।।
মেজাজ খারাপ হলো আবার, এই রিক্সাওয়ালার কথা শুনলেই মেজাজ গরম হয়ে যায় ওনার । উপায়ও নেই , কি করবেন ভাবতে ভাবতে রিক্সায় ঊঠে যান তিনি,
প্রতিদিন ১০০ টাকা করে বখশিস দেন, মিটারের ভাড়ার উপর, তবুও এই ছেলেটাকে বিপদের সময় পাওয়া যায় না , শরীফের দায়িত্বগ্যান হীনতার কথা চিন্তা করতে করতেই দেখেন চলতি রিক্সার সামনে এসে দাঁড়ায় একটা ট্যাক্সিক্যাব।
"স্যার , সরি স্যার , লেইট হয়ে গেছে, চলেন স্যার, জ্যামে আটকাইয়া গেছিলাম" । হালিম সাহেব জানেন এগুলো সব তার মিথ্যা কথা , প্রচন্ড লোভী সে, নিশ্চয় কোথাও ট্রিপ মেরে আসছে । রিক্সাওয়ালা কে ১০ টাকা দিয়ে শরীফের গাড়িতেই উঠে পড়ে, অসহ্য লাগা রিক্সাওয়ালাটার হাত থেকে বাচতে পেরেই আপাতত খুশী তিনি ।
“এই প্রথম স্যারে উঠলো, আজকেও বাগড়া পরলো , ধুর ,কেন যে এতো মায়া লাগে আমার মাইনশের লাইগা, বুঝিনা । - পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে মজিব মিয়া । মজিব মিয়া থাকে মান্ডা এলাকায় , নিজেরই রিক্সা, নিজেই চালায়, জসীম উদদীন রোড ও এর আশে পাশেই রিক্সা চালায় , নিজের ছেলে মেয়ে গুলারে স্কুল থেকে আবার বাড়িতে পৌছে দেয় সে, তাই বেশি দূরে কোথাও সে যায় না। অনেকদিন ধরেই এই গলিতে রিক্সা চালাতে চালাতে মোটামুটী সবারই চেহারা চিনা, শুধু তাইই না, কার গন্তব্য কোথায়, গলির আপাদের অফিস, ভার্সিটি, স্কুল কোথায়, স্যারদের কে কোন অফিসে, আনা নেয়া করতে করতে মুখস্ত ওনার । হালিম সাহেবের নিজের গাড়ী আছে, কিন্তু বড় ছেলে শুভ নিজে ড্রাইভ করে ভার্সিটি তে নিয়ে যায় । তাই তিনি ট্যাক্সি ক্যাব করেই ওনার পোস্তগোলার অফিসে যান । শরীফও একজন ফিক্সড কাস্টমার পেয়ে গেছে ।
হালিম সাহেবকে দেখতে রিক্সাওয়ালা মজিব মিয়ার তার বড় ভাইটার মতো লাগে দেখতে । তার বড় ভাই বছর তিনেক আগে, নদী লঞ্চ ডুবিতে মারা গেছিলো, হালিম সাহেবের মতোই একটা ভুড়ি ছিলো তার মৃত ভাইয়ের, তাই হালিম সাহেবকে খুব মায়া লাগে তার । তাই প্রতিদিন ৮ টার দিকে এসে , “মায়াকানন” বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে সে, গলির টং দোকানদার, দারোয়ান হতে সবাই চিনে, কারণ এই গলিতে সবার আগে ঢুকে ।
গরীব মানুষ এমনই, সাদা মন তাদের , কাকে যে কখন তার ভাইয়ের মতো লাগে, বোনের মতো লাগে তারা নিজেও জানে না । তাদের এতো শোক ব্যাথায় জর্জরিত থাকে যে, কিছুটা ভাই হারানোর বেদনা ভুলার জন্য,কখনো বা ধোঁকা দেয়া অন্য কোনো আত্মীয়ের অভাব ভোলার অজানা তাগিদেই ক্ষণে ক্ষনে আত্মীয় পাতায়, আবার সেই নতুন আত্মীয় তাদের দুঃখ দেয়, আবার নতুন কারো মাঝে তারা তাদের কোনো এক আত্মীয় কে খুজে পায় । তাদের আত্মীয় পাতানো তাদের কাছে এক মানসিক শান্তির মতো , যা আবার তাদের দুঃখেরও কারণ । আর দুঃখ পাবার একটা নেশা তো আছেই তাদের ।
মজীব মিয়া কষ্ট পেয়েছে হালিম সাহেব নেমে যাওয়ায় ।
রিক্সাওয়ালা দেখেই বড় মানুষ গুলো আমাদের গাড়ীতে চড়ে না – এই কারণ খুজে পায় সে ।
এভাবেই চলতে থাকে প্রতিদিন, মজীব এসে জিজ্ঞেস করবে আর হালিম সাহেব দাঁত কিটমিট করে না বলবেন এইটাই নিত্য ঘটনা । একদিন মেজাজ চটে বলেই ফেললেন, “এই গলির মধ্যে যদি তোমারে আমি দেখি তাইলে কিন্তু খবর আছে, পুলিশে দিমু তোমারে।“ সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলো মজিব মিয়া, চোখ দিয়ে কয়েকফোটা জলও বের হয়েছিলো তার । ওইদিন আর রিক্সা চালাতে পারে নি সে ।
“স্যারের তো আমারে দরকার নাই, আমার তো দরকার, আমি চুপে চুপে হৈলেও ঐ রোডেই থাকমু, আর আমার ভাইটারে দেখমু ।“- নিজে নিজে বিড় বিড় করতে থাকে মজিব ।
পরদিন সকালে বের হয়ে দাড়ীয়ে আছেন, শরীফের ছিটেফোটা ও নেই, চারপাশে শূণ্যতা , দাড়ীয়ে থাকা মানুষ উনিই কেবল, বাকি সবাই চলন্ত গাড়িতে গতিশীল । বুকের বাঁ পাশ টায় হঠাৎ চিনচিনে ব্যাথা, মূহুর্তের মধ্যেই দুনিয়া ঝাপসা হয়ে উঠলো , ডান হাতে বুক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না তিনি, রাস্তার মধ্যে বসতে যেয়েই ধপ করেই পড়ে গেলেন তিনি, আমাকে ধর কেউ আমাকে ধর, দুই চোখ লাগানোর আগে, শুধু মুখে গামছা পেচানো নীল লুঙ্গি পড়া কেউ একজনকে দৌড়িয়ে আসতে দেখেন । তারপর আর কিছু জানেন না তিনি ।
হাসপাতাল থেকে বাড়ীতে ফিরেছেন, মনে পড়ে সেই গামছা পেচানো লোক টা কে, কোত্থেকেই বা আসলো সে, কয়েক মূহুর্ত আগেও তো কাউকে দেখেন নি তিনি । দোকান পাট একটাও খুলে নি তখন, কে ছিলো সে ?
আবারো অফিসের জন্য রাস্তায় এসে দাড়ান তিনি, কেনো জানি হঠাৎ করে ওই রিক্সাওয়ালাটা কে মনে পড়ছে তার, আজ বহুদিন দেখেন না ওই রিক্সাওয়ালাটাকে । সেদিনের সেই নীল লুঙ্গি পড়া, গামছা পেচানো লোকটা কি সেই রিক্সাওয়ালা ?? – প্রশ্নটা আর সন্দেহ টা ঘুরপাক খেতেই থাকে হালিম সাহেবের মনে ।