কিন্তু সে আনন্দের দিন শেষ হয়ে আসে। বাবার বদলীর আদেশ আসে। যেতে হবে বহুদুর..... নাৎসী অধিকৃত পোল্যান্ড! নিতান্ত অনিচ্ছায় বন্ধুদের পেছনে ফেলে ব্রুনো পরিবারের সাথে চলে আসে এখানে। গাছগাছালি ঘেরা সুন্দর তাদের নতুন বাড়িটি।
বন্ধু-বান্ধবহীন ব্রুনো বড় একা হয়ে পড়ে। নিজেদের বাড়ি হতে অনেক দূরে কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ে, কিন্তু তার যে বাড়ির ত্রিসীমানার বাইরে পা দেয়া নিষেধ! কী করবে ব্রুনো?
এমনসময় দুই ভাই-বোনকে পড়াবার জন্য শিক্ষক রাখা হয়। ব্রুনোর পছন্দ অ্যাডভেঞ্চারের বই, কিন্তু শিক্ষক পড়ান বিজ্ঞান! ব্রুনো যেন আরো একা হয়ে যায়।
একদিন, কিভাবে যেন খিড়কী দুয়ার খোলা পেয়ে সেখান দিয়ে সে বাইরে চলে আসে। দৌড়ে যেতে চায় ঐ দুরের বাড়িগুলোর দিকে। কিন্তু মাঝপথে বিশাল কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে যেতে হয় তাকে! অবুঝ বালক তো জানে না ঐ বাড়িগুলো আর কিছুই নয়, নাৎসী কন্সেনট্রেশন ক্যাম্প আর তার নিজের বাবাই এর পরিচালক!
যাই হোক, বেড়ার ওপারে আনমনে বসে থাকা আরেক ছোট্ট ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়, নাম শ্যামুয়েল (Shmuel)। পরনে স্ট্রাইপড্ পায়জামা। ব্রুনো এমন অদ্ভুত নামও কখনো শোনেনি, এমন অদ্ভুত ইউনিফর্ম তো দেখেই নি। তবু, তারা দুজনে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে, কাঁটাতারের বেড়ার এপার-ওপার! দিনে দিনে গাঢ় হয়ে ওঠে সে বন্ধুত্ব। ব্রুনো বেড়ার বাধা পেরিয়ে শ্যামুয়েলের সাথে একসাথে খেলতে চায়। কিন্তু, শ্যামুয়েল বেড়া পেরিয়ে এ পাশে আসতে পারে না। কারন, শ্যামুয়েল ইহুদী!
ব্রুনো অবাক হয়ে যায়! বাড়িতে তার শিক্ষক তাঁকে পড়ান ইহুদী খারাপ, এ মহাযুদ্ধে ওরা জার্মানির শত্রুপক্ষ। কিন্তু, শ্যামুয়েলকে তো তার শত্রু মনে হয় না। বাড়িতে রান্না ঘরে যে ইহুদী বৃদ্ধ পাভেল (Pavel) বসে বসে আলুরকখোসা ছাড়ায় সেও তো শত্রু নয়; বরং ব্রুনো পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলে পাভেল কী আদর করে সুন্দর ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়! হায় রে ছোট্ট শিশু! বোঝে না, যুগে যুগে যুদ্ধবাজেরা নিজেদের প্রয়োজনেই নিরীহদের শত্রু বানিয়েছে আর যুদ্ধের নেশায় হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছে।
যাই হোক, সেখানেও ব্রুনোর বাবার দায়িত্বের পাট চুকে যায়। চলে যাবার দিন ব্রুনো শেষ বারের মত বন্ধু শ্যামুয়েলের সাথে দেখা করতে যায়। এবার সে ঠিক কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ভেতরে চলে যায়। স্বাচ্ছন্দে চলার জন্য নিজের পোশাক ছেড়ে শ্যামুয়েলের কাছ হতে ধার করে পরে ফেলে স্ট্রাইপড্ পায়জামা! এমন সময় ক্যাম্পের সবাইকে টেনে নিয়ে জড়ো করা হয় একটি ঘরে। ব্রুনো ভাবে, বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টির হাত হতে বাঁচাতেই বুঝি সবাইকে এভাবে জড়ো করা হয়েছে! বোকা শিশু! কেমন করে বুঝবে, বাবার দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়া মানে হলো, ক্যাম্পের বাসিন্দাদেরও জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া! কেমন করে সে বুঝবে, এ ঘরের নাম "গ্যাস চেম্বার" (Gas Chamber)! যখন বুঝলো, তখন সবার গা হতে স্ট্রাইপড্ পায়জামা খুলে নিয়ে চেম্বারের দরজা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে, বাড়িতে ব্রুনোর খোঁজ পড়ে গিয়েছে। খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত যখন বাবা চেম্বারের দরজায় পৌঁছেছে, ততক্ষনে সব শেষ। দরজার কাছে পড়ে আছে শুধু শত শত স্ট্রাইপড্ পাজামাস্! বেড়ার ওপাশে পরে থাকা ব্রুনোর ছেড়ে যাওয়া পোশাক হাতে নিয়ে মা এলসার (Elsa) আর্তনাদের মধ্য দিয়েই ছায়াছবির যবনিকা পড়ে।
সংক্ষেপে এই হলো The Boy in the Striped Pyjamas চলচ্চিত্রটির কাহিনী। হলোকাষ্টের (The Holocaust) উপর ২০০৮ সালে নির্মিত এ ছবি সত্যিই মন ছুঁয়ে যায়। মূল কাহিনীটি অবশ্য ২০০৬ সালে প্রকাশিত আইরিশ ঔপন্যাসিক জন বোয়েনের The Boy in the Striped Pyjamas নামের উপন্যাস হতে নেয়া হয়েছে। Rapidshare দিয়ে ছবিটি নামাতে পারবেন এখান হতে-
পার্ট-১
পার্ট-২
পার্ট-৩
পার্ট-৪
(Extract করতে WINRAR ব্যবহার করুন)
অফ টপিকঃ এখন যে বিষয়ে কথা বলবো তা চলচ্চিত্রটির রিভিউয়ের অংশ নয়; বরং চলচ্চিত্রটি দেখার সময় আমার মনে জেগে ওঠা একটি খটকা বলতে পারেন। শেয়ার করছি। সেই চল্লিশের দশক হতে হলোকাষ্টের উপর পৃথিবীর নানা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে আসছে। চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত "The Great Dictator" হতে শুরু করে আজ পর্যন্ত কম করে হলেও হাজার খানেক চলচ্চিত্রের মূল প্রতিপাদ্য ছিল হলোকাষ্ট! কিছুটা ধারনা পেতে পারেন এই লিষ্ট থেকে। গ্যাস চেম্বার দিয়ে লাখো ইহুদী মেরে ফেলা হয়েছে। অনেক ইউরোপীয় দেশেই ইহুদীরা ছিলো অচ্ছুৎ। বারের দরজায় লেখা থাকত- 'Dogs and Jews are not allowed'। কিন্তু, এশিয়া বিশেষ করে আরবে ব্যাপারটা এমন ছিল না। যথেষ্ট সম্মানের সাথেই সেখানে ইহুদীদের শান্তিপুর্ণ সহাবস্থান ছিল। যে ইউরোপ লাখো ইহুদী হত্যা করেছে নৃশংসভাবে, মহাযুদ্ধ শেষে সেই ইউরোপেরই ইহুদী দরদী উথলে উঠলো, কয়েক লাকগ ইহুদীর জন্য বিশাল ইউরোপে কোন মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো না; ঠাঁই মিললো আরব ভূমিতে! আর ইহুদীরা ও ভোজবাজির মত ভুলে গেলো অতীত! কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা ছোট ছোট কন্সেনট্রেশন ক্যাম্প হতে বেঁচে ফেরা ইহুদীরাই নিরপরাধ গোটা ফিলিস্তীনকেই কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে পরিণত করল মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পে!
এ নিয়ে কিন্তু খুব বেশী চলচ্চিত্র ও নির্মিত হয় নি! খুঁজে পেতে এই তিনটিই পেলাম! কেমন করে মানুষ এত সহজে অতীত ভুলে যায়!
ফিলিস্তীন-ইসরাইল সংকট নিয়ে আজ আমার দুটি কথাই বারে বারে মনে হয়-
১. "ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, মানুষ ইতিহাস হতে সিক্ষা নেয় না।"
২. "ইতিহাসের মার বড় বড়ো নির্মম, সে কাউকেই ছেড়ে কথা কয় না!"
আমি আজ ইতিহাসের সেই মার দেখবার আশায় আছি। যদি এ জীবনে দেখে যেতে পারি!
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১:২৭