somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবু লাহাবঃ লোভের আগুনে নিঃশেষিত যার কাছে, আত্মীয়তার বন্ধন

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দীর্ঘ কষ্টকর রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে। আরবের মরুভূমির বুক চিরে দেখা দিচ্ছে ভোরের আলো। নিদ্রামগ্ন শহর মক্কার সবগুলো বাড়ি। আবদুল মোত্তালিবের বাড়িটিই শুধু জেগে আছে। সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের মাথা তিনি। ক'মাস আগেই প্রিয়তম পুত্র আব্দুল্লাহকে হারিয়েছেন। সেই আব্দুল্লাহর বিধবা স্ত্রী আমিনা প্রসব বেদনায় অস্থির; তাঁর চোখে ঘুম আসে কী করে? একটু পরেই ভুমিষ্ট হল একটি শিশু- চাঁদের মত সুন্দর। রূপ দেখে তাঁর আকাশের চাঁদও মুখ লুকালো বুঝি? আনন্দাশ্রু আবদুল মুত্তালিবের দু'চোখে; নবজাতক পৌত্রের মাঝে প্রয়াত পুত্রের ছায়া খুঁজে পেলেন বুঝি?

প্রাচীরের ওপাশেই আবদুল উয্‌যার বাড়ি- আবদুল মোত্তালিবের আরেক সন্তান। প্রচন্ড ফর্সা বলে 'আবু লাহাব' নামে সুপরিচিত। হাড়কেপ্পন আর রগচটা বলে সমাজে তার অনেক সুনাম(!)। তারই কৃতদাসী সুয়াইবা সারারাত আমিনার শিয়রে বসে ছিল। শিশু ভুমিষ্ট হতেই দৌড়ে গিয়ে মালিককে জন্মের পুর্বেই ইয়াতীম ভ্রাতুষ্পুত্রের সংবাদ দিতে গেল। মৃত ভ্রাতার এই একমাত্র নিশানীর আগমনে তার কী হল কে জানে! আনন্দে আত্মহারা সে এক কথায় সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়ে দিল! সমগ্র জীবনে এই বোধ হয় ছিল আবু লাহাবের প্রথম আর শেষ ভাল কাজ!

চার দশক পর। ইয়াতীম সেই ভ্রাতুষ্পুত্র এখন মধ্যবয়সী। সততা আর সুন্দর আচরন তাঁকে আরবের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষে পরিণত করেছে। 'আল-আমীন' (সত্যবাদী) নামে সবাই এক ডাকে চেনে। আবু লাহাবের ও বয়স হয়েছে। সেই সাথে কৃপণতা, সম্পদের মোহ আর রগচটা স্বভাব- সবই বেড়েছে। এমনি একদিন, ভোর হতেই আল-আমীন উঠলেন শহরের নিকটবর্তী সাফা পাহাড়ের চূড়ায়। ডাক দিলেন সকলকে। বললেন, "আজ আমি যদি বলি, এই পাহাড়ের ওপাশে রয়েছে বিপদ, একদল সৈন্য জমায়েত হয়েছে তোমাদের আক্রমন করবে বলে, তবে তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?" রবাহুত জনতার সমস্বরে জবাব, "কেন নয়? তুমি তো আল-আমীন। তুমি তো কখনো মিথ্যে বল না!" তখন তিনি বলে উঠলেন, "তাই যদি হয়, তবে ক্বাবার প্রভুর শপথ, জেনে রাখ, এর চেয়েও ভয়াবহ বিপদ তোমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। মৃত্যুর পর জাহান্নামের আগুন তোমাদের অপেক্ষা করে আছে। সময় থাকতেই আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা-সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্তা বলে স্বীকার করে নাও, আর আমি সেই সত্ত্বার পক্ষ হতে প্রেরিত হয়েছি তোমাদের সাবধান করে দেবার জন্য।" সমবেত জনতা নিশ্চুপ-বাক্যহারা। শুধু একটি মুখ ঔদ্ধত্য আর অহংকারে কথা বলে উঠল। দুর্বাক্যে জর্জরিত করে দিল সাবধানকারীকে। "এজন্যই কি তুমি আমাদেরকে এখানে ডেকেছো? ধবংস হও তুমি।" এক জোড়া হাত পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল পর্বতারীহীর দিকে। মুখ আর হাতের মালিক আর কেউ নয়- আবু লাহাব। ক্বাবার কর্তৃত্ব হারাবার ভয় ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মাদের (স) প্রতি তার ভালবাসাকে হারিয়ে দিল সেদিন।

পরবর্তী এক যুগ ছিল নির্যাতনের যুগ। কুরাইশের সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হল এ নতুন আদর্শের কণ্ঠরোধে। স্ত্রী উম্মে জামিলাকে সাথে নিয়ে আবু লাহাব এ অপকর্মে সকলকে ছাড়িয়ে গেল। প্রথমেই মুহাম্মাদের (স) দুই কন্যা, যাদের সে স্বীয় পুত্রবধুরূপে বরণ করেছিল, তাঁদের পিতার গৃহে ফেরত পাঠিয়ে দিল। পথের উপর কাঁটা বিছিয়ে তাঁর চলাচলে বাধার সৃষ্টি করতে লাগল। আদর্শের কথা বলতে পথে বেরুলেই পেছনে গালিগালাজের নহর বইয়ে দিতে লাগল। 'উন্মাদ', 'যাদুকর', 'কবি' - আরও কত কী! তীব্র আক্রোশে সে এতটাই অন্ধ হয়ে গেল যে, সদ্য দুই শিশুপুত্রকে হারিয়ে শোকাতুর মুহাম্মাদের(স) প্রতি সমবেদনা জানানো তো দূরে থাকুক, সে তাঁকে লেজকাটা-বংশহীন অপবাদ দিয়ে বেড়াতে লাগল।

সাত বছর পর। মুহাম্মাদের (স) সত্য আদর্শের প্রচারে কুরাইশের মিথ্যে প্রাসাদের ভীত টলটলায়মান। প্রতিবিধান সাধনে ব্যর্থ হয়ে সকলে মিলে তাঁকে আর তাঁর সাথীদের সামাজিকভাবে বয়কট করল। মুহাম্মাদের (স) পরিবার বনু হাশিমের অনেকেই তখন তাঁর আদর্শের পথিক হন নি। কিন্তু, আত্মীয়তার বন্ধনকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা মুহাম্মাদের সাথে থেকে বয়কটের যন্ত্রনাকে মেনে নিলেন, কেবল একজন ছাড়া। আবার সেই আবু লাহাব! আত্মীয়তা কিংবা রক্তের সম্পর্কের যে অটুট বাঁধনকে আরব সমাজ হাজার বছর ধরে মেনে চলেছে, এক ঝটকায় তা ছিন্ন করে দিল সে।

এমন ব্যক্তির পরিণতি শুভ হতে পারে কখনো। তারও হয় নি। হিংস্র জন্তুর আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রথমে নিহত হয় তার পুত্র। এরপরে অজানা রোগে সারা শরীরে পচন ধরে বিনাচিকিৎসায় নির্বান্ধব অবস্থায় মারা যায় সে। মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগেই তার কাছে বদর যুদ্ধে কুরাইশের পরাজয় সংবাদ আসে। নিজের সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে যাঁদের বিরোধীতায় নেমেছিল সে, তাঁদের বিজয় যেন আবু লাহাবের মৃত্যুকে তরান্বিত করে। তার মৃতদেহ এতটাই দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল যে, আত্মীয়স্বজন যথাযথ সৎকার ব্যতীরেকেই ক'জন কৃতদাসের হাতে একে মাটি চাপা দিতে বাধ্য হয়। আর শোকে-দুঃখে গলায় দড়ি দেয় স্ত্রী উম্মে জামিলা। এভাবেই নির্বংশ হয়ে যায় আবু লাহাব।

বিঃদ্রঃ ব্লগার তানভীর চৌধুরী পিয়েল পরশুরাতে "একটি সুরা ও কয়েকটি প্রশ্ন" শিরোনামে একটা পোষ্ট দিয়েছিলেন, সুরা লাহাবের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে। কোরআনের পাঠ সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর এই পোষ্টের প্রশ্নগুলো আমার কাছে শিশুশুলভ মনে হলেও মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। অনেককথা উঠে আসছিল। হঠাৎ করে পোষ্টটি সরিয়ে দেয়া হল! পোষ্টের বিষয়বস্তু আমার পছন্দ হয় নি। তাই বলে এটি সরানোরও তো কোন যৌক্তিকতা দেখি নি! এভাবে মুখবন্ধ করে রাখা যায় না- এটা কবে মানুষ বুঝতে শুরু করবে! যাই হোক, আমার এই পোষ্টের প্রেরনা ঐ পোষ্টটি যার কিছু স্ক্রীনশট পাবেন এখানে। এই পোষ্টটি প্রচলিত অর্থে সুরা লাহাবের ব্যাখ্যা কিংবা পিয়েলের পোষ্টের জবাব নয়, বরং আবু লাহাব সম্পর্কে আমার জানা তথ্যের সংকলন মাত্র। স্মৃতির উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। তবে, বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে এবং সীরাত সংকলনে এ সব তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে।


এ সংক্রান্ত আগের দুইটি লেখা।

তাদের গল্প,আল-কুরআন যাদের বদলাতে পারে নি।-১
ওমর (রা)- আল-কু'রআন যাঁকে বদলে দিয়েছিল!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১:২৯
৬৫টি মন্তব্য ৬১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×